সন্দেহ ছিল উত্তরকাশী আজ পৌঁছোতে পারব কিনা? হলও তাই। ঘটনাচক্রে পড়ে পৌঁছোতে পারলামও না। ফলে কেদারযাত্রার পথে পিছিয়ে গেলাম অনেকটাই। Gangotri মন্দিরে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পুজো দিতেই লং-টাইম অতিক্রান্ত। হোটেল থেকে লাঞ্চ সেরে সকলকে ডেকেডুকে গাড়িতে তুলতেই, বিকালের ঘড়িতে ছ’টা ছুঁই ছুঁই। ভৈরবঘাঁটি, লংকা, হরশিল পেরিয়ে গাড়ি যখন গতি বাড়িয়ে ছুটছে, তখনও সব ঠিকঠাক। কিন্তু এরপরই পাহাড়ি রাস্তা হয়ে গেল অফিস টাইমের কলকাতা। দু’হাত যাচ্ছে তো মিনিট দশেক বেফালতু অপেক্ষা।
শেষমেশ গাড়ি ডেড স্টপ। কারণ যাই হোক, বনধ-রোকোর নোংরা রাজনীতি নেই শান্তির গাড়োয়ালে। শুনলাম একটা বড়ো গাড়ি বিগড়েছে ইউ-টার্ন পাহাড়ি বাঁকে। প্রমাদ গুনি। সঙ্গের অবাঙালি যাত্রীরা জোরে জোরে হনুমান চালিসা শুরু করল। অপেক্ষাকে প্রলম্বিত করতে কোরাস চালিসায় গলা মেলাচ্ছি, বসার মুদ্রা বদল করছি, মশা মারছি আওয়াজ করে। আর অন্ধকারের পর্দা টাঙানো আকাশে তারা ফ্যামিলিদের আইডেনটিফাই করছি। বজরংওয়ালির করুণায় কিনা জানি না, শেষমেশ গাড়ি ছাড়ল।
রাত বারোটার ঘর ছুঁয়ে। সকলেই যারপরনাই বিধ্বস্ত, পরিশ্রান্ত। শরীর-মন খাওয়ার চেয়ে পরিপাটি বিছানা খুঁজছে। কিছুটা চলার পরই আবার গতিরুদ্ধ গাড়ির। এবার মেষপালের চক্রব্যূহে। এই গভীর রাতে দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরে মেষপালকরা মেষপালসহ স্থানান্তরিত হচ্ছে এক উপত্যকা থেকে অন্য পাহাড়ি উপত্যকায়। সভ্যতার ঊষালগ্নে খাদ্য সংগ্রাহকদের মতো এরা চলেছে চারণভূমির খোঁজে। ভাটোয়ারি নামক স্থানে অনেক চেষ্টায় অধিক অর্থের বিনিময়ে জুটল রাত-আস্তানা। আসলে সকল আটকে পড়া গাড়ির যাত্রীরাই হোটেলের অনুসন্ধানে নেমেছে। ফলে হোটেল রেট তো বাড়বেই। খাওয়ার কথা ভুলে রাত দুটো পনেরোয় গেলাম বিছানায়। বাইরে তখন আকাশ ভেঙে শুরু হয়েছে বৃষ্টি।
পরদিন ঘুমের কোটাপূরণে বেলা গড়াল। বৃষ্টি কিন্তু রাতের অন্ধকারের সঙ্গে আজও বিদায় নেয়নি। কর্পোরেশন জলের মতো ঝরাচ্ছে অল্পবিস্তর। থামলে তো চলবে না। তাই মনের প্রশ্রয়কে পাত্তা না দিয়ে, বৃষ্টি মাথায় ছুটল গাড়ি। সহযাত্রীদের ভক্তির ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করতে চলতি রাস্তায় দাঁড়ালাম পাইলটবাবার আশ্রমে। ওপথে না গিয়ে ক্যামেরা বার করি আমি। ক্যামেরায় বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে ছবি ধরি।
প্রকৃতির সাথে ল্যান্ডস্কেপে ধরা দেয় পাইলটবাবার আশ্রমও। আশ্রম-ব্রেক শেষে আবার ছুটে চলা। কাঙিক্ষত উত্তরকাশী পৌঁছে বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন। বৃষ্টিকে বিদায় জানিয়ে উত্তরকাশীর আকাশ রোদ ঝলমলে। উত্তরকাশী থেকে এবার আমরা রংরুটে। প্রচলিত টেহরি রুদ্রপ্রয়াগের পথেই কেদারতীর্থ গমন করে গঙ্গোত্রী ফেরত যাত্রীরা। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার ভগবতী পাহাড়তলির অপ্রচলিত পথকেই বেছে নেয়। কিছুটা দূরত্ব কমাতে। পরে জানলাম, এই এলাকার মানুষ বলেই ছোটোখাটো রাস্তাও ওর নখদর্পণে।
গাড়ি চলেছে এক পাহাড়ের পাকদণ্ডি শেষে অন্য পাহাড়ে। পাহাড়ি প্রকৃতির প্যাকেজে সংযুক্ত পাহাড়তলির ছোটো ছোটো জনপদও। ক্যালেন্ডারের ছবির মতো সেসব জনপদ পার হয়ে যাচ্ছি গতির নিয়মে। এবার চৌরঙ্গী খাল নামক ছোট্ট এক বাজারের কাছে গাড়ি ব্রেক নেয়। সামনেই ছোট্ট, অনাড়ম্বর চৌরঙ্গী বাবার মন্দির। মন্দিরে মানুষজনের আনাগোনা দেখে বোঝা যায় বেশ জাগ্রত। কয়েকটা ছড়ানো-ছিটানো পাহাড়ি ধাপে দোকানপাট নিয়ে বাজার বেশ জমজমাট। আশেপাশের পাহাড়তলির গ্রামের এটাই বোধহয় বড়োবাজার! টিফিনে গাড়োয়ালি ডিশ ‘আলু-কা-পরোটা’ আর দুধসর্বস্ব মিষ্টি মিষ্টি চা খেয়ে পুনরায় গাড়ি ছেড়ে দেয়। ঢেউ খেলানো পাহাড়শ্রেণী একাধিকবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চোখ পড়তেই, মনে প্রশ্ন জাগে একই পাহাড়ে সারাদিন ঘুরছি না তো? অসমের গুয়াহাটি থেকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা সড়ক পথে আসতে অষ্টমোড়া বলে একটা পাহাড় আছে। রাস্তাটা সেখানে আট-আটবার পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। আমরাও কি সেই অষ্ট বা বারোমোড়ার পাল্লায় পড়েছি? পাহাড়ি পথের ভুলভুলাইয়াতে ভুল করেনি তো ভগবতী? রুটের যাত্রী বোঝাই কিছু ট্রেকার আর মালবোঝাই ছোটো-বড়ো ট্রাক ছাড়া এপথে গাড়ির দেখা সেভাবে আর মেলেনি।
ঘানশালী আসতেই বুঝে গেলাম ঠিক পথেই চলেছি আমরা। ওখানকার এক হোটেলে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য যখন উপস্থিত হলাম, দেখি খাবার-দাবার সব শেষ হয়ে গেছে। অনেক অনুরোধে দোকানি জিরা-আলুর সঙ্গে কটা লুচি ভেজে দিল। বাজার ছেড়ে আবার পাহাড়ি পরিমণ্ডলে। এবার চিরবাটিয়ার কাছে নির্জন পাহাড়ি বাঁকে গাড়ি থামাতে বাধ্য হলাম, একদল গাড়োয়ালি শিশুর সমবেত কলরবে। খুবানি নামক ছোটো-ছোটো মিষ্টি পাহাড়ি ফল বিক্রির জন্যই তাদের এই সমবেত হইচই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কয়েক প্যাকেট কিনলাম শিশুগুলোর কথা ভেবে। আর উপরি পাওনা হিসাবে ধাপচাষ জমির ব্যাকগ্রাউন্ডে তুললাম ছবি, সরল-নিষ্পাপ সেসব শিশুদের। অনবদ্য সেই ক্ষণ রয়ে গেল মনের ইনবক্সেও।
ময়ালি তিলওয়ারার পর বড়ো রাস্তায় পড়ে গাড়ি এবার ছুটছে তুফান বেগে। অগস্ত্যমুনি পেরিয়ে শিয়ালসোর ছুঁয়ে প্রকৃত গন্তব্য আমাদের গৌরকুণ্ড। কিন্তু এখনও ঢের রাস্তা পড়ে। এদিকে আলো ফুরিয়ে আসছে। সারাদিনের ধকলের ধারাবাহিকতায় না গিয়ে গতির আপাত ইতি টানতে চাইছে অনেকেই। অতএব শিয়ালসোরেই নোটিশ পড়ে গেল হোটেল খোঁজার। অবশ্য শিয়ালসোরের ক্ষেত্রে হোটেল খোঁজাখুঁজির দরকার নেই। মন্দাকিনীর ধার বরাবরই সব হোটেলের অবস্থান। যে হোটেল চুজ করে মালপত্র নামালাম এককথায় দুর্দান্ত। ভাড়া কিন্তু সে তুলনায় অনেকটাই কম।
মন্দাকিনী পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রাক সন্ধ্যার মুখে দেখলাম, আকাশ আলো করা কেদারশৃঙ্গকে। এককথায় অনবদ্য। ঝকঝকে সেই রূপোলি শৃঙ্গের হাতছানি, ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দিল নিমেষেই। এক কাপ চা নিয়ে বাগানছাতার নীচে বসে গেলাম। তার রূপের বিহ্বলতায় মোহচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম কিছুক্ষণ। ডিনারের পর কমন ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। নিস্তব্ধ পাহাড়ি প্রকৃতি। জমাট অন্ধকারমাখা রাত। ম্যাজিক আলোয় দেখা সামনের পাহাড়শ্রেণী ডুব দিয়েছে সেই অন্ধকারের আড়ালে। নীচে সশব্দে বয়ে চলেছে হিমালয়-কন্যা মন্দাকিনী। তার জলতরঙ্গের উচ্ছলতার শব্দ অনুরণিত হচ্ছে কাছে-দূরের পাহাড়ে। রাত বাড়তেই হিমালয় থেকে নেমে আসছে ভলকে ভলকে ঠান্ডা বাতাস। হালকা পোশাকে আবৃত শরীরে অনুভূত হচ্ছে শিরশিরানিভাব। কাল যাব ঐ হিমতীর্থে। সেই স্বপ্নবিভোরেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমায়।
পরদিন সড়কপথের শেষ গন্তব্য গৌরীকুণ্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা। আজ আর কোনও সাইট সিয়িং হিসাবের মধ্যে নেই। সেই মতো দ্রুত এগিয়ে চলেছে গাড়ি। কিন্তু কুণ্ড, গুপ্তকাশী পেরিয়ে সোনপ্রয়াগ আসতেই আবার গঙ্গোত্রী পথের পুনরাবৃত্তি ঘটল। রাস্তা অবরুদ্ধ। রাস্তা জুড়ে গাড়ির সারিবদ্ধ লাইন। অপেক্ষায় অপেক্ষায় সময় বরবাদ। সিজনের হরিদ্বার, ঋষিকেশের সমস্ত গড়িই যেন এখানে এসে হাজির হয়েছে। ফলে সমস্যা হল স্থান সংকুলানের। অপেক্ষায় থাকা গাড়ি-জানালা থেকে কেদারশৃঙ্গের হাতছানি মনকে নাড়িয়ে দিল। গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। ক্যামেরা তুলে নিই হাতে। ঐ পরিস্থিতিতে হকারদের জবরদস্তি মাল বিক্রির জন্য টানাহ্যাঁচড়াতে সকলেরই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। জাফরান, মালা, পলা, মুক্তো, কস্তুরী, শিলাজিৎ শিকড়-বাকড় শাল-সালোয়ারের মতো হাজার রকমারি পসরা তাদের ঝোলায়। গাড়ি, যাত্রীদের পসরার প্রতি আকৃষ্ট করতে তারা যে বক্তব্য পেশ করছে, তা অধিকাংশই মিথ্যার বাঁধনে ঠাসা। একসময় কেটে যায় যানজট। নড়েচড়ে ওঠে জগদ্দল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সামনের গাড়িগুলো। গতির মুক্তি মেলে আমাদের গাড়িরও। গৌরীকুণ্ড আসতেই সড়কপথের ইতি পড়ে যায়। আমরাও চটজলদি নেমে পড়ি।
অধিকাংশ মালপত্তর গাড়িতে রেখে, প্রয়োজনীয় কিছু ব্যবহার্য জিনিস রুকস্যাকে ঢুকিয়ে গুটি গুটি পায়ে বাজার অভিমুখে এগিয়ে যাই। উষ্ণকুণ্ডের চড়াই সিঁড়ির মুখেই মিলে যায় বাঁকুড়াবাসীর এক বাঙালি হোটেল। মনের তৃপ্তিতে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নেমে পড়ি পথে।
আমরা পদব্রজেই তীর্থপথে। অন্যান্যরা অন্যান্য উপায়েঃ ঘোড়া, ডান্ডি, কান্ডির দলে। কিন্তু ঘোড়া-খচ্চরদের আস্তাবল পার হতেই সশরীরে নরক দর্শন সারা হয়ে যায়। রাস্তা জুড়ে লোকে-লোকারণ্য। মোট চোদ্দো কিমি পথ কেদারের। খরিদ্দার ধরার জন্য সহিসরা পথের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে। চড়াইটা প্রথমেই এত কষ্টদায়ক যে, শেষ ডেস্টিনেশনে পৌঁছোনোর ইচ্ছার মানসিকতায় অনেকখানি ঘাটতি এনে দেয়। সেটা ধর্মো-মাদক তীর্থযাত্রীই হোক বা আমাদের মতো ভ্রমণপিপাসুর দলবল। আমার ব্যক্তিগত মতামত, চোদ্দো কিমি কেদারের এই বন্ধুর দুর্গম রাস্তাটা অতি সহজেই ট্রেকার বা ছোটোগাড়ি চলতেই পারে। সান্দাকফু বা রিশপের রাস্তাটা তো এর চেয়েও শতগুণে খারাপ। সেখানে তো জিপ, ট্রেকার চলে দিব্যি। তবে মনে হয় এখানকার মানুষজনের রুটি-রুজির কথা ভেবেই এপথ দুর্গমই রাখা হয়েছে।
সবদিক বিবেচনা করে অন্তত রামওয়াড়া পর্যন্ত জিপ বা ট্রেকার চালিয়ে বাকি সাত কিমি পথ এই সিস্টেমই চালিয়ে রাখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেকটাই সুরাহা হবে পায়ে চলা যাত্রীদের। মনের কোণে প্রশ্ন জাগে অদূর ভবিষ্যতে সত্যি সত্যি যদি রেলপথ চালু হয়? সেক্ষেত্রে সরকার কি রেজিষ্ট্রিকৃত ঘোড়া, ডান্ডি, কান্ডি, পিট্টু-বৃত্তিভোগীদের ভাতার ব্যবস্থা করবে? সিঙ্গুর বিতর্কের মতো প্রশ্নটা আপাতত ঝুলেই থাক।
জঙ্গল চটির কাছে এক ধাবায় বসে দেখছিলাম ফিরতি যাত্রীরা কতটা বিধবস্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরছে। আমাদের চলার পথ তো বারো-আনাই পড়ে। পারব তো এইপথ অতিক্রম করতে? রাস্তা প্রশস্ত হলেও, ঘোড়া-ডান্ডি-কান্ডিদের অনেকটা পথই ছাড়তে হচ্ছে। পথপ্রান্তে রেলিং যে সর্বত্র আছে তা নয়। ফলে গাইড দিতে হচ্ছে বুদ্ধি করে। লাঞ্চপেটে বেরিয়েছি বারবেলায়। ফলে পা চালাতে হচ্ছে দ্রুত। বোল্ডার সর্বস্ব রাস্তায় সেটা অসম্ভব। ক’বার শর্টকাট রাস্তা মারতে গিয়ে কামারের হাপরের মতো শ্বাস টেনেছি অনেকটা। ফলে ওপথে আর পা বাড়াইনি। জায়গায় জায়গায় পথ সিক্ত।
এপথে বৃষ্টি যখন-তখন। ফলে পাহাড়ের এ ঢালে শুষ্ক তো অন্য ঢালে টিপটাপ বা ঝমঝম। রাস্তার উপর শায়িত ঝোরাও শিঞ্চিত করছে পদযুগল। পাহাড়ি শরীর বেয়ে অপেক্ষাকৃত বড়ো যেসব অনামি ঝোরা, তারা নিজের পথ করে লোহাব্রিজের নীচে দিয়ে সশব্দে সফেন নেমে যাচ্ছে গভীর খাদে। রাস্তার ধারে জায়গায় জায়গায় ঘোড়াদের যে পানীয় জলের পাত্র, তারও উৎস এই সব ঝোরা। কেন জানি না সিকিমের ইয়ুমথাং-এর মতো পথের মিল পাচ্ছি অনেক জায়গায়। মন্দাকিনীর সঙ্গে দূরত্বটা কখনও বাড়ছে, কমছেও কখনওবা। তুষার পোশাকপরা পাহাড়গুলো সুস্পষ্ট হচ্ছে যত এগোচ্ছি। তবে ঘোড়া-খচ্চর পটির পটভূমিতে পাথর-সর্বস্ব পথের পরিস্থিতি পদে পদে দুর্বিসহ। গলা ভেজাতে মাঝে দু’তিনবার থেমেছি। আবার হাঁটা।
রামওয়াড়া পার হতেই দেহে বল পেলাম। অন্তত অর্ধরাস্তা তো অতিক্রম করেছি। ব্যাটম্যানের ব্যাট তুলে অর্ধ-সেঞ্চুরির ভঙ্গিতে আমরা দু’হাত তুলে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করলাম। আনন্দের আতিশয্যে দাঁড়িয়ে ছবিও নিই বেশ কয়েকটা। বলার অপেক্ষা রাখে না, যেদিকে তাকাই সমস্তটাই ছবির জগৎ। কিন্তু এবার পা জড়াচ্ছে। সে সাথে জিহ্বাও। সঙ্গে আনা লজেন্স মুখে ফেলি। সহিসদের হাতছানি মাঝেমধ্যেই মনের ইচ্ছাশক্তিকে অক্ষম করে দিচ্ছে। তবে অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় যারা যাচ্ছেন, তারা যে খুব ভালো ভাবে যাত্রা করছেন তা বলা যাবে না। আমাদের সামনেই এক মাড়োয়ারি ফ্যামিলি তিনটে ঘোড়ায় চলেছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই পাথরে স্লিপ কেটে সেই ভদ্রলোক ঘোড়াসমেত প্রপাত ধরণিতল। ক্রোধান্বিত ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গেই টাকাপয়সা মিটিয়ে সহিসকে বিদায় জানালেন। আমাদের পদাতিকদের দলে আরও একটি ফ্যামিলি যুক্ত হল।
পথ যেন আর শেষ হয় না। একটা দমফাটা চড়াই এর পর বিশ্রাম নিই। সামান্য বিশ্রামের ফাঁকে পিছন ফিরে দেখি পিঁপড়ের সারির মতো অগণিত মানুষজন উঠে আসছে। যেন পুণ্যের টানে অর্ধেক ভারতবর্ষই কেদারমুখী। গরম চায়ে গলা ভিজিয়ে আবার চলা শুরু। ইচ্ছা ছিল পথে ব্রহ্মকমল দেখব। কিন্তু সন্ধান পাইনি। শুনলাম আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ফুল ফোটে। তবে স্নেক লিলি দেখলাম। তীর্থ ফেরত বহু যাত্রীর হাতে। আকাশপথের সঙ্গেও কেদারতীর্থ যুক্ত। মন্দাকিনীর পথ ধরেই অনবরত যাতায়াত করছে হেলিকপ্টার। শুনলাম আছে দুটো রুট। এক ফাটা থেকে অন্যটা গুপ্তকাশী হয়ে। অতএব আকাশপথেও পুন্যার্জনের সুবর্ণসুযোগ।
সূর্য ডোবার পালা এসে গেল। তবে মেঘ-কুয়াশার পরিবেশে সূর্যাস্তটা দৃষ্টিগোচর হল না। কেবল অন্ধকারের অঘোষিত নোটিশ ফেলল যেন পাহাড়ি প্রকৃতি। পথের শেষে কী প্রাপ্তি লুকিয়ে আছে, সে ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে বুকের মাঝে। ইতিমধ্যে বরফছোঁয়া ক্ষুরধার তীক্ষ্ন-হাওয়া বইতে শুরু করেছে। রাস্তার স্ট্রিট লাইট জ্বললেও জায়গায় জায়গায় তার চক্ষুদান ঘটেছে। দূরে দৃষ্টিগোচর হয় আলোর মালায় সজ্জিত কেদারধাম। আরও দু’দুটো বাঁক পার হলেই ওই আলোর রাজ্যে প্রবেশ করব। নেতিয়ে পড়া শরীরটা চাঙ্গা করতে অতি ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠি ‘জয়বাবা কেদারনাথজি, শেষ পথটুকু পার করে দাও।’
সকালে ঘুম ভাঙতেই, হোটেলের প্রশস্ত করিডরে এসে দাঁড়াই। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় অসাধারণ দৃশ্যের মুখোমুখি হই। সামনে উদ্ভাসিত হিমালয়। যেদিকে তাকাই শুধু বরফ আর বরফের শৃঙ্গ। শৃঙ্গরাজি আবৃত খোদ কৈলাসেই যেন আমরা উপস্থিত। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ভিত্তিক কল পড়বে শীঘ্রই শিব ঠাকুরের কাছে। তাঁকে জানাব দেশ ও রাজ্যের বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতির কথা। জানাব ভ্রমণের পথে বাধাসৃষ্টিকারি সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশের। চেয়ে নেব অমরত্ব ব্যতিরেকে অন্য দু-একটা বর।
কাল রাতে পথ হাতড়ে অনেক কষ্টে উঠে এসেছি। অন্ধকার পথে ঝোরার বরফজলে পা পড়ে মোজা জুতো সব ভিজেছে। মূল বাজারে খোঁজাখুঁজি করে শেষে অধিক অর্থে মিলেছে মাঝারিমানের এক হোটেল। ইচ্ছা ছিল সন্ধ্যারতি দেখব। কিন্তু সে সময় অতিক্রম করে রাত সাড়ে ৯টায় পা ফেলেছি। বরফঠান্ডা বিছানায় দুটো লেপ নিয়েও অনেক কষ্টে ঘুম এসেছিল। মন্দাকিনীর কুলুকুলু ধবনি ঘুম না আসা মুহূর্তকে ভরিয়ে দিয়েছিল।
হাতে গোনা হোটেল, ধর্মশালা আর অজস্র দোকানপাট নিয়ে ছোট্ট জনপদ কেদারনাথ। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম এই কেদারনাথ। মূলত মন্দিরকে ঘিরেই আবর্তিত এখানকার জীবনযাত্রা। হোটেল ছেড়ে রেলিং দেওয়া মন্দিরচত্বরে গিয়ে দাঁড়াই। কী অসাধারণ দৃশ্য চারদিকে। আকাশজুড়ে উড়ে চলা মেঘ-বালিকাদের ফাঁকে বরফচূড়ার দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য এককথায় অবর্ণনীয়। ভোর থেকেই শুরু হয়েছে মন্দিরে পূজা-অর্চনা। ভক্তদের বাজিয়ে দেওয়া ঘণ্টার ধবনি নীরবতা ভেঙে চলেছে বারে বারেই। অন্ধকার মোছার আগেই আমজনতার লাইন পড়ে গেছে। লাইন সাপের মতো এঁকেবেঁকে টিনের শেড ছেড়ে পাহাড়তলির কাছে চলে গেছে। দেবতাকে দর্শনের জন্য কতই না কৃচ্ছসাধন করা হয়, আর আমরা তো কেবল কয়েক ঘণ্টার জন্য লাইনে দাঁড়াব।
লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিপ্রেমে বিভোর হয়ে যাই। চলন্ত লাইনে থাকতেই দেখেনি আদিগুরু শঙ্করাচার্যের সমাধিমন্দির। কেদারেই তিনি দেহত্যাগ করেছিলেন। সময়ের সাথে লাইনও এগোয়। ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শেষে পৌঁছে যাই মন্দির সম্মুখে। প্রবেশদ্বারের সামনেই মন্দিরের দিকে মুখ করে বসা পাথরের সুবিশাল নন্দিমূর্তি। পৌরাণিক মিথ অনুযায়ী পাণ্ডবরাই এই মন্দিরের স্থাপয়িতা। গ্রানাইট পাথরে নির্মিত অনিন্দ্যসুন্দর এই মন্দির বর্তমানে বহুবার সংস্কার করা হয়েছে।
কেদারমন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা মন্দাকিনী আসলে কেদারপাহাড় থেকে নেমে আসা দুধগঙ্গা, মধুগঙ্গা, স্বর্গদ্বারী আর সরস্বতীরই মিলিত জলধারা। মন্দিরের গর্ভগৃহে দেখি দেয়াল জুড়ে পঞ্চ-পাণ্ডবদের ফ্যামিলি-ফোটাগ্রাফ খোদাই করা। এ ছাড়া আছেন লক্ষ্নী-নারায়ণ, পার্বতী ও সিদ্ধিদাতা গণেশ। ঘি, ফুল, বেলপাতা, ছোলা-ডাল, ধূপ, চন্দন মিশ্রিত এক গন্ধ মন্দির জুড়ে। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে মাটির মধ্যে ঢুকে থাকা একখণ্ড পাথরই মহাদেবের প্রতিভূ। একেই দেবতাজ্ঞানে পুজো করা হচ্ছে। চলছে লাগাতার স্তোত্রপাঠ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ পরবর্তীকালে জ্ঞাতিহত্যার পাপস্খলনে পঞ্চ-পাণ্ডবরা শিব তপস্যায় রত হন। শিব সন্তুষ্ট হলেও সশরীরে দেখা দেন না, ফলে পাঁচভাই-এর সঙ্গে চলে লুকোচুরি খেলা। শেষে মহিষরূপী শিব ভীমের হাতে ধরা পড়ে পশ্চাৎ অংশ বাইরে রেখেই পাতালে প্রবেশ করেন। সেই মহিষের পশ্চাৎদেশ রূপী শিলাখণ্ডকেই স্পর্শ করে পুজো দিই। শুনলাম শীতের দিনে কেদারনাথের বাস, চুয়াল্লিশ কিমি নীচে উখিমঠের মন্দিরে। ফটোসেশন শেষে চললাম, কুণ্ড পরিদর্শনে। এখানে রেতম, উদাক, রুদ্র ও ঋষি মোট চারটি কুণ্ড। এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি।
বৃষ্টি থামতেই এক চায়ের দোকনে ঢুকি। পরদিন আমাদের যাত্রা শুরু চোরাবালিতালের পথে।
জরুরি তথ্য
কীভাবে যাবেনঃ হাওড়া থেকে ট্রেনে প্রথমে হরিদ্বার। হরিদ্বার থেকে হৃষীকেশ হয়ে গৌরীকুণ্ড। খুব সকালে গাড়ি নিয়ে বার হলে, দিনে দিনেই পৌঁছোনো সম্ভব। এপথে হৃষীকেশ থেকেই পর্যাপ্ত বাস মেলে। তবে মাঝে রুদ্রপ্রয়াগ, শিয়ালসোর বা চন্দ্রপুরীতে রাত্রিবাস করে পরদিন যাত্রা করলে শারীরিক ধকল কমে।গৌরীকুণ্ড থেকে কেদার হাঁটাপথ। অক্ষমে ঘোড়া, খচ্চর, ডান্ডি, কাণ্ডির ব্যবস্থা আছে।
কখন যাবেনঃ কেদারের মন্দিরের দরজা অক্ষয় তৃতীয়া থেকে দীপান্বিতা অমাবস্যা পর্যন্ত খোলা থাকে। ফলে বর্ষাকালটা বাদ দিয়ে, মে থেকে অক্টোবরের যে-কোনও সময় গেলেই চলে।
কোথায় থাকবেনঃ রাত্রিবাসের জন্য এখানে পাবেন ভারত সেবাশ্রম, আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম, যোগমায়া আশ্রমের ধর্মশালা, বিড়লা মঙ্গল নিকেতন, মন্দির কমিটির রেস্ট হাউস, কালীকমলি ধর্মশালা ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগম দ্বারা পরিচালিত আবাসস্থল।
কেনাকাটাঃ মন্দিরের আশেপাশে দোকানগুলিতে পুজোর উপকরণসহ নানা দ্রব্যাদি মেলে। তবে স্মৃতি হিসাবে কিছু কিনতে চাইলে ফেরার পথে হরিদ্বারেই কিনুন। অর্থের সাশ্রয় হবে।
সঙ্গে নিনঃ গৌরীকুণ্ড থেকে চড়াই পথে হাঁটার সময় জলের বোতল আর স্পাইকওয়ালা একটা লাঠি সঙ্গে নিন। মুখে দেওয়ার জন্য কাজু, খেজুর, কিশমিশ, লজেন্স নিলে ভালো।তবে রাস্তাজুড়ে দোকান অজস্র।