বাংলা গান আর রেডিয়োর শ্রোতারা যখন তাঁর গলার মৌতাতে মজে আছেন, তখন হঠাৎই তাঁর বিদেশে পাড়ি। যেখান-সেখান নয়, সাগরপারের এক নির্জন দ্বীপে পাতলেন ঘরকন্না। যার কথা বলা হচ্ছে, তিনি হলেন বহু বাঙালির প্রিয় শিল্পী শ্রাবন্তী মজুমদার (Sravanti Mazumdar)। সেই দ্বীপ Isle of Man থেকেই পাঠকদের পাঠালেন খোলা চিঠি৷
‘আমি শ্রাবন্তী বলছি। এখন আমি সাগরপারে থাকি, চারপাশের বিদেশ আমাকে আনমনা করে দেয়– নিয়ে যায় সেই ফেলে আসা দিনগুলিতে। সাতসমুদ্দুর তেরো নদীর পারে বসে মনে হয়, ভিক্টোরিয়ার চুড়োটা কি এখনও পড়ন্ত বিকেলে অতটাই লাল দেখায়?
আইল অফ মান, মানে আমি বর্তমান ঠিকানা, তার পার্লামেন্ট হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে ‘ওল্ডেস্ট কন্টিনিউয়াস পার্লামেন্ট’। আমাদের লোকসংখ্যা কত জানেন? মাত্র আশি হাজার! আমার প্রথম আইল অফ মান-এ আসার দিনটার কথা আজ খুব মনে পড়ছে৷। এক সবুজ দ্বীপের স্বপ্ন দুচোখে নিয়ে পা বাড়িয়ে ছিলাম নতুন জীবনের দিকে।
সেটা ছিল ১৯৯৪-এর ফেব্রুয়ারি মাস। লন্ডন থেকে গাড়িতে, তারপর হেশাম থেকে জাহাজ। জীবনে প্রথম দেখলাম কীভাবে আমাদের গাড়িটা জাহাজের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ল! সাড়ে চার ঘন্টার জলসফর। তখন প্রায় সন্ধে– প্রচন্ড ঝড় আর তারপর বৃষ্টি শুরু হল। জাহাজের উপর থেকে সমুদ্রের সেই উত্তাল রূপ কোনওদিন ভুলব না।
সাড়ে চার ঘন্টা পরে ডগলাসে জাহাজ থামল। ডগলাস হল আইল অফ মান-এর রাজধানী। এবার গাড়িতে উঠে নতুন ঠিকানার উদ্দেশে রওনা হলাম। ততক্ষণে বরফের ঝড় শুরু হয়েছে। সেই বরফের ঝড় ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভাবছি কোথায় এসে পড়লাম! গাড়ি চালানোই দায়। রাত তখন সাড়ে ন’টা, কোথাও কোনও শব্দ নেই। রাস্তায় গাড়ি না থাকারই মতো।
রাত সাড়ে দশটার সময় পৌঁছোলাম নতুন ঠিকানায়। এটাই আমার রাজপাট, আমিই এর সম্রাজ্ঞী।
সকালে উঠে দেখি সবুজের কণামাত্র নেই, চারদিকে শুধু সাদা। তখনও বরফ পড়া থামেনি, আর সে কী ঠান্ডা! হিটিং চলছে, তবুও আমি কাঁপছি। কলিন সকালে কাজে চলে গেল। আমি সেই ঘুমন্তপুরীতে একা– বুঝতে পারছি না কী করব? পাগল-পাগল লাগছিল। শেষপর্যন্ত দশ দিন পরে আমি কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলাম। পরে শুনেছিলাম বারো বছর পরে আইল অফ মান-এ সেবার ওইরকম বরফ পড়েছিল, ষোলোদিন ধরে!
স্বপ্ন দেখতাম ছোটোবেলা থেকে– বিরাট গায়িকা হব, জয় করব পৃথিবী। বড়ো স্বপ্ন দেখতাম বলেই হয়তো আপনাদের মনে ছোট্ট একটা জায়গা করে নিতে পেরেছি। আমার প্রথম গান, প্রথম পুজোর গান ছিল,
‘আমি একটা ছোট্ট বাগান করেছি,
চারধারে তার ডালিয়া মাঝখানে ফোটে লিলি,
জায়গাটা বেশ নিরিবিলি’— পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা, ভি বালসারার সুর। তখন কী জানতাম এ-গানটা আমার জীবনে সত্যি হয়ে যাবে! শুনে পুলকদা খুব হেসেছিলেন এবং খুশিও হয়েছিলেন।
জমজমাট বাড়ির মেয়ে, বা বলা ভালো জমজমাট শহর কলকাতার মেয়ে। ভাবিনি শেষপর্যন্ত এমন একটা নিরিবিলি দ্বীপে সংসার পাতব।
বছরের অনেকটা সময় এখানে বৃষ্টি আর ঠান্ডা– আর এখানকার হাওয়া যেন সূঁচ বিঁধিয়ে দেয়। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তুলনা নেই। প্রকৃতি যেন তার সৌন্দর্যের ভাণ্ডার এখানে উজাড় করে দিয়েছে। চারদিকে সমুদ্র, তার সাথে পাহাড়। এই কথা বলতে বলতে আমার গাওয়া একটা গানের লাইন মনে পড়ে গেল,
‘নীল অপরাজিতা আর সবুজ সবুজ ঝাউপাতা, উপমা খুঁজে পাই সাগরের পাহাড়ের
সব ছবি সবকিছুতে তবু তোমার তুলনা কিছু নেই, তবু তোমার তুলনা কিছু নেই’
গানটা লিখেছিলেন এবং সুর দিয়েছিলেন ফিল্ম ডিরেক্টর পার্থপ্রতীম চৌধুরী, যিনি ‘ছায়া সূর্য’ করেছিলেন। আর গানটা তৈরি করা হয়েছিল হরলিক্স-এর ‘সুচিত্রার সংসার’ রেডিও সিরিয়ালের জন্য।
আমার এই ছোট্ট বাড়ির সামনে আর পিছনে একফালি বাগান আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের বাড়ির এলাকার মাটি তেমন ভালো নয়। তবুও যতটা পারা যায় যত্নআত্তি করে কিছু ফুলগাছ করেছি। আর কিছু ধনেপাতা। কয়েকটি লংকাগাছও আছে। কিন্তু গাছগুলোকে একটুও অবহেলা করা চলে না, যেহেতু এখানে বছরের বেশিরভাগ সময়েই বৃষ্টি আর হাড়কাঁপানো হাওয়া। সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে পাতা ঝরতে শুরু করে। সব ফুল ঝরে যায়। প্রকৃতি মনে করিয়ে দেয় এবার শীতের পালা। চারপাশের ওই রিক্ত রূপ দেখে খুব কষ্ট হয় তখন।
দেখতে দেখতে এই জায়গাটাই কেমন যেন আপন হয়ে গেছে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, এখন আমার সত্যিই ভালো লাগে এখানে থাকতে। নানা দেশের মানুষ থাকে, কাজ করে। ছোট্ট দেশ হলে হবে কী, কালচারালি খুব অ্যাক্টিভ। ছোটো-বড়ো সবার জন্যই নানারকম বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। নাটক, নাচ, গান, নানারকম উৎসব, বইমেলা, খেলাধুলোর ব্যবস্থা, মিউজিক ক্লাব। আছে বহু পুরোনো ক্যাসল। বহু যুগের ইতিহাস বুকে করে আজও যা স্পর্ধার সঙ্গে দাঁড়িয়ে।
এখানকার অন্যতম আকর্ষণ আইরিশ সি। গ্রীষ্মের নরম রোদের ওম নিতে গরমকালে এখানে ভেসে আসে প্রচুর বাস্কিং শার্ক (এক ধরনের হাঙর)। এরা মানুষের তেমন কোনও ক্ষতি করে না। তাই সমুদ্রের তীরে আনন্দ করতে আসা মানুষজনের কাছে হাঙর ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
আর আছে ঘোড়ায় টানা ট্রাম, ইলেকট্রিক ট্রেন, মিউজিয়াম, নীল সমুদ্র এবং স্টিম রেল। স্টিম রেল বলতে গিয়ে আমাদের দার্জিলিংয়ের টয়-ট্রেন-এর জন্য বড়ো মনকেমন করে। এখানে স্টিম রেল-এর খুব যত্ন নেওয়া হয়।
আমার পায়ে বোধহয় চাকা লাগানো আছে। আমি বেড়াতে খুব ভালোবাসি। স্বপ্ন দেখতাম একদিন সারা পৃথিবী দেখব, গান দিয়ে জয় করব। সেই পৃথিবী দেখার শুরু ১৯৮২ সাল থেকে। প্রথম বিদেশ বেড়ানো ব্যাংকক, হংকং, সিঙ্গাপুর। তখন এসব জায়গায় যেতে ভিসা লাগত না, সিকিউরিটির ঝামেলা ছিল না। বেড়ানোর মজাই ছিল আলাদা। প্রথম বিদেশ দেখার যে কী অবাক করা অভিজ্ঞতা, তা বর্ণনা করার নয়! ঝকঝকে রাস্তা, কতরকমের গাড়ি, সাজানো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স, সুপার মার্কেট। তখন তো এসব আমাদের দেশে ছিল না। তাই যা-ই দেখছি, অবাক হচ্ছি। আকাশচুম্বী বাড়ি তৈরি হচ্ছে, তার চারদিকে স্ক্যাফোল্ডিং, তার সঙ্গে নেট জড়ানো। ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। এসব আমার তরুণ চোখে ধাঁধা লাগিয়েছিল। আর দেখার জিনিসের তো অন্ত নেই।
সবচেয়ে মন কেড়েছিল হংকং। আজও আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম হংকং। মন খারাপ হলে বা কাজ করতে করতে ক্লান্ত লাগলে আমি চলে যেতাম হংকংয়ে। হাসছেন তো? আমি যে শ্রাবন্তী! আমার জীবনে আর একটা শহরের একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে– প্যারিস। প্রথম দর্শনেই প্রেম। তখন কি জানতাম, যে একদিন এই শহরেরই আইফেল টাওয়ারের ওপরে আমাকে কেউ বিয়ের প্রস্তাব দেবে!
জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্তই খুব দামি এবং গুরুত্বপূর্ণ। কতকিছু ঘটে প্রত্যেকদিন। আমরা সবসময় সেগুলোর তেমন গুরুত্ব দিই না এবং বড়ো সহজে সেসব ভুলেও যাই। আমার নিজের জীবনে কত কিছু ঘটল, মাঝে মাঝে ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে। যেমন আমার কেরিয়ার। কথা ছিল উচ্চাঙ্গ সংগীত গাওয়ার– হয়ে গেলাম পপ সিঙ্গার।
আসলে আমার গানের জগতে আসাটাও খুব আকস্মিক! জিঙ্গল গাইবার জন্য অডিশন দিতে গিয়েছিলাম বাড়িতে লুকিয়ে। খালি গলায় দুটো গান গেয়েছিলাম। যার স্টুডিওতে গিয়েছিলাম তিনি একেবারে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন আমার গলার আওয়াজ, গাওয়ার স্টাইল, আর উচ্চারণ শুনে। তিনি জিঙ্গল তো গাইয়েছিলেনই, এছাড়াও সুযোগ দিয়েছিলেন পরবর্তী বহু বিজ্ঞাপনে কন্ঠদানের, সেসব অবিস্মরণীয় বিজ্ঞাপন আপনারা আজও মনে রেখেছেন। নিজে আমাকে দিয়ে চারটে গান রেকর্ড করিয়ে এইচএমভি-তে শুনিয়েছিলেন। এইচএমভি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে পুজোর গান করার অফার দেয়। ব্যস সেই আমার গানের যাত্রা শুরু, যা আজও চলছে। তবে জানি না কোনও অজ্ঞাত কারণে অনেকেই কেন মনে করেন যে, আমি আর গান গাই না।
পুজোর রেকর্ড বেরোনোর পর আমার প্রথম স্টেজ প্রোগ্রাম। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য। বাঙালি মেয়ে, শাড়ি পরে হাতে মাইক, সঙ্গে ব্যান্ড। ভাবুন তো একবার। সেটা সত্তরের দশক। কোনও গায়ক, গায়িকাকে বাঙালি দর্শক এভাবে আগে দেখেনি। সবাই হতবাক, কারণ এটা সেই সময়, যখন গায়ক, গায়িকারা বসে হারমোনিয়াম ও তবলা নিয়ে অনুষ্ঠান করতেন। খুব সমালোচনা হয়েছিল, তবে সেটা যত না দর্শকের কাছ থেকে এসেছিল, অনেক বেশি সমালোচনা করেছিলেন সাংবাদিকেরা এবং আমাদের গানের জগতের মানুষজন।
বহু বড়ো সুরকার, গীতিকার, গায়ক, গায়িকা, সাহিত্যিক, অভিনেতা, অভিনেত্রীর সঙ্গে কাজ করেছি। সেসব ভাবলেও আজ অবাক লাগে। গান গাইতে এসে কবে যে কথা বলার জন্য সবার প্রিয় হয়ে উঠলাম, নিজেই জানি না। এমনকী ভালোবাসায়, স্নেহবশত অনেকের কাছেই ‘ন্যাকা শ্রাবন্তী’, ‘কথুড়ে শ্রাবন্তী’ পর্যন্ত হয়ে গেলাম। কোনওদিন যেকথা ভাবিনি সেই বাচিক শিল্পের জগতে আমার জন্য পাকাপাকি একটা ঠাঁই হয়ে গেল। যে-গলার আওয়াজ নিয়ে এত লজ্জা ছিল, সেই আওয়াজ যে আপনারা এমন আপন করে নেবেন, তা ভাবিনি কখনও।
রেডিয়ো নাটক পরিচালনা, সম্পাদনার হাতেখড়ি বীরেনদা মানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-র কাছে। ভাবতে অবাক লাগে যে, আজ সবাই বীরেনদার কথা প্রায় ভুলেই গেছেন। ওঁকে দেখেছিলাম আমাদের স্টুডিয়োতে, বীরেনদা যখন সিএমডিএ-র জন্য একটা স্পনসরড প্রোগ্রাম-এর নির্দেশনা দিতে আসেন। দেখেছিলাম সেই বয়সেও বীরেনদার কী অফুরন্ত এনার্জি। আমি তখন কত ছোটো, তবু মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠতাম, কিন্তু বীরেনদার কোনও ক্লান্তি ছিল না।
দেখেছিলাম মিহির সেনকেও, যাঁকে ছাড়া আমার নাটকের জীবন অসম্পূর্ণ। একটা নাটকের স্ক্রিপ্ট পছন্দ না হলে দশবার লিখিয়েছি কিন্তু মিহিরদার তাতে কোনও রাগ বা ক্লান্তি ছিল না। ওরকম রেডিয়ো নাটকের স্ক্রিপ্ট খুব কম জনই লিখতে পারতেন। সেসব নাটক শুনে শ্রোতারা চমকে উঠেছে। আজও কতজন সেসব রেডিও নাটকের কথা জিজ্ঞেস করে। রেডিও নাটক করতে গিয়ে কত যে প্রতিভাধরের সাথে কাজ করেছি, প্রতি মুহূর্তে তাঁদের কাছে শিখেছি, তা বলার নয়।
আমি সবসময়ই একটু অন্যরকম। গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বলতেন যে, আমি সময়ের থেকে দশ বছর এগিয়ে আছি। কেন জানি না আমার ভাবনাগুলো কিছুতেই গতানুগতিক হয় না। সেইজন্যই বোধহয় আমার গান এত অন্যরকম, ঠিক আমার গলার মতো। আমার দুটো সমান্তরাল কেরিয়ারও বোধহয় সেই কারণেই অনেকসময় একটার থেকে অন্যটা বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।
পশ্চিমবাংলা আমাকে অনেক দিয়েছে। বিশেষ করে কলকাতা। এতদূরে বসেও ওই শহরটার উষ্ণ আলিঙ্গনের জন্য মনটা সবসময় ব্যাকুল হয়ে থাকে। এই নস্টালজিয়ায় মনে পড়ছে পুলকদার (পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়) কথা ও বাপ্পিদার (বাপ্পি লাহিড়ি) সুরে গাওয়া আমার গানের দুটো লাইন–
‘যেথা আনন্দে মন ভরানো , খুশিতে রং ছড়ানো এ যে কলকাতা ’