খাতড়া থেকে পরকুল দুই ক্রোশ পথ। নির্দিষ্ট কোনও ছক নেই যাওয়ার। ফলে অধিকটাই চাষ মাঠের আল ধরে হাঁটা। সেখানে কাঁসাই নদীর পাড়ে এই মকর সংক্রান্তির ভোর থেকেই টুসু মেলার আয়োজন শুরু হয়েছে। জানুয়ারির মাঝ বরাবর মুকুটমণির জলাধার থেকে ঠান্ডা বাতাস মারছে। সেই বাতাস উপেক্ষা করে গোড়াবাড়ি, অম্বিকানগরের মেয়ে-পুরুষের দল গাঁ উজাড় করে হাঁটা ধরেছে। লক্ষ্য পরকুল। এদিকের দূর গ্রাম ইস্তক পরকুলের টুসু মেলার খাতির। আর মেলা যাত্রীর মুখে মুখে লুটিয়ে বেড়ায় টুসু গান– ‘মেলা লাগেঁছে পরকুল য চালতা বনে শ্যাম ডাঁড়াঞ্চ য লুটতে চাহে জাত কুল য ও পিসিলো…।’ হরিজনের এই টুসু-মিছিলে পা জুড়েছি আমরাও। মকরের ভোর। মাঠ-ডহর ভিজে সারা রাতের শিশিরপাতে। হাড় হিম শীতের বাতাস। আর এই সর্পিল মিছিল চলেছে সরষে ফুলের কেয়ারি ভেঙে। মেয়েদের মাথায় টুসু ঠাকরুনের সুসজ্জিত চৌদল। নানা বর্ণের কাগজে বানানো সিংহাসনে উপবিষ্ট কন্যা। শ্রমজীবী সন্তানের ঘরে ক’টা দিন কাটিয়ে আজ কাঁসাইয়ের গর্ভে তার শ্বশুরঘরে প্রত্যাবর্তন। বেদনার্ত দিনটিকে দলিতজনের আনন্দের আবহে মুড়ে উদ্যাপন। টুসু পরব ঘিরে কুর্মি, মহালি, মেটে, বাগদি, বাউরি ঘরে দেশজ পিঠা, ব্যাঞ্জন, মাংস, মদের যথেচ্ছ ব্যবহার।
সেসব রাতের আয়োজন। এখন এই কবোষ্ণ রোদ ঝলমল সকালে সকলের পায়ে একটাই ঠিকানা– কাঁসাই চর। সেখানে মেলা-খেলা, নাচ-গান-দারু পান জুড়ে আনন্দ সওদার পাইকারি বাজার। চলতে চলতে চন্দ্রমোহনকে বাগে পেয়ে যাই। সাত সকালেই গলা জলে ভাসছে সে। মানুষটার ডেরা রানিবাঁধ। অনেকটা পথ। মকরের দিনে পথে যানবাহন নেই। মাঝে মাঝে মানুষের হল্লা-ট্রাক ছুটে যাচ্ছে পরকুল অথবা অম্বিকানগরে কুমারী নদীর ঘাটে। সেখানেও যে মেলা লেগেছে। সংক্রান্তির বড়ো মেলা পরকুলের কাঁসাই চরে। চন্দ্রমোহন খাতড়ার মোড়ে নেমে পরকুলে পা মিলিয়েছে। আর গলা মিলিয়েছে গানের কোরাসে– ‘হামার টুসু কাজ জানে নাই ননদ দিল্য গঞ্জনা য টুসু রানি মান করেছে শ্বশুরঘরকে যাবে না।’ গান ছেড়ে অবাধ্য পায়ে নাচ ধরল ক্ষ্যাপাটা। বগলের বোতল থেকে আরও খানিক দম-পানি গলায় ঢালল সে। তারপর কপট বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘এ দ্রব্যে ধক্ লাগছে নাই। বাবু-পয়সায় ল্যাশা না খাঁলে দম চড়া লাগব্যে নাই। হঁ গ বাবু লঁকট, পার্বণী দিবে কি ন?’ পয়সা উশুলের এই এক ফিকির ওদের। বলি পরবের মেলায় পেৌঁছে তবে না পার্বণী।
মদ ফুর্তির ব্যবস্থা পাকা করে সে ভিড়ের দমকে ভেসে গেল। এই হরিজন মিছিলে এক হারালে আর-এক এসে ধরা দেয়। চন্দ্রমোহন গিয়ে সূরজ সিং-কে পেলাম। ভূমিজ সমাজের মানুষ। কালো পালিশ গায়ের রং। একেবারে জট পাকানো স্বাস্থ্য। গোঁফটি বেশ পুষ্ট। অযত্নে অনাদরে অনিয়মে এই গড়পড়তা শরীর-স্বাস্থ্য রাঢ় দেশের মানুষের। চলতে চলতে বলতে থাকে, তার জমি নাই। কাঁড়া (মোষ) বলদ নাই। নিজস্ব হাল নাই। বাবুর জমিতে চাষ দেয়। ‘একশো দিনের রোজগারে যাও না?’ ‘শরীর অত লিঁব্যেক নাই দাদা। হামি বাবু ঘরে খেতি করলাম, পরিবারটি গেল শতক দিনের রজগারে।’ এ ভাবেতে উপায়দারী।
চন্দ্রমোহন সরেন আর সূরজ সিং দু’জনার জীবনের মতলবে কতটা ফারাক। এই মানুষটা তার স্ব-উপার্জিত পয়সায় মেলার ফুর্তি কুড়োতে এসেছে, আর চন্দ্রমোহন মহাজন থেকে কর্জ নিয়ে পার্বণের তাপে তপ্ত হতে এসেছে। এভাবেই যত মানুষ, তত ভিন্ন স্রোতধারা এই মানব প্লাবনে। ভাবছিলাম আর হাঁটছিলাম। পাশের এক বৃদ্ধ সহযাত্রী সুধান, ‘পরকুল পরবেতে লুতন মুখ লাগছে যে?’ হ্যাঁ, আমরা নতুনই বটে। ‘মেলা যাত্রাটি কেমন লাগছে বলত?’ ‘দেদার লাগছে।’ বৃদ্ধ ওরফে হরিহর মাহাতো বলেন, ‘দেখ বাপু, অ্যাই রাঢ় দুনিয়ার হরিজন ঘরেতে অভাব, কষ্ঠ আমাদের নিত্য ভগবান। কিন্তুক পরব লাগলে কড়ি ফটকা মানুষগুলাকে দেখছ ত? উদমষাঁড়ি হয়ে ছুটছ্যেন। জীভনে দুখ্ তো থাকতেই লাগবে। ফুর্তি তামাশাটুকু তাঁড়্যে লিঁতে হবে। এইটুকু আমার পাওয়া।’ হরিহর বুড়োর বচনটুকু বহু যত্নে মনের ভল্টে জমা পড়ে গেল। পরকুলের ধারে এসে পড়েছি। এদিকে মাঠে ফুটেছে প্রবল সরষে ফুল। দূরের মাঠ থেকে অপস্রিয়মাণ কুয়াশা। বহুবর্ণ সাপের মিছিল এগিয়ে চলেছে টুসু গানের কোরাস গলায় ধরে। মেয়েদের মাথায় ধরা ঠাকরুনের চৌদল।
পরকুলের লাল মাটি ফুঁড়ে হঠাৎ যেন নদীটা কিলবিলিয়ে উঠেছে। নদী কংসাবতী। তার দু’পাড়েতে হলুদ ফুলের ঢেউ লেগেছে। নদীর পুলিনে বেশ খানিক জায়গা চৌরস করে মেলার প্রস্তুতি চলছে। দিন এখনও সাবালক হয়ে ওঠেনি। সবে দশটা। বাঁশ দড়ি ত্রিপল তাঁবুতে দোকান গড়ার প্রস্তুতি চলছে। তারই একটিতে গিয়ে উঠেছি চায়ের সন্ধানে। দোকানির নাম ঠাকুর কালিন্দী। পায়রাচালির এই ঠাকুর প্রতি পরকুলেই দোকান বসান। তিনি বলেন, ‘চা হবে, টুকু দম ধরথ্যে লাগবে।’ ‘সে-টি পারব না ভাই। এতটা পথ হেঁটে বে-দম হয়ে পড়েছি।’ ‘তাহলে্যঁ বসেন, চুলায় আগুন মারি। কিন্তু মেলার চেহারা তো ছরকট লাগছে ভাই। পরকুল জাগতে আর টুকু টেম লাগবে। ত্যাখন দমে ভিড়। অ্যাই দকানের টুঁইয়েতে (শিখরে) একট চির (পতাকা) উড়বে, বিবেচনায় লিঁবেন উয়াঁই ঠাকুর কালিন্দীর নিশান।’
কাঠের চুলাতে আগুন দাপিয়ে উঠেছে। কেটলির ঠোঁট দিয়ে গরম ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ঠাকুর নিবিষ্ট মনে চা করেন আর কথা বলেন। তারপর কাচের গেলাসে খয়েরি তরল ঢেলে দেন এবং একটি টিনের পাত্রে নিজেও একপ্রস্থ নেন। রৌদ্রের মেজাজ চড়ছে। আমাদের গরম পোশাক ঠাকুরের হেফাজতে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করে বেরিয়ে পড়ি।
ঠাকুর কালিন্দী কিছু মিছা বলেননি। বেলা চড়তেই বাঁধ ভাঙ্গা জল যেভাবে ঘর বসত ভাসিয়ে নিয়ে চলে, এ যেন তেমনই কতকটা। দূর প্রান্তরের শিরা-উপশিরা ধরে মানুষ ঢুকছে পরকুল মেলায়। নদীর মাথায় স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে দেখি। কাঁসাই চরে ঠান্ডা বাতাস মারছে। মেয়েদের মুখে গানের বিরাম নাই। পায়েতে নাচের অন্ত নাই। মাথায় চৌদলে টুসু দেবী দেখেন বসে মানুষের পাগলামি। মেলার দোকানগুলি সেজে উঠেছে পণ্যে– কাঠের সরঞ্জাম, লোহার বস্তু, প্রসাধনী থেকে বস্ত্রবিপণি। ভাজা, মেঠাই, পোশাক, জুতো, খেলনা, পাঁচমুড়ার হাতি ঘোড়া থেকে বিষাণ শিল্প, সবংয়ের মাদুর, রাজগ্রামের গামছা, বিকনির ডোকরা শিল্পের সুনিপুণ বিজ্ঞাপন।
কতক গরম লবঙ্গলতা শালের পাতায় নিয়ে বসেছি মেলার মেঠাই শপে। সেই হলুদ লবঙ্গ ধুলোর চাদরে মোড়া। চায়ে কাঁসাইয়ের বালি। আর আছে মানুষের শ্রমের গন্ধ, প্রাণের আনন্দ। চারপাশে মেলা যাত্রীর ভিড়ের চাক। খুশির ফোয়ারা উড়ছে চারিদিকে। মাদল ধমসায় দল ঢুকল মিঠাআম গ্রামের। মানুষগুলি মদের পালিশে মদন-চড়া হয়ে আছে। মদাসক্ত মেয়েরাও। ওই যে মেয়েটি চৌদল মাথায় নিয়ে নাচে আর গায়, তার স্খলিত আঁচলটি ধুলাতে লুটায়। পায়ে পায়ে জড়িয়ে সে বহু দূরে যায়। নাচের উন্মাদনায় তার কোনও সম্ভ্রম বোধ নেই। তাকে জড়িয়ে ধরে ঝপকা চুল দাড়ির পুরুষটিও নাচে। আর রেগডা বাজছে। ফ্লুট, মীরকোষ। মানুষের পিন্ড জমা হয়েছে। নৃত্যরত নারীর শরীর থেকে বিচ্ছুরিত অগ্ন্যুৎপাত দেখি আর ভাবি, এই টুসু দেবীর নিরঞ্জন পর্ব! ওই কাঁসাইয়ের গর্ভে তার স্বামীগৃহ। আলো মরে এলে দেবী জলে পড়বেন। জল-ঘরে শুয়ে তাঁর শরীর থেকে ধুয়ে মুছে যাবে জীবন-যৌবনের চটক। তারপর শুধু খড়ের মৃতদেহ। মানুষের জীবন পর্বের অন্তিমও তো তাই। আগুনের নদীতে দহনে দহনে ভস্ম হয়ে যাওয়া।
মেলার একপাশে দাঁড়িয়ে ছুরি কাঁচি কোদাল কুড়ালে শান তুলছিল ঝামেলা সহিস। রোগাটে মানুষটার ভাঙা গালে বে-মানান গালপাট্টা, চুনট করা চুল, খর দৃষ্টির চোখ। ‘তোমার নাম ঝামেলা কেন ভাই?’ সে এক চটকা হেসে বলে, ‘আমার আসলি নাম ছিল লখন সহিস। কাঁসাই নদীর সে ধারে বেলবনি গাঁয়ে থাকা হয়। গাঁয়েতে ঝামেলি করতাম হামেশা। আমি ছিলম সিঁধল চোর দাদা, ‘মানুষটার অকপট স্বীকারোক্তি।’ দু’পাঁচ গাঁয়ের লঁক দিশাহারা হঁয়্যে পড়ল আমাকে লিঁয়ে। বুঝাঁল সুঝাঁল, কিছু হঁল্য নাই। ‘কেন করতে এই অপরাধ?’ ‘গন্ডগল ত সিখানেই। উয়াঁ যে উচিত কর্ম নহে বুঝথে লারছি। পেটে ভখ্ (ক্ষুধা) থাকলে ভাখ বাগাতে লাগবে। ঝামেলাকে কেহ কাজ-কাম দিবেক নাই তো রাইতে সিঁধ কাটতে লাগলম। ধরা পড়ে হাজত ভি হঁল্য। দু-পাঁচ দফা হাজত করার পর গাঁয়ের মন্ডল সালিশি বসাল। আমাকে ডাকা করে মুরুব্বি লঁক বুঝাল-ইয়াঁ অধর্ম কর্ম, ছাড়ান দে ঝামেলা। আমার ভি উলটা সওয়াল– তা হঁল্যে খাব কি? কাজকর্ম কে দিব্যে ঝামেলাকে? প্রধান গেরেন্টি দিল, আমি দেখব। তু চুরি ছাড়। সেই থাকতে এই পথ ধরলম।’ চুরি ছাড়লেও চুরির পথ ছাড়তে পারলে না ঝামেলা ভাই?’ সে হেসে বলে, ‘ওই দেখেন, ঝামেলি ছাড়লেও নাম ট ঝামেলাই রহে গেঁলি যে!’ ‘ওটা তোমার উপাধি হয়ে গেছে। তোমার সম্মান।’ কথাটা না বুঝে সে হাসতেই থাকল। আমি ভেসে পড়লাম মানব দরিয়ায়।
দুপুর টলে পড়েছে। ভিড়ের দাঁপ বেড়েছে হাজার গুন। ঠাকুর কালিন্দীর দোকানের নিশানাটা মানুষের মাথা ছাপিয়ে ফরফর উড়ছে। শর্ত মোতাবেক সঙ্গীরা সব শীত পোশাক ঠাকুরের দোকানে জমা করে নিজের মতো করে মেলায় ভেসে পড়েছি। ফের সামিল হব ভাঙা বেলায়। এখন ভরা কোটাল লেগেছে মেলায়। কাঁসাই নদীতে স্নান সেরে, নতুন বস্ত্র পরে খেটেল মানুষ নদীর চরে সপরিবারে আহারে বসেছে। নদীর জলে মুড়ি ভিজিয়ে, গুড় কদমা ফেনি বাতাসায় মেখে পার্বণের আহার। চেয়ে থাকি অপলক। পল্লী ঘরের অ্যানিমিক মানুষগুলির পরব-ভোজ কত যত্নবান গ্রাসে। আমাদের শহরের ফেস্টিভ ফিস্ট মনে পড়ে যায়। তাদের পান-ভোজনে কত অপচয়, মদ-মত্ততায় কদর্য প্রকাশ। এখানেও মত্ততা আছে। নাচ-গান-পানে তূরীয় আনন্দ আছে। সেই আনন্দের বাজে খরচ নেই। দলিত মুখগুলিতে খুশির ঝিলিকে যে দ্যুতি, শহরের ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ফেস-এ তার কণামাত্র নেই। একান্ত সেই ভাবনার মুখে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল চন্দ্রমোহন সরেন, ‘চলেন দাদা!’ ‘কোথায় ভেগেছিলে হে?’ ‘ভাগব কুথা? আজ-দিন যে একটাই ঠেক্ পরকুল।’ মানুষটা আমাকে মহা প্লাবনের স্রোত দু’হাতে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে চলল কোন জাহান্নামে জানি না! দাগি নেশাড়ুটা আমাকে টেনে এনে পৌঁছে দিল যেন মদন গঞ্জের ঘাটে। মেলার উত্তরপ্রান্তে জাঁকাল ভাবে পড়েছে মদ-মচ্ছবের আসর। ধাতব পাত্রে হাঁড়িয়া নিয়ে বসেছে গন্ডা পাঁচেক সঁড়ালে যুবতি। মদের সঙ্গে আছে অনুষঙ্গ। হরিজন মানুষ শালের দোনায় ভরে রস পানি খায় সঙ্গে কবুতর মাংস, চানা-বুট, কাঁচা মরিচ। সংসারের জ্বালা যন্ত্রণা হরক এ-ই ওদের পেইন কিলার। চন্দ্রমোহন বলে, ‘দাও দাদা পরব খর্চা। তুমি যত পার খাও, পয়সার কথা তো নয়।’ সে নিশ্চিন্ত হয়ে দাবড়ে বসে পড়ে মন ভুলাইয়া আসরে। এখন বেলা-ডোবা আলোয় মুখে মুখে ফিরছে একটাই গান– ‘হামার টুসু জলকে যাবে য আর ত ফিরে পাব না।’
সরষে ফুলে আগুন ঠুকে সূর্যটা টলে পড়েছে পশ্চিমের মাঠে। মেলা-যাত্রীর পায়ে এখন ভাটির টান। ওদিকে মাইকে লাগাতার ঘোষণা চলছে নিরুদ্দেশের– ধবনির লীলাবতী মাহাত, উমর রজ্জ যিখানে থাক…। হলুদকানালির কমলা হাঁসদা, চ্চ্ বছর, তুমার স্বামী মেলা অপিসে বসে…। লক্ষ্মীসাগরের সনামন…। চন্দ্রমোহন হঠাৎ ডুকরে ওঠে, ‘অই দেখ দাদা! আমার মাল্তিটাও দু’বছর আগেতে পরকুলে হাঁরায়েন গেঁলি। আর ফিরলিঁ নাই।’ ওকে বোঝাই, ‘এদের অনেকেই যে সংকল্প করেই হারায় চন্দ্রমোহন। তোমার কোনও কসুর নেই। ভালোবাসা নামক এই পাখি কার পিঞ্জিরা ভেঙে উড়ে বসে কার চালে কে বলে!’ পাতলা বোধের মানুষ অত শত বোঝে না। সে দোনা ভরে মদ খায়, আর বুক উজাড় করে কাঁদতে থাকে। তরল দ্রব্য গুনে মালতির অতীত ওর উপরে যত চেপে বসে, বিলাপ বাড়তে থাকে। মদের হিসেব চুকিয়ে আমি ফের ভেসে পড়ি মানব সাগরে।
ছায়ায় ঢেকেছে কাঁসাই চর। কাছে-দূরে দিনের রং মুছে গিয়ে সব সিল্যুট। মানুষগুলিও তাই। প্রকৃতির কালোয় ঢেকে প্রাকৃত জন এখন ঘরমুখো। সারাদিন ধরে এক মুঠো খুশি সওদা করে মানুষ ফিরে চলেছে তাদের চিরাচরিত তমশাচ্ছন্ন বিবরে। কাঁসাইয়ের বুকে ভাসছে ভগ্ন চৌদল। ঠান্ডা নামছে ঘন করে। মেলা প্রাঙ্গণ এখন যুদ্ধ শেষের রণক্ষেত্র। শুধু একপাশে মানুষের ভিড় এখনও। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাই। দেখি, ওখানে আবার কীসের তামাশা।
ঝান্ডির আসর পড়েছে এখানে। অর্থাৎ জুয়া কল। তাকে ঘিরে মানুষের চাক। তাদের কারও হাতে কাঁচা নোটের তাড়া, কারও খুঁটায় বাঁধা মহাজনি কর্জর টাকা, কেউ গাই-কাঁড়া বেচে দিয়ে সে টাকায় দান লাগাতে এসেছে। আমি জরিপ করি উৎকণ্ঠিত মানুষগুলির চোখ মুখ। বড়ো এক কাঠের ডাব্বায় নম্বর লেখা ছক্বা-পাঞ্জা ঘুঁটির মতো বড়োসড়ো এক ঘুঁটি ঝাঁকিয়ে ফেলা। যে নম্বর পড়ল, সেই নম্বরে যে আইটেম উঠবে, জুয়াড়ির ভাগ্যে সেটাই জুটবে। সেখানে সস্তা বিস্কুটের প্যাকেট থেকে ঘড়ি, ক্যামেরা, সাইকেল, টিভি, নানা প্রসাধনী সবই আছে। প্রতি পাঁচ টাকার দানে সকলেরই প্রায় জুটছে সস্তা আইটেম। কেউ বা ফিরছে শূন্য হাতে। বোঝা গেল কারসাজির চক্বরে পড়ে গেছে মানুষগুলি। দলিত মানুষ একটু সৌভাগ্যের আশায় তার সামান্য সঞ্চিত অর্থটুকু এই ঝান্ডির আগুনে ঢেলে দিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। তারপর ভেঙে পড়ছে অনুশোচনায়।
পাকড়াও করি মলিয়াড়ার ধনঞ্জয় মাহাতকে। ভাগ্যচক্রে পড়ে শ’তিনেক টাকা খুইয়ে সে বসে পড়েছে। ওইটুকু অর্থ শ্রম লগ্নি করে সে সঞ্চয় করেছিল। ভাগ্যদেবতা কেড়ে নিল। ওকে বলি, ‘ওই অর্থে সপরিবারে ক’দিনের মাংস-ভাত হতো। লোভ দমন করলে ওই খুশিটুকুন সকলে মিলে উদ্যাপন করতে পারতে। কি বলো ধনঞ্জয়?’ ‘কি বলব্য দাদা!’ তার গলায় হতাশা। ঝান্ডির টাকা মেটাতে না পেরে জগৎ খাটুয়ার সাইকেলটা জমা পড়ে গেল ঝান্ডিদারের হাতে। চোখের সামনে ঘটল ঘটনা। দুষ্টচক্রে পড়ে অভাবী জন কীভাবে নিঃস্ব হয় দেখি। জানতাম না আনন্দের নেপথ্যে টুসু ঠাকরুণ বিষাদের জাল বিছিয়ে রাখেন। সে জালে জড়িয়ে নিঃস্ব করে দেন হরিজন সমাজকে!
ভাঙা মেলার ফাঁকা মাঠে মানুষটা অনেকক্ষণ থেকেই ঘুরছিল। হঠাৎ কানে গেল তার কণ্ঠ, ‘আমাকে এট্টু পথ দেখাবে মশায়রা?’ তাকিয়ে দেখি গেরুয়াধারী এক উদাসী ফকির। পড়ন্ত বয়স। চুল দাড়ি অধিকটাই ধূসর। দিক্-হারা মানুষটার কাছে গিয়ে জানি, সে একটি চোখ হারিয়েছে। অপর চোখেও নজর কম। ‘এই জনহীন পথ ধরে তুমি যাবেটা কোথায়? কী পথ দেখাব তোমায়? আমরাই যেন নতুন বাবাজি!’ বাউলটির নাম জানলাম দীনদয়াল গোস্বামী, পাথরচাপুড়িতে তার আখড়া। ‘তা এখানে কীভাবে এলে?’ সে হেসে বলে, ‘পথের সন্ধানে বাবা! আমরা সদাই যাহাকে ধেয়ানি সে যে মানী লোক গো বাবু মশায়। তাহার স্বরূপটি জানতে দেখতে ছুটে চলাই সাধু সমাজের দস্তুর গো।’ দীনদয়ালকে সঙ্গে করে মাঠের পথে পা বাড়ালাম। সে পথ তমসাচ্ছন্ন। তাকে বলি, ‘এ পথের যে সিকি ভাগও চিনি না, কোন পথে এগোই বলত?’ ‘চলতে চলতেই পথ খোলে গো মশায়রা। শুধু এট্টুখানি ধরতাই পেতে লাগে। সেই ধরতাইটুকু যে দেয় সেই যে পরম সাঁই। তোমরা যে আমার সেই কাজটাই করে দিলে মশায়বাবুরা।’
মেলা যাত্রীরা অনেক আগেই চলে গেছে। শীতের কামড় অতটা আর গায়ে লাগছে না বাউল সঙ্গ করে। পাথরচাপুড়ির মহাজনটি আমাদের সঙ্গে। তার সাধু বচনে তপ্ত থাকি। আমাদের এক সঙ্গী প্রশ্ন করে বসে, ‘যে পথ চলছি সে-টি যে তোমার সঠিক গন্তব্য জানবে কেমন করে?’ সওয়ালের পিঠেই জবাব দীনদয়ালের, ‘দিগন্তহীন সাগরে জাহাজটি ঠিক দিশায় চলে কী প্রকারে? তারও তো এক গুরু আছে, যে সঠিক পথটি চিনিয়ে দেয়। আমাদের মনের কম্পাসটিও তেমনি, তেনার নির্দেশ মতো চলে। চলায় ফারাক ঘটলে যন্তর নির্দেশ দেবে। আমাদের বাউল বৈরেগীদের কানেতে শ্রবণ, পায়েতে দর্শন। পা পথটি দেখায় আর চলায়।’ আমার সঙ্গীটি এক লঘু তামাশ করে বসে। সে সুধায়, ‘যাকে ধেয়ানো তাকে চেনো গোঁসাই?’ দীনদয়াল শব্দ করে হেসে ওঠে এবারে। ‘এ কি বে-আন্দাজি তির মেরে বসলে মশায়বাবু। আলো-অাঁধারিকে চিনতে লাগে? সে যে আপনি এসে চেনায়। অন্তরের সাঁইটিও তাই। সে আপনি এসে চেনা দেয়। ভিতর দেউলে আপন গড়ন দেখায়। তাকে সাধন, পূজন, ভজনে ধরে রাখতে হয়। তাঁকে হূদ্মাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না।’ ওই হল কথা।
কথায় কথায় মাঠ ছেড়ে সড়কে এসে পড়েছি। অদূরে খাতড়া বাজার। ওখানেই এক শিষ্যঘরে রাতটুকু গুজরান দিয়ে গোঁসাই ফিরে যাবে তার আখড়ায়। আমরাও রোডে উঠে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে ফেলেছি। গন্তব্য মুকুটমণিপুর। দীনদয়াল বলে, ‘দেখ্লে তো, পারঘাটায় একবার পহুঁছে গেলে ফেরির অভাব ঘটে না।’ তুমিও ওঠো। এই ঠান্ডায় হাঁটবে কেন? খাতড়া ইস্তক মাইলটাক পথ খাটো করে দিই।’ দীনদয়াল প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। বলে, ‘না বাবুমশায়রা। মাথার উপরে বেলে চাঁদ ভাসছে ও-ই আমাকে উতরে দেবে। আমরা হলাম চলনদার লোক। তেনার চরণদাস। শরীর মনকে সর্বদা বিবিধ পরীক্ষায় রাখতে হয়। তোমরা উঠে পড়ো। কল্যাণ হোক। জয় রাধামাধব!’ এর পরে আর কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না বুঝে উঠে বসি। গাড়ি ছেড়ে দেয়। এক সময় পিছন ফিরে দেখি কঠিন ঠান্ডায় চাঁদ-কুয়াশার গভীর নির্জন পথে হেঁটে চলেছে পাথরচাপুড়ির সহজিয়া গোঁসাই। এ তার কার কাছে কী পরীক্ষা, বুঝে উঠতে পারি না।