বাংলা ছবির দর্শক সিনেমা দেখতে গিয়ে শুধু নায়ক-নায়িকার অভিনয় কিংবা বিনোদনেই সন্তুষ্ট হন না। আখেরে তারা ছবি দেখেন একটি ভালো গল্পের আশায়। ব্যক্তিগত জীবনের হাসি-কান্না, বিরহ-বিষাদ ভুলে, আড়াই ঘণ্টার এই ‘অলীক সুখে’ গা-ভাসাতে একটি মন ভোলানো কাহিনি সত্যিই এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
বর্তমানে বাংলা ছবির যে সমস্ত প্রযোজক, পরিচালক এই সারমর্মটুকু বোঝেন, তাঁরা মাধ্যম করছেন বাংলা সাহিত্যকে। ফলে, সাফল্যের পথও সহজ হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যকে মাধ্যম করে বাংলা সিনেমা তৈরির রীতি নতুন নয়। সত্যজিৎ রায়ের মতো গুণী পরিচালকও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’-কে অবলম্বন করে পেয়েছেন বিশ্বজোড়া খ্যাতি। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র তো আছেনই। এছাড়াও বনফুল, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, শংকর, মতি নন্দী প্রমুখ নানা যুগের নানা লেখকের গল্প অবলম্বনে তৈরি হয়েছে বহু জনপ্রিয় বাংলা ছবি।
সাহিত্যমূলক ছবি তৈরির এই ধারা অব্যাহত ছিল গত শতকের প্রায় সাতের দশক পর্যন্ত। কিন্তু তারপর প্রায় এক দশক কোনও এক অলৌকিক কারণে সাহিত্যকে বর্জন করেছিলেন বাংলা ছবির প্রযোজক, পরিচালকরা। মাঝের এই সময়টুকুতে সিংহভাগ পরিচালক নিজেকে অলরাউন্ডার প্রমাণ করার জন্য গল্প, চিত্রনাট্য সবকিছু নিজেরাই লিখেছেন। আর গল্প, চিত্রনাট্য লেখার গুণ না থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ তা করেন, তাহলে যা ফল হওয়ার তাই হয়েছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে তাঁদের ছবি। দর্শকরাও তখন বাংলা ছবির থেকে প্রায় মুখ ফিরিয়েই নিয়েছিলেন।
এই হল-বিমুখতার ‘ছবি’টা সামান্য হলেও বদলাতে শুরু করল নয়ের দশক থেকে। বাণী বসুর লেখা গল্প অবলম্বনে ‘শ্বেত পাথরের থালা’ ছবিটি উপহার দিয়ে পরিচালক প্রভাত রায় কিছুটা পুনরুদ্ধার করেছিলেন বাংলা ছবির হারানো গৌরব।আর ওই দশকেরই শেষের দিকে গৌরব পুনরুদ্ধারের বৃত্ত অনেকটাই পূর্ণ করেছিলেন পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। তিনি উপহার দিয়েছিলেন সুচিত্রা ভট্টাচার্যর লেখা গল্প অবলম্বনে তৈরি ছবি ‘দহন’। তবে, ‘শ্বেত পাথরের থালা’ এবং ‘দহন’ দুটি ছবিই সাহিত্যমূলক হলেও, দুটি ছবির গল্পের ধরনের বিশেষ পার্থক্য নজরে পড়েছে। ‘দহন’ অনেক বেশি যুগোপযোগী কাহিনিতে সমৃদ্ধ। আর এই যুগোপযোগী কাহিনিতে সমৃদ্ধ ছবির সাফল্য প্রেরণা যুগিয়েছে সাম্প্রতিককালের অনেক পরিচালককেই। তাই তাঁরাও হেঁটেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষের পথ ধরে। এই তালিকায় রয়েছেন অঞ্জন দাস, শেখর দাস, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ গুপ্ত, নীলাঞ্জন ভট্টাচার্য, বিষ্ণুপাল চৌধুরি, সুদেষ্ণা রায়-অভিজিৎ গুহ প্রমুখ।
আবার যাঁরা যুগোপোযোগী না হলেও, মাঝেমধ্যে সাহিত্যকেই মাধ্যম করছেন ছবির জন্য, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন, অঞ্জন দত্ত, অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরি, অনীক দত্ত, সুমন মুখোপাধ্যায়, বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ পরিচালক। কিন্তু যাঁদের লেখা গল্প-উপন্যাসে সমৃদ্ধ হচ্ছে সাম্প্রতিককালের বাংলা ছবি, কী বলছেন সেইসব সাহিত্যিকরা? কারাই বা আছেন এই তালিকায়? কতটাই বা খুশি তাঁরা? এই সমস্ত কৌতূহল মেটানোর জন্য সম্প্রতি তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করেছেন তিন সাহিত্যিক– সুচিত্রা ভট্টাচার্য, স্বপ্নময় চক্রবর্তী এবং রূপক সাহা।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য
আমার লেখা অনেকগুলি গল্প-ই চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। এরমধ্যে দহন, ইচ্ছে, টলিলাইটস, অলীক সুখ, হেমন্তের পাখি এবং ক্যানসার অনেকদিন আগেই মুক্তি পেয়েছে এবং সকলেই জানেন যে, ছবিগুলি দর্শকদের মন জয় করতে পেরেছে। এছাড়া মুক্তির প্রতীক্ষায় রয়েছে ‘কাচের দেয়াল’।
সত্যি বলতে কী, গল্প-উপন্যাস লেখা আমার নেশা এবং পেশাও। লেখার সময় প্রথমে মাথায় থাকে পাঠকদের ভালোলাগার বিষয়টি। সেইসঙ্গে থাকে নিজস্ব অনুভূতি। যে-সমস্ত স্পর্শকাতর বিষয় আমার মনকে নাড়া দেয়, তা আমি লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করে মনের ভার কিছুটা লাঘব করি। আর সাহিত্য এবং সিনেমা যেহেতু সমাজদর্পন, তাই আমার লেখা কোনও গল্প-উপন্যাস নিয়ে যখন সিনেমা হয়েছে কিংবা হচ্ছে, তখন তো ভালো লাগবেই। কারণ, আমি লেখার মাধ্যমে যে বার্তা দিতে চেয়েছি, তা সিনেমার মাধ্যমে আরও অনেক লোকের কাছে পৌঁছোবে। তবে এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে, আমি যেভাবে যা লিখি, সেই লেখার মতো হুবহু প্রতিফলন ঘটে না সিনেমায়। চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক তাঁর মনের মতো সাজিয়ে পরিবেশন করেন। ‘দহন’-এ ঋতুপর্ণ ঘোষ এবং ‘ইচ্ছে’ ও ‘অলীক সুখ’-এও নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নিজস্ব মনন দিয়ে ছবিগুলি তৈরি করেছিলেন। অবশ্য আমি যে বার্তা দিতে চেয়েছি তা ঠিক আছে কিনা জানার জন্য চিত্রনাট্য দেখে নিই। কখনও আবার কাহিনির প্রধান চরিত্রে কাকে নিলে ভালো হয় সেই পরামর্শও দিই কিন্তু কোনও পরিচালক তা গ্রহণ করেন আবার কেউ হয়তো গ্রহণ করেন না। অবশ্য এসব নিয়ে তেমন মনখারাপ হয় না কিন্তু পারিশ্রমিকের পরিমাণের জন্য খুব মনখারাপ হয়ে যায়। কারণ, তা এতটাই কম যে, বলতেই লজ্জা করে।
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
আগে সিনেমাকে সবাই ‘বই’ বলতেন। ‘ছবি’, ‘মুভি’ প্রভৃতি শব্দগুলি এসেছে অনেক পরে। আর ওই ‘বই’ বলার অভ্যাস এখনও অনেকে ছাড়তে পারেননি। আসলে, আগে সাহিত্যেরই চলচ্চিত্র রূপায়ণ হতো, তাই সিনেমাকে ‘বই’ বলা হতো। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প-উপন্যাস নিয়ে তখন বেশি সিনেমা তৈরি হতো। পরে অবশ্য এই তালিকায় যোগ হয়েছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম।
যাইহোক, মাঝে কিছুদিন সাহিত্য ছাড়া সিনেমা তৈরি হলেও, আবারও সাহিত্য ফিরে এসেছে সিনেমায়। এখন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প নিয়ে ছবি করার পাশাপাশি, আমার মতো সাম্প্রতিককালের অনেক লেখকদের যুগোপযোগী গল্প-উপন্যাস নিয়েও সিনেমা তৈরি হচ্ছে। তবে আমার লেখা নিয়ে এপর্যন্ত মাত্র দুটো ছবি তৈরি হয়েছে। আমার ‘ঝড়ের পাতা’ গল্প অবলম্বনে ‘আমি আদু’ ছবিটি ‘নিউ থিয়েটার্স’-এর ব্যানারে ইতিমধ্যে মুক্তিও পেয়েছে এবং দেশবিদেশে সম্মান এবং পুরস্কারলাভও করেছে। সারা পৃথিবীর যেখানেই যুদ্ধ হোক না কেন, তার প্রভাব যে-কোনও দেশেই যে পড়তে পারে, এই বার্তা আমি ঠিক যেভাবে দিতে চেয়েছি, সেভাবেই পরিচালক সোমনাথ গুপ্ত তুলে ধরেছেন ‘আমি আদু’ ছবিটিতে। তাই তাঁর উপর আমি আস্থা রেখে আমার লেখা ‘প্রমোদ সন্ত্রাস’ উপন্যাসটিও দিয়েছি সিনেমা তৈরির জন্য। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো মুক্তি পাবে এই ছবিটি।
তবে এ প্রসঙ্গে আমার আক্ষেপও রয়েছে। যতই সাহিত্যিকের গল্পে সিনেমা সমৃদ্ধ হোক কিংবা সাফল্য পাক না কেন, আসলে তা শেষপর্যন্ত শুধু পরিচালকেরই ছবি হয়ে যায়। লাইমলাইট-এ আসেন শুধু পরিচালক-ই, লেখক স্বীকৃতি পান সৌজন্যমূলক, নামমাত্র। পারিশ্রমিকের বিষয়টিতেও লেখকের প্রাপ্তির ঝোলা ভরে না। দশ-পনেরো হাজারের বেশি কপালে জোটে না আমার মতো লেখকদের। আর যদি সিনেমা তৈরির জন্য বন্ধুস্থানীয় কেউ গল্প চায়, তাহলে তো পারিশ্রমিকের বিষয়টি ‘উহ্য’ থাকে। তবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো নামি লেখকদের অবশ্য আমার মতো অবস্থা হয় না, তাঁদের প্রাপ্তির ঝোলাতে ষাট-সত্তর হাজার জমা পড়ে।
তাই আমার মতে, ভালো সিনেমা তৈরির জন্য গল্প যতই প্রধান ভূমিকা নিক না কেন, গল্পকারের কপালে নামযশ, অর্থ তেমন জোটে না। যেমন অমলেন্দু চক্রবর্তীর লেখা উপন্যাস নিয়ে ‘একদিন প্রতিদিন’ এবং ‘আকালের সন্ধানে’ ছবি বানিয়ে খ্যাতি পেয়েছেন মৃণাল সেন কিন্তু অমলেন্দু চক্রবর্তীর নাম কতজন জানেন? যাইহোক, ক্ষেপ-আক্ষেপ নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়, আমিও সেভাবেই এগোচ্ছি। আমার লেখা ‘ঝাকিনি তন্ত্র’ কাহিনি নিয়ে একটি ছবি বানাতে চেয়েছেন পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। অন্য অনেকেও আমার লেখা গল্প নিয়ে ফিল্ম তৈরির ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন, তবে সেসব কথা খুব প্রাথমিক স্তরে রয়েছে, বেশিদূর এগোয়নি।
রূপক সাহা
একসময় সাংবাদিকতা ছিল আমার পেশা, এখন গল্প-উপন্যাস লেখা আমার প্যাশন। তাই আমার লেখালেখিতে কোনও ফাঁকি থাকে না, পুরোদস্তুর রিসার্চ করে তারপর লিখি। আমার লেখা ‘লাল রঙের পৃথিবী’-র জন্যও ভীষণ খেটেছিলাম।
যৌনকর্মীদের জীবনযাপন, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-যন্ত্রণা, বেঁচে থাকার লড়াই প্রভৃতি বিষয়ে নিখুঁতভাবে জেনেবুঝে এসে, তবেই লিখেছিলাম ‘লাল রঙের পৃথিবী’। উপন্যাসটি যখন ‘লাল রঙের দুনিয়া’ নামে চলচ্চিত্রায়িত হল, তখন ভালো ফলের আশা করেছিলাম কিন্তু ছবিটি মুক্তির পর আশাহত হলাম। কারণ, আমার উপন্যাসে যা ছিল তার প্রতিফলন ঘটেনি ছবিতে।দেবশ্রী রায় যে-চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন, শুধু যদি সেই চরিত্রটিকে ধরে ছবিটা এগোত, তাহলে ঠিকঠাক দাঁড়াত ছবিটা। কিন্তু পরিচালক (নীলাঞ্জন ভট্টাচার্য) চিত্রনাট্য করার পর আমাকে না দেখিয়ে ছবি বানিয়েছিলেন, তাই এই খারাপ পরিণতি। পরিচালকের নিশ্চয়ই স্বাধীনতা আছে তাঁর নিজের মতো করে ছবি তৈরির কিন্তু এত দুর্বল চিত্রনাট্য নিয়ে তিনি যে ছবিটা বানিয়ে ফেলবেন, তা আমি ভাবতে পারিনি।
যাইহোক, এ বিষয়ে আমার দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাও তিক্ত।পরিচালক পান্না হোসেন আমার লেখা ‘জুয়াড়ি’ গল্পটি নিয়ে ছবি বানাতে গিয়েও বারোটা বাজালেন। তবে এই আপশোশ মেটানোর জন্য আমি নিজে কখনও ফিল্ম ডিরেক্টর হওয়ার কথা ভাবব না। কারণ ওটা একটা আলাদা মাধ্যম। টেকনিক্যাল দিকটা ঠিকঠাক শিখতে হবে। যা আমার সিলেবাসের বাইরে।অবশ্য অনেকেই তো এখন নিজেরাই গল্প লিখে ছবি বানিয়ে পুরস্কারও বাগিয়ে নিচ্ছেন। আমি তা কখনওই পারব না, কারণ আমি তো আর বিজ্ঞাপন জগতের লোক নই। এখন যাঁরা বাংলা ছবির হাল ধরেছেন তাঁদের বেশিরভাগই তো বিজ্ঞাপন জগতেরই লোকজন। অনিকেত চট্টোপাধ্যায়, সুদেষ্ণা রায়ের মতো হাতেগোনা দু-তিনজন অবশ্য সাংবাদিকতার পেশা থেকে গিয়ে ফিল্ম ডিরেক্টর হয়েছেন। অতএব, যিনি যে বিষয়ে দক্ষ এবং যেটাতে ন্যাক রয়েছে, সেই কাজটাই তাঁর করা উচিত, নচেৎ তাঁর নিজের এবং অন্যেরও ক্ষতি অনিবার্য বলে আমি মনে করি।
পরিচালক সুজিত সরকার আমার লেখা ‘একাদশে সূর্যোদয়’ নিয়ে একটি হিন্দি ছবি তৈরির ইচ্ছেপ্রকাশ করেছেন। খেলার দুনিয়ার কাহিনিতে সমৃদ্ধ এই লেখাটি নিয়ে ছবি তৈরির কথা এর আগেও অবশ্য বলেছিলেন ইন্দ্রনীল গোস্বামী, তবে তা হয়ে ওঠেনি। এখন সুজিত সরকার ছাড়াও অবশ্য ঈপ্সিতা পাল আমার লেখা ‘ঘাতক’ উপন্যাসটি নিয়ে ছবি করার ইচ্ছেপ্রকাশ করেছেন। কিছুদিন আগে পিনাকী চৌধুরীও আমার লেখা ‘সাদা পাতায় কালো দাগ’ শীর্ষক গল্পটি নিয়ে পদ্মনাভ দাশগুপ্তকে দিয়ে চিত্রনাট্য লিখিয়ে রেখেছেন সিনেমা তৈরির জন্য।জেলের কয়েদিদের নিয়ে বক্সিং টুর্নামেন্ট-এর বিষয়ে আমার লেখা সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘কাচে ঢাকা হিরে’ যদি কেউ সিনেমা তৈরি করেন আমি ভীষণ খুশি হব। কারণ, উপন্যাসটি সিনেমা তৈরির জন্য আদর্শ।
( এই লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হল )