সাই আর্কেড। মাথা তুলে অ্যাপার্টমেন্ট-এর নামটা আগে পড়ল পানসি। রট আয়রনে পেঁচিয়ে লেখা ইংলিশ হরফ। মানেটা প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হলেও পরে মনে পড়েছিল, গুরুস্মরণাত্মক সাই এদেশে যে-কোনও বিনির্ম্মানের শীর্ষবন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর্কেড-এও সেটা হয়েছে।

আড়াইঘণ্টার এয়ার-জার্নির পর এই ভিন প্রভিন্সের অনেক কিছুই ওর অদ্ভুত লেগেছিল। প্রথমত বে অফ বেঙ্গল-এর উপর দিয়ে উড়ে আসাটি তো ভোলার নয়। শঙ্খচিলের মতো ক্ষণকাল ভাইজাগে ডানা থামিয়েছিল এয়ার ডেকান। ফের যখন উড়ল, ক্রমশ ঝাপসা হয়ে হারিয়ে গেল সমতল।

অরিন্দম এয়ারপোর্টে ছিল। নতুন এয়ারপোর্ট-টা তখনও চালু হয়নি। লাগেজ আর পানসিকে ট্যাক্সিতে তুলে ফিরতে ফিরতে দুপুর। ভাড়া মিটিয়ে কাঁধে পিঠে ব্যাগ বোঝাই হয়ে উপরে উঠছে অরিন্দম, পানসি বলল, লিফ্ট নেই?

অরিন্দম আগেই জানিয়েছিল শহরতলির সদ্য তৈরি এইসব বাড়ির অনেক কিছুই ইনকমপ্লিট এখনও। মঞ্জিরা ওয়াটারের লাইন নিয়ে তো সবে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে…।

তার মানে তো খাবার জল! পানসি চমকেছিল– তাহলে? অরিন্দম বলেছিল, সপ্তাহে দু’দিন মিউনিসিপ্যালিটির জলের গাড়ি আসে পাড়ায়। রাস্তায় নেমে কাড়াকাড়ি করে সেই জল তুলতে অসুবিধা যাদের, দোকানের মিনারেল-ডিব্বা তো রইলই…। অরিন্দম কোনও উত্তর দিল না এখন। তার পিছু পিছু উপরে উঠছে পানসি। সেই তিনতলার ব্লকে। লালিত এক আনুগত্য কাজ করছিল ভিতরে ভিতরে। জানা নেই, কেমন হবে আগামী। তবে সহযাত্রার তাগিদটা এ মুহুর্তে মিথ্যা নয়।

বারোশো স্কোয়্যার ফিটের এই ফ্ল্যাট। সামনে সাউথফেসিং ব্যালকনি। দাঁড়ালে গা শির শির করে ওঠে। মনে হয় শূন্যে ভাসমান একখণ্ড পা-দানি, দমকা বাতাস বুঝি হড়কে দেবে। লম্বা করিডরের পিছনেও একটা বারান্দা আছে। সেখানে দাঁড়ালে ছত্রখান ভাঙ্গা পাহাড় নজরে আসে। রাত্রির আবছায়ায় সেই খুবলানো পাহাড়গুলো ভূতের মতো দেখায়। ঝোপঝাড় আর জলাভূমির পাশ দিয়ে চলে গেছে রেলের লাইন। মাঝে মাঝে বিস্তৃত সমতল জুড়ে কবরের ফলক। বাজনা বাজিয়ে পরিজনের কাঁধে মৃতদেহ যায়। শব্দটা পানসির পরিচিত হয়ে গেছে।

জয়েনিং-এ এসে অরিন্দম কোম্পানির গেস্টহাউসে উঠেছিল। পরে হন্যে হয়ে অটোতে করে বাড়ি খুঁজতে বেরিয়ে, সাই আর্কেড-এর একটিমাত্র ব্লকে টু-লেট দেখেই বুক করে দেয়। দরাজ লিভিং রুম, উদ্দাম হাওয়া খেলছে। কিচেন, বাথ, বেডরুম সব মিলিয়ে চমৎকার পরিসর। ভাড়া আপাতত, মঞ্জিরা ওয়াটারের ব্যবস্থা নেই বলে দশে থেমে আছে। অসুবিধা বলতে, লাগোয়া ট্রেন লাইনের উৎকট আওয়াজ। ময়ালের মতো ট্রেন যায় হেলেদুলে– সিগনাল না পেলে ছোট্ট বাঁকে থমকে থাকে দীর্ঘসময়। বেগমপেট পর্যন্ত গিয়ে লাইন হায়দরাবাদ আর ফলকনামার দিকে দু’ভাগ হয়ে গেছে। চেন্নাই তিরুপতি এক্সপ্রেস কি হুসেন সাগরের মতো দূরপাল্লার পথ এটাই। গভীর রাতের ট্রেনগুলো, অরিন্দমের কথায়, যেন বুকের উপর দিয়েই ছুটে যাবে মনে হয়…।

অরিন্দম এখানে প্রমোশন নিয়ে এলেও পানসিকে আসতে হয়েছে চাকরির পাট চুকিয়ে। অরিন্দমকে তার কোম্পানি প্রশিক্ষণের জন্য লন্ডন পাঠাবার সিদ্ধান্ত কেন যেন ভেস্তে দেয়। পরিবর্তে প্রমোশন দিয়ে পাঠাল এই কুতুব শাহ্-র নগরীতে। এই প্রাপ্তি অরিন্দমের কাছে নাকের বদলে নরুন বলে মনে হয়েছে। অফিসে এখানে যাদের উপর তার কর্তৃত্বের দায়, তাঁদের অনেকেরই সমৃদ্ধ বায়োডাটায় গাল্ফ কী বাফেলো ঘুরে আসার সংযোজন আছে। সেই সমস্ত কেতায় কিছু বিব্রত, বিরক্ত ফলত সামান্য ডিপ্রেসড্ও অরিন্দম। পানসিকে অনেক ভেবে তার এই নতুন জায়গার জীবনটিকে অগ্রাধিকার দিতে নিজের চাকরি ছাড়তে হল।

অরিন্দম এখন তালা খুলে বেশ দরাজ মেজাজে বলল, কী ঠিক আছে তো? এবার খাওদাও রিল্যাক্স করো– বড়ো ফ্ল্যাট নিলাম…।

পানসি কৌতুক জুড়ল– এই ফাঁকে গোটা দুই ভূমিষ্ঠ করে ফ্ল্যাটটা ভরে দিলে কেমন হয়? পানসি হেসে গড়ালেও অরিন্দম আঁতকে উঠল, দোহাই। ওই সর্বনাশটা বাধিও না। মরে যাব। এখান থেকে নেক্সট ইয়ারে কোম্পানি চারজনকে বাইরে পাঠাচ্ছে, তারমধ্যে খুব সম্ভব–

কথা কেড়ে নিয়ে পানসি বলল, অরিন্দম চ্যাট, তাই তো?

– একা অসুবিধায় পড়বে…। অরিন্দম মোবাইল বের করল।

– কাউকে ডেকে নেব – তোমার বা আমার বাড়ি থেকে।

– তোমার মা হার্টের পেশেন্ট, আর জানোই তো আমার কেউ নেই।

পানসির চোখ সরু হল – কেউ-ই নেই?

– না, নেই। ওসবে হ্যাপা আছে।

– আছে তো আছে। তাই বলে সময়মতো ফ্যামিলি কমপ্লিট হবে না?

– এই জড়িয়ে পড়া পানসির জরুরি মনে হলেও অরিন্দম নারাজ। মোবাইল কানে তুলে সরে গেল সে।

পানসি এখানে ওর প্রতিদিনের প্রভাতগুলো তাজা রাখতে চায়। দিনটা পরে যেদিকে গড়ায় গড়াক। সল্টলেকে থাকতে চমৎকার বুলেভার্ড ধরে হাঁটত। সঙ্গতায় অরিন্দম নেই। তার নাকি স্মৃতি উসকে ওঠে। কী সেটা? শঙ্খরা যখন সার্ভেপার্কে থাকত, ছুটির দিনে ওদের কাছে গেলে, রাতে আর ফিরতে দিত না শঙ্খ। – ভোরে শঙ্খ আর আমি হাঁটতে হাঁটতে বাইপাস ধরে মুকুন্দপুর চলে যেতাম…।

– আর নলিনী?

অরিন্দম দূরমনস্ক গলায় বলেছিল, ওর তো তখন কোলে বাচ্চা!

পানসি চোখ নামিয়ে দুঃখটুকু শেয়ার করেছিল।

এখানে প্রাতর্ভ্রমণটা চালু করতে পায়ে শু পরছে পানসি, বেল বাজল। কামওয়ালি কাম কুক ভূলছ্মি। ডানদিকের নাকে ধ্যাবড়া নাকছাবি ঝিকোচ্ছে।

– কী হ’ল, দাঁড়িয়ে কেন? ভ্রূর ইঙ্গিতে পানসি সেটা জানাল। ভূলছ্মিরও স্রেফ আপন ভাষাটি পুঁজি। ফলত আকার-ইশারা একমাত্র কাজের মাধ্যম। চারখানা আঙ্গুল তুলে ম্যাডামের কাছে ছুটি’র আর্জি জানাল সে। পোঙ্গল পরবে নিজের গাঁও যাবে। পানসিও তার দু’টো আঙ্গুল দিয়ে খারিজ করল দুটো দিন। বাকি দু’দিনই লুফে নিয়ে চটপট নেমে গেল ভূলছ্মি।

গতকাল হিল্স এরিয়ায় পার্টি ছিল অরিন্দমের। লেট নাইটে আর ফেরেনি। রাতের খাবার একা একা খেয়েছিল পানসি। সেই বাসন পড়ে রইল সিঙ্কে। দুপুরের খাওয়া অরিন্দম ফিরলে হবে নাকি তার পছন্দের রেস্টুরেন্ট এপি মিল-এ একটা ফোন করে দিলেই চলবে– ভাবতে ভাবতেই দরজা নক করল পানসি।

এই ফ্ল্যাটের মালিক থাকেন সিটিতে। বন্ধু রমেশ রাও, যিনি কেয়ারটেকারও, এখানেই তার ফার্স্ট ফ্লোরে সপরিবারে বসবাস। নীচের তলা পুরোটা ডছ ছাঙ্গালওয়াল রেড্ডির কেনা। একদিকে তাঁর চেম্বার, অন্যদিকে ছোট্ট কটেজটি বিউটিশিয়ান স্ত্রীর পার্লার। দোতলার একটা দিক সদ্য খালি হ’ল। অন্যটা মেস গোছের। ভাইজাগ, কটক, কর্ণাটক থেকে আসা কেউ চাকুরে, কেউ পড়ুয়া, কেউ ভিসাগডের মন্দিরে পুজো চড়াচ্ছে, বিদেশ যাবে বলে। পানসি নীচে নেমে দেখল, সাই আর্কেড-এর সামনে আজ বর্ণময় আলপনা। কামওয়ালির খড়ির দায়সারা আঁকিবুঁকিবুকি নয়। যা সে রোজ ঝাঁট দেয়া পর্বেই চুকিয়ে দেয়। আজ মালকিনের যত্নে আঁকা ফুলের লতা, সবুজ খেত আর উপচে পড়া সূর্যোদয়ের আলোয় ছড়ানো মোহর ভরা কলস…। সুন্দরী মিসেস ছাঙ্গালওয়াল নেড়া মাথাটি হেলিয়ে হাসল। পুজো চড়িয়ে এসেছে প্রভু বালাজির পায়ে। প্রতিহাস্যে পানসিও ডিঙ্গিয়ে এল চিত্রিত বেসমেন্ট। সমস্ত বাড়িরই সদর আজ আলপনা রঞ্জিত। পোঙ্গল পরব এদের শস্য উৎসব। নিজের দেশে আজ মকর সংক্রান্তির পিঠেপায়েস খেয়েছিল পানসি সহকর্মী জয়েস-এর সঙ্গে, একটা উইন্টার ফেয়ার-এ।

আশেপাশে বাবলার ঝোপঝাড় আর পাথরের চাঁই ছড়ানো জমি। তারমধ্যেই হাইরাইজ উঠছে। দৈত্যাকার দু’খানা হাতের মতো দুটো ক্রেন কুচো পাথর তুলছে তো তুলছেই। পাহাড় ফাটিয়ে, জংলা কেটে বিস্তৃত করা হচ্ছে এঁদো গ্রাম। বাড়ছে সাইবারাবাদ। ডিনামাইট চার্জের সময় পুরো সেক্টর যখন লাফিয়ে ওঠে, অরিন্দম বলে, যেন ব্যারন দ্বীপের চূড়োয় বসে আছি…।

সামনে তারানগর। পাশেই চন্দা। এইটুকু হাঁটবে ভেবে পা বাড়াতেই রিংটোন এল। ফোনটা অরিন্দমের নয় ভেবে এড়াতে চাইছিল, কানে তুলতেই, ফিরতে দেরি হবে। ব্রেকফাস্ট সেরে নিও।

– কোথায় তুমি?

– এই আর কী…।

– আ-শ্চ-র্য! দাঁতে দাঁত ঘষল পানসি। – কাল বেরিয়েছ পার্টির নাম করে। এখনও বসে আছো?

– আহুজার মেসে আছি।

পানসি কানে মোবাইল চেপে একটা বাইকের ধাক্বা বাঁচাল। হাসছে অরিন্দম ফোনে– চিন্তা কী ডার্লিং। দুটো তো জীব, আর খাঁচা যখন একটাই।

মোবাইল পকেটে পুরেছে পানসি। হাত তুলে চন্দা নগরের অটো ধরে নিল। মর্নিং ওয়াকের পথে এখন যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কিছু পত্রপত্রিকার খোঁজ খুব জরুরি ওর। বাড়িতে অনেকগুলো কাগজ এলেও একটা বাংলা কাগজের অভাব থেকেই যায়। নিত্য বিপত্তির কলকাতার খবরটা খুব টানে। এখানে সে কাগজের নাম শুনলে অবশ্য হকারের হাঁ বন্ধ হয় না।

দু’চারটে স্টলে হন্যে হয়ে কাগজপত্র ঘেঁটে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে শেষে দু’প্যাকেট ধূপকাঠি কিনে ফের অটো ধরল।

সাই আর্কেড-এর সামনে অরিন্দমের ট্যাক্সি আর পানসির অটো প্রায় একই সঙ্গে থামল। পার্স বের করতেই বাধা দিল অরিন্দম।

সিঁড়িতে উঠতে উঠতে শিস্ দিচ্ছে অনেকদিন পর। মনটা খুশি করে দিল কি মেদিনীপুরের ফোন! পানসি তালা খুলল। ব্রেকফাস্ট হয়নি। ফ্রিজে দুধ আছে, বলল, ওটস করে দেব?

– নাক সিঁটকাল অরিন্দম, শেষে চাইল্ড ফুড?

– ওমলেট আর কফি দিই তাহলে? ভূলছমি তো ছুটি নিয়েছে। অরিন্দম জবাব দিল না। চিৎপাত হয়েছে ডিভানে। চোখ সরু করে বলল, ওটা কী?

আপন ভাষার স্বপক্ষে সুন্দর একটা শব্দ বলতে ইচ্ছা হল পানসির, বলল, গন্ধদীপ…।

– সেটা আবার কী?

– বলোই না!

দেখে নিয়ে মুখ ফেরাল অরিন্দম, ধূপের বিজনেস কখনও করতে হয়নি।

কথার ধরনটা রাগিয়ে দিল পানসিকে, বলল, কী ভাবো নিজেকে! কীসের এত তাচ্ছিল্য! ঘরে তিরুপতির ছবি থাকলে ধূপ আসতেই পারে।

– সেটা বললেই হয়! আগরবাতির নাম শুনেছি, গন্ধদীপ, সেটা কী?

– ধূপের অন্য নাম গন্ধদীপ, জানো না?

– না জানি না, আমার অত ফান্ডা নেই। কী হবে! এই ভাষাটার তেমন পরিণাম নেই। আগামী একশো বছরের মধ্যেই মরে যাবে।

– তাতে তোমার কী সুবিধা হবে?

অরিন্দম পাশ কেটে বলল, তোমার পেপারের ব্যবস্থা হল?

– হয়ে যাবে।

– আর হয়েছে। অরিন্দম আড়মোড়া ভাঙছে, এখানে ওসব বিকোয় না, তাই আসেও না।

পানসি বলেই ফেলল, তাই নাকি! তাহলে!

– ইন্টারনেট থেকে পড়ে নিলেই পার। বলেই কিছু মনে পড়ার উদ্ভাসে উঠে বসল অরিন্দম, বলল, আমার অফিসে সিন্ধুকা বলছিল, নাইনটিন সেভেনটি ফোর-এ ওর বাবাও নাকি এখানে চাকরি করতে এসে কাগজের জন্য হেদিয়েছিল। পরে তো জামাই হ’ল এদেশের। এখন তো পেল্লাই বাড়ির দরজায় সিঁদুর-লেপা চালকুমড়ো ঝুলছে। দু’পাশে ল্যাব্রেডর নিয়ে পেপার পড়ে। বাংলা কাগজের কথা আর মনে পড়ে না।

– তো! পানসি একাক্ষরী।

– এই আর কী! সবই সময়ের ব্যাপার।

পানসি বলল, তাই বলে তোমার সিন্ধুকার বাবার মতো আমি এখানে গেড়ে বসতে আসিনি।

হাসছে অরিন্দম, আরে, সেটা হয়তো কেউই আসে না। এদের ধারণায় বেঙ্গলের ছেলেরা পাত্র হিসেবে অনন্য। নারী নির্যাতন নাকি জানেই না। খুক খুক করে হাসছে অরিন্দম, ওরা তাই জামাইকে এসট্যাবলিশ্ড করে দিয়ে সব খেদ ভুলিয়ে দেয়। পানসি বলল, কী বোঝাতে চাইছ সিন্ধুকা তোমায় ব্যাচেলর ভেবেছে! বাবার দশা করবে!

– বলা যায় না। তবে আমার বস-এর যে নেকনজর আছে, এটা ঠিক। যদিও খুকুমণিটি সদ্য কনভেন্ট পেরোল।

– তবে আর কী। পানসি চুল ঠেলল আঙ্গুল ছড়িয়ে, বলল, তোমার লন্ডন যাওয়া ঠেকায় কে। তবে ডোবাতে যে তোমার একটি পানসি ভাসছে, সে খবরটা?

হা হা করে হাসছে অরিন্দম, হন্যে হয়ে বাসা খোঁজাই সব ম্যাসাকার করে দিল…।

দু’জনের একাকার হাসির ভিতর দিয়ে পানসি কিচেনে ঢুকল। গলায় গুনগুন। সকালের উজ্জ্বল নীলকান্তমণি আকাশখানা যেন জানলা গলে ঘরেই হাজির। দুদ্দাড় বাতাসে দোল খাচ্ছে টবের তরুলতা। দু’টো মানুষের মশকরায় ঝুনঝুন করে যেন বাজল ক’টা বাংলা শব্দ। ফ্রিজ খুলছে পানসি, অরিন্দম হেঁকে জানাল, আমি বার্গার খেয়ে এসেছি ক্যাফে থেকে…।

অরিন্দম বোধহয় তত পজেসিভ নয়, যতটা গুরুত্ব দিতে পানসির এখানে চাকরি ছেড়ে আসা। নিজস্ব খেয়ালের গ্রহণ ওর। আবার এমনও নয়, ভালো থাকার ইচ্ছেরা সব ডেকানের পাথরখণ্ড হয়ে গেছে। ভালো থাকবার প্রয়োজন সে মানে– কিন্তু সেই ভালো-র যে আগাম কোনও পূর্বাভাস নেই কিনা মানুষের, নিস্পৃহতা তাই থেকেই যায়…।

কথাটা ভাবতে সতর্ক হ’ল পানসিও। ভরসা যে একটু দরকার। সামান্য আস্থাবোধ। সম্পর্কের আয়ু রাখতে খুঁটিনাটি ওভারলুক করে চলা, হয়তো তারই নাম সহন। প্রশ্ন, তা কতদূর পর্যন্ত। যেখানে দু’টো মানুষ ধরেই নিয়েছে যে তারা যুযুধান। নেহাত টিকে থাকাটাই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা।

মোবাইলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল এতক্ষণ। কী ভেবে হঠাৎ ছাড় দিল একটা অভ্যাসের। রেখে দিল। হাইটেক সিটির যে কনসার্নে পানসি ইন্টারভিউ দিয়ে এল, দু’দুবার সিটিং দেওয়ার পরেও রেসপন্স মেলেনি এখনও। স্লো-ডাউনের কারণে কিনা কে জানে। রোপনকে জানাবে ভেবেছিল। সন্ধানটা যেহেতু ওর দেওয়া। পানসির ফোন রোমিং করা হয়নি। কল করেছে রোপন,

– কোথায় আছিস? কোটি, না নেকলেস রোডে?

রোপনের কথা মানেই কিছু পিন পেরেক। পানসির বাস কোনও পশ এলাকা না শহরতলি, সেটা জানতেই এই প্রশ্ন। উত্তরটা তেমনই হল, তোমার দমদম পার্ক যদি হয় উনিশ, তো এটা বিশ। উনিশ-বিশ আর কী! জায়গাটা যেখানেই হোক।

– ভালো আছিস তো?

– নো ডাউট। নেহাত কোনও জব নেই, তাই বোর লাগে…। লুফে নিল রোপন, বোর কেন, অরিন্দম কী আউটিং-এ?

– না না। নতুন জায়গা, ভাষার অসুবিধা – একা লাগে। না হলে অরিন্দমই তো আমার সারাদিনে একমাত্র প্রতীক্ষার মানুষ…।

– বাহ্। সারাদিন কেন, সারাজীবন প্রতীক্ষাটা ধরে রাখবি, তবেই না বোধোদয়।

– চালুনি করছে সূচের বিচার।

ওপার থেকে গান ভেসে এল, সহেলি… রূপ দেখালি… যেমন করে মন দেখালি না…। আমি যে তোর… মনের দোসর…।

– রাখছি, রোমিং কাটছে।

– কাটুক না! বরের তো পয়সার অভাব নেই!

– ওটা আমিও বলতে পারি।

– পারিস। কিন্তু রুনাই এখনও আমার ঘরে আসেনি। এলে তখন সব ভাবনাই ওর।

– বাবা হোটেল মালিক বলে?

– তাছাড়া রুনাই আমাকে মনটা আগে দেখিয়েছে।

– আবার সে-ই মন! ফোন কেটেছে পানসি। রোপনের এই রুনাই আস্থা, তাদের সেই আস্থাহীন দিনগুলো সামনে টেনে আনল পানসির। অযত্নের যৌথ-বাস। আগোছালো ঘরদোর আর ধূ ধূ বিছানা। ছেঁড়া হয়নি ক্যালেন্ডারের পাতা। টেবিলেই বাসি হচ্ছে রুটি। দিন শুরু মানে দুটো মানুষের দৌড়। ঘর আছে, তাড়া নেই। মানুষ আছে, প্রত্যাশা নেই। প্রতীক্ষা নেই। ঝুলছে পলকা সুতো। আর এখন কিনা গাইছে মন দেখালি না…।

ফোনটা রোমিং হলে নতুন নম্বর আর নয়। পানসি ভেবে রাখল। রিং হচ্ছে। ধরল না সে। বেজেই যাচ্ছে, ধরে দেখল অরিন্দম।

– খেয়ে নিলে নাকি?

– ভ্যানতাড়া না করে কী বলছ বলো।

– আমি বানজারা হিল্স-এর রেস্টুরেন্ট থেকে বলছি…। দু প্যাকেট বিরিয়ানি নিচ্ছি…।

– গাদা রান্না পচছে ফ্রিজে।

– ভূলছমির ফ্রেঞ্চ বিন্স-এর ঘ্যাঁট আর রোচে না।

– যা ইচ্ছা করো। আমার এখনও চানই হয়নি।

– ইন্টারনেটে বসেছিলে?

উত্তরটা পেয়েই গেল যখন, হাইটেকসিটির ইন্টারভিউর কথাটা চেপে গেল পানসি। বলল, কিছু একটা করতে হবে তো!

– তো তোমার কলকাতার খবর? বন্ধ-টন্ধ বহাল তো? ওদিক নিরুত্তর দেখে কথা গোটাল অরিন্দম, ঠিক আছে, তুমি চান সেরে নাও। আমি একটু…। হাসিটা অর্থবহ বলেই ফোন কেটে দিল পানসি। ওই গরল গিলে গিলেই একদিন মরবে লোকটা…। এসব কথা আর এখন বলা হয় না। বদলে যাওয়া অবস্থা থেকে কথার রদবদল চলে মাত্র। তাই অরিন্দম ফিরে যখন শুধোল, কোনও ফোন এসেছিল? পানসির হ’ল শুধু চকিত পলকপাত। তার নম্বরে যে সেটা আসা সম্ভব নয়, পরে বুঝে বলেছিল, না, মানে, তোমার নাম্বারটাও দেয়া আছে কিনা!

অরিন্দমের এটা নিজেকে স্বচ্ছ প্রমাণের চেষ্টা মাত্র। পানসি জানে, চেষ্টাটা চেষ্টাই। সত্যি হবার নয়।

সম্পর্ক রাখতেই সে মেদিনীপুরে টাকা পাঠায়। বাস্তবত বিপন্ন বিধবা। শিশু আছে। মানবিকতা মানানসম্মত। কিন্তু তাই কী? অরিন্দম নিজে মুখেই বলেছে, নলিনী একসময় ওকে বিস্তর বিচলিত করেছে। সেটা তার দুরবস্থা নাকি অনস্বীকার্য আকর্ষণ, কে বলবে? অরিন্দমের ছ’মাসের বড়ো খুড়তুতো ভাই শঙ্খ। বন্ধুর মতো। বউ নলিনী। সার্ভে পার্কে থাকতে বাইপাসে স্কুটার অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হয় শঙ্খর। অরিন্দমের তখন এমসিএর ফাইনাল। শঙ্খর বাবা বাসা গুটিয়ে নলিনীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেও নলিনী আসত কলকাতায় চাকরির খোঁজে। দেখা হ’ত দু’জনের। ঘনিষ্ঠতা না হলে কী করে ওঠে বিয়ের প্রস্তাব!

– হলে অসুবিধে কী ছিল?

পানসির কথা তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিয়েছে অরিন্দম, কেরিয়ার গড়ার সময় অন্যের বাচ্চাসমেত বিয়ে? পাগল নাকি! দুস্থকে দয়া করার মধ্যে বিয়ে এল কোত্থেকে?

দয়ার পর্ব তো মাসের প্রথমেই ক্যুরিয়ারে চুকে যায়। তবে কেন এ অবদমিত সংযোগ! গোপন বিষাদখিন্নতা! পানসি কখনও খোঁচায় না। যত্ন করে অতীত ভুলতে পারার নামই তো বাঁচা! দেখা যাক না।

যতটা উৎসাহে বিরিয়ানি এনেছিল অরিন্দম, চান সেরে সাজানো টেবিল থেকে খেল মাত্র দু’চামচ। খেয়ে ফেলল পানসি একাই অনেকটা।

– খাচ্ছ না যে!

চেয়ারে ঘাড় পেতেছে – রাতে খাব।

পানসি এবার হাত গুটিয়ে নিল। ওদিকের মনমরা মুখটা ওর খিদে কেড়ে নিয়েছে। হতে পারে নলিনীর খবর নেই। টাকা গেল, সংবাদ আসেনি। হতে পারে নলিনী মেদিনীপুরে নেই। শুধুমাত্র টাকার মাধ্যমে সম্পর্ক রাখা ইচ্ছা নয় হয়তো। এসব জানতে না পারার এক গুমোট কষ্ট আছে। পানসি বুঝলেও প্রশ্নটা অনধিকার চর্চা মনে করে। একসময় অরিন্দমই বলে উঠল, শঙ্খ আমাকে একটা কথা বলেছিল, অ্যাক্সিডেন্ট-এর দিন দুই আগে। পিঠ খাড়া হ’ল অরিন্দমের – দুর্ঘটনা তো বলেকয়ে আসে না, তবু কথাটা মিলে গিয়েছিল।

পানসি আঙ্গুল চাটছে। তার মানে নলিনীর কথাই ভাবছিল এতক্ষণ। শঙ্খ সাইড মাত্র।

অরিন্দম বলল, শঙ্খ বলেছিল, বউরা মাইরি এমন এক মেটিরিয়ালে তৈরি, বিয়ের পিঁড়ি থেকে ভাবতে শুরু করে, ঠিক কতটা গুছিয়ে নিতে পারলে বৈধব্যটা তেমন ফ্যাক্টর হবে না…। পানসির প্রতিক্রিয়া নজর করল অরিন্দম, আমি তখন আনাড়ি ব্যাচেলর। পরে জেনেছিলাম, নলিনী ওকে ইনশিওরেন্স-এর জন্য চাপ দিচ্ছিল।

– শঙ্খ সেটা করতে পেরেছিল?

– সময় পেল কই। ভারাক্রান্ত অরিন্দম। কিন্তু চাপমুক্তির ভাষা পানসির জানা নেই। সে শুধু নতমুখ, নিশ্চুপ রইল। অরিন্দম কী ভেবে হঠাৎই অন্য ভনিতায় বলে উঠল– তো শ্রীমতি পুণ্যশ্রী… কে রেখেছিল তোমার এমন সুন্দর নামটি?

এটা প্রশ্ন নয়, পানসি জানে। অরিন্দমও জানে ভূমিকা মাত্র। সেইভাবেই বলল, রাখল যদি, তো পানসি করে ছেড়ে দিল কেন?

স্থিরদৃষ্টি টান টান তার, বলল, পানসির মতো জলে ভেসে বেড়ালেই চলবে? আস্ত একটা জীবন, আমার সঙ্গে এসব শেয়ার করবে কে?

শেয়ার! একান্ত কিছু বেদনার শেয়ার হয় না অরিন্দম। সেটা তুমিও জান, আমিও জানি। কথাটা ভাবল মাত্র, বলা হ’ল না পানসির। আচমকা ধাঁ করে একটা শব্দ ছিটকে এল, ঢেম্নি! ক্যারেক্টার লেস উওম্যান…।

পানসির কানমাথা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠবার আগেই হাত তুলে আশ্বস্ত করল অরিন্দম, বলল, নলিনী…।

পানসি বলল, আমাকে বা নয় কেন, আফটার অল সেকেন্ড হ্যান্ড তো। বলতে না বলতেই বুঝতে পারল, অরিন্দমের হ্যাঁচকা টানে হুমড়ি খাচ্ছে তার বুকে।

– আরে আ-রে, হাত এঁটো যে…।

অরিন্দম থামা জানে না। জাপটে লেপটে উঠিয়ে নিয়ে গেল বিছানায়।

হালকা অন্ধকার ঢুকছে ঘরে। দু’জনেই পড়ে আছে বিছানায়। ওদিকের রিং বেজেই গেল। এদিকেরটা যখন এল, কেটে দিল পানসি। দুদিকে ফেরানো ছিল মুখ, চিৎ হ’ল অরিন্দম, আমাদের কবে যেন রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল?

– টেনথ মার্চ।

– তখনও বাবা ছিল। ভাগ্যিস মা আগেই…।

– বিয়ে হতো না, তাই তো?

– আপত্তি আসতই। আমি ওনলি সন, পাত্রী ডিভোর্সি। পানসি বলল, বিয়ের দিন তুমি কিন্তু যথেষ্ট ফ্রেশ ছিলে অরিন্দম। তোমার বাবা যে এলেন না, আমার খারাপ লেগেছিল। অরিন্দম কথাটা পাত্তা না দিয়ে বলল, সেদিন আমাদের বিডি ব্লক-এর ফ্ল্যাটখানা নলিনী একাই সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছিল বলো!

– না তো বলিনি। পানসি হাউসকোটের বোতাম আঁটছে। পানসিকে কনেচন্দন পরিয়ে সেদিন নিজেও একটা নীল টিপ পরেছিল চন্দনের বিন্দুবৃত্তে। এলা রঙের কাঞ্জিভরমের সঙ্গে খোঁপায় হলদে গোলাপ, নলিনীকে কিছু কম সুন্দর দেখাচ্ছিল না, পানসি জানে।

অরিন্দম একটা হাই তুলে বলল, ওই দিনটাকে আর সেলিব্রেট করা হ’ল না। উঠে বসে বালিশে ভর দিয়েছে অরিন্দম, বলল, কী করে হবে। যা স্ট্রেস চলছিল – বাবাকে এনে ট্রিটমেন্টের স্কোপ পেলাম না। তোমারও…। উহ্য কথাটার ভিতর দিয়ে মিসক্যারেজের ভ্রূণটা যেন খলবল করে উঠল পানসির চোখে। দিশাহীন সময় বয়েছে ঝড়ের মতো। ধবস্ত পায়ের তলার মাটি যেন যায় যায়। বিড়ম্বিত সময় থেকে দু’জনেই চেয়েছিল দূরে কোথাও সরে যেতে। পানসি দূরমনস্ক। অরিন্দম উঠে আলো জ্বালল। সিগারেট মুখে, ধোঁয়া উড়িয়ে বলল, শ্রীমতি পুণ্যশ্রী! এবার কিন্তু জমিয়ে অ্যানিভার্সারি করছি! রেডি থেকো।

– টেনথ মার্চ। সাই আর্কেড-এর সামনে দু’একটি গাড়ি থামল।

অরিন্দম বললেও, জমিয়ে ব্যবস্থায় নিমন্ত্রিতের সংখ্যা সীমিত রেখেছে। মেরুন ব্রোকেডের পোশাক ঝলমলিয়ে স্কুটি থামাল সবার আগে সিন্ধুকা। অরিন্দমের বস মিস্টার রেড্ডি এলেন নিজস্ব গাড়িতে সবার শেষে। পাশে মিসেস না থাকার জবাব যা-ই বলুন, অ্যাবোডস-এর বাড় বাড়ন্ত পার্লস-এর দোকান ছেড়ে তাঁর আসা হয় না। এসেছে অশ্বিনী। টিকোলো নাক চোখ আর দীর্ঘচুলের চমৎকার মেয়ে তাঁর।

পানসির আজ বড়ো খোঁপা লাল টিপ সোনার বালা, বেনারসিতে ট্রাডিশনাল সাজ।

– চুলে ফুল জড়ালে হতো!

– ভূলছমি? নাকছাবি আর পায়জোড়ও চাই তাহলে! অরিন্দম হেসেই অস্থির।

মূলত নিজেকে আজ নিবেদিত নৈবেদ্যর মতো রাখবে, মনস্থ করেছে পানসি।

কেটারিং-এর দু’জন ছেলে সার্ভ করছে। ভূলছমি আর তার মেয়েও রয়েছে সঙ্গে। ভারি মিষ্টি মেয়ে অশ্বিনী। পানসি নিজে হাতে তার পাত উপচে দিলেও বিনাবাক্যে শুধু হাসে সে মেয়ে।

– কিছুই যে খাচ্ছ না অশ্বিনী।

অরিন্দম গুনগুন করে জানাল, ভোক্যাল প্রবলেম আছে।

বালিকাটি খোঁনা গো…।

পানসিও কানে কানে জানাল, ওই জন্যই বস-এর নজর তোমার দিকে…। হাসি মশকরার উষ্ণতা ছিঁড়ে কার একটা মিসড কল এল। পানসি গা করল না দেখে অরিন্দম মজা পেল। ব্যালকনিতে বসে বিভোর গান ধরেছে সিন্ধুকা। দুদ্দাড় খেয়ালি বাতাসে উড়ছে তার দোপাট্টা। তারা-ছড়ানো আকাশটি যেন কাছেই। অজানা শব্দবন্ধের সুরের আবেদনটি কিন্তু একই ভালোলাগায় জড়িয়ে নিচ্ছে। পানসি ছুটে এসে বসল পাশে। সঙ্গে টেনে আনল অরিন্দমকেও। দুজনেই মুগ্ধ। মুঠিফোন বাজছে। বাজুক। এই মুহূর্তে সে আত্মমগ্ন, আত্মপর। সময় নেই। ইচ্ছা নেই। বেজে যায় ফোন… বেজেই যায়…।

অবশেষে – হ্যালো…

– শুভ ফাল্গুন!

– ঠিক আছে, রাখছি…।

– কেন রে… কী হ’ল?

– ব্যস্ত আছি। ঘরে লোকজন আছে…।

– আমিও তো লোক… উইশ করতে পারি না!

– এত শুভকামনা তোমার কোথায় ছিল…?

– হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাচ্ছিস! এটাই হয়। শেষ হয়েও হইল না শেষ…।

কেটে দিল পানসি। তবু বাজে… আবার… আবার…।

সরে গিয়েছে অরিন্দম। থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকল পানসি। ওর কলিগ বন্ধু জয়েস বলত, বর্তমানের করিডর দিয়ে আমরা দৌড়োচ্ছি, খেয়াল থাকে না অতীতও এক ম্যাগনেট…। খামোকা গায়ে কাঁটা দিল পানসির। সিন্ধুকার গান শেষ হল কী, তাকে জাপটে ধরে অনুরোধ ছাড়াই গেয়ে উঠল পানসি, এসো গো জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি… বিজন ঘরের কোনে…। কিন্তু অন্তরা পৌঁছোবার আগেই দুম করে ছেড়ে দিয়ে হেসে উঠল, বলল, ধুরর্। আজ বিজন ঘর কোথায়! সব তো ফুলফিলড্। ওঠো ওঠো সিন্ধুকা…। খেতে হবে না! বন্ধ দরজার এপারে আপন ছন্দে ফিরল সাই আর্কেড-এর সেকেন্ড ফ্লোর। সবার চলে যাওয়ার পরে শুনশান। বোবা টিভি। রাতপোশাক পরে নিল দু’জনেই চুপচাপ। লিভিং রুমে পানীয় সজ্জার টেবিলটা কাছে টেনে নিয়েছে অরিন্দম। কিন্তু পেগ তৈরির আগেই পানসিকে টেনে নিজের হাঁটুর ওপর বসাল মুখোমুখি। বলল, যদি একবার মেদিনীপুর ঘুরে আসি, তোমার আপত্তি আছে পানসি?

– হঠাৎ? পানসি হাঁ জুড়তে ভুলে গেল।

– ওই আর কী! দেশ বাড়ি – বার্থ প্লেস – যাই একবার…!

– যে মানুষ দূর থেকে আরও দূরে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে আছে, তার হঠাৎ পিছু ফেরা?

– এমনি। কতদিন যাইনি তো!

এই সঙ্গতায় পানসি বাদ কেন! কথাটা মনে এলেও বলল না। বলল, তাই বলে এতই হঠাৎ? বলেই যেন নিজের মনে নিজেকে ধমকাল। মেদিনীপুর মানে যে নলিনী, আর নলিনী মানেই এক গোপন সঙ্গসুখ, এমন সন্দেহ কেন আসে? নিজের আত্মীয়স্বজনদের কাছে যেতেই পারে সে। তবু তো একটা প্রশ্নের সৌজন্যবোধও দেখিয়েছে অরিন্দম, কিন্তু পানসি। তার দিক থেকে তো শুধুই সতর্ক গোপনতা। রোপন যে ওকে গত সপ্তাহে বলল, অফিসের কাজে সেকেন্দ্রাবাদ যেতে পারি। সময় জানালে লুম্বিনি পার্কে আসতে পারবি? অবশ্য তোর মর্জি– জোর কিছু নেই। প্রশ্নটি এড়িয়ে অন্য কথাবার্তা চালিয়েছিল পানসি। কিন্তু প্রস্তাবটি কি তাতে নাকচ হল?

জটিল এ শব্দজব্দের সমাধান মেলে না। জয়েসের কথাটা ম্যাগনেটের মতো টানল যেন। পানসি এখন অন্য কথায় এল, বলল, আজকের অনারে ড্রিংকসটা বাদ দিতে পারতে না অরিন্দম?

– পারতাম। অরিন্দম তাকিয়ে রইল পানসির দিকে– তোমার জন্য পারা উচিত আমার… কিন্তু… কী হবে! তুমি তো আমাকে তোমার পানসিতে স্থান দাওনি পানসি!

এ বড়ো সূচিমুখ সত্য। গায়ে বিঁধলে লঘুকরণও দরকার। পানসি অরিন্দমের নাকের ডগা টিপে দিল। বুকে হাত বোলাল পরম আদরে। বলল, বাহ্ রে! তুমি যে বলো পানসিতেই তোমার ভরাডুবি হ’ল। তা হলে?

– তাহলেও সেটা লিগাল ভরাডুবি– এ ভরাডুবি বাঁচার জন্যই…। বাঁচা! পানসি দীর্ঘশ্বাস চাপল। ঠিকই তো! সেই আবেগের উষ্ণতা ছিল এই একটু আগেও। তাহলে! তাহলে কোথা থেকে জমল এত গুমোট!

পরিপাশ উচ্চকিত করে মধ্যরাত্রির ট্রেন পেরোল। কাঁপা কাঁপা ধাতব শব্দটা কান্নার মতো ভেসে বেড়াল কিছুক্ষণ। অরিন্দমের হাঁটুর ওপর বসে হিম হচ্ছে পানসি। শিথিলতা আসছে। উঠে দাঁড়াবে, চেপে বসিয়ে দিল অরিন্দম। টেবিলের গ্লাস, বোতল, বরফভর্তি আয়োজনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, এসো, দু’জনেই আজ খেয়ে বুঁদ হই। ভুলে যাই সব। স-ব। আমাদের দু’জনেরই সবকিছু ভুলে যাওয়া দরকার। ঠিক কিনা! দু’হাতে পুতুলের মতো সে ঝাঁকাল পানসিকে – ফ্যাসফেঁসে গলার করুণ আর্তি শোনাল তাকে– ‘বড়ো একা লাগে, বড্ড একা লাগে গো…।’

দু’হাতে জাপটে মুখ গুঁজেছে পানসির বুকে, ফোঁপাচ্ছে। তোলপাড় জলতাড়সের দমকে ফুলে ফুলে উঠছে অরিন্দমের কাঁধ পিঠ মাথা। পানসি টের পায়, তার বুকের নাইটির সাদা ফ্রিলে অরিন্দমের চোখের জল জমেছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াহীন পানসির চাহনি সামনের সাদা দেয়ালের দিকে। অদ্ভুত হিম জড়তায় নিস্পৃহ সে।

আসলে, শরীরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো দৃশ্যত একান্ত আপন যে পুরুষটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তার বুকে, বেহাল এক নাবিকের মতো, সে কি সত্যিই পানসির? পানসির জন্য কাঁদছে? তাহলে কেন অতীত ভুলবার জন্য এই অ্যালকোহলিক রাতের প্রয়োজন? যা নিতান্তই অবচেতনে মিলিত হওয়া। এই মিলন। এই ক্ষণবন্ধনের ভবিষ্যৎ পানসি ও অরিন্দম কি জানে! নিজের মধ্যে ঘুরপাক খায় উদ্ভ্রান্ত প্রশ্ন আর যোজন দূরত্ব নিয়ে বসে থাকে অঙ্গাঙ্গী। কাঠের মতো শক্ত হয়ে দু’টো হাত ঝুলে থাকে দুদিকে। কোনও সান্ত্বনা, কোনও আশ্বাস নিয়ে সে হাত অরিন্দমের পিঠ ছোঁয় না – ছুঁতে পারে না। কেন, সম্ভবত সে নিজেও জানে না…।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...