কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েই সোজা বিছানা নিয়েছে কেয়া। আর পেরে উঠছে না। কয়েকদিন যাবৎ একটু বাড়তি খাটনি হয়ে যাচ্ছে তার। ছাত্র-ছাত্রীদের আবদার মেটাতে প্রায় রোজই কলেজের পরে তাদের ঘন্টা-দুয়েক করে এক্সট্রা টাইম দিতে হচ্ছে। সামনেই এক্সাম, তাই না করতে পারেনি কেয়া। বাচ্চাগুলোকে বড্ড ভালোবাসে সে। আর তারাও কেয়াদি বলতে অজ্ঞান। আসলে কেয়ার ব্যবহারটাই এত মিষ্টি। কলিগদের পছন্দের তালিকায় তার নামটা সবার আগে। সাইকোলজির ডিপার্টমেন্টে বেশ ফেমাস।

আজও বাড়ি ফিরতে প্রায় সাতটা হয়ে গেছে। ফেরার পথে খানিক সবজি নিয়ে ফিরেছে। সেগুলো টেবিলের উপরেই রাখা রয়েছে। ফ্রিজে তোলা হয়নি, শুয়ে শুয়ে এসবই সাতপাঁচ ভাবছিল কেয়া। এমন সময় কৌশানীর হাসির শব্দ কানে এল। সঙ্গে খুব চেনা একটা স্বর। বুঝতে একমিনিটও সময় লাগেনি কেয়ার। নিশ্চয়ই সুশোভন। মনে মনে বিরক্তই হয় কেয়া। আজকাল এ বাড়িতে তার যাতায়াত বড্ড বেড়ে গিয়েছে। সময় নেই, অসময় নেই যখন তখন চলে আসে। তাড়াতাড়ি উঠে হাউসকোট-টা চড়িয়ে নেয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই মেয়ে কৌশানীকে প্রশ্ন করে ‘কে রে কৌশী?’

‘শুভ অঙ্কল মা।’ হঠাৎই মেয়ের ‘সুশোভন আঙ্কল’-এর পরিবর্তে ‘শুভ আঙ্কল’ সম্বোধন মনটাকে যেন আরও সংকুচিত করে দেয় কেয়ার। ক’দিন যাবৎ কেয়া নোটিস করছে, কৌশী-র প্রতি একটু বাড়তি-ই স্নেহ দেখাচ্ছে সে। সুশোভন আঙ্কল থেকে শুভ আঙ্কলের অন্তরালে আরও কত কী রহস্য আছে কে জানে। ভেবেই শিউরে ওঠে কেয়া। মনে মনে ভাবতে থাকে অনেক আদর যত্ন আর শিক্ষার সঙ্গে মানুষ করেছে কৌশী আর কুশলকে। সেই কারণেই তো লোকে এত প্রশংসা করে বাচ্চাদের। কিন্তু যতই লালন-পালন ভালো হোক না কেন, বয়স– বয়স মানুষকে ভুল পথে চলতে বাধ্য করে। বিশেষত কৌশী-র বয়সি মেয়েদের। সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে। তার আর কত বোধ তৈরি হবে। মেয়ের মা হওয়াটা যে কতবড়ো দায়িত্বের। না কিছুতেই মেয়েকে বিপথে চালিত হতে দেওয়া যাবে না। ধৈর্য আর বুদ্ধি দিয়ে বিষয়টা ট্যাকল করতে হবে।

ভাবনায় বাধ সাধে সুশোভন। ‘কেমন আছেন বউদি?’ বোধকরি এর আগেও বার কয়েক জিজ্ঞাসা করেছে? ‘কী ভাবছেন?’

চমকে ওঠে কেয়া। খানিক সহজ হওয়ার চেষ্টা করে। ‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ। না না কিছু ভাবছি না তো।’

‘উঁহু, মনে হল।’

‘আরে না না, ওই একটু ক্লান্ত আর কী, জানেনই তো, সবকিছু।’ মনের মধ্যে বিতৃষ্ণা থাকলেও হাসার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে কেয়া। তারপর প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘তা, কী মনে করে?’

‘ওই আরকী, কাছেই একটা কাজ ছিল, তাড়াতাড়ি মিটে গেল, তাই ভাবলাম একটু খবর নিয়ে যাই। নইলে তো বন্ধুর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ফিরে এসে বলবে তার অনুপস্থিতিতে আমি দায় এড়িয়ে গেছি।’

‘তা বটে, আমাদের ভালো থাকা না থাকাটা তো এখন আপনারই হাতে।’ কথাটা একটু আস্তে বললেও সুশোভনের কান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছোয়। কেয়ার কথার কী মানে করে কে জানে, একটু অপ্রতিভ হয়েই সুশোভন বলে, ‘এমন করে বলছেন কেন, এটা তো আমার কর্তব্য।’

‘চা খাবেন নিশ্চয়ই’– উত্তরের অপেক্ষা না করে, মেয়ের দিকে ফিরে বলে, ‘কৌশী দু-কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসো তো।’

এর মিনিট পনেরো পর চা-খাইয়ে সুশোভনকে বিদায় করে বারান্দায় এসে বসে কেয়া। মন খারাপ হলে এখানেই এসে বসে সে। বাগানের গাছগুলো যেন কথা বলে তার সঙ্গে। আজ গাছেরাও যেন তার মন ভালো করতে অসমর্থ্য। খুব ভারাক্রান্ত লাগে কেয়ার। কুশীলব দেশে নেই। ছেলে ব্যাঙ্গালোরে। বাড়িতে মা আর মেয়ে। তার মাঝে এই দুশ্চিন্তা, তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। কখনও ভাবেনি কুশীলবের অনুপস্থিতিতে তাকে এরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।

মাস ছয়েক আগেও সবকিছু ঠিক ছিল। যখন আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞান আর যোগ্যতার জন্য, ছাত্রদের সুবিধার্থে কুশীলবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, সংসারের কথা ভেবে পিছিয়ে গিয়েছিল কুশীলব। এক বছর মানে তিনশো পঁয়ষট্টিটা দিন পরিবারকে ছেড়ে সুদূর আমেরিকায় থাকা সম্ভব নাকি? তাছাড়া ছেলেও পড়াশোনার কারণে বাড়ি থেকে দূরে ব্যাঙ্গালোরে থাকে। সে চলে গেলে বাড়িতে কেয়া আর কৌশী একা, ভাবতেই পারে না কুশীলব। কাছাকাছি তেমন কোনও রিলেটিভও নেই যাদের ভরসায় রেখে যাওয়া যায়। কুশীলবের মা-বাবা কবেই গত হয়েছেন। দুই দাদাও থাকে অ্যাব্রডে। কেয়ার বাপের বাড়িও বেশ ঘন্টা পাঁচেকের পথ। বিপদে-আপদে যে তারা পাশে এসে দাঁড়াবে সে উপায়ও নেই। এসব ভেবেই আরও পিছিয়ে যাচ্ছিল কুশীলব। তখন কেয়াই বুঝিয়ে সুঝিয়ে…।

‘মানছি এটা আমার জন্য খুবই গর্বের বিষয়। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছ, তুমি একা এতগুলো দিন কীভাবে সামলাবে?’ কুশীলবের ভাবনাও অমূলক নয়।

‘কেন আমার উপর বিশ্বাস নেই তোমার?’ স্বামীর কাছ ঘেঁষে আসে কেয়া।

‘বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে না কেয়া, আমি জানি তুমি তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী সবটুকু দিয়ে সামলে নেবে। কিন্তু তবুও…’। ভাবনাগুলো আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে কুশীলবকে।

‘তুমি দেখো আমি সব সামলে নেব। এমন অপারচুনিটি বারবার আসে না কুশীলব। আর তাছাড়া তুমি এমন ভাবে রিঅ্যাক্ট করছ যেন আমি প্রথম গ্রাম থেকে শহরে এসেছি।’ কুশীলবকে চিন্তামুক্ত করার চেষ্টা করে কেয়া।

‘তোমাদের ছেড়ে একটা বছর’। চোখের কোণা চিকচিক করে ওঠে কুশীলবের। আবেগপ্রবণ হয়ে বুকে টেনে নেয় কেয়াকে। দূরে থাকার কথা ভেবে কেয়াও মুহূর্তের জন্য ইমোশনাল হয়ে পড়ে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কুশীলবকে। চোখ জলে ভরে আসে। বেগতিক বুঝে কোনওমতে নিজেকে সামলে নেয় কেয়া। মনে মনে ভাবে… না, স্বামীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তাকে শক্ত হতেই হবে। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কুশীলবের হাত দুটো ধরে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘একটা তো বছর। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তাছাড়া বদলে কী পাচ্ছ সেটাও তো দেখতে হবে। কিছু পেতে হলে কিছু তো ছাড়তেই হয়।’ হাসার চেষ্টা করে কেয়া।

‘কিন্তু…।’

‘আবার কিন্তু কীসের? আর কোনও কিন্তু নেই। তুমি যাচ্ছ, এটা ফাইনাল।’ শেষ পর্যন্ত কেয়ার কাছে হার মানতে হয় কুশীলবকে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজনদের আশ্বাস পায় বটে, তবে খটকা থেকেই যায় তার। আসলে কুশীলব যে ধরনের মানুষ, তাতে তার বিচলিত না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। ভীষণ দায়িত্বশীল। অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের মতো কলেজের পরে কোনওদিন আড্ডাতে বসেনি, পরিবার নিয়ে থাকতেই সে ভালোবাসে। কোথাও যাওয়ার থাকলে দুজনে একসাথে।

নির্ধারিত দিনে আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় কুশীলব। বাড়িতে এখন শুধু কেয়া আর কৌশানী। কুশীলব যাওয়ার পর বাড়িটা বড়ো খালি খালি লাগে কেয়ার। সপ্তাহে তিনদিন সন্ধের দিকে কৌশীর টিউশন থাকে। তখন একাকীত্ব যেন আরও চেপে ধরে কেয়াকে। নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য গান শোনে। পুরোনো দিনের গান। এগুলো বরাবরই কেয়ার খুব পছন্দের। কিন্তু আজকাল আর এসবও শুনতে ইচ্ছে করে না। মনে পড়ে যায় গানের মাঝে কুশীলবের গলা ছেড়ে গান ধরা, ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী…’ মনটা আরও ভারাক্রান্ত হয়ে যায় তার। কৌশী-র বন্ধুবান্ধবরা এলে অবশ্য ঘরটা গমগম করে, বেশ ভালো লাগে কেয়ার। তাদের আবদার মেটাতে মেটাতেই টাইম চলে যায় তখন।

দিনগুলো একরকম কাটছিল। তবে কৌশী বরাবরই একটু বাবা ঘেঁষা। বাবা পাশে থাকলেই যত খুনশুটি, যত আবদার। বাবাই ছিল সবথেকে বড়ো বন্ধু। বাবার অনুপস্থিতিতে কৌশী বেশ একা হয়ে গিয়েছিল। বাবাতে-মেয়েতে মিলে পুরো বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখত। সঙ্গে মাঝেমধ্যেই কৌশীর বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ। ‘দ্যাখো না মা, বাবা যাবে না বলছে… এটা আনেনি… টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে দিয়েছে…’ হাজারো নালিশ। এখন বাড়িতে কৌশীর উপস্থিতি ফিল করতে পারে না কেয়া। এর মাঝে কুশীলবের বন্ধু কখনও একা, আবার কখনও পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজখবর নিয়ে যেত। গল্পগুজব করে খানিকটা সময় কাটিয়ে যেত। কেয়ার বন্ধুরাও আসে মাঝে মাঝে। তবে কুশীলবের বন্ধু সুশোভন আর কেয়ার বন্ধু মীরার যাতায়াত ছিল অনেক বেশি। সুশোভন, কুশীলবের খুব কাছের বন্ধু। ওর সঙ্গে একই ডিপার্টমেন্টে রয়েছে। বিয়ে-থা করেনি। যাকে বলে, ঝাড়া হাত-পা আর কী। খুব সহজেই সকলের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। মন জিতে নিতে পারে। আকর্ষকও বটে। এই ক’দিনেই কৌশীর সঙ্গে বেশ ভাব জমেছিল সুশোভনের। আর মীরা কেয়ার কলিগ হলেও খুব ঘনিষ্ঠ। দুজনের ভাবনাচিন্তায় অদ্ভুত মিল থাকায় তাদের অন্তরঙ্গতা। একে-অপরের সঙ্গে সমস্ত কিছু শেয়ার করে তারা। মীরার বর ডাক্তার। দুই ছেলে অক্ষয় আর অভয়। এই বছরেই অক্ষয় পিসিএস-এর জন্য নির্বাচিত হয়েছে। আর অভয় বিএসসি ফাইনাল ইয়ার।

এর মাঝে ছেলে কুশলও কলকাতায় এসে দিন দশ-বারো কাটিয়ে গেছে। কুশলের আসাতে বাড়িতে বেশ একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। দুই ভাই-বোনের হাসি-ঠাট্টায় সামিল হতে হতো কেয়াকেও। কোনও প্ল্যানিং ছাড়াই তিনজনে হুট করে শপিং করা, খাওয়াদাওয়া করা, ঘোরা, সারাদিন পরে ঘরে ফেরা। সবকিছুর মাঝেও কুশীলবকে খুব মিস করছে কেয়া। এতগুলো বছর একসাথে থাকার একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। কোনওদিন কেউ কাউকে ছেড়ে থাকেনি। এমনকী কুশল, কৌশী হবার সময়তেও কেয়াকে বাপের বাড়িতে পাঠায়নি কুশীলব। সেই নিয়ে কম ঠাট্টা শুনতে হয়নি কুশীলবকে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে। হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে ‘বউকে ভালোবাসা কি অন্যায় নাকি?’ এতদিনের অভ্যাস বদলাতে একটু সময় তো লাগবেই। সপ্তাহে দু’দিন ফোন করে কুশীলব। সারা সপ্তাহ মুখিয়ে থাকে কেয়া ওই দিনটার জন্য। কুশীলবের সঙ্গে কথা বলার মুহূর্তটা নিয়েই বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিত সে।

একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসের মধ্যেই মাথা ঘুরে একদম মাটিতে পড়ে গেল কেয়া। কলেজের ছাত্র আর কলিগদের তৎপরতায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কেয়াকে। উচ্চরক্তচাপ, হার্টের সমস্যার কারণে লম্বাচওড়া প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে একমাস রেস্টে থাকতে বলে ছেড়ে দিলেন চিকিৎসক। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে কৌশীর উপর। একাকী ছোট্ট একটা মেয়ের পক্ষে ঘর সামলে, অসুস্থ মায়ের দেখভাল করে কলেজে পৌঁছোনোটা খুব মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তখন সুশোভন আর মীরাকে পাশে পেয়েছিল কেয়া। বাজার, দোকানপাট সমস্ত কিছুই করে দিত সুশোভন।

সেই সময় কেয়া অসুস্থ থাকায়, বাড়িতে অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন কৌশীকেই করতে হতো। মীরা এলে কেয়ার পাশে দু-দণ্ড বসে গল্পগুজব করত, কিন্তু সুশোভন মায়ের থেকে বেশি মেয়ের সঙ্গেই সময় কাটাতে পছন্দ করত। অথচ আশ্চর্যরকম ভাবে কেয়ার উপস্থিতিতে দুজনের ব্যবহারেই কেমন যেন জড়তা লক্ষ্য করত কেয়া। তারা একাকী থাকলে যতটা উচ্ছল থাকে, কেয়ার উপস্থিতিতে সেটা বদলে যায়, এটা একাধিকবার খেয়াল করেছে কেয়া। আর এক অজানা ভয় ঘিরে ধরেছে তাকে। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে আর ভেবেছে, সুশোভন আর কৌশী? দুজনের মধ্যে বয়সের কত তফাত। কুশীলবের থেকে দু-চার বছরের ছোটো হবে হয়তো সুশোভন। বাবার বয়সি একজন লোক এভাবে একটা কচি মেয়ের সঙ্গে ইনভল্ভড… ছিছি, মনটা বিষিয়ে ওঠে কেয়ার। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় কেয়ার সুস্থতার খবর নিতে এসে, তাকে ভুলে গিয়ে বেহায়ার মতো নীচ থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চ্যাঁচাতে থাকে, ‘কৌশী, বড়ো রাস্তার দিকে যাচ্ছি, যাবে নাকি? চলো একটু ঘুরে এলে মনটা ভালো লাগবে। আর তোমার যদি কিছু নেওয়ার থাকে নিয়ে নিও।’ কৌশীও ‘আসছি’ বলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই চেঞ্জ করে খটখটিয়ে বেরিয়ে যেত।

কৌশী তো না হয় ছোটো, ভালোমন্দ সেভাবে বুঝতে শেখেনি? কিন্তু সুশোভন। ও কী করে এই অন্যায়টা করছে। সরলতার সুযোগ নিয়ে একটা ছোট্ট মেয়েকে… আচ্ছা ওরা ফিজিকালি ইনভল্ভ নয় তো? দৈহিক ক্ষিদে কী ওর এতটাই বেড়ে গেছে যে বয়সের ব্যবধানও তার নজরে পড়ছে না। মনটা ভয়ে শিউরে ওঠে কেয়ার। কথায় কথায় কৌশীর জন্য গিফট আনাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না কেয়া। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কেয়া। ভাগ্য আজ ক্লিকও করে গেছে। চুড়িদারের সেট-এর সঙ্গে ম্যাচিং অ্যাকসেসরি নিয়ে ফিরেছে কৌশী আর সুশোভন। ঘরে ঢুকেই হাসতে হাসতেই প্যাকেটটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেয় কৌশী, ‘এই দ্যাখো মা, আমাকে এগুলো কিনে দিয়ে…’ মেয়েকে কথা শেষ করার সুযোগ দেয় না কেয়া। তার আগেই বলে বসে, ‘ঠিক আছে দেখছি। তার আগে তুই একটা কাজ করতো, উপরে ওষুধটা রয়ে গেছে, নিয়ে আয় তো মা। আর শোন প্রেসক্রিপশনটার সাথে একবার মিলিয়ে নিস। নাহলে কোনটা বলতে কোনটা খেয়ে নেব।’ তারপরেই মুখের চেহারা বদলে যায় কেয়ার। ‘এসবের কিন্তু কোনও দরকার ছিল না। রোজ রোজ এভাবে। ওর কিছু কমতি তো রাখিনি আমি।’, বেশ দৃঢ় শোনায় কেয়াকে।

‘কেন এভাবে বলছেন বউদি, আমি কি ওকে কিছু দিতে পারি না। এটুকু অধিকারও কি আমার নেই? স্নেহ করি বলেই তো…’ বলেই কৌশীর মুখের দিকে তাকায় সুশোভন। সে নজরে স্নেহ নেই, আছে শুধু কামনা। সেই দৃষ্টি চোখ এড়ায় না কেয়ার। আপ্রাণ চেষ্টা করে কেয়া একটু সংযত হবার, কিন্ত যেখানে মেয়ের সম্মানের প্রশ্ন সেখানে তাকে রুখে দাঁড়াতে হবেই।

‘সরি কিছু মনে করবেন না, জানি আপনি আমাদের জন্য অনেক করেছেন। তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। এর বেশি কিছু চাই না। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন, আমি কী বলতে চাইছি। এবার আপনি আসুন।’ মাথা নীচু করে বেরিয়ে যায় সুশোভন।

খানিক হালকা লাগে কেয়ার। কতদিন ভেবেছে কুশীলবকে সবকিছু খুলে বলবে। নাম্বার ডায়াল করেও ফোনটা কেটে দিয়েছে এই ভয়ে যে, সবকিছু শুনলে কুশীলব কিছুতেই আর বিদেশবিভুঁইয়ে পড়ে থাকবে না। সবকিছু উপেক্ষা করে ছুটে আসবে। আর তো ক’টা মাস। সে ঠিক সামলে নেবে। ছেলেকে পর্যন্ত বলেনি এই সমস্যার কথা। ফাইনাল ইয়ার। পড়াশোনার ক্ষতি হোক চায় না কেয়া। মেয়ের কথায় সম্বিৎ ফেরে কেয়ার। ‘মা, ও-মা প্রেসক্রিপশনটা কোথায় রেখেছে সেটাই তো খুঁজে পেলাম না। মেলাব কী করে?’ বলতে বলতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নেয় কৌশী। তারপর খুব সহজ ভাবে প্রশ্ন করে বসে, ‘শুভ আঙ্কল কোথায় গেল?’ মেয়ের মুখে সুশোভনের নাম শুনে যেন মুহূর্তেই জ্বলে উঠল কেয়া।

‘ওনার কী কোনও কাজ নেই যে, দিবারাত্রি এখানে পড়ে থাকবেন। যাও নিজের ঘরে যাও।’ হঠাৎই মায়ের ধমকে চমকে ওঠে কৌশী। মায়ের রাগের কারণ খুঁজে পায় না সে। ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে এগোতে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মায়ের সেই স্নেহমাখা ডাক, ‘শোনো কৌশী। এখন আর তুমি ছোট্টটি নও। বড়ো হয়েছ, কলেজে পড়ছ। নিজের ভালোমন্দগুলো নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। আশপাশের মানুষগুলোকে চিনতে হবে। বুঝতে হবে, তারা কেমন। তারা তোমার থেকে ঠিক কী চাইছে। তারা কী সত্যিই তোমার শুভাকাঙক্ষী, নাকি…’ আর কথা বলতে পারে না কেয়া। মেয়ের মাথায় একবার হাতটা বুলিয়ে দেয়।

মায়ের কথার অর্থ আঁচ করতে পারে কৌশী। লজ্জায় সংকুচিত হতে থাকে সে। ‘ইস্ এতদিন তো সেভাবে ভাবেনি কখনও। তাহলে কি সত্যিই সে নিজের অজান্তে ভুল পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল, নাকি সে শুধু বাবার বন্ধু হিসেবেই বাবার শুন্যস্থানটা পূরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু মায়ের অভিজ্ঞ চোখ, তাহলে কি কাকুর খারাপ কোনও অভিসন্ধি রয়েছে।’ মুখে কোনও কথা বলতে না পারলেও মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে কৌশীর।

‘কী হল, যাও। এভাবে দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’ মায়ের কথায় চমকে ওঠে কৌশী। মায়ের হাতদুটো চেপে ধরে। ‘বিশ্বাস করো মা, আমি জানি না কাকু আমাকে কী নজরে দেখে, কিন্তু আমি কখনও ওনাকে…’ কেঁদে ফেলে কৌশী।

‘আমিও তোমার থেকে ঠিক এটাই আশা করেছিলাম। ঠিক আছে যাও, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেবে এসো। কাল সকালে আবার তোমার কলেজ আছে।’

রাতটা খুব নিশ্চিন্তে কাটে কেয়ার। অনেকদিন পর ভালো করে ঘুমিয়েছে সে। বুকের উপর চেপে বসা পাথরটা সরে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছে সে। সকালে টিফিন সেরে আর এক কাপ চায়ে চুমুক দিতে যাবে, ঠিক তখনই মোবাইলটা বেজে উঠল। মীরা কল করেছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গলা ভেসে আসে মীরার, ‘শোন আজ আড্ডা মারার মুডে আছি, ভাবছি তোর বাড়িতে চলে যাই। তোর কোনও অসুবিধে নেই তো?’

‘অসুবিধের কী আছে, তুই এলে খুব ভালো লাগবে। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। কিন্তু তোর কলেজ?’

‘আরে মাঝে মাঝে তো আমাদেরও ফাঁকি দিতে ইচ্ছে করে নাকি’ বলে হেসে ওঠে মীরা।

বারোটা নাগাদ মীরা এসে হাজির হয়। কেয়ার হাতে হাতে সে-ও খানিক কাজ এগিয়ে দেয়। তারপর খাওয়াদাওয়ার পর হাজারো প্রসঙ্গের মাঝে এসে ঢুকে পড়ে কৌশী।

‘জানিস আজকাল মেয়েটাকে নিয়ে খুব টেনশন হয়। একদম চালাকচতুর নয়। খুব ভয় করে। কতদিন আর নিজের কাছে রাখব বল, একটা সময় তো বিয়ে দিতেই হবে। অন্যের হাতে তুলে দিতেই হবে, কী যে করবে কে জানে।’ চিন্তার ভাঁজ পড়ে কেয়ার কপালে।

‘কী বোকা বোকা কথা বলিস বলতো, কতই বা বয়স ওর। এখনই এই সমস্ত ভাবছিস। তুই বরং এক কাজ কর, তোর অসুবিধা থাকলে ওকে আমাকে দিয়ে দে, আমি আমার অক্ষয়ের বউ করে নিয়ে যাব।’

‘ভেবে বলছিস, এ-মেয়ে কিন্তু কিচ্ছু পারে না। পরে বলিস না যে, আমি বলিনি।’

‘ওসব আমার উপর ছেড়ে দে। তাছাড়া পারার আছেটা কী-রে। আজ অবধি আমি সংসারের ক’টা কাজ করেছি যে ও-কে বলব কাজ করতে। পড়াশোনা করবে, বাড়ির মেয়ের মতো থাকবে ঘুরবে-ফিরবে। ব্যস আর কী চাই। তাছাড়া অমন মেয়ে আমি চাইলেই পাব কোথা থেকে।’ বলেই হো-হো করে হেসে ওঠে দুজনে। কেয়া কিছু বলার আগে মীরা প্রস্তাব রাখে, ‘বরং আগামী রবিবার তুই তোর মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আয়।’

কথা কাটে কেয়া। ‘তার চেয়ে বরং সপরিবারে তোরাই চলে আয়। রাতের খাওয়াটা এখানে সারবি কিন্তু।’

‘শুধু আমরা কেন, যদি বলিস আরও দশ-বারো জনকে ডেকে নেব। শরীর একটু ভালো না হতে হতেই শুরু করে দিয়েছিস না।’

‘ইয়ার্কি ছাড় তো। বাড়িতে তো আমরা ওই মা আর মেয়ে। তোরা এলে ভালো লাগবে।’

‘ঠিক হ্যায় হুজুর। আপকে মনোরঞ্জন কে লিয়ে হাম আ জায়েঙ্গে’ বলেই আবার হো হো করে হেসে ওঠে মীরা। সঙ্গে কেয়াও।

এর মাঝে কুশীলবকে কিছুটা আভাস দিয়ে রাখে কেয়া। দু-বছর পরে হলেও, একমাত্র মেয়ের বিয়ের কথা ভেবেই মনটা ভিজে যায় কুশীলবের। কিন্তু মীরার পরিবারকে সে ভালোমতোই চেনে। এরকম পরিবারে সম্বন্ধ করার জন্য মা-বাবারা মুখিয়ে থাকে, সেখানে বাড়ি বয়ে এমন সম্বন্ধ এসেছে, এড়িয়ে যাওয়াটা বোকামো হবে। তাই আর কেয়ার প্রস্তাবে না করেনি কুশীলব।

আজ সকাল থেকেই মনটা বেশ ফুরফুরে কেয়ার। বাজার দোকান সমস্ত নিজের হাতে করেছে। তারপর থেকে চলছে রান্নার তোড়জোড়। এত আয়োজন দেখে কৌশী তো প্রশ্নই করে বসল, ‘কী ব্যাপার মা। এত তোড়জোড় কীসের? কেউ আসছে নাকি?’

‘এমনিই… অনেকদিন পর আজ শরীরটা ভালো আছে, তাই তোর মীরা আন্টিদের ডেকেছি। ওর ছেলে অক্ষয় এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে, না ডাকলে খুব খারাপ লাগত রে। ও হ্যাঁ তুই-ও বাড়িতে থাকিস।’

‘কিন্তু মা, আমার তো টিউশন আছে।’

‘একটা দিন না গেলে কিছু হবে না। একবার ভেবে দ্যাখ, বাড়িতে লোক বলতে তো তুই আর আমি। ওদের ডাকলাম, এখন তুই যদি চলে যাস, ওদের খারাপ লাগবে না। তুই বরং তোর বন্ধুদের থেকে নোট নিয়ে নিস।’

‘ঠিক আছে মা।’

কথামতো সন্ধেবেলা মীরা, ডাক্তারসাহেব, অক্ষয়, অভয় সকলে এসে পৌঁছেছে কেয়াদের বাড়িতে। রসিক স্বভাবের ডাক্তারসাহেব ঢুকতে না ঢুকতেই বলেন, ‘কী ব্যাপার কেয়া, অসুস্থতার পরে মনে হচ্ছে আরও একটু বেশি সুন্দর লাগছে।’

‘এই বুড়ো বয়সে আমার বন্ধুর দিকে কেন নজর দিচ্ছ শুনি।’

‘কী করব বলো, সারাজীবন তো তোমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতেই দিলে না। এই বুড়ো বয়সে তো একটু ছাড়ো।’ সকলে মিলে হেসে ওঠে।

‘আগে ভিতরে তো আসুন। কথা তো আমারও আপনার সঙ্গে আছে।’

‘কী কথা, কী কথা, সবার সামনে বলা যায় নাকি, অন্য কোথাও যাবে…’

‘ও সত্যি পারেনও আপনি।’ মাকে অনেকদিন পর এভাবে হাসতে দেখে কৌশানীরও ভালো লাগে।

কৌশীও খুব তৎপরতার সঙ্গে সকলকে স্বাগত জানায়। স্ন্যাক্স আর কফি খেতে খেতে অক্ষয়-অভয়ের সঙ্গে বিভিন্ন কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে কৌশী।

কথার ফাঁকেই অক্ষয়কে লক্ষ্য করতে থাকে কেয়া। যেমন দেখতে তেমনি ব্যক্তিত্ব। টল, ডার্ক অ্যান্ড হ্যান্ডসাম যাকে বলে। আজকালকার ছেলেদের থেকে যেন একটু আলাদা। ব্যবহারের মধ্যেও একটা শালীন ব্যাপার রয়েছে তার। খুব মিশুকে, সবসময় মুখে হাসি লেগে রয়েছে। কেয়া যেমনটা চেয়েছিল ঠিক তেমনটাই। কৌশীর সাথে খুব ভালো মানাবে।

ডাক্তারসাহেব আর মীরা তো কৌশীকে ভালোমতো চেনে। আগাগোড়াই শান্ত স্বভাব আর ব্যবহারের কারণে কৌশী তাদের সুনজরে ছিলই। অক্ষয়কে দেখেও কেয়ার মনে হল তারও অমত হবে না। তবে এব্যাপারে কৌশীর কী প্রতিক্রিয়া হয় সেটাই দেখার।

গল্প করতে করতে হঠাৎই চোখ যায় ঘড়ির দিকে। কেয়া তৎপর হয়ে ওঠে। ‘দেখেছ, কথা বলতে বলতে বুঝতেই পারিনি দশটা বেজে গেছে। চলো চলো সবাই টেবিলে চলে এসো। এই যে ডাক্তারসাহেব আপনাকে কি আবার আদরআহ্লাদ করে নিয়ে যেতে হবে নাকি?’

‘সেই সৌভাগ্য কি আর আমার হবে?’

‘চলুন চলুন।’

‘হ্যাঁ, চলো।’

সকলে টেবিলে বসে পড়ে। কেয়া আর মীরা এক এক করে প্লেটে খাবার সার্ভ করতে থাকে। মায়ের কাজে হেল্প করে কৌশীও। খাবার শেষে অক্ষয় তারিফ না করে পারে না। ‘আন্টি, তোমার হাতের খাবার না, জাস্ট লাজবাব। মনে হচ্ছে তোমার হাতে খাওয়ার জন্য বারবার আসতে হবে তোমার কাছে।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার যখন মনে হবে চলে আসবে।’ হাসতে হাসতে জবাব দেয় কেয়া।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব মেটার পর ফিরে যাবার সময় নিজের স্ত্রী-র উদ্দেশ্যে বলেন ডাক্তারসাহেব, ‘কী ম্যাডাম আপনি কি শুধু খেতে জানেন, নাকি খাওয়াতেও জানেন?’ মীরাও একবার বরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, ‘ওসব, আমাদের সারা হয়ে গেছে মশাই। ওরা আমাদের বাড়িতে রবিবার দিনই আসছে বুঝেছ।’

‘চলো তাহলে তো ঠিকই আছে। দুই বন্ধুতে মিলে যখন আগেই সেরে রেখেছ। বেশ বেশ, আসছি রে মা, ভালো থাকিস।’ ডাক্তারসাহেবের কথায় মাথা নাড়ে কৌশী। যাওয়ার সময়তে অক্ষয় একঝলক ভালো করে দেখে নেয় কৌশীকে। তারপর মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে পড়ে।

ল্যান্ডফোনে সচরাচর এখন আর ফোন আসে না। মোবাইল হয়ে গিয়ে ওটা এখন খানিকটা শো-পিসের মতোই। কখনও-সখনও কোম্পানি থেকে ফোন আসে, কখনও আবার ফোনটা সচল রাখার জন্য কুশীলব ফোন করে। ল্যান্ডফোনের ব্যবহার বলতে এই। পরদিন সক্বালবেলাই ফোনটা হঠাৎ করে বেজে ওঠাতে চমকে ওঠে কেয়া। আগের দিনের খাটাখাটনির কারণে তখনও বিছানা ছেড়ে ওঠা হয়নি তার। ফোনের আওয়াজ পেয়ে উঠে পড়ে সে। সিঁড়ি বেয়ে নামার আগেই ফোনটা কেটে যায়। ফোনটা আবার বেজে ওঠে। কেয়া শুনতে পায় কৌশী ফোনটা ধরে বলছে, ‘দ্যাখো কাকু, আমার মা চায় না আমি তোমার সাথে কথা বলি। আর কী এমন প্রয়োজনীয় কথা যে, মোবাইল সুইচ অফ বলে ল্যান্ডে করতে হচ্ছে। মায়ের ধারণাই তাহলে ঠিক।’ রিসিভারটা নামিয়ে রাখে কৌশী। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সবটাই কানে আসে কেয়ার। একটু আশ্বস্ত হয়।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও চারটে দিন। এর মাঝে মীরার সাথে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। অক্ষয়ের নাকি বেশ পছন্দ হয়েছে কৌশীকে। বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তে সে রাজি। আজও সকালে ফোন করেছে সক্বাল সক্বাল ওদের বাড়ি পৌঁছানোর জন্য। সেই মতো যাওয়ার তোড়জোড়ও শুরু করেছে কেয়া।

‘কৌশী আজ তুই ওই গোলাপি সালোয়ার-কামিজটা পরিস। ওটা তোকে খুব ভালো মানায়।’

‘কোনটা মা, গতবছর পুজোয় বাবা যেটা দিয়েছে।’

‘হ্যাঁ, ওটাই। চল চল তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। ওদিকে তোর মীরা আন্টির তিনচারবার ফোন করা হয়ে গেছে।’

তৈরি হয়ে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সোয়া বারোটা বেজে গেছে। পৌঁছে দেখে ডাক্তারসাহেব, অক্ষয় সকলে হাত মিলিয়েছে রান্নার কাজে। কেয়াও হাত লাগানোর জন্য এগিয়ে যায়।

‘আরে তুই বস তো। একটা দিন ওদের করতে দে। আজ ওদের পরীক্ষা। দেখি না কেমন টেস্টি খাবার বানাতে পারে। দেখছিস না বাবা-ছেলে কেমন কোমর বেঁধে নেমেছে।’ কথাগুলো বলতে বলতেই মীরার চোখ চলে যায় কৌশীর উপর। ‘ওমা তোকে কী মিষ্টি লাগছে রে।’ বলেই গালদুটো টিপে দেয় মীরা। তারপর ডাক্তারসাহেবের দিকে ফিরে বলে। ‘আরে ডাক্তারসাহেব একটু এদিকেও দ্যাখো। একে দেখে তোমার রান্না যদি একটু সুস্বাদু হয়।’

লজ্জা পেয়ে যায় কৌশী– ‘ও আন্টি তুমিও না।’

অক্ষয়ের চোখে চোখ পড়ে যায় কৌশীর। সে-ও একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। চোখ নামিয়ে অন্যদের সাথে ব্যস্ত হওয়ার ভান করে সে। এদিক-ওদিককার নানা কথা হওয়ার পর মীরা চা বানাবার জন্য উঠতে গেলে কৌশী বলে, ‘চা আমি বানাচ্ছি আন্টি, তোমরা কথা বলো।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ মা, তাই কর। এরা যে কখন খেতে দেবে তার তো কোনও ঠিক নেই। ততক্ষণ না হয় একটু চা-ই খাই। তাছাড়া তোর আঙ্কল বানালে সে চা মুখে দেওয়া যাবে না।’ ডাক্তারসাহেবের বক্র দৃষ্টি দেখে সকলে হেসে ফেলে।

কৌশী চা বানাবার জন্য এগোতেই অক্ষয় তার দিকে এগিয়ে যায়– ‘চলো আমি তোমাকে হেল্প করছি।’

ততক্ষণে ডাক্তারসাহেবও রান্নার পরিসর ছেড়ে মীরার কাছে এসে বসেছে। দুজনকে একসাথে যেতে দেখে বলেন– ‘দুজনকে দারুণ মানাবে গিন্নি। কী বলো?’

‘সত্যিই মানাবে’ ডাক্তারসাহেবের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে মীরা। তারপর কেয়ার উদ্দেশ্যে বলে, ‘কেয়া, ডাক্তারবাবুর আর আমার দুজনেরই কৌশীকে খুব পছন্দ। আমার মনে হয় অক্ষয়েরও মনে ধরেছে কৌশীকে। নাহলে অন্য সময় বিয়ের কথা বললে হাজারো বাহানা শুরু করে দেয়। কাল কৌশীর কথা বলতে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দ্যাখ আমাকে তো ছেলের বিয়ে দিতেই হবে। এখন তুই যদি বলিস তাহলে কুশীলবদা ফিরলে আশীর্বাদটা সেরে রাখব। দু-বছর পর কৌশীর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলে বিয়ে হবে, ক্ষতি কী। তুই বরং কৌশীর মতামতটা জেনে নে।’

আনন্দে চোখে জল চলে আসে কেয়ার। মীরা যে তার কত বড়ো উপকার করল, সেটা একমাত্র কেয়াই জানে। গলা ভারী হয়ে আসে তার। ‘আমার মেয়ের কপালে যে এত ভালো একটা সম্বন্ধ লেখা রয়েছে, ভাবতেও পারিনি। অক্ষয়ের মতো ছেলে, তোদের মতো শ্বশুর-শাশুড়ি, এত ভালো পরিবার,’ আর কথা বলতে পারে না কেয়া। গলা আরও বুজে আসে তার।

পরিবেশ হালকা করতে ডাক্তারসাহেব বলে বসেন, ‘আরে ভাই আমরাই কী ভেবেছি আমাদের বুদ্ধুটার কপালে…’ বলতে বলতে থেমে যান ডাক্তারসাহেব। কপালে রেখার ভাঁজগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।’ ‘আচ্ছা চা-টা কী দার্জিলিং থেকে আসছে।’ সত্যিই তো কথার মাঝে কেউ খেয়াল করেনি সময়তো অনেকটাই গড়িয়েছে। এতক্ষণে তো বোধহয় চারবার চা বানানো খাওয়া হয়ে যেত। তখন মীরা আর কেয়া কয়েক কদম এগিয়েই আবার পিছিয়ে আসে। সম্ভবত বিয়ের প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছে তাদের। যতদূর তাদের কানে আসে, ‘বাড়ির সবার ইচ্ছে তোমার সাথে আমার বিয়ে হোক।’

‘আঙ্কল, আন্টি তো বুঝলাম। আর তোমার?’ ক্ষীণ স্বর কানে আসে অক্ষয়ের।

‘তোমার কী মনে হয়?’ কৌশীর হাতদুটো ধরে অক্ষয়।

‘জানি না যাও’ বলে মাথা নীচু করে নেয় কৌশী।

আর সেখানে দাঁড়ায় না মীরা আর কেয়া। ধীর পায়ে ড্রয়িংরুমে ফিরে দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর একসাথে হেসে ওঠে।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...