শ্রেয়সীর বিয়ে হয়েছিল একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এগজিকিউটিভ এর সঙ্গে কিন্তু দু’বছরও বিয়েটা টিকল না কারণ তিনি হলেন অতিরিক্ত Workaholic husband৷ স্বামীর কর্মব্যস্ততাই সম্পর্কে ফাটল আনল। অনিক এতটাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত যে শ্রেয়সীকে ১২-১৪ ঘন্টা একাই কাটাতে হতো। বাড়ি ফিরতে অনিকের রাত হয়ে যেত ফলে অনিকের জীবনে উৎসাহ দেখানো বা রোমান্স এর জন্য কোনও সময়ই ছিল না। এর ফলে ওদের যৌন জীবনও প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল। শ্রেয়সী স্বামীর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবার জন্য ছটফট করত, আর ও নিজের চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিল যাতে দুজনেরই অফিসের ব্যস্ততা ওদের বৈবাহিক জীবন কে বিষাক্ত না করে তুলতে পারে। সপ্তাহে ৬টা দিন খুব সামান্যই দুজনের মধ্যে কথা হতো, আর রোববারটা বাড়ির কাজ, অতিথি আপ্যায়ন, কোথাও যাওয়া এই সবেই কেটে যেত বেশিরভাগ। শেষমেশ শ্রেয়সী আর সহ্য করতে না পেরে আইনের দ্বারস্থ হল এবং পরিণাম বিবাহবিচ্ছেদ।

এখানে বলা দরকার যে বিবাহবিচ্ছেদ কিন্তু সমস্যার সমাধান নয়। আজ অধিকাংশ পরিবারেই স্বামীদের কর্মব্যস্ততার Workaholic কারণে স্ত্রীয়েরা মানসিক সমস্যায় ভোগেন, তাঁদের সংসার ভেঙে যায়। যে সব স্বামীরা কাজ ছাড়া কিছু বোঝেন না তাঁরা নিজেদের কাজকেই অগ্রাধিকার দেন, অন্যান্য সব কিছুই, এমনকী পরিবারের প্রয়োজনও তাঁদের কাছে গৌণ। স্বামীদের এই ব্যবহার স্ত্রীকে মানসিক পীড়া দেয়, স্বামীর সঙ্গ পাওয়ার জন্য স্ত্রী আকুলতা বোধ করেন। অনেক সময় এই ধরনের পুরুষদের স্ত্রীয়েরা অবসাদেও ডুবে যান। স্বামীর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে খিটখিটে মেজাজের হয়ে ওঠেন, এমনকী অবৈধ সম্পর্কেও অনেকে জড়িয়ে পড়েন। কথায় কথায় লড়াই ঝগড়া অশান্তি সংসারের ভিতটাকেই নড়বড়ে করে দেয়। সংসারে অশান্তির ভয়ে স্বামীরা আরও বেশি করে কাজটাকে আঁকড়ে ধরেন এবং বাড়িতে সময় দেওয়ার কোনও ইচ্ছেই তখন আর তাঁর থাকে না।

আজ ঘরে ঘরে এই ঘটনার সাক্ষ্মী থাকছেন অনেকেই। তাহলে কী ভাবে বাঁচানো যেতে পারে বিয়ের মতো পবিত্র একটা সম্পর্ক কে?

বর্তমান সময়ে আমরা নিজেদের চাহিদাগুলো পূরণ করতে এতটাই ব্যস্ত যে আমাদের সবকিছু চাওয়া পাওয়া, কিছু করার ইচ্ছে, মনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো সব সেই চাহিদা কে ঘিরেই অবর্তিত হচ্ছে। কাজের প্রতি এতটাই অনুগত হয়ে পড়ি যে সম্পর্কগুলো অবহেলা করতে শুরু করি। কাজ এমন ভাবে মস্তিস্ককে প্রভাবিত করে ফেলে যে স্বামী ভুলে যায় স্ত্রীকেও সঙ্গ এবং সময় দেওয়া দরকার।  ‘ম্যারেড টু ওয়ার্ক’ এর কারণে যে সব দম্পতিদের বৈবাহিক জীবন সমস্যার মুখে পড়ছেন, দিল্লির ফর্টিস হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. স্বাতী কাশ্যপ তাঁদের উদ্দেশ্যে জানাচ্ছেন, ‘আপনার স্বামী যদি ওয়ার্কহোলিক হন তাহলে এটা নিয়ে ওনাকে কথা শোনানো অথবা ঝগড়া করার বদলে ওনার সঙ্গে বসে কথা বলুন। দুজনে একত্রে এমন সমাধান খুঁজুন যা আপনাদের দুজনের জন্যই উপযুক্ত হবে। মুখোমুখি না বসে পাশ ঘেঁষে বসুন এবং ‘আমি ‘ বা ‘তুমি’ শব্দটা ব্যবহার না করে ‘আমরা’ শব্দটা ব্যবহার করুন। কথা বলার সময় স্বামীকে কাজের প্রতি প্রেম নিয়ে দোষারোপ করতে আরম্ভ করবেন না অথবা প্রশ্নবাণে তাঁকে আহত করারও চেষ্টা করবেন না। আপনি বলতে পারেন যে আপনার ওনার সঙ্গ ভালো লাগে এবং ওনার সঙ্গে আরও বেশি সময় আপনি কাটাতে চান।’

পরিস্থিতি জানবার চেষ্টা করুন 

স্বামীর ওয়ার্কহোলিক হওয়ার কারণ জানার চেষ্টা করতে হবে। তাঁর এই অভ্যাস কি স্থায়ী না কি কিছুটা সময়ের জন্য? হতে পারে অফিসে প্রমোশন-এর সময় বেশি কাজ করতে হচ্ছে অথবা কোনও প্রজেক্ট-এর ডেডলাইন রয়েছে বা বস-এর চাপ রয়েছে তাঁর উপরে। অফিসে যাতে বসের কাছে অসম্মানিত না হতে হয় তার জন্য হয়তো আপনার স্বামী কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন এমনটাও হওয়া অসম্ভব নয়। কোনও একমাস বা উৎসবের সময় কি তাঁর কাজের প্রেসার বাড়ে? এসব ক্ষেত্রে এই স্থিতি অস্থায়ীও হতে পারে।

বুঝতে হবে কাজের প্রতি তাঁর একাগ্র প্রেম নাকি বাড়ির পরিবেশ এমন যে তাঁর বাড়ি ফেরার ইচ্ছেই হয় না? এগুলি সবকিছুই স্ত্রীকে নজর রাখতে হবে, প্রয়োজনে স্ত্রীয়ের ঝগড়াটে স্বভাব যদি থাকে সেটাও বদলে ফেলতে হবে। আর যদি সত্যি করেই বাড়ির থেকে অফিসের কাজের প্রতি আপনার স্বামী বেশি যত্নবান হন সেক্ষেত্রে এই অভ্যাস বদলানো কঠিন। আপনাকে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে। আপনার ব্যবহারে পরবর্তন দেখে আপনার স্বামীর মধ্যেও পরবর্তন এসে যেতে পারে।

স্বামীর কাজকে সম্মান করুন

স্বামী যদি একাই পরিবারে কর্মরত হন এবং তাঁর উপরেই পুরো পরিবারের দায়িত্ব থেকে থাকে তাহলে বোঝা উচিত তাঁর কাছে কাজটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনাদের সকলের প্রয়োজন মেটাতে ও আপনাদের ভালো রাখতেই তিনি সারাদিন পরিশ্রম Workaholic করছেন। যদি কোনও রকম আপনি তাঁর কাজে সাহায্য করতে পারেন তাহলে অবশ্যই করুন। সারাদিনে ১-২ বার ফোন করে তাঁর ভালোমন্দের খবরাখবর করুন। এটাতে আপনার স্বামীও বুঝবেন তাঁকে নিয়ে আপনিও ভাবেন চিন্তা করেন।  তাঁর কাজকেও সম্মান করেন এই বিশ্বাস তাঁর হবে। অফিসের কাজের ব্যস্ততার মধ্যে তাঁর উপর বাড়ির কাজ না চাপিয়ে নিজেই সেটা করার চেষ্টা করুন, এটা তাঁকে নিজের কাজে মনোযোগ দিতে সাহায্য করবে। বাড়ির যাবতীয় বিল, দোকান-বাজার নিজে নিজে করার চেষ্টা করুন, ছোটোখাটো বাড়ির সমস্যাও নিজেই সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। বাড়ির পরিবেশ শান্তিময় রাখার চেষ্টা করুন। বাড়িতে শান্তির পরিবেশ বজায় থাকলে তাঁরও বাড়ি ফেরার জন্য মন উন্মুখ হবে। বাড়ির সব কাজ সামলিয়েও যদি হাতে যথেষ্ট সময় থেকে যায় তাহলে সময় কাটাবার জন্য নিজের শখ পূরণ করার উপর জোর দিতে পারেন। আঁকা, নাচ, গান, বাগান করার শখ, পড়াশোনা করা বা গল্পের বই পড়া সোশাল ওয়ার্ক ইত্যাদি যা আপনাকে খুশি রাখবে সেগুলো ট্রাই করতেই পারেন। এতে পরিবারে শান্তিও থাকবে আর আপনিও কনস্ট্রাকটিভ কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারবেন। এর পর যতটা সময় দুজনে দুজনকে দিতে পারবেন সেটুকু সময় আশাকরি একে অপরকে দোষারোপ করে অন্তত কাটবে না।

 

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...