বাড়ির সামনে উঠোন। উঠোনের একপাশে গোলাপ ফুলের বাগান। এছাড়া উঠোনের চারপাশে নিমগাছ, শিউলিগাছ, লেবুগাছ ও পেয়ারাগাছ। বাড়ির ভেতরে একটা পুকুর আছে। পুকুরের চারপাশ গাছ দিয়ে ঘেরা। পুকুরে কুটিদের পাড়ার অনেকে স্নান করতে আসত।
কুটিদের বাড়ির সামনে একটি ঠাকুর মন্দির আছে। বাড়ির সামনের বারান্দায় বসে মেন রাস্তা দেখা যায়। মেন রাস্তায় দিনরাত প্রচুর লোকজনের চলাচল তো লেগে থাকেই এছাড়া প্রচুর ভ্যানগাড়ি, টোটোগাড়ি, প্রাইভেট কারও চলে। মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো ট্রাকে করে বাড়ি তৈরির জন্য বালি, সিমেন্ট, ইট আসে।
কুটিদের বাড়িটা অনেকটা জায়গা নিয়ে কুটিদের পুকুরের কাছে একটি রাস্তা আছে, তার পাশেই প্রাইমারি স্কুল। এই স্কুলে কুটি ও তার ভাইবোনেরা পড়ত। কুটি স্কুলে যাবার আগে তৈরি হয়ে ওদের বাড়ির সামনের বারান্দায় বসে থাকত। যখনই রাস্তায় হেডমাস্টার মশাই ও বন্ধুদের আসতে দেখত, তখন দৌড়ে বইয়ে ব্যাগ নিয়ে বন্ধুদের সাথে স্কুলে যেত। কুটি প্রাইমারি স্কুল থেকে বন্ধুদের সাথে খেলতে খুব ভালোবাসত। তার অনেক বন্ধু ছিল।
কুটিদের পাড়ায় মিলনসংঘ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। সেখানে সে বন্ধুদের সাথে লোকনৃত্য, জিমনাস্টিক, প্যারেড, ব্রতচারী করত। কুটির বাবা ও ভাইবোন সবাই সেখানে যেত। বাবা ছিলেন মিলনসংঘ প্রতিষ্ঠানের মেম্বার। সারাবছর কিছু না কিছু অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। তবে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠানে কবিতা কম্পিটিশন, গান কম্পিটিশন, রচনা প্রতিযোগিতা ও নাচ হতো।
কুটিদের পাড়ার নাম ছিল শ্রীনগর। পাড়ার ছোটোবড়ো সবার মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। কুটির বাবাকে পাড়ার সবাই খুব সম্মান করত, কেন-না উনি একটা হাইস্কুলের টিচার ছিলেন। লেখা পড়ার ব্যাপারে বেশ কড়া ছিলেন। স্কুলে যেমন স্টুডেন্টরা ভয় করত, তেমন বাড়িতেও কুটিরা সকলে বাবাকে ভয় পেত। তবে লেখাপড়ার সময় ছাড়া অন্য সময় বাবা খুব ভালো মানুষ। আর মা ছিলেন সহজ সরল ভালোবাসার মানুষ। সবাইকে রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসতেন।
কুটি বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করত। এর জন্য মা ও বাবার কাছে অনেক সময় বকুনি খেত। শিবানী সিকদার ছিল প্রাইমারি সেকশনের বন্ধু, শিবানী তালুকদার ছিল পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত, আর শিবানী দাস ছিল অষ্টম শ্রেণী থেকে বিএড পর্যন্ত। এছাড়া আরও বন্ধু ছিল সংসার জীবনের ব্যস্ততায় যোগাযোগ কমে গেছে।
কুটি বন্ধুদের এতটাই ভালোবাসত যে, ওদের সবার ছবি অ্যালবামে সাজিয়ে রেখেছিল। শ্বশুরবাড়ির সবাইকে দেখাত আর নিজে মাঝেমধ্যে অ্যালবাম বের করে ছবিগুলো দেখত আর পুরোনো কথা মনে করে খুব হাসত। বিশেষ করে কলেজ থেকে যখন জুওলজি এক্সকারসন-এ ৬৫ জন ছাত্রী মিলে দিঘা গিয়েছিল একসঙ্গে। তার মধ্যে ওরা ছয় প্রিয় বন্ধু একই ঘরে থেকেছিল, সে একটা আলাদা আনন্দ। সাথে অবশ্য দুজন স্যার ও দুজন ম্যাম ছিলেন আর জুওলজি ডিপার্টমেন্টের শুকুদা ও বটানি ডিপার্টমেন্টের অশোকদা ছিলেন। কুটিরা সব বন্ধুরা মিলে যেসব সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ করত, শুকুদা সেগুলো ফরমালিনের মধ্যে রেখে দিতেন।
সন্ধের পর হোটেলে একসাথে ক্লাস ও সবাই মিলে একসাথে খাওয়া তারপর একটা জলসা হতো। জলসায় গান, নাচ, কবিতা পাঠ হতো। বন্ধুদের সাথে সেই আনন্দের কথা কুটি কোনও দিন ভুলতে পারবে না।
কুটি ভালো গান জানত বলে বিয়ে পর লোকসঙ্গীত শেখার জন্য শ্রদ্ধেয় অমর পালের কাছে গিয়েছিল। মাস্টারমশাই যখন কুটিকে গান শেখাতে চাইলেন, তখন কুটির খুব আনন্দ হল আর গান শেখা শুরু হল মাস্টারমশাইয়ে কাছে। সপ্তাহে শনিবার করে ভোর ৬ টার সময় বাড়ি থেকে বেরোতে হতো।
মেট্রো ধরে টালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ থেকে রিকশা করে মাস্টারমশাইয়ে বাড়ি সকাল ৮টার মধ্যে পৌঁছোতে হতো। ফিরতে দুপুর দুটো বেজে যেত। এভাবে মাস্টারমশাইয়ে কাছে গান শেখার পর, আকাশবাণিতে গান গাওয়ার সুযোগ হল। এছাড়া অনেক অনুষ্ঠানও করতে লাগল কুটি। মজার কথা হল, প্রত্যেক শনিবার যখন কুটি ট্রেন ধরতে যায় তখন একটি ছেলে একই ট্রেনে একই কামরায় ওঠে। কিছুদিন দেখাদেখি চলতে চলতে কথা হল, পরিচয় হল, দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বও হল।
কুটির স্বামী খুব কম কথা বলে, কাজের থেকে বাড়ি এসে চা খেয়ে গল্পের বই নিয়ে বসে যায়। প্রযোজন ছাড়া বেশি কথা বলে না। কুটি আবার কথা বলতে ও গল্প করতে খুব ভালোবাসে। ফলে নতুন বন্ধুকে পেয়ে মনে মনে খুব খুশি। কেন না, নতুন বন্ধুও কথা বলতে ভালোবাসে।
মাস্টারমশাই মাঝেমধ্যে বাইরে অনুষ্ঠান করতে গেলে, সপ্তাহের যে-কোনও দিনে বাদ যাওয়া ক্লাসগুলি নিয়ে নিতেন। তখন কুটি বন্ধুকে আগে থেকে জানিয়ে রাখত, যাতে সেই দিনগুলোতেও বন্ধুর সাথে দেখা হয়। এই বন্ধুটি কুটির কাছে বিশেষ একজন হয়ে উঠেছিল। সে গান ভালোবাসত বলে কুটিকে গানের ব্যাপারে খুব উত্সাহ দিত।
কুটির শ্বশুরবাড়ির পাশেই বিশাল মাঠ আছে। সেই মাঠে প্রতিবছর মাঘ মাসে দশদিন ধরে লোকউত্সব হয়। সেখানে ভারতের প্রতিটি রাজ্য থেকে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান করতে শিল্পীরা আসেন। লোকউত্সবের মাঠের তিনদিকে তিনটি মঞ্চ বানানো হয়। পুরুলিয়ার ছৌনৃত্য, অসমের বিহুনাচ ও শেষে যাত্রা হয়। দশদিন কুটিদের খুব আনন্দ হয়। কুটি সবচেয়ে বেশি খুশি থাকত, যেদিন নিজের গানের অনুষ্ঠান থাকত।
দশদিনের মধ্যে পাঁচদিন কুটি গান গাইত। কোনও দিন আধুনিক, কোনও দিন নজরুলগীতি তবে লোকসংগীতটাই বেশি গাইত। লোকউত্সব অনুষ্ঠানে কুটি এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, বন্ধুকে দেখেছিল কিন্তু কথা বলা হয়নি। অবশ্য বন্ধু দূর থেকে হাত দেখিয়ে বাহবা জানিয়েছিল। পরে অবশ্য ফোন করে কুটিকে গানের প্রশংসা করেছিল।
এদিকে কুটির স্বামী কুটির গানের উন্নতির জন্য কলকাতায় একটি ফ্ল্যাট কিনে নিল। কলকাতায় এসে কুটি নামী শিল্পীদের কাছে ও বাউল গানের তালিম নিতে লাগল। আস্তে আস্তে কুটি দূরদর্শনেও গান গাওয়ার সুযোগ পেল। এছাড়া গানের শিক্ষক হিসাবে স্কুলে চাকরিও পেয়ে গেল। কুটি ক্রমশ গানের জগতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
কলকাতায় এসে অবশ্য কুটির সংসারে নতুন অতিথি এল, মানে এক কন্যা-সন্তান হল। গানের জগতে অনেকটা সময় দিতে হয় বলে, মেয়েকে দেখার জন্য একজন লোক রেখেছিল।
এদিকে কুটি অল ইন্ডিয়া মিউজিক কম্পিটিশনে গান করে আধুনিক ও লোক সংগীতে প্রথম হয়েছে। প্রথম স্থানের পুরস্কার আনার জন্য ও গান করার জন্য দিল্লি থেকে চিঠি এসেছে। কুটি খবরটা শুনে আনন্দে ওর স্বামী সুদর্শনকে জড়িয়ে ধরল। সুদর্শন খুশির খবরটা শুনেই, সঙ্গে সঙ্গে দিল্লি যাওয়ার টিকিট করে ফেলল।
দিল্লির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গিয়ে খুব ভালো লাগল আর পুরস্কার হাতে নিয়ে কুটি আপ্লুত হয়ে উঠল। দিল্লিতে কুটির গানের খুব প্রশংসা হল এবং জনমাধ্যমেও তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল।
এইসময় একদিন কুটির স্বামী সুদর্শনের ভাই এসে হাজির, একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে এই অচেনা লোকটিকে কেন সে নিয়ে এসেছে কুটি বুঝতে পারেনি। সুদর্শনের ভাই এখনও সেই ছোট্ট শহর হাবড়াতেই থাকে। কুটি ওর স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে সময় পেলেই দেশের বাড়ি যায়। পুরোনো সেই শহরের অনেক কিছুই বদলে গেছে।
কথায় কথায় জানা যায় এই অচেনা লোকটি হল একটি রাজনৈতিক দলের ছোটোখাটো নেতা। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে কুটিকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সুদর্শনের ভাই বলতে চায়, কুটি যেন তাতে সম্মত হয়। হাজার হোক কুটি ওদের শহরের মেয়েবউ! তাকে পুরসংবর্ধনা দিতে চায় ওই ছোট্ট শহরের মানুষজন। ওরা গাড়িতে করে নিয়ে যাবে আবার গাড়িতে করে পৌঁছে দেবে। কুটি বলল, নিজের শহরে যাবে গাড়ি করে নিয়ে যেতে হবে না। নিজেদের গাড়িতেই চলে যাবে। আর বাড়িতে অনেক দিন যাওয়া হয়নি, এই সুযোগে বাড়িতে দুদিন থেকে আসবে।
কুটিরা ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। লোকউৎসবের বড়ো মাঠেই মঞ্চ তৈরি হয়েছে সংবর্ধনার জন্য। চেয়ারম্যান, এসডিও, কাউন্সিলাররা সব উপস্থিত হয়েছেন। দুজন গানের শিল্পীও ছিলেন বক্তাদের মধ্যে, তাঁরা বললেন কুটির গানের বিষয়ে পৌরপ্রতিনিধিরা ছোট্ট শহরের গৌরব হিসেবে অভিহিত করলেন কুটিকে। তবে কুটি আশ্চর্য হল, মাঠে এত দর্শক সমাগম দেখে। তার এই ছোট্ট শহরের এত লোক ভালোবাসে তাকে! কুটির নাম শুনেই এরা দেখতে এসেছে।
যেই কুটি মঞ্চ থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে কুটিকে ঘিরে একটা বেশ বড়ো ভিড় হয়েছে। কেউ এগিয়ে এসে বলছে, আমি মহামায়া, একসঙ্গে ক্লাবে খেলতাম। কেউ বলছে, আমি জযী, এক ক্লাসে এক সেকশনে পড়তাম, চিনতে পারছিস? কুটি অবাক হয়ে শুনছে, দেখছে আর ভাবছে এরা সবাই ওর বন্ধু ছিল! অনেক অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে এসেছে। তারা এগিয়ে দিচ্ছে কুটির দিকে খাতা, স্বাক্ষর নেবার জন্য।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে কুটির চোখ স্থির হয়ে গেল একজনের দিকে তাকিয়ে কুটি প্রথমে চোখ সরাতে পারল না, দেখল একটি ছেলে কুটির দিকে চেয়ে আছে। চোখে চশমাপরা বলে কুটি প্রথমটায় চিনতে পারেনি। তারপর ছেলেটি এগিয়ে এসে বলল, আমারও একটি স্বাক্ষর চাই। কুটি এবার খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়ে চিনতে পারল পনেরো বছর আগের সেই ছেলেটিকে যার সাথে ট্রেনে আলাপ ও বন্ধুত্ব হয়েছিল। বন্ধু কিছু বলার আগেই কুটি বলল, কেমন আছ? চিনতে পেরেছ আমাকে?
বন্ধু বলল, কেন পারব না? চেহারার পরিবর্তন হলেও মুখ দেখে চেনা যায়। তাছাড়া তোমার গান আমি রোজই শুনি।
কুটি বলল, বন্ধু তুমি আমাকে মনে রাখবে সেকথা আমি ভাবতে পারিনি।
কুটির চারপাশের ভিড় আস্তে আস্তে কমে গেছে। বন্ধু বলল, কেন মনে রাখব না? আমরা কতদিন একসাথে যাতায়াত করেছি একই ট্রেনে। কত গল্প করেছি, কত গান নিয়ে আলোচনা করেছি।
কুটি বলল, তোমার এত সব মনে আছে!
বন্ধু বলল, আমি তো ভেবেছি তুমি ভুলে গেছ।
কুটি তখন বলল, ভুলিনি, সময়ে অভাবে যোগাযোগ রাখতে পারিনি।
ঠিক এই সময়ে পৌরপ্রধান এসে বললেন, কুটি চলো, ভিতরে কাউন্সিলাররা ও কয়েজন গানের শিল্পী তোমার সাথে কথা বলবেন বলে অপেক্ষা করে আছেন।
কুটি বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে কেমন একটা ঘোরের ভিতর ছিল। পৌরপ্রধানের কথা শুনে ঘোর কেটে গেলে বলল, আচ্ছা চলুন। বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে পৌরপ্রধানের সাথে উত্সব কমিটির অফিসের দিকে এগিয়ে গেল কুটি।
দুদিন দেশের বাড়িতে থাকার পর কুটি তার স্বামী সুদর্শন ও মেয়ে প্রিয়াকে নিয়ে নিজের গাড়িতে করে রওনা হল কলকাতার দিকে। কুটির কেবল মনে হতে লাগল বন্ধুর কথা। গাড়ি চলছে। কুটিদের ছোট্ট শহর ছেড়ে গাড়ি অনেকদূর চলে এসেছে। দমদম জংশনের কাছে এসে গাড়িটা আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। কেন না, এখানে বরাবরই জ্যাম হয়। গাড়ি যত এগোতে লাগল ততই বন্ধুর কথা মনে পড়তে লাগল। তার হঠাত্ই খেয়াল হল বন্ধুর কাছ থেকে ওর নতুন ফোন নাম্বারটা নেওয়া হয়নি।
এই কথাটা কুটি যখন সুদর্শনকে বলল, সুদর্শন তখন হেসে বলল, ঠিক আছে আমরা তো দেশের বাড়িতে আবার আসব কোনও অনুষ্ঠানে, তখন নিশ্চই দেখা হয়ে যাবে আর ফোন নাম্বারও পাওয়া যাবে। সুদর্শন কুটিকে আরও বলল, আসল বন্ধু হল যে, বিপদের সময় পাশে থাকে আর সব কাজে উত্সাহ দেয়।
কুটি মনে মনে ভাবল, কিছু বন্ধুত্ব হয়তো এভাবেও থেকে যায়। সুদর্শনের কাঁধে মাথা রেখে সে একটা ভালো লাগার স্মৃতিতে ডুবে রইল।