আমাদের দেশে করোনা থাবা বসিয়েছিল ২০২০ সালের শুরু থেকে। লকডাউন শুরু হয়েছিল ২০২০-র মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে। মাঝে কিছুদিন আনলক পর্ব চললেও, লকডাউন থেকে এখনও পুরোপুরি মুক্তি মেলেনি। আর তাই অন্যান্য অনেক অসুবিধার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে পড়ুয়ারাও রয়েছে মহাসংকটে। ওরা বঞ্চিত হয়ে চলেছে স্বাভাবিক স্কুলজীবন থেকে।

পঠনপাঠন জারি রাখার জন্য এখন নিরুপায় ভাবে মাধ্যম করতে হয়েছে অনলাইন ক্লাস-কে। কিন্তু এই অনলাইন ক্লাস-কে মোটেই অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ, কবে করোনা ভাইরাস থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি ঘটবে, বা আদৌ মুক্তি ঘটবে কিনা কিংবা কবে আবার পড়ুয়ারা স্বাভাবিক স্কুলজীবন ফিরে পাবে তা আমরা কেউই এখন আন্দাজ করতে পারছি না। অতএব, অনলাইন ক্লাস-কে সন্তানের শিক্ষালাভের বর্তমান অনিবার্য মাধ্যম ধরে নিয়ে অভিভাবকদের সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর এর জন্য কী কী পদক্ষেপ নিলে আপনার সন্তানের শিক্ষাজীবন অনেকটাই সুরক্ষিত থাকবে এবং শরীর, মন ভালো থাকবে সেই বিষয়ে রইল কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ।

ক্লাস করার উপযুক্ত পরিবেশ দিন বাচ্চাকে

বাসস্থান বড়ো, ছোটো যাইহোক না কেন, সন্তান যাতে উপযুক্ত নিরিবিলি আবহে অনলাইন ক্লাস করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে মা-বাবাকেই। এর জন্য একটা পুরো ঘর কিংবা অন্তত ঘরের একটা কোণ বরাদ্দ করুন। রাখুন পড়ার জন্য উপযুক্ত চেয়ার-টেবিল। আর যদি আলাদা করে চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা করতে না পারেন, তাহলে খাটের উপর বসে যাতে আরামে বইখাতা রেখে পড়তে পারে, সেই ব্যবস্থা রাখুন। কিনুন একটা ছোট্ট রিডিং টেবিল। মাত্র ৫০০ টাকায় ক্যাশ-অন ডেলিভারিতে এই রিডিং টেবিল কিনতে পারেন অনলাইনে। এই বিশেষ টেবিলে রাখা যাবে ল্যাপটপ। এমনকী, মোবাইল চালিয়ে রাখারও উপযুক্ত জায়গা করা রয়েছে।

বসার জায়গার বন্দোবস্ত করার পর, ব্যবস্থা করুন পড়ুয়ার আরামের। কারণ, দীর্ঘসময় বসে যেহেতু লেখাপড়া করতে হবে, তাই পড়ুয়া যাতে গরমে কষ্ট না পায়, সেই ব্যবস্থা করুন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে লেখাপড়ার ব্যবস্থা না করতে পারলেও, পড়ুয়ার মাথার উপর যেন একটা বৈদু্যতিক পাখা ঘোরে, সেই ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক।

হই-হট্টগোল, যানবাহনের আওয়াজে পড়াশোনায় মনোসংযোগ বিঘ্নিত হতে পারে, তাই যতটা সম্ভব সেই বিষয়ে সতর্ক থাকুন। আর নিজেরাও জোরে জোরে কথা বলবেন না কিংবা স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া করবেন না। কারণ, এই ধরনের চিৎকার চ্যাঁচামেচি যেমন পড়ুয়ার মনে বিরক্তি আনবে, ঠিক তেমনই মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ-এর মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষিকার কানেও সেই চ্যাঁচামেচি পৌঁছে যাবে। এতে আপনাদের এবং সন্তানের সম্মানহানি ঘটতে পারে। অতএব, শান্তি বজায় রাখুন।

মোবাইল, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট-এর উপযুক্ত ব্যবস্থা করুন

যদি ল্যাপটপ না কিনে দিতে পারেন, তাহলে ইনস্টলমেন্ট-এ অন্তত একটা ভালো মোবাইল কিনে দিন। সেইসঙ্গে আনলিমিটেড কিংবা প্রতিদিন অন্তত চার জিবি ডেটা ইন্টারনেট-এর ব্যবস্থা করে দিন। আর যদি ল্যাপটপ ব্যবহার করে, তাহলে হটস্পট কিনে ইন্টারনেট সংযোগ দিন অথবা কেবল-ইন্টারনেট কিংবা ব্রডব্যান্ড কানেকশন-এর ব্যবস্থা রাখুন। আর পড়ুয়াকে মোবাইল, ল্যাপটপ অপারেটিং এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে কীভাবে অনলাইন ক্লাস করবে, সেই বিষয়ে হাতে ধরে শেখান। যদি আপনার নিজের জানা না থাকে এ বিষয়ে তাহলে এক্সপার্ট-এর সাহায্য নিন। মোবাইল শপ কিংবা কম্পিউটার অপারেটরের সাহায্য নিতে পারেন এ ব্যাপারে। প্রয়োজনে স্কুলশিক্ষক এবং আপনার সন্তানের সহপাঠীদের সাহায্যও নিতে পারেন।

পড়ুয়ার শারীরিক এবং মানসিক ভারসাম্যের খেয়াল

একটানা একবছর পড়ুয়ারা হারিয়েছে ওদের স্বাভাবিক জীবনযাপন। স্কুলে যাওয়া নেই, বন্ধুদের সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলা নেই, হইহুল্লোড় নেই, স্কুলে শিষ্টাচার মেনে চলা নেই, খেলাধুলোও নেই। মনে রাখবেন, এই ছন্দপতন পড়ুয়াদের শরীর-মনে মারাত্মক খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। চিকিত্সকদের মতে, শারীরিক পরিশ্রম এবং মানসিক সংযোগের ঘাটতির ফলে যেমন শারীরিক বৃদ্ধি ব্যহত করতে পারে, তেমনই মানসিক বিকাশও বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। এর ফলে স্থলতার সমস্যা, ধৈর‌্য হারানোর সমস্যা, বুদ্ধির ঘাটতির সমস্যা প্রভতি হতে পারে। শুধু তাই নয়, সামাজিক মেলামেশার এই বিরতি, ভবিষ্যতে একাকিত্বের কবলে ফেলতে পারে পড়ুয়াকে। অতএব, সতর্ক থাকুন অভিভাবকরা এবং সমস্যামুক্ত থাকার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।

একটানা বসে লেখাপড়া না করিয়ে মাঝেমধ্যে ঘরের মধ্যে হাঁটাচলা করতে বলুন আপনার সন্তানকে। অনলাইন-এ একটা ক্লাস করার পর যাতে অন্তত পনের মিনিট বিরতি পায় পড়ুয়ারা, তা নিশ্চিত করুন স্কুল টিচার-এর সঙ্গে আলোচনা করে। কারণ, ওই বিরতি আবশ্যক পড়ুয়ার মেন্টাল রিলিফ-এর জন্য, খাওয়া এবং হাঁটাচলার জন্য।

লেখাপড়ার মাঝে সঠিক সময়ে যাতে খাবার খায় পড়ুয়ারা এবং উপযুক্ত পরিমাণে জল পান করে, সেই বিষয়ে সতর্ক থাকুন এবং সঠিক উদ্যোগ নিন।

পড়ার সময়, কিংবা মোবাইল ও ল্যাপটপ-এ চোখ রেখে অনলাইন ক্লাস করার সময় যাতে পর্যাপ্ত আলো পায় পড়ুয়ারা, সেই ব্যবস্থা রাখুন সঠিক ভাবে। কারণ, উপযুক্ত আলো না পেলে চোখে পাওয়ার আসতে পারে কিংবা পাওয়ার থাকলে তা আরও বেড়ে যেতে পারে। প্রতিদিনই যদি পড়ুয়ার মাথা ধরে থাকা কিংবা মাথার যন্ত্রণা হতে থাকে, তাহলে অবশ্যই আই স্পেশালিস্ট-কে দেখাবেন। কারণ, ডক্টর চেক-আপ না করালে, পরে বড়ো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

প্রতিদিন সকাল-বিকেল বাড়ির আশপাশ অঞ্চলে কিংবা মাঠে হাঁটিয়ে নিয়ে আসবেন পড়ুয়াকে। আর তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অবশ্যই বাড়িতে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করাবেন আপনার সন্তানকে।

সময় পেলে সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন এবং ওর সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটান। এতে ওর মানসিক ভারসাম্য স্বাভাবিক থাকবে। সেই সঙ্গে, ওর স্কুল কিংবা পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে দূরভাষে কথা বলতে বলুন। কারণ, বাড়িতে থাকার একঘেয়েছি কাটাতে এটা এখন অন্যতম উপায়।

সন্তানকে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ-এ ব্যস্ত রাখুন। ভালো গান শোনান কিংবা শুনতে বলুন এতে মন ভালো থাকবে।

টিভিতে সারাক্ষণ প্রচারিত হতে থাকা অসুস্থতার খবর কিংবা মৃত্যুর খবর দেখাশোনা থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করুন আপনার সন্তানকে। অর্থাত্, ওদের যেন কখনও নেগেটিভ চিন্তাভাবনা গ্রাস না করে।

লেখাপড়ার সময়ে অবসরে প্রয়োজনে মায়ের সঙ্গে ঘরের কাজেও ব্যস্ত রাখতে পারেন আপনার সন্তানকে। এর ফলে আপনার সন্তান বন্ধুদের সান্নিধ্য না পাওয়ার অভাব কিছুটা ভুলবে এবং একাকিত্ব গ্রাস করবে না।

বাড়িতে যেহেতু বেশিরভাগ সময়টা বসে অনলাইন ক্লাস করতে হচ্ছে ছোটোদের, তাই ওদের ফাস্ট ফুড খাওয়া থেকে বিরত রাখুন এবং খুব ভারী খাবার খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে যেন পড়তে না বসে। এতে স্থূলতা এবং হার্ট-এর সমস্যা দেখা দিতে পারে।

ইন্টারনেট যেহেতু সারা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে, তাই পড়ুয়াদের খুব সাবধানে নজরে রাখা জরুরি। কারণ, ভালো কিছুর পাশাপাশি, খারাপ কিছুর নাগাল পেয়ে বিপথেও যেতে পারে আপনার সন্তান। যেমন ডেডলি গেমস, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদির শিকার হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সতর্ক থাকুন এবং সন্তানকে সতর্কতার সঙ্গে নজরে রেখে, ওদের বিপথে যাওয়ার থেকে রক্ষা করুন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...