দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ক্যানিং থেকে ৪৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত সজনেখালি বনাঞ্চলকে ১৯৬০ সালে অভয়ারণ্য বলে ঘোষণা করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সেই থেকে ভ্রমণ পিপাসুদের মনে ঠাই পেয়েছে সজনেখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য।

সজনেখালি

কথায় বলে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। সেই ভয়াল ভযংকর পরিমণ্ডলে জলবিহারে কাটিয়ে দিলাম গোটা একখানা রাত, কী ভীষণ চমকপ্রদ ভাবে! দারুণ এক অভিজ্ঞতার রসদ হয়ে থাকে লঞ্চে কাটানো রাত। আজ এই জলযানেই রাত্রিবাস। এক অন্য রোমাঞ্চ। বাতাসে হিমেল শিরশিরানি। সামনে টইটম্বুর নিকষ কালো জল আর ওপারে কালচে সবুজ ভযংকর অরণ্য। নিঝুম রহস্য। কেবিনের এক চিলতে শয্যায় উপুড় হয়ে শুয়ে ডায়ারি লিখছি এখন। যখনই সময় পাচ্ছি, ডায়ারির পাতায় লিখে লিখে রাখছি।

আমাদের চার শয্যার কেবিনের আরও দুই বিদেশিনীর একজনের চোখ ট্রাভেল ইন্ডিয়া নামে মোটা বইয়ের পাতায়। অন্য বিদেশিনী মহিলাটি এক পেপারব্যাক বই চোখে চাপা দিয়ে ঘুম দিচ্ছে। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, আমাদের এই জলযাত্রায় সফরসঙ্গীদের মধ্যে বেশ কিছু বিদেশি, অনাবাসী ভারতীয় এবং অবাঙালি রয়েছেন। সবাই ভ্রমণ খুশিতে মাতোয়ারা।

সেই নির্জন লাবণ্যের ডুব আমেজে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম নিয়ে কাটিয়েছি শ্বাপদসঙ্কুল অন্ধকারকে সঙ্গী করে। কেবিনের রেলিং-এ ঠেস দিয়ে হুহু শীত হাওয়ায় শাল জড়িয়ে অনেকটা রাত কাটিয়েছি কাল। ভোর হওয়ার খানিক আগেই এই জলযানের কর্মকর্তারা সবার কেবিনে টোকা দিয়ে জাগিয়ে সজনেখালি স্পট দেখাতে নিয়ে চললেন। ঘড়িতে তখন সবে সাড়ে পাঁচটা।

গুমদি ও পিচখালি নদীর সঙ্গমে নিজস্ব সেই যন্ত্রচালিত ছোটো নৌকায সওয়ার হলাম সবাই। নৌকা ভিড়ল সজনেখালি স্পটে। নদীতে ভাটার টান থাকায় এখন নদীতট কাদায় মাখামাখি। সেই কাদার মধ্যে অসংখ্য গর্ত আর কাদামাটির প্রান্তরে অগুণতি লালরঙের একদাঁড়া কাঁকড়া ফুরফুর করে ঘুরে বেরাচ্ছে খেয়ালখুশিতে।

সুন্দরবন হল মূলত ম্যানগ্রোভ, ঝোপঝাড়, প্লাবিত জলাভমির অরণ্য। ১৯৭৬ সালে ৩৬২.৪০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল শক্তপোক্ত জাল দিয়ে ঘিরে তৈরি হয়েছিল সজনেখালি বন্যপ্রাণ অঞ্চল। ৮৮৫ বর্গকিলোমিটার ছড়িয়ে রয়েছে বাফার জোন। পরিব্যাপ্ত জঙ্গল শেষ হয়েছে জল-সীমানায় এসে। বাদাবনের ক্ষয়াটে রুক্ষ্ম শিকড়গুলো মাটি আঁকড়ে থাকে প্রাণপনে। এখানে লোনামাটির নিশ্ছিদ্র ঠাস বুনোটের মাঝে বাতাস থেকে প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য শিকড় উঠে আসে মাটির ওপর। উদ্ভিদবিদ্যা মতে একে ঠেসমূল বা শ্বাসমূল বলে। সরু ছুরির ফলার মতো উঁচু হয়ে থাকা ঠেসমূলের জন্য খালি পায়ে হাঁটা যায় না মোটেই। তবে ঊর্ধগামী বা নিম্নগামী এই সমস্ত ঠেসমূলের জন্য সুন্দরবনে ভমিক্ষয় রোধ হয়। জলজ লতা ও গাছগুলি জলোচ্ছ্বাসে বা ঘূর্ণিঝড় সামলে সোজা দাঁড়িয়ে থাকে।

সজনেখালি নজরমিনারের একেবারে চূড়ায় সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই আরণ্যক বিভীষিকায় ঘেরা নিবিড় সুন্দরবনের গা ছমছমে হাতছানি। রকমারি পাখির বসতবাড়ি। জলজ বৃহৎ আকৃতির পাখি, হেরন, মাছরাঙা, হাড়গিলা, বক, সারস, কাদাখোঁচা, হট্টিটি, গাংচিল, শকুন, কাঠঠোকরা, জলপায়রা, চিল, হিংস্র বাজপাখি, পেঁচা, মদনটাক, বালিহাঁস, ফিঙে, টিয়া, দুধরাজ, হাট্টিমাটিম, পানকৌড়ি, শামুকখোল, কটনটিল, ক্যাস্পিয়ান টের্ন, ইবিশ, ফ্লাইক্যাচার প্রভৃতি গ্রামবাংলার পাখি ও নির্ধারিত মরসুমে আসা পরিযায়ী পাখির মিলমিশ। এছাড়াও বাঁদর, গন্ধগোকুল, নদীচর কাছিম, ছোটো লেজওলা বাঁদর, ক্ষুদ্রকায় লাল বাঁদর, বাঘ, কুমির, সাগরকাছিম, গোসাপ বা ঘোড়েল, বনবিড়াল, উপকূলীয় হরেক সরীসৃপ রয়েছে সজনেখালি জঙ্গলে।

সজনেখালির বাকি চত্বরটুকু ঘুরে বেড়াই, প্রাতর্ভ্রমণও হয়ে যায় জঙ্গল পরিবহে। সজনেখালি মিউজিয়ামের নীচে সুন্দরবনের হালহদিশ ও মানচিত্র কংক্রিটের রঙিন গাঁথনি দিয়ে বানানো। চিনে নেওয়ার হদিশদর্শানো সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী, বন, ব্যাঘ্রপ্রকল্প আর ভ্রমণের পথ। দোতলার সংগ্রহশালায় সুন্দরবনের বাঘের চরিত্র নিয়ে নানান বিজ্ঞানসম্মত তথ্যাদিতে ভরা ছবি ও বিবরণী।

এছাড়াও এখানকার উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, ফুল, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীদের বিস্তারিত পরিচয়। অসংখ্য কাচের জারে ঔষধিকৃত নানান জলজ প্রাণীর জীবাশ্ম। সংগ্রহশালার নিজস্ব গ্রন্থাগারে রয়েছে সুন্দরবন ও সেখানকার হরেক প্রজাতির উদ্ভিদ, পাখি ও বণ্যপ্রাণী সম্বন্ধীয় কিছু অমূল্য বইপত্তর।

উলটোদিকেই কচ্ছপ পুকুর। এখানে নিষিক্ত প্রক্রিয়ায় কচ্ছপের ডিম চাষ করা হয়। ডিম ফুটে ছানা বেরিয়ে এলে তাদের কলস দ্বীপ বা হ্যালিডে দ্বীপে ছেড়ে আসা হয়। সৌরশক্তির মাধ্যমেই এখানে যাবতীয় বৈদ্যুতিন ব্যবস্থা। পর পর অনেকগুলি সোলার প্লেট ও সৌরশক্তি প্রস্তুতকারক যন্ত্র রয়েছে। বনদফতর-এর বিট অফিসে মধু বিক্রি হচ্ছিল। মউলদের প্রাণ হাতে করে জঙ্গল থেকে সেঁচে আনা সুন্দরবনের স্মারক মধু কিনে নিলাম বাড়ির জন্য।

সজনেখালি চৌহদ্দির মধ্যেই রয়েছে বনবিবির মন্দির। ব্যাঘ্রবাহন বনবিবি মূর্তির পাশে বনবিবির যমজ ভাই ও সেনাপতি শাহজাঙ্গুলি ও বাঘের রাজা দক্ষিণ রায়ের মূর্তি। বনবিবির এক হাতে ধরা একটি বালকমূর্তি ও ডান হাত বরাভয় মুদ্রায় শোভিত। সুন্দরবনের স্থানীয় অদিবাসীদের কাছে বনবিবি, গাজিসাহেব, কালু খাঁ, নারায়ণীমাতা ইত্যাদি লৌকিক বা প্রচলিত পুজো, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে।

কীভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে নানা ভাবে সুন্দরবন যাওয়া যায়। তবে ক্যানিং এবং সোনাখালি বা বাসন্তী থেকে সুন্দরবন যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

কী দেখবেন : সুন্দরবন কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে যে-সমস্ত দ্বীপে যাওয়ার ছাড়পত্র মেলে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সজনেখালি, সুধন্যখালি, পাখিরালয়, পিরখালি, চোরাগাজিখালি, দোবাঁকি, বুড়ি ডাবরি, ঝিঙাখালি, নেতিধোপানি, মরিচঝাঁপি।

কোথায় থাকবেন : সুন্দরবন ভ্রমণের চিরাচরিত প্রথা হল সারাদিন লঞ্চে ঘুরে রাত্রিবাসও লঞ্চে। বর্তমানে রাত্রিবাসের জন্য অনেকগুলি হোটেল, ক্যাম্প, বনবাংলো হয়েছে। প্রতিটি ভাড়ার সঙ্গে সাধারণত সাইটসিযিং, স্পট ভিজিট, পারমিটের খরচ ধরা থাকে।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...