আমরা তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। আমাদের বাংলা বই-এ পাঠ্য ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আরণ্যক উপন্যাসের অংশবিশেষ। আমার এক বন্ধু আমার সঙ্গেই পড়ত, একই ক্লাসে। তার আবার লাইন বাই লাইন মুখস্থ ছিল। আরণ্যক থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই পাতার নম্বর আর পুরো অনুচ্ছেদ মুখস্থ বলে দিত। আমি বুঝতে পারতাম না, ওই দোবরু পান্না বীরবর্দি আর জংলী দেবতা টাঁরবাড়ো-র মধ্যে কি এমন লুকিয়ে ছিল যে এত আগ্রহ! টীকা লেখার সময়ে টের পেতাম যে, এ এক স্বযংসম্পূর্ণ ঐতিহ্য যার বহির্জগতে কোনও সামাজিক মর্যাদা নেই। বিভূতিভূষণের হাত ধরে তা যেন আমাদের হাতে এক আয়না ধরিয়ে দেয়। যত বয়েস বেড়েছে, বুঝেছি কী রহস্য নিহিত ছিল ওই শালবনে।
সবে তখন কোভিডের প্রথম ঢেউ শেষ হয়েছে। নিজের বাড়ি যেন গিলে খাচ্ছে সবাইকে। এক একটা দিন নিয়ে এক একটা একাঙ্ক নাটক হয়ে যাবে। আইসোলেশন আর কোয়ারেন্টিনে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে উঠেছে। মানসিক স্থৈর্য ফেরাতে কোথাও একটা যেতে হবে। হোটেল-রিসর্ট আবার খুলেছে সবেই। কিন্তু ট্রেন চালু হয়নি তখনও। গাড়িটা কাজ দিল। চললাম Jhargram। গাড়িতে করে যাত্রা সেখানে দু-দিন-এক-রাতের জন্য। কলকাতা থেকে একশো সত্তর কিলোমিটার পথ। ভাগ্যক্রমে রাতারাতি বুকিং পাওয়া গিয়েছিল একটি নতুন রিসর্টে, একদম জঙ্গলের গায়ে, শুনেছি রিসর্টের মধ্যে তাঁবু-ও আছে। ঘরের থেকে ভাড়া একটু বেশি।
সক্কাল বেলায় দুটি পরিবার, ছয়জন, বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তা খুবই সুন্দর। শুধু খড়গপুরের কাছের অংশের রাস্তা সত্যিই মালভূমির মতো। তারপর সোজা লোধাশুলি। সেখান থেকে আর ফ্লাইওভারে না উঠে, সেটিকে ডানদিকে রেখে বাঁদিকের গাঁয়ে রাস্তা ধরে দ্বিতীয় মোড় থেকে ব্রিজের নীচ দিয়ে ডানদিকে বাঁক নিলাম। এবার গন্তব্য ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির আগে রিসর্ট।
রাস্তার দু-পাশে শুধু দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। তারপর আস্তে আস্তে যে, টাঁরবাড়ো-র রাজ্যে ঢুকছি মালুম হতে লাগল চারপাশের শালবন দেখে। বিশাল বিশাল শালগাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ফুঁড়ে চলে গিয়েছে রাস্তা। যেন ঘন সবুজ চুলের মধ্যে একফালি কালো সিঁথি। মনে হতে লাগল, সেই গানের লাইন এই পথ যদি না শেষ হয়...!