মহিলাদের রজঃস্রাব এমন এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা প্রতি মাসেই হয়। রজঃস্রাব শুরু হয় সাধারণত বযঃসন্ধিতে পৌঁছালে। তবে অনেক সময় ১০ থেকে ১২ বছর বয়সেও শুরু হয়ে যায় মেন্সট্রুয়াল সাইকেল। আর একবার রজঃস্রাব শুরু হলে তা চলতে থাকে মেনোপজ না হওয়া পর্যন্ত। কেবল গর্ভাবস্থার সময় বন্ধ থাকে এই মাসিক প্রক্রিয়া। কিন্তু অনেক সময় রজঃস্রাব চক্র অনিয়মিত হয়। এর নানারকম কারণ আছে। আর এই বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন ডা. ঐন্দ্রী সান্যাল।

মেন্সট্রুয়াল সাইকেল স্বাভাবিক চলছে কিনা কী ভাবে বোঝা যাবে?

প্রথমত, মহিলাদের জেনে রাখা উচিত যে, পিরিয়ডস-এর ক্ষেত্রে সাধারণ সময়ে ব্যবধান ২১ থেকে ৩১ দিনের মধ্যে থাকে। সুতরাং, এটি প্রতি মাসে মাত্র ২-৪ দিনের হেরফের হতে পারে। যেমন ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে হতে পারে। যতক্ষণ আপনার পিরিয়ডস নিয়মিত হয়, ততক্ষণ উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তাই, ক্যালেন্ডারে পিরিয়ড শুরুর তারিখ লিখে রাখুন। কারণ, পিরিয়ড সঠিক ভাবে না হলে তা স্পষ্ট বোঝা যাবে।

কীভাবে কেউ তাদের মেন্সট্রুয়াল ট্র্যাক করতে পারবে?

আপনার পিরিয়ড সাধারণত কতদিন স্থাযী হয় তার একটি নোট রাখুন। এটি কি স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী না স্বল্পমেয়াদী তা বুঝবার চেষ্টা করুন। সেইসঙ্গে দেখুন রক্ত জমাট বাঁধছে কিনা। অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিনা তাও নজরে রাখুন।

এছাড়া, পিরিয়ডকালীন অতিরিক্ত ব্যথা অনুভব করছেন কিনা তা বুঝবার চেষ্টা করুন। শুধু তাই নয়, পিরিয়ড-এর দিনগুলিতে আপনার মেজাজ বা আচরণের কোনও পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তা খেয়ালও রাখা জরুরি।

যদি এইসব সমস্যা হয়, তাহলে কী করা উচিত?

যে-কোনও সমস্যা অনুভব করলে তা চেপে না রেখে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসককে জানিয়ে প্রযোজনীয় চিকিৎসা করা দরকার। তবে, মেন্সট্রুয়াল সমস্যা যে-সব সাধারণ কারণে হতে পারে তা হল

  • বিষণ্ণতা
  • উচ্চ চাপের চাকরি
  • অ্যালকোহল বা অত্যধিক ধূমপান
  • জীবনযাত্রায় হঠাৎ পরিবর্তন
  • বেশি ফাস্ট ফুড খাওয়া
  • স্ট্রেস বা উদ্বেগ
  • পিসিওডি বা পিসিওএস (পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ কিংবা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম)
  • উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেসার )
  • থাইরয়েড (হাইপো বা হাইপার)
  • ডায়াবেটিস (মধুমেহ) ইত্যাদি।

মেন্সট্রুয়াল সমস্যা হলে কী কী সতর্কতা জরুরি?

কিছু মহিলার ক্ষেত্রে, জন্ম নিরোধক ট্যাবলেট কখনও কখনও মাসিক চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। তবে গাইনোকোলজিস্ট-এর পরামর্শ নিলে সঠিক ভাবে সতর্ক থাকতে পারবেন। যেমন-

  • যদি পিরিয়ড হঠাৎ করে ৯০ দিনেরও বেশি সময়ে জন্য বন্ধ হয়ে যায় গর্ভবতী না হওয়ার সত্ত্বেও
  • নিয়মিত থাকার পরে যদি পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে যায়
  • রক্তক্ষরণ যদি সাতদিনের বেশি হয়
  • রক্তপাত যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় বা প্রতি ঘন্টা বা দুবার একাধিক প্যাড ভিজে যায়
  • যদি পিরিয়ড ২১ দিনেরও কম বা ৩৫ দিনের বেশি সময়ে ব্যবধানে হতে থাকে
  • পিরিয়ডের সময়ে যদি আপনার গুরুতর ব্যথা হয়
  • হঠাৎ জ্বর বা অসুস্থ বোধ করেন।

পিরিয়ডের অস্বাভাবিকতা ভবিষ্যতের গর্ভধারণে সমস্যা তৈরি করতে পারে কি?

পিরিয়ডের অস্বাভাবিকতা ভবিষ্যতের গর্ভধারণের সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। যদি কারও পিরিয়ড অনিয়মিত হয় তবে এটি থাইরয়েড, প্রোল্যাক্টিন বা পিসিওএসের মতো হরমোনজনিত ব্যাধিগুলির লক্ষণ হতে পারে। যদি কেউ পিরিয়ডের সময় গুরুতর ব্যথা অনুভব করে তবে এটি পেলভিক ইনফেকশন বা এন্ডোমেট্রিওসিসের লক্ষণ হতে পারে। সুতরাং, আপনার পিরিয়ড সমস্যাটি মনোযোগ দিয়ে দেখুন এবং ভবিষ্যতের সমস্যাগুলি এড়াতে প্রাথমিক পর‌্যাযে স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করুন।

এই রোগের প্রধান লক্ষণ উপসর্গগুলি কী কী?

মাসিক সমস্যায় বিশেষত নিম্নলিখিত উপসর্গগুলি দেখা যায়

  • ব্যথা
  • খিঁচুনি
  • মাথাব্যথা
  • শরীর ফুলে যাওয়া বা ফেঁপে যাওয়া
  • প্রচন্ড বা খুব কম রক্তপ্রবাহ
  • অনিয়মিয় রক্তপ্রবাহ ইত্যাদি।
  • এর প্রধান কারণগুলো কী কী?
  • মেন্সট্রুয়াল সমস্যার অনেকগুলি বিশেষ কারণ রয়েছে। যেমন
  • পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ (পিসিওডি): ডিম্বাশয়ে সিস্টের উপস্থিতি
  • এন্ডোমেট্রেরিযোসি: জরাযুর বাইরের দেয়ালে এন্ডোমেট্রিয়াল টিসুর উত্পত্তি যেগুলো মাসিক রজঃস্রাবের সময় বেরিয়ে যায়
  • হরমোনের অসাম্য
  • জরাযুতে ফাইব্রয়েস্
  • ইন্ট্রাইউটেরাইন মাধ্যম (আইইউডি)
  • হরমোনের ওষুধ
  • থাইরয়েডের সমস্যা
  • রক্ত জমাটের সমস্যা ইত্যাদি।

মেন্সট্রুয়াল সমস্যার চিকিত্সা করা হয় কীভাবে?

যদি আপনি এর মধ্যে কোনও একটি সমস্যায় ভোগেন, তাহলে স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ, সঠিক চিকিত্সা না করালে ভবিষ্যতে নানান জটিলতা দেখা দিতে পারে। নিম্নলিখিত উপায়ে সনাক্তকরণ করা হয় :

  • মাসিক রজঃস্রাবের বিশদ ইতিহাস
  • শারীরিক পরীক্ষা
  • জরাযুর অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা
  • হরমোন নির্ণয়ে জন্য রক্ত পরীক্ষা
  • প্রস্রাব পরীক্ষা
  • আল্ট্রাসাউন্ড ইমেজিং
  • এন্ডোমেট্রিয়াল বাযোপসি
  • হিস্টেরোস্কপি (জরাযুর অভ্যন্তরীণ অংশের পরীক্ষা) ইত্যাদি।

উপসর্গ দূর করার এবং এর অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করে সেইমতো চিকিত্সার প্রযোজন। নিম্নলিখিত চিকিত্সা পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারেন

  • হরমোনের চিকিত্সা
  • রক্ত জমাট বাধা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এবং অধিক রক্তপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্লাস্মিনোজেন অ্যাক্টিভেটর ইনহিবিটর
  • ব্যথা কমাতে
  • নন-স্টেরযোল
  • অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ওষুধ (এনএসএআইডিএস)
  • রক্তপ্রবাহ বন্ধ করতে হিমোস্ট্যাটিকস্
  • ব্যথা কমাতে গরম জলের ব্যাগ ব্যবহার করুন
  • মাসিকের সময় পেলভিকের ব্যথা কমাতে ব্যায়াম করুন।

স্বাভাবিক মাসিক-চক্র এবং মাসিকের সময় সাধারণত যে-ঘটনাগুলো হয় সেগুলো বোঝাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন, স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞের দ্বারা নিয়মিত চেক-আপ করালে আপনি মাসিকের সমস্যা থেকে সুস্থ হতে পারবেন এবং ভবিষ্যতে সবরকম জটিলতা এড়াতে পারবেন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...