ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে শ্বেতার চোখটা আটকে গেল নাম আর পরিচিত ছবিটা দেখে। ষোলো বছর পর দেখছে। মুখের অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই কিন্তু চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। আর নামটা দেখলেই বোঝা যাবে শ্বেতা চিনতে ভুল করেনি। হ্যাঁ, ওই তো পরিষ্কার লেখা নীলাঞ্জনা সাহা।
কলেজের দিনগুলোয় ফিরে গেল শ্বেতা। অভিন্নহৃদয় দুই বন্ধু অথচ সামাজিক স্থিতি অনুযায়ী সকলের কাছেই বড়ো বেমানান ওদের বন্ধুত্ব। নীলাঞ্জনা ধনী পরিবারের মেয়ে বনেদি ব্যাবসাদার ওদের চোদ্দোপুরুষ। আলিপুরের মতো জায়গায় ওদের বিরাট জমিশুদ্ধ চারতলা অট্টালিকা। সেখানে শ্বেতার বাড়িটা হচ্ছে কসবার ছোট্ট একটা গলিতে। ঘর বলতে মাত্র দুটি যেখানে মা-বাবা এবং আরও দুজন ভাইবোনের সংসার। বাড়ি মেরামতিতে কতদিন হাত পড়েনি শ্বেতা ঠিকমতো মনেও করতে পারে না।
কিন্তু আর্থিক পরিস্থিতি দুই বন্ধুর মধ্যে কখনও দেয়াল হয়ে উঠতে পারেনি। বাধাহীন নদীর স্রোতের মতোই ওরা দুজনে বয়ে গেছে বন্ধুত্বের স্রোতে। শ্যামলা রঙের নীলাঞ্জনার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের কোনও অভাব ছিল না। শ্বেতা এক কথায় সুন্দরী। টানা বড়ো বড়ো চোখ, নিজেকে নিয়ে ওর যত চিন্তা ভাবনা।
শ্বেতা মনে মনে নিজেকে সবসময় নীলাঞ্জনার সঙ্গে তুলনা করত আর নিজেকে ওর আরও হতদরিদ্র মনে হতো। একমাত্র নিজের সৌন্দর্যের প্রতি মনের মধ্যে একটা গর্ব ছিল। শ্বেতা বিশ্বাস করত, সৌন্দর্যের জন্যই ও একদিন ধনীবাড়ির বউ হতে পারবে। শ্বেতা সবসময় নীলাঞ্জনাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করত। ওর মতো ব্যবহার, আদবকায়দা, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছু।
সেদিন নীলাঞ্জনার জন্মদিন ছিল। একটি পাঁচতারা হোটেলে সব বন্ধুদেরই নিমন্ত্রণ করেছিল নীলাঞ্জনা। সেখানেই ঋষির সঙ্গে নীলাঞ্জনা সকলের পরিচয় করাল। ঋষি নীলাঞ্জনার বাবার বন্ধুর ছেলে, যে-কিনা মুম্বই আইআইটি-র ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। ছুটিতে কলকাতায় উপস্থিত ছিল ঋষি। নীলাঞ্জনার বন্ধু হিসেবে জন্মদিনের পার্টি অ্যাটেন্ড করতে এসেছিল। লম্বা-চওড়া সুন্দর চেহারার ঋষিকে দেখলে যে-কোনও পুরুষেরই হিংসা হওয়ার কথা।
সাধারণত যা হয়ে থাকে, এতগুলো মেয়ের একজায়গায় হয়ে হাসাহাসি, চ্যাঁচামেচিতে পুরো হলঘর জমজমাট হয়ে উঠেছিল। একমাত্র শ্বেতা চুপচাপ একটা কোণায় চেয়ারে বসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল। ঋষির শ্বেতার উপর দৃষ্টি পড়তে নীলাঞ্জনাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটি চুপচাপ একা কেন বসে আছে? ওকেও ডাক না!
সঙ্গে সঙ্গে, নীলাঞ্জনা শ্বেতার কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে টেনে তুলে এনে ঋষির সামনে দাঁড় করাল, আমার সব থেকে ভালো আর পুরোনো বান্ধবী শ্বেতা।
এরপর খাবার অর্ডার করা শুরু হল। অর্ধেকের বেশি খাবারের নাম শ্বেতা কোনওদিন শোনেইনি। ঋষি এসে শ্বেতার পাশে চেয়ার টেনে বসল। মেনু কার্ডটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে শ্বেতার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, যেটা, আমি অর্ডার করছি আপনিও সেটাই করবেন।
ঋষির কথা শুনে শ্বেতা একটু আশ্বস্ত হল। শ্বেতার মতো মেয়ের সঙ্গে আলাপ ঋষির জীবনে প্রথম। ওর নিজের মা-বোন কত আলাদা। কথায় কথায় লজ্জা পাওয়া, মুখ রাঙা হয়ে ওঠা, শাড়ির আঁচল নিয়ে খেলা করা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে বসেও কপালে ঘাড়ে, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠা, প্রসাধন ছাড়া নিখুঁত মুখমণ্ডল এ সব কিছুই ঋষির প্রথম দেখা।
রাত হচ্ছে দেখে নীলাঞ্জনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অটোর খোঁজে শ্বেতা হোটেলের বাইরে বেরিয়ে এল। পেছনে ঋষিও এসে দাঁড়াল। একটু ইতস্তত করে ঋষি বলল, চলুন, আমার কাছে গাড়ি আছে, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। এইসময় অটো করে যাওয়াটা খুব একটা সেফ নয়।
শ্বেতার কোনও জবাব না পেয়ে ঋষি বলল, ভয় নেই, আপনার বাড়ির দরজায় নামিয়ে চলে আসব। চায়ের জন্য আপনি বসতে বললেও বসব না।
অগত্যা শ্বেতা রাজি হয়ে গেল। গাড়িতে সারাটা রাস্তা চুপচাপই বসে রইল শ্বেতা। অদ্ভুত একটা শিহরণ অনুভব করতে পারছিল ও। বাড়ির দরজায় শ্বেতাকে নামিয়ে দিয়ে ঋষি চলে গেল। বিছানায় শুয়ে ঘুম এল না। প্রাণ খুলে আগে কেউ কখনও শ্বেতার সঙ্গে কথা বলেনি ঋষির মতো। ঋষির মুখটা আর কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল শ্বেতার। ছোটোবেলা থেকে দেখে আসা স্বপ্নটা যেন এতদিনে সত্যি হতে চলেছে, বারবার এটাই মনে হতে লাগল শ্বেতার।
ধীরে ধীরে শ্বেতা নিজের সাজসজ্জার উপর বেশি নজর দিতে আরম্ভ করল। কলেজ ছাড়া বেশিরভাগ সময়টা পড়াশোনার বাহানা করে নীলাঞ্জনার বাড়িতেই কাটাতে আরম্ভ করল ও। নীলাঞ্জনা বুঝতে পারত ঋষিকে দেখতেই তাদের বাড়িতে শ্বেতার এতটা সময় পড়ে থাকা, যদি একটিবার ঋষি এখানে আসে। ঋষিকে খুব ভালো করেই চিনত নীলাঞ্জনা। ওর স্বভাব নীলাঞ্জনার অজানা ছিল না। শ্বেতার জন্য ও কষ্টবোধ করত!
একদিন থাকতে না পেরে নীলাঞ্জনা শ্বেতাকে স্পষ্টই বলল, শ্বেতা, তুই ঋষির পিছনে ছুটিস না, ও হচ্ছে মায়ামৃগ। সবার সঙ্গেই ও আপনজনের মতো ব্যবহার করে। কিন্তু বাস্তবে ওকে প্লেবয় বলাটাই বোধহয় সঠিক পরিচয় দেওয়া হবে।
কিন্তু শ্বেতার চোখে তখন ঋষি নামের ঘোর, যেটা সরতেই চায় না। নীলাঞ্জনার সাবধানবাণীও শ্বেতার মনে হল ঈর্ষাবশত। এইভাবেই নরমে গরমে ওদের তিনজনের বন্ধুত্ব এগিয়ে চলছিল। দুবছর এভাবেই কাটল অথচ এই দুই বছরে ঋষি একবারও শ্বেতার প্রতি বিশেষ ভালোবাসার কোনও দাবি জানাল না। কিন্তু শ্বেতা মনের মধ্যে নিজেকে উজাড় করে দিল ঋষির কাছে। ঋষি ছাড়া নিজের জীবনের কোনও অর্থই থাকল না শ্বেতার কাছে।
ওদিকে শ্বেতার চুপ করে সব মেনে নেওয়া, কথায় কথায় ঘাবড়ে যাওয়া ঋষিকে যেমন আকর্ষণ করত, তেমনি নীলাঞ্জনার আত্মবিশ্বাস, সহজে কোনও কথা মেনে না নিয়ে তর্ক করার অভ্যাসও সমান ভাবে ঋষিকে প্রভাবিত করত।
শ্বেতার কাছে ঋষি কোনও কমিটমেন্টে না গেলেও, শ্বেতার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, ঋষি একদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ওর কাছে অবশ্যই আসবে। দেখতে দেখতে কলেজ পার করে নীলাঞ্জনা ওর বাবার ব্যাবসায় ঢুকে পড়ল। আর শ্বেতা ঋষির প্রস্তাবের অপেক্ষায় দিন গুনতে আরম্ভ করল।
ফোনে দুজনের সবসময় কথা হতো। এরই মধ্যে ঋষি চাকরিও পেয়ে গেল। কিন্তু চাকরিটা নিয়ে ও খুব একটা খুশি হল না। আরও ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষা ছিল ওর মধ্যে। ঋষি ফোন করলেই প্রতিবারই শ্বেতা ওকে বলত, ওর বিয়ের প্রচুর সম্বন্ধ আসছে। ঋষি বুঝতে পারত না শ্বেতা কেন এইসব কথা ওকে বলে!
একদিন বিরক্ত হয়ে ঋষি শ্বেতার মুখের উপরেই বলে বসল, তুই কীরকম বন্ধু রে? আমি এদিকে ভালো একটা চাকরি খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আর তুই তোর বিয়ে নিয়ে পড়ে আছিস! জানি তুই খুব সুন্দরী, তোর বরের অভাব হবে না। কে তোকে আটকাচ্ছে, কর না বিয়ে বলে ফোনটা কেটে দিল ঋষি।
শ্বেতার মনে হল, ঋষি নিজেকে অসুরক্ষিত ভাবছে এই ভেবে যে, শ্বেতার বিয়ে অন্য কোথাও না হয়ে যায়। খুশি হল শ্বেতা, যাক এবার তাহলে ঋষি দৌড়ে ওর কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাবটা দেবে।
একদিন হঠাৎ নীলাঞ্জনার ফোন এল ওর কাছে, আর্জেন্ট তলব। বাগানে ফুলের পরিচর্যা করছিল নীলাঞ্জনা, শ্বেতাকে দেখেই দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। শ্বেতা লক্ষ্য করল নীলাঞ্জনার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। শ্বেতাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে বলল, শ্বেতা, কাল আমার আশীর্বাদ। তুই এসেছিস খুব ভালো হয়েছে। জিজ্ঞেস করলি না তো কার সঙ্গে?
শ্বেতার মুখ-চোখ মুহূর্তে কালো হয়ে গেল, কোনওমতে বলল, কেন ইয়ার্কি মারছিস। ঋষি তো বিয়ে নিয়ে এখুনি কিছু ভাবতে চায় না। ও নিজের মুখে আমাকে বলেছে।
শ্বেতার কথা শুনে নীলাঞ্জনা হেসে ফেলল। শ্বেতার চিবুকটা হাত দিয়ে তুলে ধরে বলল, তুই বড্ড সরল রে শ্বেতা। ঋষি ওর নিজের ব্যাবসা আরম্ভ করেছে। আমার বাবারও তাতে পঞ্চাশ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। বিজনেস প্ল্যানটা আমিই ঠিক করে দিয়েছি। এটা বাবারই মাথায় প্রথম আসে, যখন আমাকে আর ঋষিকে একসঙ্গেই কাজ করতে হবে তখন একসঙ্গে জীবন কাটাতেই বা আপত্তি কোথায়।
শ্বেতা নিজেকে আর আটকাতে পারে না, চেঁচিয়ে ওঠে। বলে, তাহলে বল, তোরা টাকা দিয়ে ঋষিকে কিনে নিয়েছিস।
শ্বেতার কথাগুলো নীলাঞ্জাকে দুঃখ দিলেও নিজেকে ও সামলে নিয়ে সংযত স্বরে বলে, শ্বেতা, এটা ঋষির সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত। আমার বাবা ওকে কোনও জোর দেননি। এমনিই টাকা দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু ঋষির কাছে সৌন্দর্যের থেকে নিজের কেরিয়ারের উন্নতি করাটা অনেক বেশি গুরুত্বের। তুই নিঃসন্দেহে সুন্দরী কিন্তু জীবনে এগোতে গেলে ক্ষমতা এবং স্মার্টনেসের দরকার যেটা সম্ভবত ঋষি আমার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে।
এটা হতে পারে না নীলাঞ্জনা। ঋষি আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারে না! আর আমি, তোর থেকে সব বিষয়ে অনেক ভালো।
নীলাঞ্জনা শ্বেতাকে ভালো করে লক্ষ্য করে। ওর মুখে ফুটে ওঠা হতাশা দেখে বলে, সব ঠিক হয়ে গেছে শ্বেতা। সৌন্দর্য সবার ফাস্ট প্রেফারেন্স না-ও হতে পারে। কিছু মানুষ আছে যারা সৌন্দর্যের থেকেও বুদ্ধি, আত্মবিশ্বাস এগুলিকে বেশি প্রাধান্য দেয়। আমার জন্যই ঋষি এই প্রোজেক্টটা শুরু করতে পেরেছে।
নীলাঞ্জনার কথাগুলো সহ্য করতে পারে না শ্বেতা। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায় ও। বলে, নীলাঞ্জনা, তোর বাবা ধনী বলে তোর খুব অহংকার, তাই না? আর এই টাকার জোরেই তুই ঋষিকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিলি। কিন্তু তুইও আমার একটা কথা শুনে নে, আমার এই সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ, বৈভব-কেও একদিন আমার দাস হতে হবে এবং এটা আমি তোকে করে দেখাব এই আমার প্রতিজ্ঞা তোর কাছে।
নীলাঞ্জনার ঠোঁটে হাসি খেলে গেল, বলল, শ্বেতা তোর এই চিন্তাভাবনা অত্যন্ত অন্যায়। তবুও সেই দিনটার প্রতীক্ষা আমিও করব যেদিন তোর প্রতিজ্ঞা রেখে আবার তুই আমার সামনে এসে দাঁড়াবি।
সেই দিনের পর শ্বেতা, নীলাঞ্জনা এবং ঋষির অধ্যায়কে নিজের জীবন থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলল। কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞা ও ভুলল না। জীবনে একটাই লক্ষ্যকে ও স্থির করে নিল, যেমন করেই হোক ওকে ধনী হতে হবে। তার জন্য মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা সব সম্বন্ধ ও নাকচ করতে শুরু করল। যেটা শ্বেতার পছন্দ হতো সেখানে টাকার চাহিদা দেখে শ্বেতার মা-বাবা পিছিয়ে আসতেন। শ্বেতার মর্জিমাফিক ব্যবহারে ওর পরিবারের সকলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগল।
এই করতে করতে শ্বেতার বয়স তিরিশে পড়ল। হঠাৎ-ই কোনও এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে শ্বেতা, রাজেশ্বরী দেবীর চোখে পড়ে গেল। উনি নিজের ছেলের দ্বিতীয়বার বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ে খুঁজছিলেন। একমাত্র ছেলে বিকাশের প্রথম স্ত্রী, দুটি সন্তান রেখে মারা যায়। শ্বেতাকে দেখেই রাজেশ্বরী দেবীর পছন্দ হয়ে যায়। বনেদি ধনী পরিবার। অর্থের অভাব নেই, প্রযোজন শুধু একজন মায়ের যে ওই বাচ্চাদুটিকে সন্তানতুল্য মানুষ করতে পারবে।
শ্বেতার মা-বাবার কাছে অবশ্য রাজেশ্বরী দেবীর প্রস্তাব একেবারেই মনঃপূত হল না। নিজের সন্তানকে দোজবরে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তাঁদের একেবারেই ছিল না। তার উপর পাত্রের বয়স প্রায় ৪০ ছুঁইছুঁই, যতই তারা ধনী হোক না কেন! তাছাড়া দুটি সন্তানের বাবা। কিন্তু শ্বেতাই আগ্রহ দেখিয়ে এই সম্বন্ধ স্বীকার করতে মা-বাবাকে বাধ্য করাল। বহুদিন পর এমন একটা সম্বন্ধ শ্বেতার মনের মতো হল। কারণ পাত্র কিংবা তার সন্তানের প্রতি শ্বেতার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। ওর একমাত্র নজর ছিল বিকাশের অর্থ, বৈভবের প্রতি এবং ওর সামাজিক পদমর্যাদার প্রতি।
বিয়ের পর দশটা বছর কেটে গেছে। যে টাকার জন্য শ্বেতা বিয়ে করেছিল, সেই অর্থের কোনও অভাব ছিল না ওর। বিকাশের সন্তানরা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করত। বিকাশকে শ্বেতা নিজের ইচ্ছেমতো পরিচালনা করত। শ্বেতার কথায় বিকাশ উঠত-বসত। তবুও শ্বেতার মনের মধ্যে একটা পুরোনো ব্যথা মাঝেমধ্যেই ওকে বিষণ্ণ করে তুলত।
বিকাশ সবসময় শ্বেতাকে হাতের চেটোয় রাখার চেষ্টা করত, তবুও ওদের সম্পর্কটা স্বামী-স্ত্রীর মতো নয় বরং ভৃত্য এবং মালিকের মতো ছিল। শ্বেতার মতো অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রী পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করত বিকাশ। স্ত্রীয়ের সৌন্দর্যের পূজারি হয়ে উঠেছিল ও, স্বামী হওয়ার কখনও চেষ্টা করেনি। বিকাশের সন্তানদের সঙ্গে শ্বেতা সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখত। ওর নিজের কোনও সন্তান হয়নি এবং এই নিয়ে ওর মনে কোনও দুঃখও ছিল না। সন্তান না হওয়াতে পনেরো বছর আগেকার ছিপছিপে ধনুকের মতো শরীর শ্বেতার বজায় ছিল। আয়নায় যখনই নিজেকে দেখত শ্বেতা, একটা অহংকার বোধ জেগে উঠত ওর মনের ভিতরে।
আজ অনেকদিন পর নীলাঞ্জনার পরিচিত মুখটা ফেসবুকে দেখতে পেয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি ওর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। সেটা ঈর্ষা না আনন্দ বুঝতে পারল না। নীলাঞ্জনা যেন দেখতে আগের থেকে আরও সাধারণ হয়ে গেছে কিন্তু ঋষি এখনও তেমনই হ্যান্ডসাম। হঠাৎ করেই আবার সেই পুরোনো অধ্যায় শ্বেতাকে নিয়ে চলল অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোয়।
নিয়তি হয়তো একেই বলে। নয়তো নীলাঞ্জনা আর ঋষি কীভাবে আবার শ্বেতার জীবনে ফিরে এল। ঋষির ব্যাবসা সংক্রান্ত একটি জরুরি ফাইল বার করার ছিল যা কিনা একমাত্র বিকাশের সাহায্যেই করা সম্ভব ছিল।
অফিসে বিকাশ যখন জানতে পারল নীলাঞ্জনা এবং ঋষি ওর স্ত্রীয়ের কলেজের সময়কার বন্ধু, ও ঋষিদের নিজের বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানাল। শ্বেতা এতে মনে মনে খুশি হলেও বাইরে কিছুই প্রকাশ করল না। নিজের ঐশ্বর্য ওদের দেখাবার এমন সুযোগ কেই বা হাতছাড়া করতে চায়! তাছাড়া ঋষিকেও তো বোঝাতে হবে, শ্বেতাকে বিয়ে না করে ও কী হারিয়েছে আর কাচের টুকরোকে হিরে ভেবে তুলে নিয়ে গেছে। নিজের যোগ্যতা এবং আত্মবিশ্বাসের উপর নীলাঞ্জনার অহংকারের সাক্ষী শ্বেতা নিজে। সুতরাং নীলাঞ্জনাকেও বোঝাতে হবে, জীবনের দাঁড়িপাল্লায় আজ শ্বেতার বৈভব, সৌন্দর্যের ওজন নীলাঞ্জনার তুলনায় অনেক বেশি।
সময়ের আগেই নীলাঞ্জনা আর ঋষি বিকাশদের বাড়ি পৌঁছে গেল। একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে ওরা দুজন পুরোনো স্মৃতিতে মাঝেমধ্যে তলিয়ে যেতে থাকলেও, শ্বেতার ব্যবহারে এটাই বারবার প্রকাশ পাচ্ছিল যে, পুরোনো কথা আর কিছুই ওর মনে নেই।
কথার মাঝেই নীলাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই শ্বেতা বলে উঠল, তুই কি চেহারা করেছিস! আগের থেকে কত মোটা হয়ে গেছিস। জিম-টিমে যাস না? নিজের ছিপছিপে শরীর প্রদর্শন করতে শ্বেতা শাড়ির আঁচল সারা শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে আবার সেটা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল, উদ্দেশ্য একটাই কোনও ভাবে ঋষির দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হল শ্বেতার। ঋষির চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল নীলাঞ্জনার প্রতি ওর ভালোবাসা এবং সম্মান।
নীলাঞ্জনা শ্বেতার কথায় মৃদু হেসে উত্তর দিল, শ্বেতা মা হওয়ার পর মেয়েদের ওজন এমনিতে বেড়েই যায়। তোর যখন নিজের সন্তান হবে তখন বুঝতে পারবি।
শ্বেতার মনে হল একটা থাপ্পড় মেরে কেউ ওর মুখ বন্ধ করে দিল। ওর মুখের গোলাপি আভা নীলাঞ্জনার কথায় ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করল। বিকাশের সঙ্গে ঋষি আর নীলাঞ্জনাও নিজেদের সন্তানের সম্পর্কে আলোচনায় মশগুল হয়ে গেল।
এই প্রথম শ্বেতা অনুভব করল, ও বিকাশের সন্তানদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। বিকাশকে বিয়ে করেছে ঠিকই কিন্তু ওর সন্তানদের মা হয়ে উঠতে পারেনি।
খাওয়ার টেবিলে সকলে এসে বসলে শ্বেতা মনে মনে বলল, আমার রান্নার স্বাদকে ওরা উপেক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু এখানেও ও নিরাশ হল! রান্নায় এত তেল-ঝাল মশলার ব্যবহার দেখে নীলাঞ্জনা বলেই ফেলল, এত তেল-মশলা ব্যবহার কেন করিস শ্বেতা? বিকাশদার বয়স হচ্ছে তাছাড়া আমাদের সকলেরই এখন উচিত কম তেলের খাবার খাওয়া। সম্ভবত বিকাশের শরীরে মেদের প্রাচুর্য দেখেই নীলাঞ্জনার ওই উক্তি।
শ্বেতা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, ওর রূপ, ঐশ্বর্য কেন ঋষি আর নীলাঞ্জনাকে প্রভাবিত করতে পারছে না। ওর প্রতি ওদের দৃষ্টিই নেই। ঋষি আর নীলাঞ্জনার সম্পর্কের রসায়ন যে-কোনও দম্পতির মনেই ঈর্ষার জন্ম দিতে পারে, বিশেষ করে শ্বেতার মতো মহিলার মনে তো বটেই যেখানে শ্বেতার বিয়ে কেবল অর্থের জন্য হয়েছে। এছাড়া বিকাশের প্রতি শ্বেতার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
খাওয়া শেষ হলে ঋষি আর বিকাশ কাজ নিয়ে কথাবার্তা বলতে বাগানে গিয়ে বসল। শ্বেতা নীলাঞ্জনাকে নিজের বিশাল ড্রয়িংরুমে বসিয়ে কফি আনতে ভিতরে চলে গেল।
কফিতে চুমুক দিতে দিতে নীলাঞ্জনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। শ্বেতার মনে হল এবার বোধহয় নীলাঞ্জনা ওর আতিথেয়তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে। হঠাৎই বেশ জোরেই হেসে উঠল নীলাঞ্জনা। বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, শ্বেতা, এখনও কি তুই তোর প্রতিজ্ঞার কথা মনে রেখে দিয়েছিস? মনে হচ্ছে তুই-ই জিতে গেছিস।
শ্বেতা উত্তর দিল না। কিন্তু ও বুঝে গিয়েছিল ও নিজের প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেনি। নীলাঞ্জনাদের কাছে ও হেরে গেছে। ওর সৌন্দর্য, বৈভব কিছুই ঋষি আর নীলাঞ্জনাকে প্রভাবিত করতে পারেনি।
নীলাঞ্জনাকে টেক্কা দিতেই ও বিকাশকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু আজ শ্বেতা বুঝতে পারছে, নীলাঞ্জনাকে টেক্কা দেওয়া ওর পক্ষে কোনওদিনই সম্ভবপর হবে না। কারণ একজন স্ত্রীয়ের সাফল্য তার সৌন্দর্যে নয় বরং তার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক আর দৃঢ়তার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেটা শ্বেতার বৈবাহিক জীবনে কোনও মান্যতা পায়নি।
কফি শেষ করে নীলাঞ্জনা, বিকাশ আর ঋষি যেখানে বসে, সেদিকে পা বাড়াল। শ্বেতার মনে হতে লাগল ওর অর্থহীন প্রতিজ্ঞা আজ ওকে এমন একটা মোড়ে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যেখান থেকে হয়তো সঠিক ঠিকানার দিশা ও কোনও দিনই খুঁজে পাবে না।