সঞ্চারীর একটাই অভিযোগ স্বামীর বিরুদ্ধে, ‘অভিজিৎ  বাড়িতে একটা কাজও করে না। আমিও ওর মতো অফিস করি কিন্তু বাড়ির প্রতিটা কাজ আমাকেই করতে হয়। যাওয়ার আগে কিংবা অফিস থেকে ফিরে, অভিজিৎ-কে কখনও এক কাপ চা বানিয়েও নিয়ে আসতে দেখলাম না।’

অভিজৎ বহুবার এই অভিযোগ শুনেছে। একদিন সঞ্চারীকে সারপ্রাইজ দেওয়ার ইচ্ছায় অভিজৎ সকাল সকাল উঠে ‘বেড টি’ বানিয়ে বউ-কে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। সঞ্চারী অবাক! অভিজিতের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিতেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল ওর, ‘কে তোমাকে চা করতে বলেছিল? একগাদা পাতা ঢেলেছ। চিনি আর দুধ এত কম দিলে চলে? জঘন্য, মুখে দেওয়া যাচ্ছে না। সেই আমাকেই আবার বানাতে হবে, একটা কাজ দু’বার করে করা।’

অভিজিতেরও রাগ হয়ে গেল, ‘তোমার কাজ করে দিলেও দোষ, আবার না করলেও দোষ। আমার কোনও কাজ ভালো হয়েছে এটা তোমার মুখ থেকে কখনও শুনলাম না’, বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল অভিজৎ।

এই দৃশ্য প্রতি ঘরেই উঁকি মারলে দেখা যাবে। ভারতীয় দাম্পত্যে এমন ঘটনায় কেউ অবাক বা বিচলিত হয় না। অনেক সময় স্বামী-রা চেষ্টা করেন, রান্না করতে না পারলেও রান্নার জন্য রাখা সবজিগুলো কেটে দিয়ে স্ত্রী-কে যতটা পারা যায় সাহায্য করতে কিন্তু সেখানেও কারও কারও কপালে জোটে স্ত্রীয়ের বিরক্তি। ‘ঠিক করে সবজি কাটতে পারো না যখন, তখন কাজ দেখাতে যাও কেন।’ হয়তো ফুলকপির পিসগুলো বেশি ছোটো কাটা হয়ে গেছে আর আলুগুলো রয়ে গেছে বড়ো।

আবার একটু অন্য দৃশ্যও চোখে পড়ে। রাহুল আর শালিনীর তিনমাস হল বিয়ে হয়েছে। ভোপাল ছেড়ে দুজনে ফ্ল্যাট নিয়ে দিল্লিতে থাকে চাকরির খাতিরে। কাজ থেকে ফিরেই রাহুল বসে পড়ে ল্যাপটপ নিয়ে, নিজের সোশ্যাল অ্যাকাউন্টের মেল চেক করে সব উত্তর দেওয়ার জন্য। এটা নাকি ওর মুড-কে ফ্রেশ রাখে। শালিনী এসে হাত-মুখ ধুয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে যায়। চা-জলখাবার দিয়ে রাতের খাবার বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাহুলের পছন্দ জেনে নিয়ে মেনু ডিসাইড করে।

সেদিন ল্যাপটপে চোখ রেখেই রাহুল উত্তর দিল, ‘নিজের পছন্দের কিছু একটা বানিয়ে নাও।’

মটরপনির চলবে কিনা জেনে নিয়ে শালিনী রান্নাঘরে এসে জোগাড়ে মন দিল। ফ্রিজ খুলে দই-টা বাসি হয়ে যাচ্ছে দেখে মটরপনিরের বদলে দই দিয়ে পঞ্জাবি কারি আর ভাত রান্না করল। রাত্রে খেতে বসে মটরপনিরের জায়গায় কারি দেখে রাহুলের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। রাগ দেখিয়ে বলল, ‘যদি নিজের ইচ্ছেতেই রান্না করবে বলে ঠিক করেছিলে তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করার কী দরকার ছিল?’

রাহুলের ব্যবহারে শালিনীরও রাগ হয়ে গেল। উত্তর ওর জিভের ডগায় চলে এল, ‘বলতে কী চাও তুমি? রোজ তোমাকে জিজ্ঞেস করেই প্রতিটা রান্না করি। একটা দিন আমি নিজের মতো করেছি বলে এত রাগ হয়ে গেল তোমার।’ কাঁদতে কাঁদতে খাবার ছেড়ে শালিনী অন্য ঘরে চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে বাড়ির পুরো পরিবেশটাই বদলে গেল।

এই ঘটনাতেও কোনও নতুনত্ব নেই। হামেশাই চারপাশে ঘটছে। যেসব মহিলারা চাকরি করেন না তারা সন্ধেবেলা স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় অধীর হয়ে থাকেন, সারাদিনের সবকথা শেয়ার করবেন বলে। আবার স্বামীর পছন্দের খাবার বানানোটাও স্ত্রীয়ের কাছে ভালো টাইমপাস। সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও বেশিরভাগ মহিলাই ভেবে চিন্তে একটা সীমিত আর্থিক গন্ডির মধ্যে সংসারের খরচ বেঁধে রাখাটা নিজের দায়িত্ব মনে করে।

তাই তাদের চেষ্টা থাকে, যে-খাবারটার খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেটা আগে রান্না করে ফেলা। সেখানে স্বামীর পছন্দ-কে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের বিচার-বিবেচনা দ্বারা প্রভাবিত হয় তারা। আবার কর্মরতারা চিন্তা করে সময় নষ্ট না করে, পুরো দায়িত্বটাই স্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। স্বামীর উত্তর যদি স্ত্রীয়ের মনের ইচ্ছার সঙ্গে ম্যাচ করে যায় তাহলে তো ঠিক আছে, কিন্তু যদি উত্তর সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া না যায় তাহলে স্ত্রী অপেক্ষা না করেই নিজের মনের মতো খাবার বানিয়ে নেয়।

মজার বিষয় হল, যদি বাড়ির গৃহিণীটি বুঝতে না পারে কী খাবার বানাবে, তাহলে সেই দোষটাও এসে পড়ে বেচারি স্বামীর উপর। স্ত্রীর মুখঝামটা তৈরি থাকে, ‘এই সামান্য কাজটাও তোমার দ্বারা হয় না। কী রান্না হবে সেটাও আমাকেই দেখতে হবে!’

উপায়ের সন্ধানে

এর কী উপায়? তাহলে কি স্বামীর কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা করাটা স্ত্রীয়ের অন্যায়? নাকি কোনও প্রতিকার না করেই স্বামীকে স্ত্রীয়ের সব অনুযোগ স্বীকার করে নিতে বাধ্য থাকতে হবে? এই দুটোর কোনওটাই সুখী দাম্পত্যের সহায়ক নয়। তাহলে এর প্রতিকার কী?

স্ত্রীর কর্তব্য

–          স্ত্রীর যদি মনে হয়, স্বামী তাকে সাহায্য করুক, তাহলে সব থেকে আগে দেখতে হবে সত্যি সত্যি স্বামীর কাছে স্ত্রীকে সাহায্য করার মতন সময় আছে কিনা

–          স্বামীকে ডমিনেট করে সাহায্য চাওয়ার থেকে তাকে রিকোয়েস্ট করাটা বাঞ্ছনীয়

–          প্রথম থেকেই স্পষ্ট করুন কী ধরনের সাহায্য পেতে আগ্রহী আপনি, অন্যথা পরে আশানুরূপ ফলাফল না হলে ঝগড়া, অশান্তি হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হবে

–          স্বামী অফিস থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে কাজের ফর্দ ধরে বসে যাবেন না। স্বামীকে রিল্যাক্স হওয়ার সময় দিন তারপরেই নিজের বক্তব্য পেশ করুন

–          পছন্দমতো কাজ হলে স্বামীর প্রশাংসা করুন বিশেষ করে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সামনে তো বটেই

–          সাংসারিক কাজে যদি স্বামীর আগ্রহ না থাকে, তাহলে বাচ্চাদের পড়াশোনাটা দেখে দিলেও আপনার অনেক সাহায্য হবে

–          আপনার মনের মতো কাজ না হলেও জিভে আগল রাখুন। কারণ, রাগ করলে কোনও লাভ হবে না বরং হতে পারে স্বামী দ্বিতীয়বার আর আপনাকে সাহায্য করার কথা ভাববে না।

স্বামীর কর্তব্য

 

–          সব স্ত্রীরাই চান তাদের স্বামী তাদের কষ্টটা বুঝুক। তাই যখনই সুযোগ পাবেন স্ত্রীকে সাহায্য করুন। স্ত্রী চাকরি করুক কি না করুক, সকলেই স্বামীর কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা রাখে। স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যবহার করুন, ডমিনেট করার ভুল করবেন না

–          অত্যন্ত ব্যস্ত কর্মজীবন হলেও চেষ্টা করুন ছুটির দিনগুলোতে অন্তত স্ত্রীকে কিছুটা সাহায্য করার, যাতে স্ত্রী-ও কিছুটা স্বস্তি পায়

 

–          স্ত্রীর যে-কোনও কাজে সাহায্য করার আগে প্রথমে কাজটা সম্পর্কে পুরোপুরি জেনে নিন যাতে স্ত্রীর মনে না হয় যে কাজটা তার মনের মতো হল না

–          স্ত্রীকে যতই সাহায্য করুন, স্ত্রীয়ের বান্ধবীদের সামনে বলুন, ‘আমি আর কী করতে পারি, ওই বেচারাকেই সবকিছু করতে হয়। ইচ্ছে থাকলেও আমি ওকে কোনও সাহায্যই করতে পারি না।’ এরপর দেখুন স্ত্রীয়ের চোখে আপনার গুরুত্ব কতখানি বেড়ে গেছে

–          বাসন ধোয়া হয়ে গেলে সেটা গুছিয়ে রাখাটাও একটা বড়ো সাহায্য শুধু খেয়াল রাখতে হবে যাতে কিছু না ভাঙে

–          সবজি কেটে দেওয়া এবং ভালো করে ধুয়ে স্ত্রীকে রান্নার সময় সাহায্য করাটাও বিফলে যাবে না। রান্নার শখ থাকলে সপ্তাহে

এক-আধ দিন স্ত্রীকে ছুটি দিয়ে নিজেই ঝামেলাটা সামলান, দেখবেন স্ত্রী খুশী হবে। কাজ কিছু না করেও যদি রান্নাঘরে স্ত্রীর সঙ্গে কিছু সময় কাটান সেটাও অতিরিক্ত পাওনা হবে

তবে স্ত্রীয়ের কাজের চুলচেরা বিচার কখনও করতে যাবেন না। নিজের এলাকায় দখলদারি স্ত্রী কখনওই সহ্য করে না।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...