আমরা ধীরে ধীরে নেমে আসি প্রায় ৮০-৯০ ফুট নীচে। সেখানে অনেকটা প্রশস্ত জায়গা। চুনাপাথরের দেয়ালে প্রত্যক্ষ করি স্ট্যালাকটাইটে তৈরি ঐরাবতের মুখ। গুহার মেঝে তৈরি হয়েছে মাটি, নুড়ি, বড়ো পাথর এবং বেশ কয়েকটি আড়াআড়ি ও নিম্নগামী পথ নিয়ে৷ গুহায় স্বাভাবিক কারণেই অক্সিজেন কম, উষ্ণতা মোটামুটি ২৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে। কোটুমসার কেভস দেশের মধ্যে প্রথম গুহাসমষ্টি যার জৈবিক অন্বেষণ করা সম্ভব হয়েছে। গুহার ভিতর স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইটে তৈরি বিভিন্ন সব আকৃতি বিস্ময় জাগায় মনে। গুহাগুলির মধ্যে পাঁচটি বড়ো কক্ষ আছে যেগুলো বহু দেয়াল বিশিষ্ট। সরু পথে আমরা আরও কিছুটা এগিয়ে পৌঁছোই এক প্রশস্ত জায়গায়। পাথর চুঁইয়ে পড়া জলে মেঝের এক কোণে সৃষ্টি হয়েছে ছোটো এক জলাশয়ে, যেখানে আলো নেই আর অক্সিজেন নেই বললেই চলে। টর্চের আলোয় দেখি, জলে খেলে বেড়াচ্ছে ছোটো ছোটো অন্ধ, সাদাটে মাছ যার বৈজ্ঞানিক নাম ইন্ডোরিওনেকটেস ইভেজারড (Indoreonectes evezard)। এছাড়াও গুহায় থাকে বাদুড়, ব্যাং, সাপ, ঝিঁঝিপোকা, মাকড়সা ইত্যাদি।

আমরা গাইডকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলি সাবধানে। এবার গুহাগাত্রে দেখি, প্রাকৃতিক উপায়ে স্ট্যালাকটাইটে তৈরি কুমির ও বাঘের প্রতিকৃতি। তবে, সবচেয়ে অবাক হলাম গুহার ছাদে স্ট্যালাগমাইটে তৈরি দুটি চোখ ও মাঝে একটি বিন্দু প্রত্যক্ষ করে। গাইড জানাল, আমরা গুহার প্রায় শেষ অংশে এসে পৌঁছেছি। আরও কিছুটা এগিয়ে ডান দিকে তাকিয়ে দেখি বিরাট এক শিবলিঙ্গ যার পিছনেই গুহার শেষ দেয়াল। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে দেখি আশেপাশের মেঝেতে বহু লিঙ্গাকৃতি অবয়বের প্রকাশ। শ্রদ্ধায় মাতা নত হয়। মুগ্ধ আমরা সবাই। ধীরে ধীরে একই পথে উঠে আসি গুহার প্রবেশ দ্বারে। কয়েক পা হেঁটে পৌঁছে গেলাম আমাদের জিপের কাছে। আমরা ফিরে চললাম জঙ্গলের মধ্য দিয়ে।

জঙ্গলে প্রাকৃতিক জলাবদ্ধতার কারণে তৈরি জলাভূমি থেকে উৎপন্ন কয়েকটি জলধারা হল একতা ঝোরি, ক্যাম নালা, কারাঞ্জি ঝোরি, রাজামুণ্ডা, পাঞ্জি ঝোরি ইত্যাদি। তারা তৈরি করেছে আরও কিছু জলাজমি, যা বুনো শুয়োর ও শ্লথ ভাল্লুক ছাড়াও চিতল হরিণ, বার্কিং ডিয়ার এবং প্যান্থার-এর পছন্দের জায়গা। এই জাতীয় উদ্যানে ৪৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৪৪ প্রজাতির পাখি, ১৬ প্রজাতির উভচর, ৩৭ প্রজাতির সরিসৃপ, ৫৬ প্রজাতির মাছ, ৯১ প্রজাতির প্রজাপতি, ২৬ প্রজাতির মথ এবং ১১৩ প্রজাতির মাকড়সার বাস।

কাঙ্গের ভ্যালি জাতীয় উদ্যানের মাঝে ও আশেপাশে কিছু মনুষ্য বসতি আছে, যাদের বেশির ভাগই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। জঙ্গলের দুটি ভাগ পশ্চিমে কোটামসার ও পূর্বে কোলেং। কোটামসার রেঞ্জের সীমান্তে রয়েছে কয়েকটি গ্রাম এবং সীমান্তের বাইরে জঙ্গল প্রায় নেই বললেই চলে। পূর্বভাগের কোলেং রেঞ্জের সীমান্তে গ্রামের সংখ্যা কম, তাই জৈব চাপ থেকে প্রায় মুক্ত। পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তের ৫ কিলোমিটার মধ্যে সাকুল্যে ৪৮টি গ্রাম আছে এবং জাতীয় উদ্যানের মধ্যে একটিই গ্রাম Kotumsar।

গাড়ি চলছে ধীরে ধীরে। এই ফাঁকে জাতীয় উদ্যানের ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র সম্বন্ধে জানাই কিছু কথা। উদ্যানে প্রধানত কুড্ডাপা এবং বিন্ধ্যায়ন শিলাগঠন দেখতে পাওয়া যায়। কুড়াপা গোষ্ঠীর শিলাগঠনে অনুভূমিক ভাবে সজ্জিত শেল পাথরই প্রধান, অন্য শিলাগঠনে শ্লেট পাথরের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। উত্তর-পশ্চিম ভাগে অর্থাৎ তিরথগড়-কামানার-কোটামসার অঞ্চলে চুনাপাথর, বেলেপাথর, কোয়ার্টজাইট ও ল্যাটেরাইটের প্রাধান্য। দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগে শিলাগঠন প্রধানত বিন্ধ্যায়ন গোষ্ঠীর, যেখানে গ্রানাইট ও বেলেপাথরই প্রধান।

আবার যেখানে শিলাগঠন কুড্ডাপা গোষ্ঠীর সেখানে কোয়ার্টজাইট ও গ্রানাইট-এর প্রাধান্য। খারাপ, পাথুরে মাটি রয়েছে পাহাড়ের চূড়ায় ও ঢালে। কাঙ্গের উপত্যকার মাটির রং হলদেটে বাদামি, পিঙ্গল-লাল ও বাদামি ধরনের। ভূখণ্ডে দোআঁশ মাটি, বালি ও ল্যাটেরাইটের প্রাধান্য। মাটির ঘনত্ব ৪ থেকে ৬ ফুট, ঈষৎ অম্লযুক্ত।

প্রায় নিস্তব্ধ জঙ্গলে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে অজানা পাখির ডাক। জাতীয় উদ্যান কাঙ্গের নদীর উপত্যকাতেই। নদী বয়ে গিয়েছে উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গভীর গিরিসঙ্কটের মধ্য দিয়ে উপত্যকার দুই দিকই দুরারোহ, পাহাড়শ্রেণী দিয়ে ঘেরা। ভারি ভালো লাগছে এই জঙ্গল সাফারি। জাতীয় উদ্যানের পূর্বভাগ পাহাড়-পূর্ণ, পশ্চিমভাগে পাহাড় অপেক্ষাকৃত কম। উদ্যানে অনেকগুলি ঋতু-নির্ভর নালা রয়েছে যেগুলি দুই দিক থেকে এসে মিলিত হয়েছে কাঙ্গের নদীতে। জাতীয় উদ্যানের উচ্চতা ১১০৯ থেকে ২৫৬২ ফুটের মধ্যে।

ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব ভাগ পাহাড়-পূর্ণ, উঁচু, অগম্য, তাই মানুষের অনধিকার প্রবেশ কষ্টসাধ্য। পূর্ব সীমান্তে কোলাব নদী পাথরময়। ওই অঞ্চল গুহাপূর্ণ এবং মনুষ্যপ্রবেশের পক্ষে কঠিন। জাতীয় উদ্যানের ভূগর্ভস্থ গুহাগুলিতে লেপার্ড, হায়েনা, ভাল্লুক ও শজারুর বাস। পাথুরে এলাকার ছোটো গুহায় বুনো কুকুর, শিয়াল, নেকড়ে ও বেঁজির বাস। কাঙ্গের নদীর বাঁকে বাঁকে বালুরাশি দৃশ্যমান। উদ্যানের পূর্বাংশে ভঁয়সাধারা-র বালুতীরে কুমির আসে রোদ পাহোতে৷

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...