কলকাতা থেকে ১৩৯.৪ কিলোমিটার দূরত্বে লালমাটির দেশ বিষ্ণুপুর স্থাপত্য পর্যটন মানচিত্রে অনন্য হয়ে আছে। মল্লরাজারাই এই মল্লভূমের প্রতিষ্ঠাতা। একসময় প্রদ্যম্নপুর থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করে বিষ্ণুপুরে করা হয়। মল্লভূমের সোনালি যুগ আসে দ্বিতীয় রঘুনাথের রাজত্বকালে। সেই ১৬ শতকে স্থাপত্য, ললিতকলা, সংগীত, ইতিহাস, শিল্পের উত্কর্ষতা শীর্ষে পৌঁছোয়। ২০টিরও বেশি মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটনক্ষেত্র, মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর। বয়সের রেখা পড়েছে মন্দিরগুলির শরীরে। প্রাচীনত্ব ও অতীত গরিমা মন্দিরনগরীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অসাধারণ সব স্থাপত্যশৈলী।

বৈষ্ণব ভাবধারায় দীক্ষিত মল্লরাজাদের আমলে রাজধানী বিষ্ণুপুরে নির্মিত হয়েছিল একের পর এক মন্দির। এই অঞ্চলের সহজলভ্য মাকড়া পাথরে চুন-সুরকির গাঁথনি দিয়ে তৈরি করা হতো মন্দিরগুলি। তারপর পাথরের ওপর খোদাই করে টেরাকোটার দেবদেবী, পুরাণগাথা, গ্রামবাংলার প্রকৃতিদৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হতো। মাকড়া হালকা ধরনের নিকৃষ্ট পাথর, পালিশও ধরে না, তবু শিল্পীরা এই পাথর কুঁদেই বিচিত্র সব শিল্পকর্ম করে গেছেন।

মল্লরাজা প্রথম রঘুনাথ সিংহ ১৬৫৫ সালে পরস্পর দুটি দোচালা কুটিরের সমন্বয়ে ও সংযোগস্থলে চারচালা শিখরের অসাধারণ টেরাকোটার জোড়বাংলা মন্দির নির্মাণ করেন। প্রকৃত নাম কেষ্টরাই মন্দির। ১৬৫৮ সালে মল্লরাজ বীর সিংহ নির্মিত রাধালালজি মন্দির। ১৭২৬ সালে মল্লরাজ গোপাল সিংহের আমলে মাকড়া পাথরের তিনটি মন্দিরকেও জোড় শ্রেণির মন্দির বলা হয়। মন্দিরগাত্রে কৃষ্ণলীলার চিত্র।

মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ ১৭৫৮ সালে নির্মিত গম্বুজাকৃতি শিখরবিশিষ্ট রাধেশ্যাম মন্দির, রয়েছে নহবতখানা ও নাটমঞ্চ। বাংলার চালার ধাঁচে সৃষ্ট জোড়বাংলা মন্দির এবং পঞ্চশিখর নিয়ে শ্যামরাই মন্দিরের টেরাকোটা কাজ দেখার মতো। শ্যামরাই মন্দিরটি বীর হাম্বিরের প্রপৌত্র, মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ ১৬৪৩ সালে নির্মাণ করান, এখানে শ্রীকৃষ্ণসহ গোপিনীদের নানা প্রেমজ দৃশ্য খোদিত রয়েছে। উল্লেখ্য, এখানকার প্রসিদ্ধ বালুচরি শাড়ির বুনোটেও এই দৃশ্যের নকশা তুলে আনা হয়। মহাভারত, রামায়ণ, দশাবতার, কৃষ্ণলীলা, যুদ্ধযাত্রা ইত্যাদি রয়েছে পোড়ামাটির মন্দিরগাত্রে।

রাজবাড়িটি আজ কালের প্রবাহে বিধ্বস্ত। উত্তরের প্রবেশদ্বার বিখ্যাত গড় দরওয়াজা বা পাথর দরওয়াজা শুধুই বিগত ইতিহাসসাক্ষ্য বহন করছে। তারই মাঝে রামকৃষ্ণ পদধুলিপ্রাপ্ত শতাধিক প্রাচীন দেবী দুর্গার মৃন্মযী মন্দির। বিপরীতদিকে রাধালাল জিউ মন্দির। কাছেই রাধেশ্যাম মন্দির। এই মন্দিরের নহবতখানায় আরব্যশৈলীর ছোঁয়া। মল্লরাজ দুর্জন সিংহের মদনমোহন মন্দিরটি একরত্ন শৈলীতে নির্মিত।

মল্লরাজ বীর সিংহের আমলে নির্মিত গুমঘর, এখানে নাকি একসময় অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হতো। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, মোটেও তা নয়, এটি রাজবাড়ির জলাধার ছিল। ১৬৬৫ সালে রাণি শিরোমণি দেবী প্রতিষ্ঠিত মুরলিমোহন মন্দির। এছাড়াও কালাচাঁদ মন্দির, মদনগোপাল মন্দির, রাধামাধব মন্দির, মল্লেশ্বর মন্দির, গোকুলচাঁদ মন্দির, ছিন্নমস্তা মন্দির, সর্বমঙ্গলা মন্দির ইত্যাদি।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...