ইদানীং বিষ্ণুপুরের শনিবারের পোড়ামাটির হাট পর্যটক মহলে বেশ জনপ্রিয়। দোকানিরা বসেন বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে৷ দশাবতার তাস, টেরাকোটার ঘোড়া, পেঁচা, ডোকরার শিল্পসম্ভার, পেতলের পিলসুজ, বাসনপত্র, শাঁখের নানা কাজের সংগ্রহ, বিষ্ণুপুরি গামছা, পোড়ামাটির গয়না, ঘর সাজানোর জিনিস। স্মারকচিহ্ন হিসেবে কিছু কিনতে হলে, হস্তশিল্প বিপণিগুলির জুড়ি নেই।
বিষ্ণুপুরের অতি বিখ্যাত দশাবতার তাস। অনেকে বলেন মল্লরাজ বীর হাম্বির এই খেলা চালু করেছিলেন, আকবরের রাজা-উজির তাস খেলার অনুকরণে। আবার অন্যমতে পাল সাম্রাজ্যের আমল থেকেই এই খেলা চলে আসছে। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ ইত্যাদি। প্রতি শ্রেণিতে বারোটি তাস থাকে। সংগ্রহযোগ্য জিনিস। হাটে বসে বাউলগান, কীর্তন, সাঁওতালি নাচ, ছৌ নাচের আসর। বিষ্ণুপুরের তাঁতিদের তৈরি বালুচরি, স্বর্ণচরি, গরদ, তসর শাড়ির বিশ্বজোড়া কদর তো রয়েছেই। কেনাকাটা করতেই অনেকখানি সময় পেরিয়ে যায়। সব কিছু দেখার জন্য একটা দিন ছোটো মনে হয়, মন ভরে না। তবে ফিরতিপথে জয়পুর জঙ্গলে ঢুঁ মারার সিদ্ধান্তে নড়চড় করি না।
বিষ্ণুপুর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে শাল-পলাশ-কুসুম- পিয়াল-নিম-মহুল-সেগুন-মহুয়া গাছদের নিয়ে এক দ্রষ্টব্য বাঁকুড়ার জয়পুর জঙ্গল। সূর্যের আলো সেখানে সরলবর্গীয় গাছেদের থেকে জঙ্গল প্রবেশের ছাড়পত্র চায়। যাত্রপথের বাঁদিকে জয়পুর জঙ্গল লেখা সাইনবোর্ড। দু’পাশে ঘন শালের জঙ্গল চিরে পথ। পথ বলতে লাল কাঁকুড়ে মাটি, জঙ্গল থেকে খানিক উঁচুতে পথ। এই জঙ্গলে প্রায়ই হাতি দেখা যায়।
হাতিদের আনাগোনা, ময়ূরের কেকাধ্বনি, হরিণের রাস্তা পারাপার যখন তখন। একটা বাঁক ঘুরে ক্যানালের পাশ দিয়ে মোরাম বিছানো পথ। আমরা সেই মোরামের পথ সাঁতরে জঙ্গলের ভেতর গেলাম। মাঝে মাঝে পাখির ডাক ছাড়া নিস্তব্ধতা এখানকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অদ্ভুত জংলি গন্ধ! এখানে মূলত শবর, লোধা আদিবাসীদের বসবাস। মহারাজা প্রদ্যুম্নের আবাস ছিল জয়পুর সংলগ্ন ঐতিহাসিক গড় প্রদ্যুম্নপুরে। কয়েকধাপ সিঁড়ি উঠে বারো ভুঁইয়া মন্দির নামে পূজিত এক স্থল।
বাসুদেবপুরে রয়েছে ব্রিটিশ আমলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত প্রায় ২ কিলোমিটার দীর্ঘ ঐতিহাসিক পিয়ার ডোবা এয়ারফিল্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার সেনাবাহিনী এই বিমান অঙ্গন ব্যবহার করত। বিশ্বযুদ্ধের পর সেটি তারা ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়। জঙ্গলের মধ্যেই রানওয়ে তবে এখন ঝোপঝাড় আগাছায় ঢাকা। জয়পুর জঙ্গল লাগোয়া রিসর্টে থাকার ইচ্ছে থাকলেও, হাতে সময় না থাকায় এ যাত্রায় বিরতি দিতে হল। কারণ আজই রাতের মধ্যে কলকাতা ফিরতে হবে। তাই এখানে দুপুরের খাওয়াটা সেরে, বেরিয়ে পড়লাম।
কীভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে সড়কপথেই চলে যাওয়া যায় বিষ্ণুপুর। ধর্মতলা থেকে বহু বাস যাচ্ছে। সময় লাগবে মোটামুটি চার-সাড়ে চার ঘন্টা। রেলপথে হাওড়া থেকে চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার, রূপসী বাংলা, পুরুলিয়া এক্সপ্রেস ইত্যাদি।
কোথায় থাকবেন : বিষ্ণুপুর শহরের হাইস্কুল মোড়ে রাজ্য সরকারের পর্যটন দফতরের পর্যটকাবাস রয়েছে। এছাড়াও বেসরকারি কিছু হোটেল, রিসর্টও রয়েছে শহরে। জয়পুরেও জঙ্গল লাগোয়া কিছু রিসর্ট রয়েছে।