শৈশব থেকে কৈশোর এবং তারপর যৌবনে পদার্পণ মানুষের জীবনে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। মা-বাবার কাছেও সন্তানের প্রথম হাঁটতে পারা, প্রথম কথা ফোটা, প্রথমবার স্কুলে যাওয়ার স্মৃতি এক মধুর অনুভূতি। এটাই শিশুর স্বাভাবিক গ্রোয়িং প্রসেস।

কিন্তু জীবনছন্দের এই প্রাকৃতিক গতি কখনও-সখনও ব্যহত Child Problems হয় বই-কি। দেখা যায় পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটি মেক-আপ ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরোতেই চায় না। ১০ বছর হতে না হতেই অনেকেই আলমারি ভর্তি নিজস্ব জামাকাপড় ছেড়ে বড়োদের জামাকাপড়, এমনকী অন্তর্বাস পরতে বেশি আগ্রহ বোধ করছে। ছোট্ট বয়সেই বাইরের পৃথিবীতে পা রাখতে চাইছে। পরিবারের গন্ডি তার কাছে মনে হচ্ছে দমবন্ধ করা পরিবেশ। বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার এখানেই শুরু।

এখন সময়টাই এমন যে বাচ্চারাও নিজেদের বড়ো ভাবতে শুরু করেছে। এমন জামাকাপড় পরছে যাতে সকলের চোখে নিজেদের সেক্সি এবং আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। টিভির পর্দায় রিয়্যালিটি শো-গুলোতে সেক্সি গানের সঙ্গে ওদের যেভাবে নাচতে শেখানো হয়, তা আর যাই হোক শৈশবের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কোনও কোনও অভিভাবক হয়তো সন্তানের এই ধরনের অ্যাটিটিউড দেখে লজ্জিত বোধ করেন। টিভি, ইন্টারনেটের লাইন কাটিয়ে দেন, এমনকী প্রয়োজনে বাচ্চার অজান্তেই তার উপর নজর রাখেন। কিন্তু একবারও কী তারা ভেবে দেখেন যে, পরোক্ষে এসবের জন্যে তারাই নিরানব্বই শতাংশ দায়ী। অলক্ষ্যে তারাই, সন্তানদের শিশুমনের স্বাভাবিক ছন্দকে কেড়ে নিয়ে তাদের ঠেলে দিচ্ছেন পরিণত মনোভাবের দিকে। ভেবে দেখুন তো অজান্তে মা-বাবাই কি দায়ী নন, শিশুর জীবন থেকে শৈশবকে কেড়ে নেওয়ার জন্যে?

কী ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় অভিভাবকদের –

সন্তান যখন শাসনের বাইরে চলে যেতে থাকে অথবা মা-বাবার শাসনে, কথা শোনার পরিবর্তে উলটে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তখন সেই ক্ষেত্রে অভিভাবকদের মানসিক যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যেতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সন্তানের ইচ্ছের কাছে তাদের হার স্বীকার করে নিতে হয়। অপরাধবোধে তারা ভুগতে থাকেন। তাদের মনে হয় হয়তো দরকারের বেশিই তারা সন্তানকে আদর দিয়ে ফেলেছেন। শিশুর অন্যায় আবদারে একবার ‘না’ বলে কতজন অভিভাবক পারেন সেই ‘না’-তেই অনড় থাকতে?

অনেক সময় দেখা যায় মা-বাবা তাদের সন্তানদের শিশু বয়সেই একাধিক এমন কারিকুলাম-এর সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেন যেগুলি কোনও ভাবেই শিশুসুলভ ক্রিয়া বলা চলে না। ফলত বাচ্চারাও সেক্ষেত্রে আনন্দ করার পরিবর্তে কাজের জগতে ঢুকতে বাধ্য হয়। গরমের ছুটি হলেই মা-বাবাদের টেনডেন্সি থাকে অ্যাকটিভিটি ক্লাস, সাইন্স ক্যাম্প, কম্পিউটার ক্লাস, স্পোকেন ইংলিশ ক্লাস ইত্যাদিতে বাচ্চাদের নাম এনরোল করানো, যা বাচ্চাকে অলরাউন্ডার করে তুলবে। অথচ শৈশবের যা স্বাভাবিক ক্রিয়া যেমন খেলা, মজা করা, বন্ধুরা মিলে মজা করে হইচই করা, এগুলো থেকেই তাদের বিরত করা হয়। এইভাবেই শৈশবকালটা শিশুর জীবন থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। বাচ্চারা বয়সানুযায়ী বেশি মাত্রায় ম্যাচিওরড হয়ে ওঠে।

অভিভাবকের দায়িত্ব –

বাচ্চাকে বাচ্চার মতো থাকতে দেওয়াটা খুবই জরুরি। বাচ্চারা ভুল করবে, ভুল করতে করতেই শিখবে এটাই স্বাভাবিক। বড়োদের কখনও ভাবা উচিত নয় যে, তাদের সন্তান অতিমাত্রায় প্রতিভাবান হবে, সবকিছু তার জানার মধ্যে হবে। এমনিই বাচ্চারা তাদের বয়সের তুলনায় আজকাল অনেক বেশি জানে। বয়স অনুপাতে বেশি জেনে গেলে শিশুর শৈশবের ইনোসেন্স ভাবটাও হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে।

কিশোরাবস্থায় তারা নিজেদের আগ্রহ মেটাতে বিভিন্ন সোর্স থেকে নানা তথ্য জোগাড় করে। এর বেশির ভাগই আনসেন্সার্ড হয়। এই বয়সটাতে জানার ইচ্ছা প্রবল হয় ফলে মিডিয়া, বিভিন্ন পত্রিকা, ইন্টারনেট তাদের জানার ক্ষুধা নিবৃত্তি করে। মা-বাবাও কাজের জন্য বাড়ির বাইরে থাকেন, সুতরাং চোখে চোখে রাখার লোকের অভাব। বয়সানুযায়ী, নতুন পাওয়া তথ্যগুলি নিজেদের উপর পরীক্ষা করতে গিয়েই শৈশব ক্ষতিগ্রস্ত Child Problems এর সূত্রপাত হয়।

প্রাপ্তবয়স্ক তথ্যগুলি যাতে অপরিণত বয়সি কিশোর-কিশোরীদের হাতে না পড়ে তার একমাত্র উপায় হল সর্বক্ষণ তাদের উপর লক্ষ্য রাখা। আর একটা উপায় হল সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশা। তারা যাতে নির্ভয়ে মনের কথা মা-বাবার কাছে ব্যক্ত করতে পারে। যা কিছু জিজ্ঞাস্য সব শেয়ার করার সাহস যাতে সঞ্চয় করতে পারে। শিশুর মন সবসময় নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। যেখানে সে তার সব প্রশ্নের উত্তর পায়, স্বভাবতই সেদিকে ঝোঁকার প্রবণতা বেশি থাকে। বহুক্ষেত্রেই মা-বাবা সন্তানের সঙ্গে সেক্স, পিউবার্টি, যৌনরোগ, অ্যালকোহল ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেন। সেইক্ষেত্রে অভিভাবকদের কাউন্সেলিং-এর প্রয়োজন হয়, কীভাবে এরকম স্পর্শকাতর বিষয়ে সন্তানদের অবগত করা যায়। সন্তানের এই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলে, ভুল উত্তর দিয়ে বাচ্চাদের মন ভরানোর চেষ্টা না করাই বাঞ্ছনীয়। প্রশ্ন করার জন্য তার মনের মধ্যে অপরাধবোধও জাগিয়ে তোলা উচিত নয়। প্রশ্ন করা থেকে তাদের বিরত করাও উচিত নয়। উপরন্তু যদি শিশুর মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয় যে মা-বাবাকে মনের মধ্যে ওঠা যে-কোনও প্রশ্ন অনায়াসেই করা যায় এবং সঠিক উত্তরও পাওয়া যায় তাহলে বেঠিক সোর্স-এর সাহায্য না নিয়ে মা-বাবাকেই বাচ্চারা বেশি মূল্য দেবে।

পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় করা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতে বহু সংখ্যক বাচ্চারা, নিজেদের বয়স বাড়িয়ে সদস্যপদ লাভ করেছে। বাড়ির বড়োদের কাছে ঘটনাটা অজানা নয় সুতরাং মনে করা যেতে পারে বড়োদেরও এতে স্বীকৃতি রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে প্রভোকেটিভ জামাকাপড়ে নিজেকে সজ্জিত করা, অশ্রাব্য গানের তালে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে নেচে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ইত্যাদি। বাচ্চাদের এই ধরনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে বলেই আজ প্রি-টিন সেক্স, চাইল্ড ড্রাগ কেস, ড্রিংকিং হ্যাবিট এবং সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ, টিন-এজারদের মধ্যে এত বেশি। আগে লিভ-ইন কালচারের এতটা রমরমা ছিল না অথচ আজ আর এই নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না, যেন এই জীবনযাত্রাটাই স্বাভাবিক। কম বয়সেই যদি এতটা স্বাধীনতা তাদের দেওয়া হয়

তাহলে তার পরিণাম দেখেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

আপনার সন্তান কি খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছে?

বয়সের তুলনায়, শারীরিক বা মানসিক ভাবে বাচ্চারা বেশি বেড়ে উঠতে থাকলে মা-বাবার কাছে একটা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিজেদের চারিত্রিক গঠনের থেকে শরীরের সৌন্দর্যকে বাচ্চারা বেশি প্রেফারেন্স দিয়ে ফেলে। আপনার সন্তান সত্যিই কী বয়স অনুপাতে বেশি পরিণত হয়ে উঠছে সেটা নিজেই খেয়াল রাখুন।

নিজের কাছে নিজেই কয়েকটা প্রশ্ন রাখুন যেমন –

– আপনার সন্তান যেসব গল্পের বই পড়ছে সেগুলি কি তার বয়স অনুপাতে ঠিক?

– আপনার সন্তানের আচরণ কি শিশুসুলভ নাকি শৈশবের স্বাভাবিকতার তুলনায় বেশি ম্যাচিওরড।

– সন্তান কি বড়োদের মতন পোশাক পরতে আগ্রহী বেশি অথবা বড়োদের নকল করতে চেষ্টা করে?

– বড়োদের জিনিসে কি তাদের বেশি ঝোঁক রয়েছে?

– আপনার সন্তান কি অস্থির প্রকৃতির অথবা সবসময় ‘বোর’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ করে?

– খেলনার প্রতি আগ্রহ কতটা?

– আপনার সন্তানের যারা বন্ধুবান্ধব তারা কি ওর থেকে বয়সে বড়ো?

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...