শীতের রোদ গায়ে মেখে বেড়ানোর মজাই আলাদা। এবার পা বাড়ালেই পৌঁছোনো যায়, এমন জায়গা বেছেছি আমরা। কিরিবুরু ও লাগোয়া মেঘাতুবুরু। কিরি মানে হাতি আর বুরু মানে বন। আর মেঘাতু হল মেঘে ঢাকা বন যাকে বলে ‘রেন ফরেস্ট’। তাই এই অঞ্চলে বৃষ্টিও বেশি। কাছেই রাউরকেল্লা স্টিল প্লান্ট– ফলে বোঝাই যায় এখানে মাটিতে লৌহের পরিমাণ বেশি। মিশে আছে নানা খনিজ পদার্থও। এ জায়গার আরও এক টান হল সারান্ডার জঙ্গল।
পাশাপাশি জায়গা হলেও Travel spot কিরিবুরু আর মেঘাতুবুরু দুটি ভিন্ন রাজ্যে। সিংভূম অঞ্চলের কিরিবুরু আসলে ওরিশায় আর মেঘাতুবুরু ঝাড়খন্ডে। কিন্তু মালভূমি বলেই দুটির সৌন্দর্য অতুলনীয়। হাওড়া থেকে ইস্পাত এক্সপ্রেস-এ মনোহরপুর পৌঁছে দুপুর দেড়টার বাস ধরে পৌঁছোনো যায় মেঘাতুবুরু। ঘন্টা দুয়েকের পথ পেরোলেই পৌঁছে যাওয়া যায় গন্তব্যে। বাসের কনডাক্টরকে বলে রাখায় সে-ই সযত্নে থামিয়ে দিল সেইল-এর গেস্টহাউসের দোরগোড়ায়।
স্টিল অথরিটির গেস্টহাউসে অতিথি হয়ে নিকটবর্তী সানসেট পয়েন্টে যাবার লোভ সামলানো গেল না। মেঘাতুবুরু যারাই আসেন তারা এই সানসেট পয়েন্টে অবশ্যই যান। চারপাশে টিলা, পাহাড় আর সেখানে হাতি, হরিণ, ভাল্লুক ও নানা প্রজাতির সাপের বাস। আরণ্যক পরিবেশে এক নিরিবিলি উইক-এন্ড ডেস্টিনেশন হতে পারে কিরিবুরু। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এক আদর্শ জায়গা। এ অঞ্চলে একসময় থালকোবাদ বাংলো ও কুমডি বন-বাংলোয় থাকা যেত। মাওবাদী হামলায় সেসব জায়গা এখন আর বাসযোগ্য নয়।
দ্বিতীয় দিনে সেইল-এর বড়োকর্তার অনুমতিক্রমে আমরা খনি দেখে এলাম। তারপর একটি গাড়ি ঠিক করে বেড়িয়ে নিলাম কিরিবুরু। ছোটোছোটো ঝরনা আর জঙ্গুলে পথ – অচিরেই মন কেড়ে নেয় কিরিবুরু।
পরদিন আমাদের বুকিং রয়েছে সারান্ডা গেস্টহাউস-এ। মনোহরপুর-কে বলা হয় সারান্ডার প্রবেশদ্বার। কোয়েল, কোয়েনা আর কারো – এই তিন নদী পাড় ছুঁয়ে যায় মনোহরপুরের। মাইনস্ এরিয়া ছাড়িয়ে পথ চলে গেছে সারান্ডার জঙ্গলে। রাজনৈতিক সমস্যায় জায়গাটির সুনাম অনেকটাই খণ্ডিত হয়েছে। তবু জায়গাটার সৌন্দর্য অপরিসীম। মূলত শাল জঙ্গলে ঘেরা সারান্ডা। এক-দুপুরের-পিকনিকের জন্য আদর্শ। আমাদের গন্তব্য হল সারান্ডার পুণ্ডুল ফলস। আর জঙ্গলের মধ্যে স্বপ্নেশ্বর মন্দির নামের এক শিবমন্দির।
ড্রাইভার বলল সন্ধে না করাই ভালো। হাতির উৎপাত তো আছেই, আছে অন্য সমস্যাও। তাই রোদ পড়ার আগেই আমরা গেস্টহাউসের পথ ধরলাম।
পরদিন আমরা গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম দুটি অসাধারণ ঝরনা দেখতে। প্রথমটি হল Travel spot খন্ডধারা ফলস। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পথ। প্রায় ৮০০ ফিট উচ্চতা থেকে জলরাশি স্পর্শ করছে মাটি। অপূর্ব এক পিকনিক স্পট। ফেরার পথে আরও একটি ঝরনার সঙ্গে দেখা হল। এর নাম বড়াঘাঘরা। ঘাঘরা নদী থেকে এর উৎপত্তি, জলধারা নামছে ২০০ ফিট উচ্চতা থেকে। ঝরনা দেখে ফিরে এলাম আস্তানায়।
রাতে ক্যাম্প ফায়ার আর ঝলসানো মুর্গি দিয়ে হইহই সন্ধে। ‘সারান্ডা’–সাতশো জঙ্গলের দেশের সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে কেটে গেল রাতটা। পরদিন বারবিল থেকে জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে আমাদের কলকাতায় ফেরা।