দিল্লির গৌরবময় ইতিহাস আজও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। মহাভারতে ইন্দ্রপ্রস্থের স্থাপনা থেকে শুরু করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সূচনা, বিভিন্ন বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির একের পর এক আক্রমণ, দিল্লির মাটিতে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার– এসবই দিল্লির পটভূমিকে রক্তাক্ত করেছে ঠিকই কিন্তু ঐতিহাসিক গুরুত্ব দিয়েছে অনেক বেশি। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ভারতের আজকের রাজধানী।
মহাকাব্যের যুগের ইতিহাস খুললে পাওয়া যায় যুধিষ্ঠির তাঁর স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। তার কিছু নিদর্শনও সংরক্ষিত হয়ে আছে ‘পুরোনো কেল্লা’ বা ‘ওল্ড ফোর্টের’ কক্ষগুলিতে। এইসময়েই শ্রীকৃষ্ণের তত্ত্বাবধানে পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে যে-ধর্মযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, সেই কুরুক্ষেত্রও কিন্তু দিল্লিরই অন্তর্ভুক্ত। আজ এই দুটি স্থানই পর্যটকদের একটি প্রধান আকর্ষণের জায়গা।
পৌরাণিক যুগের অবসানে দিল্লির মাটিতে রাজত্ব করতে আসে মৌর্য, গুপ্ত, রাজপুত, আফগান, খিলজি, তুঘলক, সৈয়দ, লোধি, মোগল এবং সবশেষে ইংরেজরা। সর্বধর্ম সমন্বয়ে ভারতের রাজধানী আজ ধর্মনিরপেক্ষ শহর হিসেবে প্রসিদ্ধ। বিড়লা লোটাস টেম্পল, অক্ষরধামের মতো মন্দির যেখানে আছে– সেখানেই পাশাপাশি সেন্ট স্টিফেন্স চার্চ, মজনু কা টিলা, জুম্মা মসজিদও মাথা উঁচিয়ে রয়েছে।
শিল্পকলার অমূল্য উদাহরণ
পর্যটকদের কাছে দিল্লির প্রধান আকর্ষণ হল এখানকার ঐতিহাসিক সমৃদ্ধি। লালকেল্লা, সিরি ফোর্ট, তুঘলকাবাদ দুর্গ আজও পুরোনো স্মৃতি বহন করে চলেছে। দিল্লি পর্যটকদের কাছে চাঁদনির বিপরীতে লালকেল্লার আকর্ষণ অপরিসীম। মোগল সম্রাট শাহজাহান দ্বারা নির্মিত এই শাহি মহলের নির্মাণ। এক কোটি টাকা খরচের বিনিময়ে এর নির্মাণকার্য শেষ হয়। লালকেল্লার ভিতরে দিওয়ান-এ আম, দিওয়ান-এ খাস, মুমতাজ মহল, হামাম খানা এবং রংমহল দেখতেই পর্যটকদের ভিড় বেশি হয়। লাল পাথর দ্বারা অষ্টকোণের আকারে নির্মিত হওয়ার কারণে, ভারতীয় ইসলামিক ভবন নির্মাণ কলাশিল্পের এটি একটি উজ্জ্বল অমূল্য দৃষ্টান্ত।
এছাড়াও লালকেল্লার প্রধান দরজার সামনেই মিনা বাজার বহু পর্যটকদের বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করে। এরই উত্তরে মোগল শাহজাদা সালিমের নামে সালিমগড় কেল্লা রয়েছে যেটি পিকনিক স্পট হিসেবে দিল্লিবাসীর কাছে খুবই প্রিয়।
লালকেল্লার সামনেই রয়েছে জুম্মা মসজিদ। এটির নির্মাণকার্যও শাহজাহান করেছিলেন। মোগলযুগে লালকেল্লা, জুম্মা মসজিদ, দিল্লি গেট এবং চাঁদনি চকের আশেপাশের অঞ্চলটিকে বলা হতো শাহজাহনাবাদ। এখন এই পুরো জায়গাটার নামকরণ হয়েছে দিল্লি। শাহজাহান কন্যা জাহানারা বেগমের হাতে গড়া ইতিহাসখ্যাত চাঁদনি চক আজ দিল্লির অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা। কেল্লার কিছুটা দূরত্বে রয়েছে দিগম্বর জৈন মন্দির। সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত মন্দিরের দেবতা জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথস্বামী।
দেশবাসীর মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করায় রুষ্ট ঔরঙ্গজেবের বিধানে নবম শিখগুরু তেগ বাহাদুরের শিরচ্ছেদ হয় কদলীবৃক্ষ তলে, শিশগঞ্জে। স্মারকরূপে তৈরি করা হয় শিশগঞ্জ গুরুদ্বারা।
দিল্লির আর-একটি প্রিয় পর্যটক স্থান হল কুতব মিনার। মেহেরৌলি গ্রামে স্থিত কুতুব মিনার কুতব-উদ-দিনের হাতে নির্মাণ শুরু, শেষ হয় কুতউদ্দিনের জামাতা ইলতুৎমিশের হাতে। ভারতে উচ্চতম স্থাপত্যে অনুপম কুতব মিনারটি পাঁচতলায় গড়ে উঠেছে। অনেকের মতে মিনারটি শেষ করেছিলেন কুতবের উত্তরপুরুষ ফিরোজ শাহ তুঘলক। প্রতিটি তলায় রয়েছে ব্যালকনি। কুতবের উত্তর পশ্চিম লাগোয়া ভারতের প্রাচীনতম কুওয়াত-উল ইসলাম মসজিদ। কুতবের হাতে মহম্মদের মদিনার বাড়ির অনুকরণে, হিন্দু মন্দিরের উপর এটি গড়ে উঠেছে। স্থাপত্যে ও শিল্পকলায় তৎকালীন ভারতীয় নিপুণতার এ এক আশ্চর্য নিদর্শন।
আকর্ষণীয় লৌহ স্তম্ভ
মেহেরৌলিতেই রয়েছে গুপ্তকালীন শাসক চন্দ্রবর্মার তৈরি উঁচু লৌহ মিনার। মরচেহীন মিনারটির সংস্কৃত উদ্ধৃতিটি আজও অবিকৃত। স্তম্ভটির ঐতিহাসিক গুরত্ব রয়েছে ঠিকই কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের কাছেও এটি একটি বিস্ময়। এটির নির্মাণে যে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ব্যবহৃৎ হয়েছিল তা আজও বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা রয়ে গেছে।
উঁচু ইন্ডিয়া গেট বা ভারত তোরণকে নতুন দিল্লিতে ঢোকার প্রবেশদ্বার বলা হয়। ব্রিটিশের পক্ষে মিত্রশক্তির হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও আফগান যুদ্ধে নিহত ভারতীয় ও ব্রিটিশ সেনার স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি ওয়ার মেমোরিয়াল আর্চ।
শ্রদ্ধাঞ্জলির স্মারকস্তম্ভ ইন্ডিয়া গেট
ইন্ডিয়া গেটের নির্মাণ করেছিলেন আধুনিক দিল্লির নির্মাতা স্যার এডউইন ল্যুথিয়েনস। এরপর শিলান্যাস করেন ডিয়ুক অফ কনট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক সৈনিকের মৃত্যু হয়েছিল, সেই ভারতীয় ও ব্রিটিশ সৈন্যদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পিত করার জন্যই এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এরই নিচে প্রজ্জ্বলিত ভারত-পাক যুদ্ধে নিহত ভারতীয় জওয়ানদের স্মারকরূপে গড়া শাশ্বত শিখা ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ অতুলনীয় করে তুলেছে একে।
ইন্ডিয়া গেট জনপথের কিছুটা দূরত্বেই অবস্থিত। যেসব পর্যটকরা দিল্লির আকর্ষণে শহরে আসেন তারা জনপথের দু’দিকের দোকানগুলিতে ফ্যাশনদুরস্ত পোশাকের আকর্ষণে ভিড় করেন পথের দু’পাশে।
জনপথ থেকে কিছুটা দূরে দিল্লি গেটের সন্নিকটে রিং রোডে যমুনার ধারে গড়ে উঠেছে আধুনিক ভারতের অবিস্মরণীয় জাতীয় মন্দির। জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির শেষকৃত্য এখানে সম্পন্ন করা হয়। তাঁরই স্মৃতিতে কালো মর্মরের সমাধিবেদি তৈরি হয় এই রাজঘাটে। জনসাধারণ, দেশিবিদেশি দিল্লি ভ্রমণার্থীরা শ্রদ্ধা জানাতে আসেন জাতির পিতাকে। পাশেই গান্ধি স্মারক সংগ্রহালয়।
রাজঘাটের লাগোয়া শান্তিবন। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর শেষকৃত্য হয় এখানে। গড়ে তোলা হয় সমাধিবেদি। পাশেই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত নাতি সঞ্জয় গান্ধির সমাধিবেদি। ইন্দিরা গান্ধির স্মৃতিতেও এক জাতীয় মন্দির গড়ে উঠেছে রাজঘাট আর শান্তিবনের মাঝে শক্তিস্থলে। ইন্দিরা-তনয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির স্মরণে তৈরি হয় বীরভূমি। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী চরণ সিং-এর স্মরণে কিষাণঘাট এবং দলিত নেতা আর এক প্রধানমন্ত্রী বাবু জগজীবন রামের স্মরণে সমাধি সমতা স্থল। পর্যটকরা এই স্থানটির সৌন্দর্যে সহজেই আকর্ষিত হয়ে সারাদিনটা এখানে অতিবাহিত করেন।
দিল্লির নেহরু প্লেস-এ অবস্থিত লোটাস টেম্পল বাহাই ধর্মের জন্যে সমর্পিত। ‘এক জাতি এক প্রাণ’-এ একতার মূলমন্ত্রকে রূপ দিতে, পারস্যে উন্মেষ ঘটেছে বিশ্বের কনিষ্ঠতম ধর্ম বাহাই-এর। মনোরম বাগিচার মাঝে জলাশয়ের ফোয়ারার মাঝ দিয়ে, রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায় উঁচু না-ফোটা পদ্ম অর্থাৎ বাহাই মন্দিরে। ভিতরে ভক্তদের বসার ব্যবস্থা। কোনও দেবদেবীর মূর্তি নেই। ভাস্কর্যশিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন এই লোটাস টেম্পল। এছাড়াও আছে অক্ষরধাম মন্দির। গুজরাতের অক্ষরধাম মন্দিরের অনুকরণে এটির নির্মাণ হয়েছে। প্রতিদিন বহু পর্যটক এখানে এসে মন্দির দর্শন করেন।
দিল্লির সংসদ মার্গে অবস্থিত যন্তরমন্তর জয়পুরের মহারাজা সওয়াই জয় সিং দ্বিতীয়র সৃষ্টি। সেকালের পঞ্জিকা অর্থাৎ মানমন্দির সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্রের গতিবিধি ও সময় পরিমাপক যন্ত্র। বিশালাকার প্রিন্স ডায়ালটি অনবদ্য।
প্রগতি ময়দানের মেট্রো স্টেশন থেকে মথুরা রোড-এর দিকে যেতে পড়ে পুরোনো কেল্লা। এটি বাচ্চাদের বেড়ানোর খুব প্রিয় জায়গা।