ময়নাগুড়ি স্টেশনে নেমেছি ভোরের ট্রেনে। তারপর রিকশায় বাস স্ট্যান্ড। এইটুকু পথে বৈচিত্র্য তেমন নেই। শুধু জেলা বদলের পার্থক্য কিছু নজরে পড়ে। দু’ধারে ছড়ানো ইট-কোঠা, টুকরো বাগিচা, স্কুলবাড়ি, খোলা মাঠ। নতুন পরিবেশে চলতে গিয়ে চোখ লুটে নেয় এটুকুও। রিকশাওয়ালা হরিনাথ দাস স্থানিক ব্যক্তি। সে প্যাডেল ঠেলে আর গল্প বলে– এই দেশটায় স্যার বেঘোর জঙ্গল ছিল এক সময়। বড়ো বড়ো ময়না গাছ করাত-সাফা হয়ে গেল! তুমি দেখেছ সে জঙ্গল? শুনেছি, দাদামশায়ের মুখে। এখন দ্যাখেন ময়না উড়ে গিয়ে মানুষ এসে বসল। তার হাঁসফাঁসের সঙ্গে হতাশাও টের পাই। আমি বলি এ সবই যুগধর্ম হরিনাথ। কিছুই এক ঠাঁই-এ থাকে না। সবই আসা যাওয়ার তামাশা। ময়না কেটে বসত হল। হরিনাথ জীবনের রসম জানে। সে বলে, ঠিক বলেছেন। মানুষ, দেশ-কাল-পরিবেশ জুড়লেন, গড়লেন, মানুষই তাকে ভাঙলেন।
পথের বাঁক ফিরতেই বাজার পাড়া এসে পড়ল। চওড়া সড়ক ধরে ছোটো-মাঝারি বাস দাঁড়িয়ে। হল্লা করে ডাক দেয় খালাসি– চালসা, লা-টা-গু-ড়ি…। আমাদের যাত্রা ওই পথের দিশায়। উঠে বসেছি একটি ফাঁকা মিডি বাসে। পাশের যাত্রীটি বলেন, যাবেন কতদূর? লাটাগুড়ি। যাওয়ার তাড়া আছে? তা একটু…। তা হলে এটায় উঠলেন কেন? কেন? এটা ঠেক খাওয়া বাস। থামা-নামায় চলে। এক্সপ্রেস ধরুন এক দমে পৌঁছে যাবেন। ঠেক খেলেও ঠিক চলে তো? মানে মাঝ পথে বেগড়বাই…? তিনি বলেন শুকুরের হাট আছে মৌলানায়। রয়ে সয়ে যাবে বই কী। মনে ভাবি সে মন্দ নয়। আমি যে মনফকিরা। ঘাটে ঘাটে জীবন বারি পান করি। অমৃত কুম্ভ উপুড় করে তৃষ্ণা নিবারণ। আমার পক্ষে ঠেক চালের বাহনটিই সঠিক। বাসের পিঠে খালাসির চাপড় পড়ে আর তার পেট ভরে। যাত্রী বেশিটাই হাটুরে।
এক সময় বাস ছাড়ল বারুদ ঠাসা হয়ে। তারপর দু’ধারে দৃশ্য এল গেল। সেই মাঠ, দাবাখানা, ছাপাখানা, লাইন হোটেল, গুমটি দোকান শেষে হাটে এসে ভিড়ল। রোড সাইডে মৌলানার খুচরো পাইকারি হাট। বেশ জোরালো জমায়েত। যাত্রী যত নামল ভরল বেশি। এবারে সঙ্গে জুড়ল বেগুন বস্তা, আলু, করলা। পাইকার সাউকার, আড়তদার, চা-বাগানের দফাদার সব মিলিয়ে চলা দায়। আবার খালাসির চাপড় এবং চলা। তবে ভরসা একটাই বাস যত চলে যাত্রী নামাও চলে। অবশেষে লাটাগুড়ি। অনেক যাত্রীর গন্তব্য এই জনপদ। নামি আমরাও এবং খোঁজ করি বন অফিসের।
লাটাগুড়ির রেঞ্জার স্বপন বোস নির্ভেজাল মানুষ। যেমন জানদার, মিতবাক তেমন কার্যকরী। আমাদের বসিয়ে গুটিকয় মোবাইল সেরে নিয়ে চায়ের অর্ডার পেশ করে বলেন, আপনাদের প্রোগ্রাম জেনে নিন। বলুন। এখনই গাড়ি আসছে। নেওড়া ক্যাম্প যাওয়ার আগে বেশ কটি স্পট ছুঁয়ে যাবেন। একটা বিট অফিসও ধরা আছে। তিন দিন আমার রেঞ্জে থাকা, তার মধ্যে সব দেখা। আপনার ফোন নম্বর দিয়ে রাখুন, যোগাযোগ করে নেব। আপনাকে যে সঙ্গে চাই। তিনি বলেন ঠিক সময়ে হাজির হব। তাছাড়া স্থানীয় ছেলেরা আছে, সঙ্গে গাড়ি থাকছে। কথার মাঝেই চা পর্ব শেষ এবং গাড়িওয়ালা এসে পড়েছে। সময় অমূল্য জেনে চটপট উঠে পড়ি।
আমাদের যাত্রায় বন গার্ড রানা সেন জুড়ে গেছেন। জঙ্গলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রানার দীর্ঘ দিনের। গাড়ি ছোটার আগে বলে রাখেন, ধূমপানের অভ্যাস থাকলে এখান থেকেই কেনাকাটা সেরে ফেলুন। জঙ্গলের ফাঁসে জড়িয়ে গেলে সহসা বেরতে পারবেন না। তাহলে নিত্যকার খাওয়াদাওয়া? নদীর ওপারে গ্রাম আছে বামনি, ওখানকার ছেলেরা এসে টুরিস্টদের পরিষেবা দেয়। এই লাটাগুড়ি থেকে র্যাশন নিয়ে যায়। লাটাগুড়ি বাজারে বসে আরও এক প্রস্থ চায়ের সঙ্গে এইসব গল্প চলে। আমি বলি তাহলে চলুন এবারে নির্বাসনে যাই। বলুন স্বেচ্ছা-নির্বাসন, আপনারা চেয়েছেন তাই এই আয়োজন রানাবাবু হাসেন। আমরা গাড়িতে উঠে বসি।
গাড়ির স্টিয়ারিং-এ কেশব রায়, বেশ পোক্ত চালক। সে উঠেই বলে, অ্যানিমেল সাইট হলে চেল্লাবেন না, ছবি তুলতে বাড়াবাড়ি করবেন না। এই সাত সকালে হাতি? সে বলে এ জঙ্গলে ওদের চলাফেরা হর হামেশাই। এখানে দিনরাতের ফারাক নেই। গাড়ি গরুমারা এলাকায় ঢুকছে। দু’ধারে ছমছম জঙ্গল, মাঝের সড়ক ন্যাশনাল থার্টিওয়ান। যেমন চওড়া তেমনই বন বাফেলোর পিঠের মতো মসৃণ। গতির কাঁটা সত্তর ছাপিয়ে আশীতে ঝুঁকছে। এ পথে সব গাড়িই ওই গতিবেগে ধাবিত। দু’পাশে সাঁই সাঁই কদম, কাটুস, ওদাল, লাটোর পিছলে যাচ্ছে। প্রতি গাছের বয়সের ভার যেমন, উচ্চতাও আকাশচুম্বি। কেশব বেমক্বা গাড়িকে বাগে এনে ফেলে। পিছনে আরও কতক গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। ডাউনে এসে দাঁড়িয়েছে গাড়ি। সামনে অনেকটা পথ ফাঁকা। কী হল কেশবসাহেব? ওই যা বলছিলাম। ভিআইপি বেরচ্ছেন জঙ্গল থেকে। তুমি বুঝলে কেমন করে? সিক্সস্থ সেন্সের টাওয়ার থেকে। কে ভিআইপি-টি? দেখি এক মাস্তান হাতি দলকে আগলে নিয়ে রোড ক্রস করছে। কুচো, ধাড়ি ধরে ঊনিশটার হার্ড বেপরোয়া চালে চলে। একেই বলে বুঝি গজেন্দ্র গমন। রানাবাবুকে বলি যাত্রার শুরুতেই গজ দর্শন শুভ না অশুভ? তিনি মুচকি হেসে বলেন, গজ দূরে হলে শুভ, স্বস্তি। নিকট হলেই কিন্তু জীবন নাস্তি।
বাঁদিকের জঙ্গল ধরল গাড়ি। পথ কাঁচা, সরু। জঙ্গল সরে এসেছে কাছে বেশ ঘন হয়ে। তারপর পাশে এক জলাশয়। এরই নাম মহাকাল। কেশব গাড়ি থামিয়ে বলে এবারে ব্রেকফাস্ট সেরে ফেলুন। জলাশয়ের পাশে বসে দেখি জঙ্গলকে জড়িয়ে ধরে জলাশয়টি গভীর অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কেশব পুরুণ্ডি পাতায় সাজিয়ে দেয় কালাকাঁদ সন্দেশ, ছানার বল প্রমাণ সাইজের। জঙ্গলের চোরবাটায় বসে একদিকে প্রাণভয় অপরদিকে প্রাতরাশ। চেয়ে দেখি ওই অাঁধারে কোনও হানাদার পাই কী না।
এদিকে হাতির বাড়াবাড়ি আছে। সুতরাং সময় বেশি দেওয়া চলে না। রানাবাবুর নির্দেশে গাড়িতে উঠে বসি। তিনি বলেন জঙ্গলটা ভালো করে দেখতেই এই দিকটা আসা, নইলে লাটাগুড়ি থেকে নেওড়ার সহজ পথও আছে। বসন্তের জঙ্গল নির্বিকল্প ভাব ধরে আছে। দীর্ঘায়ু মহীরুহ। কোনওটা লসুনি, রানিচাপ, জারুল, চিকরাশি। কী তাদের বৈভব! চৈত্রের সকাল কুয়াশা ছিঁড়ে স্পষ্ট হচ্ছে। প্রাণের মাঝে সুর জাগছে। আনন্দের ভেরি বাজছে বুকের মাঝে– ‘এই তো তোমার প্রেম ওগো হূদয় হরণ…।’ গাছে কচি পাতা লেগেছে। বনপথে ঝরে আছে ধূসর পত্ররাজি। বাতাসের টানে পাতা ওড়ে, পাতা পড়ে। কথাকলি মুদ্রায় গাছের কোরিওগ্রাফ। ফুটে আছে কাটুস ফুল, ঝরছে ওদাল ফল। কচি পাতার পিপ-হোল দিয়ে সোনা রং আলোর ফোয়ারা, রোগা পথে ছড়িয়ে আছে। মন গেয়ে ওঠে– ‘এই যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরণ…।’ শম্বুক গতি ধরে গাড়ি চলে অাঁকাবাঁকা পথের নির্দেশ মেনে। মন চলে আরও ধীরে। সেই অরণ্যের হাতায় দেখি এক বিট অফিস। রানা বলেন চলুন এক সঙ্গে দুটি কাজ সেরে যাই। দুটি কাজ? তিনি হেসে বলেন, বিটবাবুটির সঙ্গে আলাপ হবে, আবার চা-আড্ডাও হবে। খুবই লাগসই প্রস্তাব। গাড়ি ঢুকে পড়ে বড়োদিঘি বিট অফিসে।
বিটবাবু সুনীল চৌধুরী দরাজ প্রজাতির মানুষ। যেমন তাঁর পেটাই স্বাস্থ্য, তেমন চড়া ডেসিবেলের গলা। বাইরে চেয়ার পড়ল। সেখানে আড্ডায় বসে বলেন, আপনারা কোন পথে ঢুকলেন? রানাবাবু বলেন মহাকাল দিয়ে। একটা হার্ড ঘুরছে ওদিকে, দেখতে পেলেন? নাহ্ তো। বেঁচে গেছেন। খুব টাফ হার্ড। জঙ্গল ড্যামেজ করে বেড়াচ্ছে। আমি বলি সারাটা জীবন তো ওয়াইল্ড লাইফ ট্যাকল করলেন, আপনার লাইফ পার্টনারকে কীভাবে ট্যাকল করছেন। শুনেছি ‘বুনো’ স্বামীদের স্ত্রীরা খুব বেশি পছন্দ করেন না। তিনি উচ্চগ্রামে হেসে বলেন, ভেরি হার্ড কোয়েশ্চেন। এক কথায় বলি বউকে বাগ মানানো বাইসনকে বাগে আনার থেকেও দুরূহ কাজ। মেজাজে উভয়ই রাফ অ্যান্ড টাফ। কিছু ঘরণী এমনই পদার্থ, সামান্য মতান্তরেই উচ্চ আদালতে পৌঁছে যাবেন। তারপর মহামান্য বিচারপতি শ্বশুরমশায় সমন ধরাবেন এজলাসে হাজির হতে। তাহলে আপনাদের জীবন জোড়া ফলায়? ঘরে-বাইরে জীবন আর জীবিকায় ব্যালেন্স করে একজন ফরেস্টারের চলা মশাই। আবার তাঁর ডেসিবেল ভাঙ্গা হাসি। এক প্রস্থ চা শেষ হয়ে দ্বিতীয় কাপ হাতে। সুনীল বলেন, সামনে বড়োদিঘি চা-বাগান দেখছেন, গাছের ছায়ায় চিতাবাঘের সংসার পাতা। রাতের ঝোঁকে গেরস্তর ছাগল-বাছুরে কোপ পড়ে। সুযোগ পেলে মানুষও। এই তো সেদিন এক ঝুল (দল) বাইসনের মুখে পড়ে গেলাম। আচমকা জঙ্গল ফুঁড়ে বেরিয়ে এল। বাইকটা কোনও মতে বাগে এনে পালাতে গিয়ে দেখি আরও একটা পথ আগলে দাঁড়ান। অর্থাৎ সামনে পিছনে যমরাজের হাতে ডেথ ওয়ারেন্ট। মাথা কাজ করে না। মনে পড়ল ওরা একবগ্গা হলেও স্বভাবে ভীতু। জোরে হর্ন বাজিয়ে দিলাম। দামাল বাইসনটা পথ ছেড়ে বনের পথে ধাঁ হয়ে গেল। ওর ছোটার ভঙ্গিতে মনে ভয়ও হল। হার্ট অ্যাটাক না হয়ে যায় বেচারার। ওদের হূদযন্ত্র বড়োই দুর্বল। একটা ওয়াইল্ড লাইফ ইনজুরি মানে আপনাদের টিভিতে ব্রেকিং নিউজ, তারপরই শিকড় ধরে টান। ঘরের মানুষটি জানেন এসব কথা? একেবারেই না। ওই যে বলছিলাম, ব্যালেন্স করে চলা। জানলে? সম্পর্ক নট হয়ে যাবে। সুনীল হোঃ হোঃ হাসেন। মৌরসি আড্ডা মাঝ পথে ভেঙ্গে দিয়ে আমরা উঠে পড়ি।
নতুন এই পর্যটন কেন্দ্রের আত্মপ্রকাশ তদানীন্তন বনমন্ত্রী অনন্ত রায়ের হাতে। জন্মলগ্ন থেকেই জনপ্রিয়তায় নেওড়া জঙ্গল ক্যাম্পের এগিয়ে চলার গল্প। উঁচু টাওয়ারে বসে রেঞ্জার বলছিলেন সাফল্য কেন আসবে না বলুন? গরুমারা জঙ্গলের ঢেউ এদিকেও এসে পড়েছে। তার সঙ্গে ফ্রেমে জুড়েছে নেওড়া নদী। ফলে জল-জঙ্গলের টানে মানুষ ছুটছে নেওড়া জঙ্গল ক্যাম্প। সঙ্গে ফ্রি গিফ্ট নৈঃশব্দ। বসে থাকি বসন্তের মুখচোরা সকালে। পাশের জঙ্গল রচিত হয়েছে চাপ, চিলৌনি, কুটমেরু, পাকা সাজের সাজে। গাছ ভরে আছে টাটারি ফুলে। সোনার পালিশ গুচ্ছ ফল। ঝুলে আছে লাল ভেলভেট ওদাল ফল। রাতের ঝোঁকে হরিণ আসে নিঃশব্দে, লাটোর ফলের লোভে। খরকি ঘাসের টানে। হাতি আসে পুরুণ্ডি খেতে। বাইসন এসে দাঁড়ায় সল্ট লিকের পাশে। ফলে রাত নামলে টুরিস্টের টহলে রাশ টানতে হয়। এদিকে বাতাসের টানে ঝরে চিকরাশি ফুল। বেগুনি শটি ফুলের মাথায় ময়না উড়ছে। টিয়ার ঝাঁক বসেছে জারুলের ডালে। আমরা উঠে নদীর কাছে যাই। সে বাঁকে বাঁকে ওই দূরে হারিয়েছে কোন ফাঁকে। নদীর ওপারে ওঁরাও গ্রাম বামনি। নদীর বুকে পা ফেলে মেয়েরা আসছে এদিকে। ঘন কালো মেঘ-রং মেয়েরা জল পেরোয় আর হাসে। আমরা শুধাই চলেছ কোথায় তোমরা? চলেছি ওই বাংলায়। কেন? নাচ দেখাতে। পিছে সর্দার আসছে। সে বলল, বাংলায় বাবুরা আছে। নাচলে পয়সা মিলবে তাই…। এ যে বাদল না গর্জাতেই বরষণ! বলি আমরা সেই বাবু গো। নিসা নামের পিচ-রং মেয়েটি বলে দেখবে তো নাচ? কী নাচবে তোমরা? সারনা, বাগান নাচ (চা-বাগান) যা দেখবে। তোমাদের সঙ্গে বাজনা কোথায়? পিছনে দেখি মাদল, ধামসা, রেগড়া নিয়ে বেশ কতক যুবক। ওদের সঙ্গে নিয়ে উঠে আসি বাংলো প্রাঙ্গণে।
এই মেয়ের নাম বিফো কুজুর। তারপর চিলো তিরকি, জ্যোৎস্না কেরকেট্টা, চিন্তা কুজুর, কার্মি কচুয়া, যেন গুলদস্তায় তেরোটি ব্ল্যাক প্রিন্সের স্তবক। তাদের যেমন মাজা রং, তাজা যৌবন, খোঁপায় ঝুটা ফুল, কানে গিল্টি দুল, মুখে হাসি, চোখে লাজ। রেগড়া বাজল বেদা টপনোর হাতে। বুতরুর হাতে বাজল মাদল। মেয়েরা ধরে নিল সংঘ নাচ। তেরোটা কেঁদ গাছের চারা যেন চৈত্রের বাতাসে আন্দোলিত হয়। নাচের আসরে ঝরে লসুনি ফুল। ওদিকে গানে গলা দিয়েছে নিমা– ‘হাপপা হাপপা লাফা শাক চেল নদীর পানিযদহলা বাড়ির পুঁটি মাছ রসুন তুলানি।’ মাদল বাজে দমকে। ফুলে ফুলে সৌরভে যুবতি অরণ্য দিশাহারা। তার মাঝে ওঁরাও মেয়ের সারনা নাচ জুড়ে গেছে। আমাদের সে এক সসেমিরা দশা। দীর্ঘ নাচের পরে মেয়েরা বিশ্রামে বসেছে। তাদের শরীর ধরে নামছে স্বেদ ঝরনা। প্রশ্বাসে ভরা চাঁদের ওঠাপড়া। নাকে ঝুটা পাথরের চমক। বিফার ভ্রূ জোড়ায় পাখির উড়ান। চোখে চোখে সম্পর্ক হতেই সে শরমে নুয়ে পড়ে। আমি চিবুক তুলে দেখি এক প্রদীপ শিখার কাঁপন। সে চাহনি ভগ্ন দেবালয়ের নিঃস্ব দেবতারও নিদ্রাভ্রষ্ট করে ছাড়ে। বিজলী নামের মেয়েটি বলে ও বাগিচায় সর্দারের দলে ‘পাতা টিপে’। আমি মনে মনে একটি কাওলা ফুলের নম্র ঘ্রাণ নিই। মৃদু গলায় বলি তুমি বিফো কুজর? জি। কোন বাগানে কাজ করো? ছাওয়াফুলি চা-বাগানে। বাবা কী করে? অই বাগানের সর্দার। লক্ষ্নণ তাড়া দেয় এবারে ঘর যাব। ঘর মানে নদীর ওপারে সেই গাঁ-খানা। বেলা বাড়ছে। ওদের ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়ি আমরাও। ওরা দ্রুত পায়ে নেমে যায় নদীতে। দূরে দেখি হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে ফিরে ফিরে হাত নাড়ে বামনি গাঁয়ের এক ঝাঁক কালো পরি। আমি বলি, বিদায় হে সুন্দর!
বিকেলের মুখটায় নেওড়া ক্যাম্পের মাতব্বর বন্ধন ওঁরাওকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে পা চালাই। সে ঘর থেকে একখানা মজবুত লাঠি নিয়ে আসে। জানোয়ারকে বাগে আনতে লাঠিতে কাজ হবে? সে বলে বুনোকে সামনা করতে দুটো জিনিস প্রয়োজন, বুকে বল আর কৌশল। কিছুটা এগিয়ে টের পাই সত্যিই এক ওজনদার জঙ্গলে ঢুকছি। যত হাঁটি ততই তার টান, আমাদেরও ওষ্ঠাগত প্রাণ। প্রতি পদে ময়ূর দম্পতির বনকেলি চলে। এই সময়টা ওদের ‘মেটিং টাইম’। জঙ্গলের অবরোধ থেকে বেরিয়ে বনের শাখা পথে এসে, পেখম মেলে পুরুষটি নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে বীর্য স্খলন করে। স্ত্রী-টি তাকে প্রদক্ষিণ করে আর স্খলিত বীর্য খুঁটে নেয়। কোন অভিশাপে নারীটি তার পুুরুষের তপ্ত শরীরের সুখ পায় না জানি না। প্রকৃতপক্ষে মযূরের ঝাঁক ঠেলে সরিয়ে আমরা এগোতে থাকি। চৈত্র বনের এমনই দস্তুর, সে পান্থজনকে ক্ষান্তি দেয় না। ক্লান্ত হলেও অবিরাম ফুঁসলে নিয়ে চলে অগাধ বনে। সেই চলার রাশ টেনে ধরে বন্ধন। বলে কতটা পথ এলেন তো? এ সফর কি ওজন করে হয় ভাই? আমাদের বেশ পথ পেরোনো হল। চলুন এবারে ভাঁটির টানে যাই। চলো ফেরা যাক।
সন্ধ্যার মুখটায় আকাশের প্রান্তে এসে থম ধরল ভরা চাঁদ। আমরা টাওয়ারে বসে দেখি চাঁদ-মারি খেলা। কখনও সে আকাশের পট, কখনও সে কেপমারি হয়ে যায় মেঘের পকেটে। সামনে কামার্ত নদী পোড়ে তার নরম আগুনে। চাতকের দল আকাশের প্রাঙ্গণে ঘুরে ঘুরে ডাকে টিট্টি-হা। বামনি গাঁয়ে দমকচ নাচের বাজনা শোনা যায়। ডানদিকের বনে চাকা চাকা আলো-ছায়া দাগে ময়াল শুয়ে থাকে। শোনা যায় হাতির বৃংহন। ঝরে লাটোর ফল টুপটাপ। আমরা বসে দেখি নাইট অপেরা। বন্ধন পাশে এসে বলে, আজ অপারেশন শুরু হবে স্যার। কার? শুনছেন না? বড়োদিঘির জঙ্গলে ওরা নেমে পড়েছে। আমরা আরও তীক্ষ্ন হয়ে বসি দৃষ্টিকে ক্ষুরধার করে। চারিদিক সুনসান। কেবল রাতপোকা ডেকে চলে ক্রিং ক্রিং। ঝপঝপ ডানা ঝাপটে উড়ে গেল রাতপাখি শিকার সন্ধানে। নেওড়ার মুক্ত ট্রেজারি ভিজতে থাকে ঝমঝম জ্যোৎস্নায়। আমাদেরও সর্বস্ব ভিজে যায় চন্দ্র প্রপাতে।
প্রয়োজনীয় তথ্যঃ হাওড়া অথবা শিয়ালদহ থেকে কামরূপ এক্সপ্রেস কিংবা তিস্তা তোর্সায় পরদিন সকালে ময়নাগুড়ি স্টেশনে নেমে রুটের বাসে অথবা ভাড়া গাড়িতে লাটাগুড়িতে নেমে মোটরে নেওড়া জঙ্গল ক্যাম্প পাঁচ কিমির মধ্যে। জঙ্গল সফরের জন্যে লাটাগুড়ি থেকে গাড়ি নেবেন। কটেজ বুকিংয়ের জন্যে লিখুন – ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার, জলপাইগুড়ি ডিভিশন। ডাক ও জেলা – জলপাইগুড়ি।
এখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় ছেলেরা। তিনটি কটেজ, যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্য-সহ থাকার জন্য আদর্শ। শ্বাপদসংকুল অরণ্য, সংযমের রাশ আলগা হলে বিপদ ঘটতে পারে। সঙ্গে মশার দাওয়াই চাই।