ময়নাগুড়ি স্টেশনে নেমেছি ভোরের ট্রেনে। তারপর রিকশায় বাস স্ট্যান্ড। এইটুকু পথে বৈচিত্র্য তেমন নেই। শুধু জেলা বদলের পার্থক্য কিছু নজরে পড়ে। দু’ধারে ছড়ানো ইট-কোঠা, টুকরো বাগিচা, স্কুলবাড়ি, খোলা মাঠ। নতুন পরিবেশে চলতে গিয়ে চোখ লুটে নেয় এটুকুও। রিকশাওয়ালা হরিনাথ দাস স্থানিক ব্যক্তি। সে প্যাডেল ঠেলে আর গল্প বলে– এই দেশটায় স্যার বেঘোর জঙ্গল ছিল এক সময়। বড়ো বড়ো ময়না গাছ করাত-সাফা হয়ে গেল! তুমি দেখেছ সে জঙ্গল? শুনেছি, দাদামশায়ের মুখে। এখন দ্যাখেন ময়না উড়ে গিয়ে মানুষ এসে বসল। তার হাঁসফাঁসের সঙ্গে হতাশাও টের পাই। আমি বলি এ সবই যুগধর্ম হরিনাথ। কিছুই এক ঠাঁই-এ থাকে না। সবই আসা যাওয়ার তামাশা। ময়না কেটে বসত হল। হরিনাথ জীবনের রসম জানে। সে বলে, ঠিক বলেছেন। মানুষ, দেশ-কাল-পরিবেশ জুড়লেন, গড়লেন, মানুষই তাকে ভাঙলেন।
পথের বাঁক ফিরতেই বাজার পাড়া এসে পড়ল। চওড়া সড়ক ধরে ছোটো-মাঝারি বাস দাঁড়িয়ে। হল্লা করে ডাক দেয় খালাসি– চালসা, লা-টা-গু-ড়ি...। আমাদের যাত্রা ওই পথের দিশায়। উঠে বসেছি একটি ফাঁকা মিডি বাসে। পাশের যাত্রীটি বলেন, যাবেন কতদূর? লাটাগুড়ি। যাওয়ার তাড়া আছে? তা একটু...। তা হলে এটায় উঠলেন কেন? কেন? এটা ঠেক খাওয়া বাস। থামা-নামায় চলে। এক্সপ্রেস ধরুন এক দমে পৌঁছে যাবেন। ঠেক খেলেও ঠিক চলে তো? মানে মাঝ পথে বেগড়বাই...? তিনি বলেন শুকুরের হাট আছে মৌলানায়। রয়ে সয়ে যাবে বই কী। মনে ভাবি সে মন্দ নয়। আমি যে মনফকিরা। ঘাটে ঘাটে জীবন বারি পান করি। অমৃত কুম্ভ উপুড় করে তৃষ্ণা নিবারণ। আমার পক্ষে ঠেক চালের বাহনটিই সঠিক। বাসের পিঠে খালাসির চাপড় পড়ে আর তার পেট ভরে। যাত্রী বেশিটাই হাটুরে।
এক সময় বাস ছাড়ল বারুদ ঠাসা হয়ে। তারপর দু’ধারে দৃশ্য এল গেল। সেই মাঠ, দাবাখানা, ছাপাখানা, লাইন হোটেল, গুমটি দোকান শেষে হাটে এসে ভিড়ল। রোড সাইডে মৌলানার খুচরো পাইকারি হাট। বেশ জোরালো জমায়েত। যাত্রী যত নামল ভরল বেশি। এবারে সঙ্গে জুড়ল বেগুন বস্তা, আলু, করলা। পাইকার সাউকার, আড়তদার, চা-বাগানের দফাদার সব মিলিয়ে চলা দায়। আবার খালাসির চাপড় এবং চলা। তবে ভরসা একটাই বাস যত চলে যাত্রী নামাও চলে। অবশেষে লাটাগুড়ি। অনেক যাত্রীর গন্তব্য এই জনপদ। নামি আমরাও এবং খোঁজ করি বন অফিসের।