পৃথিবী বদলাচ্ছে। উষ্ণায়নের প্রভাবে অস্তিত্ব সঙ্কট। সঙ্কটে পরিবারতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজও। উষ্ণায়ন নয়, সম্পর্কের বন্ধনে কিন্তু শীতলতার ছোঁয়া। আবেগের পরিবর্তে, হূদয়ে জায়গা নিয়েছে পশ্চিমি হিসেব কষা লাইফস্টাইল। আমি, আমার পরিবার ও সন্তানের গণ্ডিতে ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্কগুলি। ভেঙে যাচ্ছে ভারতীয় সমাজব্যবস্থার মেরুদণ্ড, যৌথ পরিবারের প্রাচীন ভিতটাই।

কাকা-জ্যাঠা, দাদা-ভাইদের নিয়ে ভরা পরিবারের চিত্রটা কার্যত উধাও। পরিবর্তে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির নতুন ট্রেন্ড। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে, সন্তানদের আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের তীব্র আকাঙ্খার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে যৌথ পরিবার, সবার সঙ্গে সুখ-দুঃখ, আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা।

পরিবর্তনের এই পালাবদলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুমন ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। সবার মাঝে বেড়ে ওঠার সুযোগ হারিয়ে চার দেয়ালে বন্দি হচ্ছে শৈশব। সবচেয়ে করুণ অবস্থা বয়স্ক পিতা-মাতার। সারাজীবন যৌথ পরিবারে কাটিয়ে দেওয়ার পর, শেষ বয়সে Old age সন্তানদের নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে মানিয়ে নেওয়া বড়ো কঠিন। দাদা-ভাই, কাকা-জ্যাঠার ভরাট সংসার থেকে চার দেয়ালে আটকে পড়া, হঠাৎই যেন পৃথিবীটা বদলে দেয়।

সন্তানদের হয়তো পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। আর্থিক সুরক্ষা, স্ট্যাটাস বজায়ের ইঁদুরদৌড়ে সামিল সন্তানেরা সারাদিন দৌড়োচ্ছে। হাতে সময় নেই বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য। সকাল-সন্ধ্যা কর্মব্যস্ততার মাঝে গুড-মর্নিং, গুড-নাইটেই সম্পর্কের বাঁধন ঝুলে থাকে। ফলে ফিকে হচ্ছে হূদয়ের যোগ। প্রাধান্য পাচ্ছে মস্তিষ্ক। হিসেব কষে পা ফেলার মানসিকতার সামনে আবেগ, ভালোবাসাগুলি যেন পরিযায়ী পাখি।

সুকল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই ধরুন। কর্মজীবনে আইনজীবী হিসেবে সুখ্যাতি ছিল। বন্ধুবান্ধব, মক্বেলদের নিয়ে দিব্যি সময় কেটে যেত। কিন্তু বয়সের ভারে এখন অনেকটা ন্যুব্জ। মফসসল ছেড়ে শহরে প্রতিষ্ঠিত ছেলের কাছে চলে এসেছেন শেষ জীবনটা কাটাতে। নতুন শহর, নতুন পরিবেশ। শুরুর কয়েকটা দিন বেশ ভালো কাটছিল। কিন্তু তারপর ঘিরে ধরল একাকিত্ব। অনেকে পরামর্শ দেন প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করার। যদিও বাড়িওয়ালার নিয়মের জাঁতাকলে সে উপায় নেই। ভাড়া বাড়িতে ব্যাবসা ফেঁদে বসা মানা।

মধ্য সত্তরের পরেশবাবুর হালও একইরকম। মহকুমা শহরে জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই কাটিয়েছেন। একডাকে সবাই চিনত। শরীর খারাপ হলে ডাক্তার বন্ধু বাড়িতে এসে দেখে যেতেন। কাঁধে হাত রেখে ভরসা জোগাতেন। সময়ে সময়ে সমবয়সি পড়শিরা বসে যেতেন চায়ের আড্ডায়। কিন্তু শহরে একদম উলটো। চাকুরিজীবী মেয়ে সারাদিনই ব্যস্ত কাজ নিয়ে। সপ্তাহে একটা দিন ছুটি। মেয়েকে বলতে অস্বস্তি হয়। অথচ, কারওর সাহায্য ছাড়া অচেনা রাস্তায় বেরোতে সাহস পান না। অগত্যা বন্দিজীবন। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির সাইড এফেক্ট।

বৃদ্ধ বাবা-মার প্রতি যত্নশীল হওয়া ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। সামাজিক পরিকাঠামোর পটপরিবর্তনে বৃদ্ধ Old age পিতা-মাতারা বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সন্তানদের কাছে। ললিতা-মনোহর এখন দুঃখ করেন গ্রাম ছেড়ে শহরে থাকা ছেলের কাছে চলে আসার জন্য। ছেলে মোহিত সারাদিন অফিসে ব্যস্ত। রাতে ফিরেও ফুরসত নেই। রয়েছে বিভিন্ন প্রোজেক্টের কাজ। এমনকী সময়ে-অসময়ে কর্মসূত্রে দীর্ঘদিনের জন্য বাইরে থাকতে হয় তাকে। তখন বাড়িতে শুধু দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। জরুরি কোনও সমস্যা হলে দেখার মতো কেউ নেই। চিকিৎসা থেকে দোকানবাজার, অচেনা শহরে সব নিজেদেরই সামলাতে হয়। ললিতার মতে, গ্রামে কিছু প্রয়োজন পড়লে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীরা দৌড়ে আসতেন। এখানে ঠিক তার উলটো। অনেকটা নিজভূমে পরবাসী। কারওর সময় নেই তাকিয়ে দেখার।

শহুরে লাইফস্টাইলও গ্রাম্য বৃদ্ধ পিতামাতার পক্ষে বেমানান। এরজন্য শুধুমাত্র সন্তানদের দোষ দেওয়া যায় না। বর্তমান জীবনযাত্রা অনেকবেশি জটিল ও সমস্যাসঙ্কুল। যার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ছোটো ছোটো অনুভূতিগুলি হারিয়ে যাচ্ছে। সময় কমছে নিজের এবং পরিবারের জন্য।

একাকিত্ব, নিঃসঙ্গ এই জীবন থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজে নিতে হবে নিজেদেরই। নিজের হবিগুলিতে নতুন করে ডুব দিন। কী করতে ভালোবাসেন, কী নয়, তা নিয়ে একটা পরিকল্পনা ছকে নিন। ভালোলাগার বিষয়গুলিতে বেশি করে সময় দিন। নতুন বন্ধু তৈরি করুন। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখুন। দেখবেন, একঘেয়ে জীবনে অনেকটা প্রাণ ফিরে এসেছে।

বৃদ্ধ পিতা-মাতার একাকিত্ব নিয়ে বেশ কিছু সংগঠনও তৈরি হয়েছে বিদেশে। সংগঠনের সদস্যরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, জানতে চান তাদের সমস্যার কথা। বেঙ্গালুরুর মতো শহরগুলিতে পুলিশ বিশেষ গ্রুপ তৈরি করেছে, বৃদ্ধ পিতা-মাতাদের প্রতি নজরদারির জন্য। বৃহত্তর ভাবে এই উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে নব্য যুবাদেরও যুক্ত করতে হবে। পুরোটাই হতে পারে পেশাদারিত্বের মোড়কে। নিঃসঙ্গ প্রবীণদের মেডিকেল চেক-আপ, ট্রিটমেন্ট থেকে তাদের সময় দেওয়া –পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এই কাজে যুক্ত হতেই পারেন বেকার যুবকেরা। অসহায় বয়স্করা সাহায্য পাবেন, নিশ্চিন্ত হবেন বাইরে থাকা সন্তানরা, একই সঙ্গে আরও একটা আয়ের রাস্তা খুলে যাবে বেকারদেরও। অনেকটা কেয়ারটেকারের একটু অন্যরকম রূপ। কলকাতা পুলিশের উদ্যোগে প্রবীণদের নিঃসঙ্গতা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে ‘প্রণাম’। নানা পরিষেবা দান করে থাকে এই সংস্থা।

সন্তানদের করণীয় –

 রোহিত বিশ্বাস, এব্যাপারে দারুণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তুতোভাই, বন্ধুদের সঙ্গী করে এলাকার বয়স্কদের নিয়ে একটা গ্রুপ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন। গ্রুপের যুব সদস্যদের কাজই হল সময় সুযোগ মতো বয়স্কদের খোঁজখবর রাখা। ফলে ওই গ্রুপের কে কেমন আছেন, কার কী প্রয়োজন, তা সবসময় কেউ না কেউ খোঁজ নিতে পারছেন।

এছাড়াও প্রবীণদের নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া উচিত। পুরোনো আমলের বাড়ির বাইরের টয়লেটের কনসেপ্ট বদলে ঘরের মধ্যে পশ্চিমি ঘরানার টয়লেট দরকার। পর্যাপ্ত আলো এবং জলের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। নিরাপত্তার জন্য দরকার সঠিক গেট ও গ্রিলের ব্যবস্থা। মোবাইল ফোন হাতের সামনে থাকাটা জরুরি। একাকিত্বময় জীবনে ফোন হল বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম। আপৎকালীন প্রয়োজনে সাহায্য চাইতে পারবেন ফোনের মাধ্যমে। রয়েছে ইন্টারনেটও। বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে আধুনিক এই লাইফস্টাইলের সঙ্গে পরিচিত করে তুলুন।

বাবা-মায়ের মূল্যবোধকে সম্মান জানান –

 অনেকেরই ধারণা বয়স্কদের Old age-এ কোনও গোপনীয়তা বা নিজস্বতা থাকতে পারে না। ধারণাটা একদম ভুল। প্রতিটি মানুষেরই নিজস্বতা রয়েছে। এ নিয়ে শ্রদ্ধাশীল হওয়া দরকার। এছাড়া পুরোনো বাড়ি থেকে আনা বাবা-মায়ের জিনিসপত্রের স্থান যেন কখনওই বাড়ির গোডাউনে না হয়। খেয়াল রাখা দরকার বাড়ির দামি আসবাবপত্রের ভিড়ে তা যেন হারিয়ে না যায়।

বয়স্করাও আশা করেন সন্তানদের থেকে একটু যত্ন। মাঝেমধ্যে দু-চার দিনের জন্য বাবা-মাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন আউটিং-এ। ব্যস্ততার মাঝে তাদের একটু সময় দিলে তাদেরও খুব ভালো লাগবে।

সবকিছু ছাপিয়ে পারিবারিক শিক্ষা। সন্তানদের প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার ভারটা বাবা-মায়েদেরই। বড়োদের শ্রদ্ধা এবং তাদের নিজস্বতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষাটা দিতে হবে বাবা-মায়েদের। নাহলে বৃদ্ধ বয়সে অবহেলা, অশ্রদ্ধা এবং একাকিত্ব ছাড়া কিছুই জুটবে না।

চার দেয়ালের ঘেরাটোপে আটকে না থেকে, বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিজেদের যুক্ত করতে হবে। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা স্বাভাবিক ব্যাপার। সেক্ষেত্রে মেডিকেল ইনসিওরেন্স আবশ্যিক। নিজের সাধ ও প্রয়োজন অনুসারে কাছাকাছি কোনও ভালো হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা জরুরি।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...