মুন্নার বেড়ানো শেষ। এবার আমাদের সফরসূচি মাফিক পা বাড়ালাম পেরিয়ারের দিকে। গন্তব্য থেক্বাডি। ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফির নেশায় যারা এদিক-সেদিক ছুট দেন বা অ্যাডভেঞ্চারের আশায় নতুন নতুন স্পট খুঁজে বেড়ান– তাদের অবশ্য গন্তব্য পেরিয়ার।
মুন্নার থেকে রওনা দিয়ে পেরিয়ার টাইগার রিজার্ভে পৌঁছোতে বিকেল গড়াল। তাই সেদিন বিশ্রাম নেওয়ার আগে পরের দিনের অগ্রিম প্ল্যান-টা সাজিয়ে ফেললাম। পেরিয়ারে যারা বেড়াতে আসেন তাদের মোড়ক সফরে থাকে বোট-এ করে পেরিয়ার লেক-এ ভ্রমণ এবং একই সঙ্গে লেকের গা-ঘেঁষা জঙ্গলে বন্যপ্রাণ দেখার আনন্দ লাভ করা। অ্যাডভেঞ্চারাস মানসিকতার মানুষদের জন্য আছে ব্যাম্বু র্যাফটিং এবং জঙ্গুলে পথে নেচার ওয়াক। আমরা পরদিনের প্রোগ্রামে প্রথমে বোট রাইড ও পরবর্তী সময়ের জন্য নেচার ওয়াক-কেই বেছে নিলাম।
ব্যাম্বু র্যাফর্টিং সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে। তিন ঘণ্টা র্যাফর্টিং ও পরবর্তী তিন ঘণ্টা নেচার ওয়াক, এই প্যাকেজ-টির অন্তর্গত। সঙ্গে থাকে খাওয়াদাওয়ারও ব্যবস্থা। আর দেরি না করে কেরলের অপূর্ব রান্নার স্বাদ নিলাম ডিনারে। ফিশ কারি আর চিকেনের একটি পদ। তারপর সোজা ঘুমের দেশে পাড়ি।
পরদিন ভোর পাঁচটায় আমরা প্রস্তুত হয়ে পৌঁছে গেলাম টাইগার রিজার্ভ-এর গেটে। আরও অনেক গাড়িই গেটের বাইরে অপেক্ষমান। জঙ্গলের গেট পেরিয়ে আরও কিলোমিটার দুয়েক গেলে জেটি থেকে বোটে ওঠার টিকিট কাটতে হয়। পেরিয়ার টাইগার রিজার্ভ-এর ওয়েবসাইট থেকেই প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম আমরা।
বোটের উপরের ডেক-এর টিকিট আমাদের পছন্দ ছিল, কারণ উপর থেকে জঙ্গলের ভিতরের পশুপাখি দেখার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের ভাগ্যও সুপ্রসন্ন ছিল। তাই বোট চলতে শুরু করতেই প্রথমেই দেখা মিলল কিছু সম্বর, গউর আর বন্য শূকরের। প্রচুর পাখির দেখা পেলাম। সারস, মাছরাঙা, করমোর্যান্ট প্রভৃতি। কুয়াশার ঘন চাদরে গোটা বনাঞ্চল ঢাকা পড়ে থাকায় এক অদ্ভূত রহস্যময়তা অনুভব করছিলাম। জল কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে বোট আর এক অজানা শিহরণ নিয়ে আমরা চোখ রাখছি জঙ্গলের দিকে। নৌ-সফরের শেষে জেটি-তে থামতেই আমাদের প্রাতরাশ দেওয়া হল।
এবার নেচারওয়াক-এর পালা। প্রতিটি দলের সঙ্গে একজন করে ট্রেন্ড গাইড দেওয়া হয়। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতে হয়। আমাদের গাইড জঙ্গলে প্রবেশ করার সময়ই নানারকম তথ্য দিলেন জঙ্গল সম্পর্কে। বহুরকমের গাছপালা, পাখি চেনালেন, পশুদের হ্যাবিট্যাট সংক্রান্ত নানা বিষয় জানালেন। তবে এই জঙ্গলের সেরা আকর্ষণটি হল বিশালাকার বিশেষ কাঠবেড়ালি, যার নাম দ্য জায়ান্ট মালাবার স্কুইরেল। গাছের সঙ্গে এমনভাবে রং মিলিয়ে মিশে থাকে, যে অনভিজ্ঞ চোখে চট করে ধরা পড়ে না। তবে এটির রং আদতে কিন্তু বেশ উজ্জ্বল, শুধু সজাগ দৃষ্টি থাকলেই তার দেখা মেলে। প্রায় ঘণ্টা তিনেক ট্রেক-এর পর পরিপূর্ণ মনে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।
সে রাতেই আমাদের সেরা অ্যাডভেঞ্চারের পালা। নাইট সাফারি। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে অগ্রিম পারমিট সংগ্রহ করা ছিল। মোট তিনটি স্লটে হয় এই নৈশ জঙ্গল ভ্রমণ। সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১০টা, ১০টা থেকে ১টা এবং রাত ১টা থেকে ভোর ৪টে। প্রতিটি স্লটে পাঁচজন করে পর্যটক যেতে পারেন। সঙ্গে তিনজন বনরক্ষী, একজনের হাতে টর্চ অন্য দুজনের হাতে বন্দুক। রাতের জঙ্গলকে চেনার এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। ১০০০ টাকা করে জমা দিতে হয় এই সফরের জন্য এবং জঙ্গলে ঢোকার আগে এরা দেন একটি খাকি পাজামা ও হাই বুটস। প্রতি দুজনের জন্য একটি করে টর্চও দেন বনদফতর। চন্দন বনের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে সম্বর, কোটরা, হরিণ দেখা ছাড়াও, এক দুর্লভ অভিজ্ঞতার শরিক হলাম আমরা। ফুট দশেক দূরে দাঁড়ানো একপাল হাতি। গাইড বেশিক্ষণ ওখানে দাঁড়ানো উচিত নয় বললেন। বেরিয়ে এলাম জঙ্গল ছেড়ে কিন্তু সারা জীবন হূদয়ে থেকে যাবে পেরিয়ারের এই অমূল্য Travelogue অভিজ্ঞতা।