মৌর্য শাসক অশোকের রোষানলে পড়ার ভয়ে দলে দলে ভগবান বুদ্ধের অনুগামী হয়ে যাওয়া, ভারতের ইতিহাসের এক অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য পর্যায়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হয়ে পড়ার পর সম্রাট অশোক যেসব স্থানে এই ধর্মের সবচেয়ে বেশি প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন, তার মধ্যে সাঁচি অবশ্যই অন্যতম।

ভোপালবিদিশার অন্তর্গত রায়সেন জেলার ছোট্ট শহরে বিশ্ববিখ্যাত সাঁচি স্তূপ আজও শান্তির বার্তাবাহক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রত্যেক বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পর্যটক এবং ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীরা এই অনন্য স্থাপত্যকীর্তি দেখতে আসেন।

পশ্চিম-মধ্য রেলওয়ের দ্রুত গতির ট্রেন সাঁচি পৌঁছোতেই পর্যটকদের নজর কেড়ে নেয় সাঁচি স্তূপ।

উজ্জয়িনীর শাসক অশোক তাঁর শেষজীবন, বৌদ্ধধর্মতেই সমর্পণ করেছিলেন। তাঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল বিদিশায়। জায়গাটি সাঁচি থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে। সম্রাট অশোক তাঁর ছেলে মহেন্দ্র ও কন্যা সঙঘমিত্রাকেও বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। কথিত আছে, এই ধর্মের প্রচারের স্বার্থে মহেন্দ্র ও সঙঘমিত্রাকে তিনি শ্রীলঙ্কায় পাঠিয়ে দেন।

বৌদ্ধধর্মের মূল কথা শান্তি। শান্তিস্থাপনে সম্রাট অশোক যে কতখানি ‘কড়া’ মনোভাবাপন্ন ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাঁচির শিলালিপিগুলিতে। সাঁচির এমনই একটি শিলাখন্ডে সম্রাট অশোকের সতর্কবার্তায় লেখা হয়েছে, বৌদ্ধধর্মে ফাটল কিংবা বৈষম্য সৃষ্টি করলে শাস্তি পেতে হবে।

এহেন ঐতিহাসিক সাঁচি স্তূপ স্থাপত্যকলারও এক অনুপম দৃষ্টান্ত। প্রথম স্তূপটি এ দেশে স্থাপত্যবিদ্যার এক অনন্য নিদর্শন। স্তূপটি প্রস্থে ৩৬.৫ মিটার। উচ্চতা ১৬.৪ মিটার। শীর্ষে অর্ধগোলাকার গম্বুজাকৃতির ছাদ। যা দেখে নির্মাণকর্মীদের দক্ষতা ও প্রযুক্তি-জ্ঞান সম্পর্কে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসবেই। গম্বুজটিকে পেঁচিয়ে একটি সরু পথও রয়েছে।

পাহাড়ের একেবারে ধারে রয়েছে সাঁচির দ্বিতীয় স্তূপটি। প্রথম স্তূপটির সঙ্গে এর গঠনগত মিল রয়েছে। সম্রাট অশোক মোট আটটি স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন সাঁচিতে। তার মধ্যে মাত্র তিনটে অবশিষ্ট রয়েছে এখন।

সাঁচির তৃতীয় স্তূপটি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। বুদ্ধদেবের প্রিয়তম দুই শিষ্য, সারিপুত্ত এবং মহামোদগলায়নের অস্থি এখানে রয়েছে। প্রত্যেক বছর নভেম্বর মাসের শেষ রবিবারে এই অস্থি সর্বসাধারণের দর্শনের জন্য রাখা হয়। ওই দিন বিরাট মেলা বসে সাঁচিতে। কয়েক হাজার বৌদ্ধমতাবলম্বী যোগ দেন এই মেলায়।

প্রথম স্তূপের চারদিকে চারটি তোরণ রয়েছে। তোরণের সর্বাঙ্গে বুদ্ধের জীবন ও দর্শন, ছবি এঁকে বোঝানো হয়েছে। পদ্মফুল বুদ্ধের জন্মের, বৃক্ষ জ্ঞানের, চক্র বুদ্ধদেবের প্রথম উপদেশ এবং পদচিহ্ন তাঁর অস্তিত্বের প্রতীক বলে মনে করা হয়।

প্রথম স্তূপটির দক্ষিণ দিকের তোরণদ্বারের কাছেই রয়েছে সাঁচির অন্য এক দর্শনীয় বিষয়, অশোক স্তম্ভ। অশোক স্তম্ভের গায়ে অনন্য শিল্পকীর্তি পর্যটকদের দৃষ্টি সহজেই আকর্ষিত করে।

সাঁচি স্তূপ দেখতে গিয়ে, ‘মহাপাত্র’ না দেখে ফেরা যাবে না। কথিত আছে, তৃতীয় স্তূপে পাথরের তৈরি বিশালাকার এই পাত্রটিতে এককালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভিক্ষালব্ধ খাদ্যসামগ্রী জমিয়ে রাখা হতো।

সাঁচি স্তূপের আর-এক আকর্ষণ, স্তূপের নীচে অবস্থিত মিউজিয়াম। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক বস্তু সেখানে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।

সাঁচি স্তূপ দেখতে গেলে সমস্যা একটাই। ছোটো শহর হওয়ার জন্য থাকা-খাওয়ার অসুবিধা রয়েছে। কোনও ভালো হোটেল পাবেন না। রেস্তোরাঁও নেই তেমন। সম্ভবত সেইজন্যেই পর্যটকরা ভোপালে থাকেন। সারাদিন সাঁচি দেখে, সন্ধেয় ভোপালে ফিরে আসেন। এমনিতেই সাঁচি পুরোটা ঘুরে দেখার জন্য চারঘণ্টা সময় যথেষ্ট।

বছরের যে-কোনও সময়ই সাঁচিতে ঘুরে আসতে পারেন। তবে, সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল, এই সময়টা পরিবেশ মনোরম থাকে।

সাঁচির সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর এবং রেলস্টেশন ভোপাল। সাঁচি থেকে দূরত্ব মাত্র ৪৫ কিলোমিটার। দেশের সমস্ত বড়ো শহরের সঙ্গে ভোপালের রেলপথে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। ভোপালে নেমে সড়কপথেও সাঁচিতে আসা যায়। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বাস পাবেন। এ ছাড়া পাবেন প্রাইভেট ক্যাব। ভাড়া মোটামুটি নির্দিষ্ট।

 

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...