গত দুদিন ধরেই আবহাওয়া বেশ খারাপ। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একের পর এক নিম্নচাপে পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব ভারতের উপকূলবর্তী বহু এলাকায় চলছে প্রকৃতির তাণ্ডব। এহেন পরিস্থিতিতে সাতকোশিয়া গর্জ অভয়ারণ্যে বেড়াতে যাবার চিন্তা মাথায় থাকলেও, মনে অস্বস্তি কমছে না। ভোর ৫টা ২০তে রাউরকেলা স্টেশন থেকে ধরতে হবে ভুবনেশ্বরগামী ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস।

গাড়ি ছাড়ল ঠিক সাড়ে ৫টায়। এসি চেয়ার কারের জানলা দিয়ে দেখছি, বাইরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। মেঘে ঢাকা প্রকৃতিতে ভোরের স্তিমিত আলো। সবুজ গাছগুলো বৃষ্টিস্নাত। আম, খেজুর, নারকেল ও কৃষ্ণচূড়া গাছেরই প্রাধান্য। বাঁ-পাশে সবুজ ধানখেত, দূরে ছোটো ছোটো পাহাড়। বৃষ্টি থেমেছে। সূর্য‌্যের নরম আলো মেখে ট্রেন ঝাড়সুগুদা পৌঁছলো সকাল ৭টার আগেই।

ট্রেন সম্বলপুর সিটি স্টেশনে পৌঁছোলে যোগ দিল আমার সহকর্মী। আমরা নামব অঙ্গুল স্টেশনে। সেখান থেকে ছোটো গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে টিকরপাড়া নেচার ক্যাম্প-এ পেঁছানোর জন্য। আকাশ আবার মেঘলা হয়েছে। দিগন্তে সবুজ পূর্বঘাটের কিছু অংশ চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে। দুপাশেই সবুজের মেলা তাল, খেজুর, নারকোল এবং সঙ্গে শাল, মহুয়া, আম ও ইউক্যালিপটাস। ট্রেন অঙ্গুল স্টেশনে পৌঁছোল সকাল ১০টায়। আকাশ মেঘলা।

স্টেশনের বাইরে এসে অটোয় চেপে চলে এলাম বাস/কার স্ট্যান্ডে। একজন হাসিখুশি যুবক এগিয়ে এল। তার সঙ্গেই কথা বলে ঠিক করে নিলাম, সুইফ্ট ডিজায়ার-এ টিকরপাড়া যাওয়া-আসার ভাড়া, গাড়ির নাইট হল্ট চার্জ এবং জঙ্গল সাফারি সমেত কত টাকা দিতে হবে। খরচ খুব বেশি নয়, ৪২০০ টাকা! দেরি না করে বসে পড়লাম গাড়িতে।

ড্রাইভার বিজয় কুমার দাস জানাল, ৬২ কিমি দূরে অবস্থিত টিকরপাড়া পৌঁছোতে সময় লাগবে ঘণ্টা দেড়েক। প্রায় ১৫ মাইল পেরিয়ে এসেছি। সুন্দর রাস্তা, দুপাশেই হালকা জঙ্গল। বাঁ-দিকে দূরে ছোটো ছোটো পাহাড়। মাঝে মাঝে সবুজ ধান খেত, আর ছোটো ছোটো গ্রাম। করাটপাতা চক পেরিয়েছি একটু আগে। গাড়ি চলেছে এনএইচ-৫৫ হয়ে বদাকেড়া-টিকরপাড়া রোড ধরে। ড্রাইভার দেখাল, পথের পাশে ইলেকট্রিক পোলগুলিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে কাঁটা লাগানো। কারণ জিজ্ঞেস করাতে সে জানাল, ওই ব্যবস্থা হাতির পিঠ চুলকানির উপশমের জন্য। নাহলে, হাতি অনেক সময় অস্বস্তিতে ইলেকট্রিক পোলকেই ভেঙে ফেলে।

রাস্তার দুপাশেই এখন ঘন জঙ্গল। দারুণ ভালো লাগছে এই যাত্রা। ৩৩ কিমি দূরত্ব পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম পম্পাসর। এখানেই টিকরপাড়া অভয়ারণ্যের প্রবেশ দ্বার। ড্রাইভার গাড়ি থামাল রাস্তার পাশে। গাড়ি থেকে নেমে নেচার ক্যাম্প বুকিং-এর কাগজপত্র নিয়ে টিকিট ঘরের দিকে এগোলাম। ওএফডিসি-র ওয়ে সাইট থেকে বুক করা কাগজপত্র পরীক্ষা করা হল। গাড়ির নাম্বারও নথিভুক্ত হল। শুধু ড্রাইভারের দুদিনের প্রবেশ কর বাবদ আরও ৮০ টাকা জমা দিতে হল। আমরা গাড়িতে এসে বসতেই গাড়ি গেট পেরিয়ে প্রবেশ করল টিকরপাড়া ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিতে।

দুপাশে ঘন জঙ্গল শাল, সেগুন ও শিমূলের। গাড়ি চলছে মধ্যম গতিতে। প্রায় ৩-৪ কিমি এগোনোর পর এল নন্দিনী নালার ওপর তৈরি এক পোল, যেখান থেকে টিকরপাড়ার দূরত্ব ২৯ কিমি। পুরুনাকোট পেঁছোলাম দুপুর সোয়া ১২টায়। অঙ্গুল থেকে ৫৩ কিমি দূরত্বে অবস্থিত পুরুনাকোট বন-বাংলোটা ভারি সুন্দর। আমাদের গাড়ি অবশেষে মহানদীর তীরে অবস্থিত টিকরপাড়া নেচার ক্যাম্পে এসে পৌঁছোল দুপুর ১টা নাগাদ।

বনদফতরের পরীক্ষিত কাগজপত্র নিয়ে সোজা পেঁছোলাম নেচার ক্যাম্প-এর অফিসে। সেখানে তখন ডিউটিতে ছিল মি. সামিম চৌহান। আমাদের জন্য বরাদ্দ হল ৫ নম্বর টেন্ট, যাতে রয়েছে অ্যাটাচ বাথরুম। টেন্ট-এ ব্যবস্থা ভালোই। দুজনের জন্য পরিষ্কার বিছানা, স্ট্যান্ড ফ্যান, দুটি চেয়ার, একটি ছোটো টেবিল এবং জামা-কাপড় রাখার সুব্যবস্থা। অ্যাটাচ বাথরুম ও টয়লেট পরিষ্কার। সবচেয়ে ভালো লাগল, টেন্ট সংলগ্ন বারান্দায় একটি সেন্টার টেবিল ও দুটি চেয়ার রাখা। প্রকৃতির মাঝে চা পান করার সুন্দর ব্যবস্থা। আমরা হাত-মুখ ধুয়ে ও পোশাক পালটে পৌঁছে গেলাম অদূরে অবস্থিত ডাইনিং হলে।

ডাইনিং হলটি বেশ পরিপাটি করে সাজানো। বুফে সিস্টেমে খাওয়ার ব্যবস্থা। ভাত, রুটি, ডাল, আলুচোখা, ভেন্ডি ভাজা, মহানদীর টাটকা মাছের ঝোল এবং কার্ড স্যালাডে ভালোই হল লাঞ্চ। টেন্টে না ফিরে বিজয়কে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে বার হলাম। টিকরপাড়া গ্রামের মাঝ দিয়ে কিছুদূর হেঁটে পেঁছোলাম এক গাছের কাছে, যেখানে দেখি আরও ২-৩ জন মোবাইল কানে লাগিয়ে ব্যস্ত। এর কারণ জিজ্ঞেস করতে বিজয় জানাল, ওই গাছের কাছে বিএসএনএল ও এয়ারটেল-এর কানেক্শন টাওয়ার পাওয়া যায়। এই আপাত অচেনা গাছটির নাম জিজ্ঞেস করে জানলাম, পানিগাম্বারি। কিছুটা নীচে বয়ে চলেছে মহানদী আপন ছন্দে। নদীর বুকে ভেসে রয়েছে তিনটি মাছ ধরার ডিঙি আর দুটি মোটর বোট যার একটি আবার সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন-এর। কয়েকটি ছবি তুলে ফিরে এলাম ক্যাম্পে।

আমি বলি, থোড়া দের পহলে তুম বতায়া থা আম দোনো কো নদী অউর নালা কা সঙ্গম দিখাযে্গে। চলো, ওহি দেখনা হ্যায় হমে।

আমরা এবার বিজয়ে পিছন পিছন ক্যাম্পের অন্যদিক দিয়ে হালকা জঙ্গল পেরিয়ে কিছুটা নেমে পৌঁছোলাম মহানদীর তীরে। অপূর্ব সুন্দর রূপ মহানদীর। পূর্বঘাট পর্বতমালার বুক চিরে মহানদী এখানে সাত কোশ (চোদ্দো মাইল বা সাড়ে বাইশ কিমি) দীর্ঘ গর্জ সৃষ্টি করেছে। সাতকোশিয়া গর্জ পূর্বঘাট থেকে পৃথক করেছে ছোটোনাগপুর মালভমিকে। দুচোখ ভরে দেখতে লাগলাম মহানদীর প্রেক্ষাপটে সজীব পূর্বঘাটের ছোটো ছোটো পাহাড়গুলিকে। ডানদিকে তাকাতে দেখি, অদূরেই মহানদীতে এসে মিশেছে প্রশস্থ নন্দিনী নালা। যাকে সাতকোশিয়া অরণ্যের মাঝে একাধিক বার দেখেছি। বিজয় বলল, সঙ্গমস্থল থেকে মাইলখানেক দূরে নালার পাশে জঙ্গলে সুন্দরী (কানহার জঙ্গল থেকে নিয়ে আসা) নামক বাঘিনীটি এক গ্রামবাসীকে হত্যা করে। নিস্তব্ধ জায়গাটিকে দেখে হঠাৎই গা ছমছম করে উঠল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...