আমরা বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছি জঙ্গলে পশুপাখি দেখতে পাওয়ার ব্যাপারে। সবে রাত ৮টা, আমরা পৌঁছোলাম জগন্নাথপুর গ্রামে। এখানেও রাস্তার দুপাশে ঘন জঙ্গল।পথের পাশে এক নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাল বিজয়। এখানে মোবাইল টাওয়ার সাড়া দিচ্ছে, চাইলে বাড়িতে ফোন সেরে নেওয়া যেতে পারে।

আমরা গাড়ি থেকে নেমে এলাম, নিকষ কালো অন্ধকারে গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে রেখে। মিনিট ৫-৭ পরে রাস্তা পার হয়ে এক-দেড়শো মিটার দূরে টর্চের আলোর রশ্মি অনুসরণ করে দেখি, এক জোড়া কমলা আলোক বিন্দু কিছুটা উপরে-নীচে ওঠা নামা করছে। বিজয় ফিসফিস করে আমায় জিজ্ঞেস করে, স্যার, ক্যা সমঝতে হ্যায়? আমিও নীচু স্বরে বলি, লগতা হ্যায় হাথি, নিশ্চিত নেহি।

সে বলে, আপ বিলকুল সহি হ্যায়। অভি অউর নজর দিজিয়ে বলেই সে টর্চের আলো আরও নীচু অংশে নামিয়ে এনে আমায় জিজ্ঞেস করল, কুছ দিখাই দেতা হ্যায়?

আমি বলি, নেহি। স্রিফ অউর কালা লগতা হ্যায়। সে জানায়, ওহি হাথি কা শরীর হ্যায়। আমি মেনে নিলাম, কারণ টর্চের আলোয় এত দূর থেকে এর চেয়ে বেশি দেখা বা বোঝো সম্ভব নয়।

আমরা আবার গাড়িতে এসে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করল। দুদিকে টর্চের আলো ফেলে আমরা আরও এক কিমি পথ এগোলাম। এবার বিজয় গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। আমরা ফিরে চললাম পুরুনাকোটের পথে। প্রায় ৫ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে এসে বিজয় গাড়ির গতি একেবারে কমিয়ে দিল। গাড়ির আলোয় সে দেখেছে একটা লম্বা সাপকে রাস্তার বাঁ পাশের ঝোপের দিকে এগোতে। আমি দেখতে না পাওয়ায় সে গাড়িকে কিছুটা এগিয়ে নিল এবং পরক্ষণেই গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ক্রমশ অপসৃযমান সাপটির কাছে নিয়ে গেল। দেখি, একটি লম্বা কালো সাপ এঁকেবেঁকে বাঁ দিকের ঝোপের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। দেখেই চিনতে পারলাম, সেটা একটি বিষধর চিতি সাপ। বিজয় জানাল, স্থানীয় লোকেরা একে পর্বতিয়া চিতি বলে। কারণ এরা পাহাড় বা জঙ্গলেই থাকে। জঙ্গলে নাইট সাফারি আমাদের কাছেও নতুন অভিজ্ঞতা, তাই বেশ উত্তেজনা বোধ করছি।

গাড়ি চলেছে ধীর গতিতে। আবার আমরা দুপাশের জঙ্গলে টর্চের আলো ফেলে এগোচ্ছি। প্রায় ১০ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে বিজয় গাড়ি থামাল দত্তবাবুর টুরিস্ট লজের কাছে। জঙ্গলের মাঝে কিছুটা পরিষ্কার জায়গায় মাটির তৈরি একতলা কটেজ। ৪-টে ফ্যামিলি থাকতে পারে। ওনার সঙ্গে আলাপ করার সময় জানলাম, দুটি ফ্যামিলি তখন রয়েছে কটেজে। গত ৪০ বছর ধরে দত্তবাবু ওই জায়গায় রয়েছেন। কটেজ সমেত জায়গাটার মালিকও উনি। ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন, ঠিক কোন জায়গায় তখন হরিণ দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা।

গাড়ি স্টার্ট হতেই আমরা দুপাশের জঙ্গলে আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে চললাম। প্রায় ২ কিমি দূরে নন্দিনী নালার উপর তৈরি পোল পর‌্যন্ত দুপাশের জঙ্গলে হরিণ দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পোল পর্যন্ত পৌঁছে কোনও হরিণ দেখতে না পেয়ে আমরা একটু হতাশ হলাম। তবে কিছুদূর এগোতেই চমক! টর্চের আলোয় ডান দিকে দেখি, জঙ্গলে অন্তত ৭-৮ টি ছোটো-বড়ো চিতল হরিণের দল দাঁড়িয়ে টর্চের আলো পড়ায় হরিণদের চোখগুলো হালকা সবুজ রঙের দেখাচ্ছে।

প্রায় মিনিটখানেক পর হরিণগুলো গাছের ফাঁক দিয়ে এগোতে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে আমরাও গাড়িতে এগোতে লাগলাম। অন্তত আরও ২-৩ মিনিট ধরে হরিণগুলোর দেখা পেলাম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মন আনন্দে কানায় কানায় পূর্ণ। কিছুক্ষণ পরেই ডান পাশে পুরুনাকোট-এর নেচার ক্যাম্প (বন বাংলো) নজরে পড়ল।

গাড়ি এগিয়ে চলল টিকরপাড়ার দিকে। প্রায় ১৫ মিনিট পরে রাত ৯টা নাগাদ আমাদের গাড়ি ঢুকে পড়ল নেচার ক্যাম্পের চত্বরে। টেন্ট-এ ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। গরম রুটি, ডাল, আলুভাজা ও চিকেন কারিতে সারা হল ডিনার। পরের দিন সকাল ৭টায় জঙ্গলের মাঝ দিয়ে যাব আর এক গন্তব্যে।

ভোর সাড়ে ৫টায় ঘুম ভাঙতেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে টেন্টের বারান্দায় রাখা চেয়ারে এসে বসলাম। প্রকৃতির অপরূপ শোভার মাঝে চা পান করে ভারি ভালো লাগছিল। সকাল ৭টার আগেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম ঘরিয়াল রিসার্চ অ্যান্ড কনজারভেশন ইউনিট-এর উদ্দেশে। জঙ্গল পথে শর্টকাট করলে মোটামুটি ১০ মিনিট লাগে গন্তব্যে পৌঁছোতে। বনের মাঝে একটি গাছে দেখি ময়না, দোয়ে আর কাকের সহাবস্থান।

জঙ্গল ছেড়ে বার হতেই পথের পাশে সুন্দর এক শিব মন্দির। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে মহাদেবের দর্শন পেলাম এবং বৃদ্ধ পুরোহিতের শুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণে মনে আনন্দ পেলাম। নীচে নেমে এসে আরও ২-৩ মিনিট হেঁটে পৌঁছে গেলাম উদ্দিষ্ট স্থানে। গেট দিয়ে ঢুকেই ডান পাশে একটি ওয়াচ টাওয়ার। কিছুটা এগিয়ে মুগ্ধ হলাম ফুলের বাগান ও বিভিন্ন গাছপালায় সমৃদ্ধ কনজারভেশন ইউনিট দেখে।

প্রথমে বড়ো বড়ো খাঁচায় ঘেরা কয়েকটি চৌবাচ্চার ভিতরে ও বাইরে দেখি কয়েকটি বিভিন্ন আকারের কুমির। তার পাশেই ছোটো ছোটো খাঁচায় ঘেরা চৌবাচ্চায় ছোটো, বড়ো বেশ কয়েকটি কচ্ছপ। শেষে খাঁচা ঘেরা কয়েকটি চৌবাচ্চার ভিতরে ও বাইরে রয়েছে বিভিন্ন আকারের ঘরিয়াল। আরও কিছু সময় সেখানে কাটিয়ে চলে এলাম গেটের বাইরে এবং জঙ্গলপথে ফিরে চললাম আমাদের ক্যাম্পে।

সকালে স্নান সেরে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ডাইনিং হলে গিয়ে প্রাতরাশ সারলাম। ছোটো একটি ফটোসেশন সেরে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। সকাল ১০টায় চেক আউট কিন্তু আমরা একটু আগেই ফিরে যাচ্ছি। গাড়ি ফিরে চলেছে দ্রুত গতিতে। পুরুনাকোটের কাছে গত রাতে যেখানে আমরা হরিণের দল দেখেছিলাম, সেই জায়গাটা আবার দেখলাম। গাড়ি এসে থামল পুরুনাকোট নেচার ক্যাম্পের চৌহদ্দিতে। গাড়ি থেকে নেমে একটা উঁচু জায়গায় উঠে সুন্দর বন-বাংলো-র ছবি তুলে ফিরে এলাম।

অঙ্গুল শহরে ঢোকার আগেই আলোচনা করে ঠিক করলাম আমরা শহরের ইকো পার্কে গিয়ে বসব। অনেকটা সময় কাটাতে হবে। বিজয়কে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে দুটি টিকিট কেটে পার্কে প্রবেশ করলাম। বিশাল ইকো পার্কটি পরিষ্কার এবং সাজানো। পার্কের মাঝে গাছের ছায়ায় এসে বসলাম একটা গোল বেদিতে। দুপুর বেলায় পার্ক থেকে বেরিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে হোটেলে লাঞ্চ সারলাম। এরপর একটা অটো বুক করে চললাম অঙ্গুল স্টেশনে।

ছোট্ট, পরিষ্কার স্টেশন। আমরা লাগেজ নিয়ে বসলাম। আধঘণ্টা পরেই জোর বৃষ্টি এল। চলল প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। রাউরকেলাগামী ইন্টার সিটি এক্সপ্রেস ১০ মিনিট দেরিতে এসে পৌঁছোল। রাত ৯টায় পৌঁছে গেলাম রাউরকেলা স্টেশনে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অটোয় বসলাম। আমি জানি, রাতে বিছানায় শুলেই কয়েক দিন ধরে মনে পড়বে সাতকোশিয়া অভয়ারণ্য আর টিকরপাড়া নেচার ক্যাম্পের নানা কথা!

কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য :

সাতকোশিয়া ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিতে পৌঁছোতে হলে অঙ্গুল হয়ে আসতে হবে। ভুবনেশ্বর ও রাউরকেলা থেকে রেল ও সড়ক পথে অঙ্গুলে আসা যায়। সেখান থেকে টিকরপাড়া নেচার ক্যাম্প মাত্র ৬২ কিমি। অন্যান্য নেচার ক্যাম্পগুলির অবস্থান পুরুনাকোট, ছোটকেই, বাঘামুন্ডা, বালিপুট এবং টারাভা-তে। যে-কোনও নেচার ক্যাম্পে রাত কাটাতে হলে ওড়িশা ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন-এর ওয়েসাইট (www.ecotourodisha.com) থেকে বুকিং করতে হবে। ক্যাম্পে চেক ইন ও চেক আউট-এর সময় যথাক্রমে দুপুর ১২টা এবং সকাল ১০টা। সাতকোশিয়া অভয়ারণ্যে ঘোরার সেরা সময় নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...