তিন চার দশক আগেও যখন বাড়ির বউটি কাজে বেরোনোর কথা জানাত, তখন শুধু তার পরিবারের মানুষদেরই নয়– এমনকী পাড়ার লোকেরও চোখ কপালে উঠত। গৃহলক্ষ্মী, পুরুষদের মতো আবার চাকরি করবে কী! ‘মহানগর’ ছবির আরতি-কে মনে পড়ে? সে তো এই মহানগরেরই কতশত আরতির প্রতিভূ, যে কিনা সামাজিক বেড়া লঙঘন করে তার একক সত্ত্বা আর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়েছিল। ষাটের দশকের সেই-সব আত্মবিশ্বাসী বউমা-রা সন্তান পালন আর কর্মক্ষেত্র সামলানো, দুই-ই করেছেন ভরপুর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। তাঁরা অনেকেই এখন শাশুড়ি-মা। সেই সময়ের ‘ওয়ার্কিং মাদার’ হওয়ার গৌরবের কথা যাঁরা শেয়ার করেন, তাঁদের বউমাদের সঙ্গে।
আরও-একদল ‘শাশুড়ি-মা’ আছেন, যাঁরা হালফিল সমাজের চটপটে বউমাদের দেখে অনুপ্রাণিত। বউমাদের স্বয়ম্ভরিতা তাঁদের মনে সাহস জোগায় নতুন করে জীবনটাকে নিয়েঞ্জভাবার। আজ্ঞে হ্যাঁ, একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই বুঝবেন এই সময়টা হল ‘ওয়ার্কিং’ শাশুড়িদের।
কথা হচ্ছিল রুপালি শাহ’র সাথে। শহরের আই-টি ফার্ম-এ চাকরি করা রুপালি, ভীষণ খুশি শাশুড়ির এই বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তে। তিনি বলেন, ‘আই গেট অ্যালং পার্ফেক্টলি উইথ মাই মাদার-ইন-ল। আমার শাশুড়ি-মা সংসারের চাপে চাকরি ছেড়ে দেননি, তাঁর এই সিন্ধান্তটাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। উনি একটি ব্যাংক-এ চাকরি করেন, ওঁর কাজের ফিক্সড আওয়ার্স থাকার জন্য উনি সংসারের রান্নাবান্নাও করেন। আমার ওয়ার্কিং আওয়ার্স একটু অড। আমি তেমন কিছু করতে পারি না সংসারের জন্য। তবু সেটা নিয়ে উনি কিছু মনে করেন না। আবার ছুটির দিনে আমি সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিই। ওঁকে রিল্যাক্স করার সুযোগ করে দিই। উনি টিভি দেখে বা বন্ধু-আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়ে গল্পগুজব করে সময় কাটান। আর যদি দুজনেই টায়ার্ড থাকি, তাহলে বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নিই। এভাবেই চলে আমাদের ঘরকন্না।’
এ তো গেল বউমার কথা। এবার দেখা যাক তাঁর শাশুড়ি কী বলছেন। গায়ত্রীদেবী, রুপালির শাশুড়ি। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘আমি রুপালি-কে ভালো ভাবে চিনি। ও মোটেই অলস প্রকৃতির মেয়ে নয় যে সংসারের কাজে ফাঁকি দেবে। সপ্তাহের অন্যান্য দিন ও সত্যিই সময় পায় না, তাই সংসারের কাজ করে উঠতে পারে না। কিন্তু ওর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, আর কেয়ারিং নেচার আমায় মুগ্ধ করে। তাই ওর অফিস থেকে আসতে দেরি হলে, বা অফিস থেকে কোথাও সোশ্যালাইজ করতে যাওয়ার থাকলে, আমি রাগ করি না। একাই সামলে নিই সংসারের কাজ।’
অনেকেই হয়তো অবাক হয়ে ভাববেন, এও কি সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। যদি অ্যাডজাস্টমেন্টের মানসিকতা থাকে।
‘আসলে অফিসের পাশাপাশি বাড়িতে রান্না করা, ঘর গোছানো এসব আমার প্রকৃতিগত হয়ে গেছে। খানিকটা অভ্যেসেই হয়তো রুপালির থেকে অনেক দ্রুত গতিতে আমি এসব কাজ সম্পন্ন করতে পারি। রুপালি এত গুছিয়ে সংসার সামলাতে পারে না, কারণ ওর চাকরিতে অবসর কম,’ সংযোজন গায়ত্রীদেবীর।
শাশুড়ি-বউমা রাজযোটক
শাশুড়ি এবং বউমা আর নিজেদের প্রতিপক্ষ না-ভেবে, বন্ধু হয়ে উঠছেন, এই চিত্রটা খুবই আশাব্যঞ্জক। শাশুড়ি-মা যদি নিজে ওয়ার্কিং লেডি হন, তাহলে কর্মরতা বউমা-কে বোঝা তাঁর পক্ষে সহজ হয়। এটা অবশ্য উভয়ের দিক থেকেই সত্যি। কর্মস্থলের টেনশন, কাজের শেডিউল ইত্যাদি সম্পর্কে শাশুড়িরও হাতেকলমে অভিজ্ঞতা থাকার ফলে, তিনি বউমার সমস্যা ভালো ভাবে বুঝতে পারেন। এর ফলে বউমার সংসারে সময় না-দিতে পারাটা তিনি উদার মনে মেনে নেন।
আবার উলটোটাও ঘটে। বউমা অযথা শাশুড়িকে পরিশ্রম করানোর এবং নিজে আরামে থাকার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে, শাশুড়ির সঙ্গে সহযোগিতা করে। শাশুড়ি বোঝেন, সংসারের কত প্রতিবন্ধকতা, বাধা ও অশান্তির বেড়াজাল টপকে তবে তাঁকে বাইরের দুনিয়ায় পা রাখতে হয়েছিল। আর এও বোঝেন যে বউমা, মনে মনে সমীহও করে তাঁর সেই লড়াই। একাধারে ভালো বউ, পারফেক্ট মাদার আর সুযোগ্য ‘অফিস গোয়ার’ হওয়ার মন্ত্রটি তিনি যেভাবে রপ্ত করেছিলেন, তা শেয়ারও করেন বউমার সঙ্গে। এভাবেই তিনি বউমাকেও একই চ্যালেঞ্জ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন এই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, যে বউমাও নিশ্চয়ই পারবে তাঁর দেখানো পথে সফল হতে।
সীমা বিশ্বাস একটি মিডিয়া সংস্থায় কর্মরতা। তাকে শিফ্ট ডিউটি-তে কাজ করতে হয়। নানা অসুবিধার মধ্যে একটাই শুধু সুবিধা, সেটা হল সীমা অগ্রিম জানতে পারেন তাঁর সাপ্তাহিক শেডিউল। সেই মতো সামলে নেন সংসারের বাজারহাট বা অতিথি আপ্যায়ন। শাশুড়ি একটি বাণিজ্যিক সংস্থায় সিনিয়র অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে কর্মরতা। তাঁর অফিস যাওয়া-আসার সময় নির্দিষ্ট। সীমা তাঁর রুটিন অনুযায়ী বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন, অন্যান্যদিন এই কাজের ভার নেন তাঁর শাশুড়ি।
সবচেয়ে আনন্দের কথা হল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষরাও যথেষ্ট সহযোগিতার মানসিকতা তৈরি করে ফেলেছেন। বাড়ির দুই মহিলা সদস্য, মা এবং স্ত্রী কর্মস্থলে যাবেন বলে একধরনের মানসিক প্রস্তুতি যেন তৈরি হয়ে গেছে এখনকার পুরুষদের মধ্যে। ফলে অনেক সময় শিশুদের দেখভাল বা সংসারের কাজকর্মে তারাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। দক্ষ হাতে বাচ্চার ডায়পার বদলানো কিংবা দুধ গুলে ফিডিং বট্ল-এ করে বাচ্চাকে খাওয়ানো– এখন অনেক পুরুষের কাছেই খুব সহজ কাজ হয়ে গেছে।
শাশুড়ি-বউমার অ্যাডজাস্টমেন্ট বহু পরিবারেই আনন্দ নিয়ে এসেছে। ঈর্ষা বা রেশারেশির প্রশ্নই ওঠে না, উপরন্তু দু’জনে নিজের উপার্জনে পরস্পরকে উপহার দেওয়া ছাড়াও, শাশুড়ি-বউমা পরস্পরের ব্যাংক-এর কাজকর্ম বা অতিথি আপ্যায়নের কাজটা সামলে দিচ্ছেন অক্লেশে। এমনটা হয়তো একদশক আগেও ভাবা যেত না!
আধুনিক মনস্ক শাশুড়ি-মা
এখনকার ওয়ার্কিং শাশুড়ি-মা’রা সংসারের দায়িত্ব নিতে সর্বদা প্রস্তুত। প্রীতিলতা মিত্র এমনই একজন শাশুড়ি, যিনি একটি বাচ্চাদের স্কুল চালান। কিন্তু এই কাজের অবসরে তিনি তাঁর একমাত্র নাতি রোহনের দেখাশোনা করতে ভোলেন না। তাঁর বউমা রাইমা, মাতৃত্বের ছুটির মেয়াদ পেরোতেই পুনরায় কাজে যোগ দিয়েছে। কিন্তু রাইমা নিশ্চিন্ত যে, তার সদ্যজাত শিশুটি তার শাশুড়ি-মা’র তত্ত্বাবধানে ভালোই থাকবে। প্রীতিলতা স্কুলের প্রধানা হওয়া সত্ত্বেও, কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার স্কুল-সংলগ্ন বাড়িতে গিয়ে নাতির দেখাশোনা করে আসেন। রাইমা জানে, শাশুড়ির ব্যস্ততা তার চেয়ে হয়তো অনেকগুন বেশি, তবু প্রীতির মধ্যে এমন একটি সহজাত স্নেহশীলতা আছে, যা দায়িত্ববোধ পালনে প্রতিনিয়ত তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে।
এ যুগের শাশুড়িরা অবশ্য সেকেলে শাশুড়িদের মতো রক্ষণশীল বা ডমিনেটিং নন। কর্মজগতের নানা চ্যালেঞ্জ নিতে নিতে হয়তো তাদের মধ্যে উদারতার মনোভাব তৈরি হয়ে গেছে। কর্মক্ষেত্রে অ্যাডজাস্ট করার প্রবণতা হয়তো পারিবারিক জীবন যাত্রাকেও প্রভাবিত করেছে। ফলে বউমাদের আজকাল শাশুড়িকে কিছু শেয়ার করতে অসুবিধা হয় না। আর্থিক স্বয়ম্ভরিতা দুজনের মধ্যের পাঁচিল ভেঙে, সম্পর্কটাকে সহজ-স্বাভাবিক করে তুলেছে। দুজনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে হয়ে উঠছেন পরস্পরের প্রিয় সখী।