আমরা যাব ১৬১ কিমি পথ পেরিয়ে দাপোরিজো-য়। পথের দুপাশে ঘন অরণ্যের নিবিড় সবুজ। বুনো কলাগাছ, পাইনের সারি, বাঁশঝাড়ের সবুজ সহাবস্থান। মাঝে মাঝে জনপদ কখনও ছোটো কখনও বড়ো। আর ওই ধরনের বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি বাসস্থান। কোথাও কোথাও স্কুল রয়েছে। পথের ধারে মাঝে মাঝে গরুর পাশেই দেখা যাচ্ছে মিথুন, অনেক সময় বাচ্চা-সহ। নাদুসনুদুস বিশাল চেহরার প্রচুর মিথুন দেখলাম পথে। বেশখানিক পরে একটি নদীর উপর ব্রিজ পার হলাম, নদীর নাম কমলা। এই ব্রিজটি নাকি ভারতের সঙ্গে চিনের যুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল। পাহাড়ের উপর থেকে আর-একটি জলধারা নদীতে এসে মিশেছে। তাছাড়া সারাপথেই পাহাড়ি ঝোরা ও পাহাড়ি নালা ঝরে পড়ছে। সন্ধ্যা ঘনাতেই দেখা গেল আলোর প্রদীপে সজ্জিত পাহাড়ে ঘেরা দাপোরিজো জনপদ। সামান্যক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম দাপোরিজো-র লেগু টুরিস্ট ভিলেজে। এখানকার একটি লজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল।
পরের দিন সকালে ঘরের বাইরে এসে দেখি চারিদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঝরে পড়ছে। ভারি সুন্দর এই গ্রাম। সাড়ে আটটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়া। আমরা টুরিস্ট ভিলেজ থেকে দাপোরিজো শহরে এলাম। সুবনসিরি নদীর ধারে মোটামুটি বড়ো জনপদ। সমুদ্র সবুজ জল নিয়ে সুবনসিরি বয়ে চলেছে। আমাদের গন্তব্য মেঙ্গা কেভ। স্ট্যাল্যাকটাইট স্ট্যাল্যাগমাইটের তৈরি গুহায় শিবলিঙ্গের অধিষ্ঠান। নদীর কিনারা ধরে গাড়ি ছুটে চলে। নদী কোথাও বিস্তৃত কোথাও বিস্তার কম, দু’পাশে সাদা বালুর রুপোলি পাড়, নয়নলোভন দৃশ্য। ২২ কিমি পথে, নদী সারাক্ষণই সঙ্গী হল। মাঝে মাঝে পথের ধারে ফলে ভরা কমলালেবু গাছ। কিছুক্ষণ পর জায়গামতো পৌঁছোনো গেল, তারপর বেশ খানিক সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ের উপরে কেভে পৌঁছোলাম। গুহার মধ্যে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। শান্ত সুন্দর পরিবেশ। ফেরার পথে দাপোরিজোর খানিক আগে বাঁদিকে বেঁকে আলং-এর পথ ধরা হল, প্রায় ১৬০ কিমি দূরত্ব। সারাপথের সঙ্গী সুবনসিরি এবার বেশ বিপুলা। সমুদ্র সবুজ জল আর রুপোলি বালুর পাড় নিয়ে বড়োই মনোহরা। আলং পৌঁছোতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখানকার হোটেলে থাকার ব্যবস্থা হল।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আলং এর পথে বের হলাম। প্রকৃতির কোলে পাহাড়ে শান্ত নির্জন জনপদ। চারিদিক সবুজ তারুণ্যে ঝলমল করছে। খানিকটা হেঁটে দূর থেকে দেখা গেল সিয়াং নদী, যার অসমে নাম ব্রহ্মপুত্র। ৭.৩০ মিনিট নাগাদ হোটেলে ফিরে গাড়িতে ওঠা। এবার সারাটা পথ সিয়াং রইল আমাদের পাশে, কখনও গাঢ় নীল কখনও নীলচে সবুজ জল নিয়ে বয়ে চলল। মাঝে মাঝে পাহাড়ি নালা ঝাঁপিয়ে পড়ছে সিয়াং-এর বুকে। সিয়াং-এর জলে মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে বালুর দ্বীপ, তার উপরে বুনো গাছগাছালি ঝোপ।
পথের ধারে দেখা মিলল পায়ে সাদা মোজাপরা বেশ কয়েকটি গাউরের (ইন্ডিয়ান বাইসন), মিথুনের দেখা তো প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে। অরুণাচলে মিথুন গৃহপালিত পশু। শীতকালে এত সবুজ সজীব তারুণ্য সাধারণত বনভূমিতে দেখা যায় না কিন্তু অরুণাচল যে চিরনবীনা অনন্ত যৌবনা প্রকৃতির উর্বশী। পথের একধার ঘন জঙ্গলের দখলে অন্য ধার দিয়ে বয়ে চলেছে সিয়াং। কিছুক্ষণ পর একটি অপরূপা ঝরনার দর্শন মিলল। সুন্দরী ঝরনার ছবি তুলে আবার গাড়িতে ওঠা। বনের সবুজ আর নদীর নীলে চোখ ডুবিয়ে ৩.৩০ মিনিট নাগাদ পাসিঘাট পৌঁছোলাম। ডিসি-র অফিসে দেখা করে ইন্সপেকশন বাংলোতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হল।
পরের দিন যথারীতি ব্রেকফাস্ট সেরে সকাল আটটা নাগাদ বেরিয়ে পড়া গেল। পাসিঘাটে এখন দোয়নিপোলোর মন্দিরের (নতুন মন্দিরের) সিলভার জুবিলি উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দোয়নিপোলো হলেন আদিবাসীদের চন্দ্রসূর্য দেবতা। দোয়নি-সূর্য, পোলো-চন্দ্র। আমরা মন্দিরে গিয়ে দেবতা দর্শন করলাম, তারপর মন্দিরের বিশাল মাঠে, মন্দিরের সিলভার জুবিলি উপলক্ষে মেলা বসছে তাও দেখা হল। এখানকার রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমটিও খুব সুন্দর। পাসিঘাটের বাজারে যাওয়া হল, বেশ বড়ো বাজার। এবার গাড়ি ছুটে চলে শিলাপাথর হয়ে মালিনীথানের উদ্দেশে। পাহাড়ি পথ শেষ হওয়ার পর সমতল পথে চলা। পথের দুধারে সবুজ গাছ ফুঁড়ে দেখা যাচ্ছে ধান খেত। কোথাও পাকা ফসলের সোনা রং কোথাও কাটা ফসলের ধূসর বর্ণ। মাঝে মাঝে বনভূমি। নানাজাতীয় বাঁশঝাড়ের প্রাধান্যই বেশি, আর আছে তাল গাছ (পাম গাছও হতে পারে), এই গাছের পাতা দিয়ে এখানকার কুটিরের চাল ছাওয়া হয়।
বেলা ১টা নাগাদ শিলা পাথরে পৌঁছে গেলাম, কিন্তু আমরা আরও এগিয়ে চলে গেলাম মালিনীথানে। শিলাপাথর থেকে ১০ কিমি দূরে লিকাবলিতে অরুণাচল সীমান্তের মালিনীথানে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাচীন মন্দিরের ধবংসাবশেষ। ১২০০ শতকের পাথরে গড়া মন্দির ও ভীষ্মকনগর রাজপ্রাসাদ। ১৯৭০-এ জঙ্গল কেটে মাটি খুঁড়ে আবিষ্কৃত হয়েছে কারুকার্যময় দুর্গার প্রস্তর মন্দির ও মূর্তি। সিয়াং জেলার মালিনীথানে, মন্দিরের ভাস্কর্যের নানান সম্ভার নিয়ে মিউজিয়াম হয়েছে। এখানে একটি বিশাল নন্দীমূর্তি রয়েছে। এখান থেকে কিছু দূরে আকাশগঙ্গার পথে লিকাবলিতে এই মূর্তিটি মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায়। এখানকার প্রকৃতিও আশ্চর্য সুন্দর নয়নলোভন। মালিনীথান দেখে শিলাপাথরে ফিরে এলাম। আজ এখানেই রাত্রিবাস।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে তৈরি হয়ে সোয়া ছটার মধ্যে গাড়ি ছাড়ল করণছাব্বি ফেরিঘাটের উদ্দেশে। খামার গ্রাম চিরে চলা। সকালের মিঠে রোদ বেশ ভালো লাগছে। প্রায় কুড়ি কিমি এসে পথ শেষ। এবার গাড়ি চলল ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা অর্থাৎ মাটি মেশানো বালির উপর দিয়ে প্রায় ৫ কিমি চলার পর ব্রহ্মপুত্রের ধারে করণছাব্বিতে পৌঁছোলাম। এখানে ব্রহ্মপুত্রের বিস্তার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। পাড়ে বড়ো বড়ো স্টিমার দাঁড়িয়ে আছে আর পাড়ের উপর বসেছে সামান্য কিছু দোকানপত্র। আমরা দোকানে রুটি সবজি খেয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। তারপর চা খেয়ে স্টিমারে ওঠা। ওখানে গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হল। স্টিমারে তিনটি মোটর গাড়ি, গোটা চারেক বাইক ও বেশ কিছু লোক উঠল। ব্রহ্মপুত্রের জলে ঢেউ, রোদ পড়ে ঢেউয়ের মাথায় লক্ষ হিরের ট্যাঁকশাল। ৪৫ মিনিটের জলযাত্রা একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা। এপারের ফেরিঘাটের নাম বগিবিল। এখানেও একই দৃশ্য, নদীর পাড়ের কিনারায় লঞ্চ দাঁড়িয়ে আর পাড়ের উপর দোকানপত্র। আমরা একটা সুমো ভাড়া করে রওনা হলাম ডিব্রুগড় স্টেশনের উদ্দেশে। কামরূপ এক্সপ্রেসে ওঠা হল। চোখে লেগে রইল সবুজ প্রকৃতির মায়াঅঞ্জন।