আগে দক্ষিণ সিকিম বেড়াতে গেলে তালিকায় থাকত পেলিং, রাবাংলা ইত্যাদি। এখন South Sikkim-এর ওই তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরেকটি নাম- বোরং। আমাদের Borong যাওয়ার প্ল্যান হয়েছে বসন্তে৷ পাহাড়ের বসন্ত একদম অন্যরকম হয়। আর সিকিমে বসন্ত মানেই লাল টুকটুকে রডোড্রেনডন। তার মাঝখানে সবুজে মোড়া ছোট্ট পাহাড়ি হ্যামলেটের নাম হল বোরং। পাহাড়ের বসন্ত গায়ে মেখে নিতে পারবেন এই পাহাড়ি নির্জন গ্রামে বসে।
খুব সকাল সকাল উঠে মেঘমুক্ত আকাশ দেখে মনটা এক অনাবিল আনন্দে ভরে উঠল। হোমস্টে থেকেই দেখা মিলল Mt Pandim, Mt Sinolchu, Mt Narsing এর শ্বেতশুভ্র শৈলীগুলো। দু’চোখ ভরে দেখলাম সেই রূপ৷আমাদের হোমস্টেকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন পাহাড়ি গাছের সারি।এই অরণ্যজ সৌনন্দর্য,পাখিদের কলকাকলি,রংবেরঙের অর্কিড,প্রজাপতিদের মেলা, সবুজ বাগিচা দেখে দেখেই বেলা গড়িয়ে যায়৷ যেন ঠিক একটি স্বর্গরাজ্য ! হোমস্টের মালিক আমাদের ঘুরিয়ে দেখালেন তার সবজি বাগান, যা পুরোপুরি জৈবসার নির্ভর।অর্গ্যানিক ফার্মিং-এর জন্য সিকিমের সুনাম বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে৷
ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম কাছাকাছি দ্রষ্টব্যগুলো ঘুরে দেখার জন্য। ড্রাইভার আমাদের আমাদের ঘুরিয়ে দেখাল ওদের গ্রাম। পথচলতি নানা গাছ আর পাখির বিবরণ ছিল বাড়তি পাওনা৷একে একে ঘুরে দেখলাম সিলভার ফলস,রেনবো ফলস, হ্যাঙিং ব্রিজ, সুইসাইড রক এবং আরও কত কী। প্রতিটি স্টপ ওভার যেন এক একটি পিকচার পোস্টকার্ড৷ রামধনু দেখেছি এর আগেও বার কয়েক কিন্তু Rainbow falls এ তাকে ছুঁয়ে দেখার বিরল অভিজ্ঞতা হল এই প্রথম।
বিকেলে ঘুরে এলাম রালং মনস্ট্রি। পড়ন্ত বিকেলের আকাশ জুড়ে রক্তিম আভা ও মায়াবি রঙের খেলা উপভোগ করলাম মনস্ট্রী থেকেই।ফিরে এসে চা-পকোড়া সহযোগে টিফিন ও রাতে হাড় হিম করা ঠান্ডায় জমিয়ে গরম মুরগির ঝোল আর ভাত খেয়ে একটু সকাল সকাল শুয়ে পড়লাম।
পরদিন আমাদের গন্তব্য ছিল রঙ্গিত নদীতে সৃষ্টি হওয়া একটা উষ্ম-প্রস্রবণ বা hot sulphur spring দেখা।সেই সঙ্গে কিছু বার্ডিং-এর ও পরিকল্পনা ছিল৷ সেইমতো গরম গরম মোমো খেয়ে, ক্যামেরা, লেন্স প্রভৃতি গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম৷
ভেসে চলা মেঘেরা আমাদের সঙ্গী হল৷কিছুটা পথ গাড়িতে যাবার পর পায়ে হেঁটে যেতে হবে প্রায় ৪কিমি উৎরাই পথ। ড্রাইভার গুরুং আমাদের গাইড করে নিয়ে গেল পাকদন্ডী পথ ধরে। পথ চলতে জঙ্গলের মধ্যে দেখা পেলাম অনেক রকম পাখির৷ স্কার্লেট মিনিভেট, ব্ল্যাক ম্যাগপাই, ব্লু ফ্রন্টেড রেডস্টার্ট, striped throated yuhina স্ট্রাইপড থ্রোটেড ইয়ুহিনা—এক কথায় পাখির স্বর্গরাজ্য৷ সবাক’টি-কে ক্যামেরা-বন্দি করতে না পারলেও তারা রয়ে গেল মন ক্যামেরায়৷
এবার এসে পড়লাম প্রস্রবণের কাছে৷ সত্যিই মন ভরে গেল।এটা যেন একটা natural spa৷ প্রস্রবণের বারিধারায় স্নান সারলাম৷ শীতল হয়ে আসা আমাদের শরীর নিমেষে উষ্ঞ হয়ে উঠল। রঙ্গিত এখানে খরস্রোতা৷ একটা বেশ বড়ো আকারের পাথরের উপর বসে রৌদ্রের তাপ উপভোগ করলাম৷ চারিদিকের নৈঃশব্দকে ভেঙে গমগম শব্দে বয়ে চলা রঙ্গিত নদীর এই সৌন্দর্য মনে গেঁথে রইল চিরকালের মতো!
সম্বিত ফিরল ড্রাইভারের ডাকে৷ এবার যে উঠতে হবে, ৪ কিমি খাড়াই পথ।আস্তে আস্তে পা বাড়ালাম।স্মৃতিতে থেকে গেল এই অসাধারন Nature trail.
দুপুরে homestay-তে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল গরম গরম ভাত আর ডিমভাজা৷ দেখে খিদে বেড়ে গেল দ্বিগুন৷ বিশ্রাম সেরে, সেদিন বিকেলটায় একটু হেঁটে কাছেই বোরং মনস্ট্রি ঘুরে এলাম। রাতে লনে আমাদের জন্য ছিল বারবিকিউ-এর আয়োজন৷ মেঘমুক্ত আকাশের কালো ক্যানভাসে অজস্র তারা ও নক্ষত্রের মেলা৷ আগপনের ধারে গোল হয়ে বসে আমরা সেই নৈস্বর্গিক শোভা উপভোগ করে অবশেষে শুতে গেলাম।
পরদিন আমাদের ফেরার পালা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদায় জানাতে হবে এই স্বপ্নের জগৎকে৷ এই ক’দিনে পাহাড়ি মানুষগুলোকে ভালোবেসে ফেলেছি আমরা।তাই ছেড়ে যেতে মন খারাপ করে৷ অগত্যা গাড়িতে এসে বসলাম। মোহময়ী প্রকৃতির আশ্চর্য রূপ উপভোগ করতে করতে বিকেলের মধ্যে NJP পৌঁছে গেলাম।
প্রয়োজনীয় তথ্য:
হোমস্টে ও গাড়ির জন্য যোগাযোগ: Sanchita Gurung(09735917591)/9593785573.