আমাদের পরের গন্তব্য জৈনতীর্থ নাথনগর। এখানে প্রতিটি ঘরে তাঁতে বোনা হচ্ছে ভাগলপুরী রেশমের বস্ত্র। রঙিন সুতো রাস্তায় শুকোতে দেওয়া হয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে বস্ত্র বিক্রয়ের দোকান রয়েছে। এ এক অভিজ্ঞতা।

স্টেশন চকে প্রাচীন অপূর্ব কারুকার্য খচিত কাচকা জৈন দিগম্বর মন্দির দেখলাম। এখানে জৈন তীর্থংকর বাসুপুজর মূর্তিই বেশি রয়েছে দাঁড়ানো ও বসা ভঙ্গিমায়। আর আছে বাসুপুজের গুরু আদিনাথের কুড়ি ফুট উঁচু কালো পাথরের মূর্তি, আর কালো পাথরে নির্মিত পার্শ্বনাথের সুন্দর মন্দির। এই মন্দিরে দুটি সুড়ঙ্গপথ ছিল। একটির পথ ছিল মন্দার পর্বত পর্যন্ত, অন্য সুড়ঙ্গের পথ দেওঘরের পরেশনাথ পাহাড় পর্যন্ত ছিল। ভূমিকম্পের ফলে পথ দুটি বন্ধ হয়ে যায়। যাওয়া হল বহু প্রাচীন দিগম্বর জৈন মন্দির তথা তীর্থংকর বাসুপুজ বাসগৃহে। এই মন্দিরেরই একটি ঘরে তাঁর মাতৃদেবী তাঁকে গর্ভে ধারণ করেন এবং এখানেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এখানেই তিনি গুরু আদিনাথের কাছ থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেছিলেন। মোক্ষলাভের পর আদিনাথের অন্য শিষ্যরা অন্যত্র চলে যান কিন্তু বাসুপুজ গৃহে ফিরে আসেন। কারণ তাঁর নাকি অনেক কাজ বাকি ছিল তাঁর পুণ্য স্মৃতিতে এই গৃহ, জৈন মন্দির হয়েছে। মন্দির সংলগ্ন সুন্দর বাগানে  তীর্থংকরের মূর্তি রয়েছে। চার কোণে চারটি মন্দির। মন্দিরটির ভিতরের দেয়ালের শ্বেতপাথরের উপর রঙিন পাথর দিয়ে অনবদ্য মিনার কাজ। এরপর আরও একটি জৈন মন্দির দর্শন করতে যাওয়া হল চম্পানগরের বিষহরির মন্দিরে। কথিত আছে মন্দিরের পাশেই চাঁদ সওদাগরের বসত বাড়ি ছিল। মন্দিরের সামনেই ছিল খাল। খাল দিয়ে সওদাগরের বাণিজ্যতরণী গঙ্গায় গিয়ে পড়ত। এখন গঙ্গায় চরা পড়েছে। লখীন্দরের লোহার বাসরঘর ভূমিকম্পের ফলে মাটির নীচে চাপা পড়েছে কিন্তু রয়ে গেছে সওদাগরের পূজিত মনসাদেবীর মন্দির। অভিনব সুন্দর মনসার ধাতুনির্মিত প্রতীক মূর্তি। এখানেও সব বাড়িতেই তাঁত চলছে, ঘরে ঘরে কাপড়ের দোকান। কল্পনায় দেখি চাঁদ সওদাগর অপূর্ব রেশম বস্ত্রের সম্ভার তাঁর সপ্তডিঙ্গায় পূর্ণ করে সুদূর বিদেশে বাণিজ্যে যাচ্ছেন।

শহরে ফিরে পুলিশ চৌকির পাশ দিয়ে চললাম কুপপা ঘাটে মহর্ষি মাহির আশ্রমে, কর্ণগড় পর্বতের গুহা দর্শন করতে। স্থানটি প্রায় শহরের শেষপ্রান্তে। বিশাল জায়গা নিয়ে গঙ্গার ধারে মনোরম এই আশ্রমের পরিবেশ। বাগান দিয়ে সুন্দর করে সাজানো প্রাঙ্গণে দুটি সুন্দর ও অভিনব স্থাপত্যের মন্দির দর্শন করলাম। দেখা হল মাহির সাধন গুহা, তবে গুহার অন্দরে প্রবেশ নিষেধ। মহর্ষির কক্ষ দর্শন করলাম। শুনলাম এখানেই নাকি শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের বিখ্যাত চরিত্র ‘অন্নদাদিদি’ থাকতেন।

সকালে ঘুম ভাঙতেই বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। সেদিনই আমার কাঙিক্ষত স্থান বিক্রমশীলা বৌদ্ধবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে যাব। ভাগলপুর স্টেশন থেকে সকাল জ্ঝটার বর্ধমান প্যাসেঞ্জারে চেপে বিক্রমশীলা হল্ট স্টেশনে নামা হল। স্টেশন থেকে একটা ঘোড়াগাড়ি চেপে আমরা রওনা দিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে। প্ত কিমি পথের একেবারেই বেহাল অবস্থা, কিন্তু পথের দুধারের দৃশ্য মনোহর। মুসুরখেতের বাসন্তী রঙের ফুল আসন্ন বসন্তের আগমন বার্তা বহন করছে। মাথার উপরে নীল আকাশ আর অন্যদিকে অড়হড় ক্ষেতের সবুজ বিস্তার। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছোলাম বিহারে। ধর্মপালের তৈরি বিক্রমশীলা বিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয় আজ ধবংসপ্রাপ্ত, কেবলমাত্র অতীত গৌরবের স্মৃতি বহন করছে। প্রাচীনকালে গঙ্গাতীরে এক উঁচু পাহাড়ে পূর্ব ভারতের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র ছিল বিক্রমশীলা। দেশবিদেশ থেকে শিক্ষার্থী আসত এখানে অধ্যয়ন করতে। ররশো শতকের গোড়ায় পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকর ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উন্নতির শিখরে পৌঁছোয় প্রথমে রাজা রামপালের সময়ে। সেন বংশের রাজত্বকালে খিলজি দুর্গ ভ্রমে ধবংস করেন এই শিক্ষায়তন। বর্তমানে গঙ্গা সরে গেছে, পাহাড়ও নেই। আবিষ্কৃত হয়েছে টেরাকোটা, প্রাচীন স্থাপত্য, বুদ্ধদেবের ছোটো বড়ো নানা ভঙ্গিমায় অষ্টধাতুর মূর্তি, উঁচু স্তূপ, মুদ্রা, জলাশয়। ছাত্রদের থাকার জন্য ঘর, লাইব্রেরি। এখনও অনেক জায়গায় খনন কার্য হয়ে ওঠেনি। প্রধানস্তূপের ভিতর ফাঁকা, এখানে বুদ্ধমূর্তি ছিল, মূর্তিটি এখন পটনা মিউজিয়ামে রক্ষিত। মন্দিরের নিশ্চয় কপাট ছিল কারণ স্তূপের মেঝেতে দেখলাম শিকল লাগাবার জন্য লোহার আংটা রয়েছে। দেয়ালগুলি কারভিং করা যাতে জল লেগে নষ্ট না হয়। ড্রেপিং স্টোন রাখা আছে জল টেনে নেওয়ার জন্য। প্রধান স্তূপের পিছন দিকে লাইব্রেরির ধবংসস্তূপ। প্রধানস্তূপ ঘিরে রয়েছে ছাত্রাবাসের ঘরের সারি। আর সামনের দিকে রয়েছে হিন্দু মন্দির, জৈন মন্দির ও তিব্বতিদের বৌদ্ধ মন্দিরের ধবংসস্তূপ। প্রধানস্তূপের নীচের দিকে দেয়ালের গায়ে অপূর্ব টেরাকোটার শিল্পকর্ম। তাছাড়া দেখা গেল কিছু ভাঙা মূর্তি, টেরাকোটার বস্তু প্রভৃতি।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...