শোনা যায় একবার এক শাস্ত্রীয় সংগীত অনুষ্ঠানে বিখ্যাত সেতারবাদক উস্তাদ ওয়ালিউল্লাহ খান সাহেবের বাজানো একটি রাগ, অনুষ্ঠানের পরের দিনই হুবহু খানসাহেবের কায়দায় তাঁকেই বাজিয়ে শুনিয়ে দিয়েছিলেন সুধীন। ওয়ালিউল্লাহ খান সাহেবের বাদন, অনায়াস দক্ষতায় তুলে নিয়েছিলেন নিজের কচি আঙুলে! অথচ সেই সময় সেতারে কোনও প্রথাগত শিক্ষাই ছিল না তাঁর। বস্তুত শিল্পী তখনও স্কুলের গণ্ডিই পার হননি। উস্তাদ এনায়েৎ খাঁ সাহেবের সেতার শুনে, সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় নাকি তিনি সেতার শিখেছিলেন। শিল্পী Sudhin Dasgupta-র জীবনের আরও নানা অজানা কথা তুলে ধরছেন তাঁর পুত্র সৌম্য দাশগুপ্ত।
সুধীন দাশগুপ্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় ধারার সংগীতেই সমান ভাবে বিচরণ করতে পারতেন। এটা কেমন করে সম্ভব হয়েছিল, ওনার সঙ্গীত শিক্ষার জার্নিটা যদি তুলে ধরেন।
দার্জিলিং-এ থাকাকালীন প্রথমে প্রখ্যাত জ্যাজ পিয়ানোবাদক লুইস ব্যাংকস-এর বাবা জর্জি ব্যাংকসের কাছে পিয়ানোয় ওযে্টার্ন ক্লাসিকাল শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন আমার বাবা সুধীন দাশগুপ্ত। পরে বিভিন্ন সময়ে তিনি আরও দুজনের কাছেও পিয়ানো শিখেছিলেন। পরবর্তীতে কলকাতায় আসার পরে তিনি রয়েল কলেজ অফ লন্ডনের অধীনে ওযে্টার্ন মিউজিক কম্পোজিশন এবং অ্যারেঞ্জমেন্টের ওপরে একটি পোস্টাল কোর্স করেন। এভাবে, দেশের মাটিতে থেকেই পাশ্চাত্য সংগীতে বাবার দক্ষতা তৈরি হয়। এর জন্যে তাঁকে কখনও বিদেশ ভ্রমণ করতে হয়নি।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে তিনি নিজের আগ্রহেই নিজেকে তৈরি করেছিলেন। ধ্রুপদী সংগীতের প্রাথমিক বিষয়গুলি শিখেছিলেন মূলত লাইভ কনসার্ট, রেডিও এবং রেকর্ড করা সংগীত শোনার মাধ্যমে। সেতার ছিল তাঁর পছন্দের যন্ত্র এবং তিনি এটি বেশ ভালো ভাবে বাজাতে পারতেন। আমার ঠাকুরদা ছিলেন স্কুলের হেডমাস্টার। গান-বাজনার প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আমার ঠাকুমা অত্যন্ত সমাজ সচেতন, সাংস্কৃতি-মনস্ক মানুষ ছিলেন যার ফলশ্রুতিতে তাঁর চার ছেলেই নানা ভাবে সংগীতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এবং আপন পরিধিতে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছিলেন। বাবার বড়ো তিন ভাই, ছোটো এক ভাই এবং বড়ো দুই বোন ছিলেন। বড়ো ভাই পিয়ানো এবং বেহালা বাজাতেন। অন্যান্য ভাই-বোনেরা তাঁকে অনুসরণ করেন।
দার্জিলিংয়ে থাকার দরুণ পাহাড়ের সুর, পাহাড়ি দর্শন ওঁর সুরকে কতটা প্রভাবিত করেছিল বলে মনে হয়?
পাহাড়ি মানুষ প্রকৃতিগত ভাবে অত্যন্ত সহজ মনের হন। বাবা নিজেও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। শৈশব-কৈশোরের জীবনযাত্রা তাঁর সুরে, কাজে প্রভাব ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক। স্বভাবতই সরল দৈনন্দিনতার সাধারণ, স্বাভাবিক জীবনবোধ তাঁর সুরে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর করা গানগুলো জনপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণই হয়তো সুরগুলোর আপাত সরলতা। যদিও এই গানগুলো গাওয়া কিংবা গানগুলোর নির্মাণশৈলী মোটেও সহজ নয়, যথেষ্ট জটিল। তবু তাঁর গান খুব সহজে মানুষের শ্রুতিতে, মননে দীর্ঘস্থাযী ছাপ রাখে, শ্রোতা অনায়াসে সে সুর গুনগুনিয়ে ওঠে।
সুরের প্রযোগে বাবার বেশ কিছু গানে ভপালির মতো পাহাড়ি রাগ, স্কেল/ ধুন বা মোটিফের ব্যবহার দেখা যায়। সেই প্রযোগ তিনি খুব সচেতন ভাবে করেছেন কিনা জানা না গেলেও, ধরে নিতে পারি পাহাড়ে কাটানো সময়ে অনায়াস প্রতিফলন ঘটেছে।
সুধীনবাবুর ব্যাডমিন্টন খেলা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে থাকেন। এমনও বলেন যে সুরসৃষ্টির দিকে চলে না গেলে তিনি জাতীয় স্তরের শাটলার হতেন। এই দিকটা একটু বলুন।
খেলাধুলোয় বাবার সহজাত দক্ষতা ছিল। তিনি ক্যারম খেলে ষোলো বছর বয়সে দার্জিলিং-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। এছাড়া খুব ভালো হকি এবং ব্যাডমিন্টন খেলতেন। তবে, বেশিরভাগ মানুষ শুধু তাঁর ব্যাডমিন্টন খেলার কথাই জানেন। প্রকৃতপক্ষে তরুণ বয়সে তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একজন প্রথম সারির খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিলেন। একজন উচ্চমানের ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হিসেবে মিক্সড ডাবলস-এ তাঁর স্থান ছিল অনেক উপরে। সেই খেলা থেকে কেন, কখন সরে এলেন আমি সেই গল্প তাঁর মুখে শুনেছি। মূলত, সেবার তিনি তখনকার সর্ব ভারতীয় চ্যাম্পিয়ন, সম্ভবত নন্দু নাটেকরের বিপক্ষে খেলতে গিয়ে প্রথম গেমটা খুব ভালো খেললেও ক্রমশ আবিষ্কার করছিলেন যে, শাটল যদি পেছনে দূরে বাঁ দিকে চলে যায়, তাহলে সেটা মারতে গিয়ে তিনি বারবার মিস করছিলেন। খেলা শেষে কোচের পরামর্শে চোখ দেখানোর পর তাঁর বাম চোখে দুর্বলতা ধরা পড়ল। ফলে এরপর তিনি পেশাদার খেলার জগৎ থেকে অবসর নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
বাবা মূলত কলকাতায় এসেছিলেন হকি খেলতে যদিও হকি খেলায় তাঁর দক্ষতা সম্পর্কে মানুষ খুব বেশি কিছু জানেন না। তিনি তখন ভবানীপুর ক্লাবের হয়ে হকি খেলতেন, যা ছিল সেই সময় কলকাতায় হকি খেলার শীর্ষ দুই ক্লাবের মধ্যে অন্যতম। হকিতে তাঁর একটি অসাধারণ বিশেষত্ব ছিল, আর তা হল, তিনি গোলরক্ষক হওয়া থেকে শুরু করে সেন্টার ফরোয়ার্ড হওয়া পর্যন্ত যে-কোনও পজিশনে খেলতে পারতেন। এমনকী তিনি কে ডি সিং (বাবু)-এর মতো প্রথিতযশা খেলোয়াড়দের সঙ্গেও হকি খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন।
আমি যথেষ্ট সৌভাগ্যবান যে, বাবার কাছে ব্যাডমিন্টন আর হকি খেলার কিছু কৌশল শেখার সুযোগ পেয়েছিলাম।
সুধীনবাবুর বিভিন্ন গান তৈরির পিছনে অনেক চমকপ্রদ গল্প আছে শুনেছি। তেমন কিছু গল্প যদি আমাদের শোনান।
এখানে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব।আমি তখন বেশ ছোটো। সেসময় আমাদের বাড়িতে বাহাদুর নামে একজন তরুণ নেপালি কাজ করতেন। বাবা তাকে নিয়ে চার লাইনের ছোট্ট একটি ছড়া লিখে তাতে সুর দিয়ে আমায় শুনিয়েছিলেন আর বলেছিলেন ওটা আমার গান। সেই গানটি ছিল এরকম
ছোট্ট বাহাদুর/ যাচ্ছ কতদূর/ রাস্তা থেকে কিনে এনো গরম চানাচুর!
কিন্তু কয়েকমাস পরে আমি আবিষ্কার করি যে, আমার সেই গানটার কথা বদলে দিয়ে একই সুরে শ্যামল মিত্র তখন আরেকটি গান গাইছেন।
কী নামে ডেকে/ বলব তোমাকে/ মন্দ করেছে আমাকে/ ওই দুটি চোখে…
শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে তখনই দারুণ জনপ্রিয় হয় এই গানটি! কিন্তু ব্যাপারটা আমার একদম পছন্দ হয়নি। বিরক্তি প্রকাশ করে বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম কেন তিনি আমার গানটা চুরি করেছেন। বাবা সেই দায় স্বীকার করে কথা দিয়েছিলেন যে, এমন ভুল আর করবেন না। এখন সে কথা মনে পড়লে ভাবি, আমার আড়ালে পরে এই নিয়ে বাবা নিশ্চয়ই খুব হেসেছিলেন।
পরের গল্পটি অনেক বছর পরের ঘটনা। তখন আমরা ডোভার রোডের বাড়িতে থাকি। বাবা ছোটোদের জন্য রামায়ণ নিয়ে কাজ করার কথা ভেবেছেন এবং এর জন্য গান রচনার ভার পড়ে প্রখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উপরে। তিনিও সানন্দে রাজি হয়ে যান। এই কাজের সূত্রে সুভাষ জেঠু তখন প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতেন। কিছুটা লিখে আনতেন তারপর সেটা নিয়ে কথাবার্তার সঙ্গে সঙ্গে গল্প আড্ডায় দারুণ সময় কেটে যেত। ক্রমশ দেখা গেল, রেকর্ডিং-এর তারিখ এগিয়ে এলেও লেখার কাজ শেষ হয়নি।
এরপর একদিন বাবা বাকি কাজটুকু শেষ করার কথা ভেবে সুভাষ জেঠুকে আমাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। সুভাষ জেঠু এলেন, বেশ খানিক্ষণ চা-আড্ডার পর দুজনে বাবার মিউজিক রুমে গেলেন। সেই ঘরে তখন ফ্লাস্কে চা আর জলখাবার রেখে দিয়ে বাবা জেঠুকে বললেন যে, এবারে তিনি তাঁকে এই ঘরে আটকে রাখবেন এবং সুভাষ জেঠুর লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি এই ঘরের দরজা খুলবেন না।
তারপর! তারপরে বাবা সত্যিই বাইরে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আর সুভাষ জেঠুও সেদিন তাঁর লেখার কাজটি শেষ করে তবেই সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম জেঠু হয়তো মনঃক্ষুণ্ণ হবেন। কিন্তু মোটেই তা ঘটেনি। কাজটা শেষ করার প্রযোজনীয়তা আর আনন্দে দুজনেই তখন দারুণ খুশি।
দুটি সৃষ্টিশীল মনের বন্ধুত্বপূর্ণ পারষ্পরিক নির্ভরতা, সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার দাবি মেটানোর এমন ছবি এ যুগে বিরল।
বাংলার সমকালীন প্রায় প্রত্যেক শিল্পীকে দিয়ে গাওয়ালেও আশা ভোঁসলের গলায় ওঁর হিট গানের সংখ্যা খুব বেশি। এর কারণ কী?
এ কথা সত্যি যে, আশা ভোঁসলের গাওয়া বাবার তৈরি সমস্ত গানই অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর কণ্ঠ এবং গান গাওয়ার ক্ষমতা ছিল বাবার গানের জন্য একেবারে উপযুক্ত। কিন্তু একই ভাবে, বাবার তৈরি মান্না দে-র গাওয়া বেশিরভাগ গানও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও কথাটি সমভাবেই সত্য।
তবে, সম্ভবত ভালো রেকর্ডিং-এর কারণে আশা ভোঁসলের গাওয়া গানগুলি শ্রোতাদের কাছে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। কেননা, তাঁর গানগুলো সবই মুম্বাইয়ে স্টুডিওতে অনেক উন্নত সুবিধা-সহ রেকর্ড করা হয়েছিল। মান্না দে বা আরতি মুখোপাধ্যায়ের গানের ক্ষেত্রে সে সুযোগ ঘটেনি।
( চলবে…)