সুধীন দাশগুপ্ত–র তৈরি করা অসংখ্য গানের গীতিকার তিনি নিজেই, সুরকার পরিচয়টা কি তাঁর গীতিকার পরিচয়কে ঢাকা দিয়েছে অনেকটা, কী মনে করেন?
হ্যাঁ, এই অনুমান অনেকটা সঠিক বলেই মনে করি। বাবার লেখার দক্ষতা তাঁর সংগীত রচনার জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। তবে Sudhin Dasgupta সত্যিই একজন প্রতিভাবান গীতিকার ছিলেন। বলা যায় তাঁর করা প্রায় অর্ধেক গানের গীতিকার তিনি নিজেই। কিন্তু এ কথা সে হারে পরিচিতি পায়নি। তাঁকে অধিকাংশ মানুষ সুরকার বলেই জানেন। এই সুযোগে একটি কথা জানিয়ে রাখতে চাই। ছেলেবেলাটা দার্জিলিং-এ কাটানোর ফলে সাহেবি কায়দায় ইংরেজিটা রপ্ত হলেও বাংলা লেখা-পড়ায় বাবা খানিকটা পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি।
কলকাতায় এসে আলাদা ভাবে শিক্ষকের কাছে গিয়ে নিয়মিত ভাবে বাংলা ভাষা শিখেছিলেন, রপ্ত করেছিলেন পরবর্তীতে যা তাঁর গীতিকার হয়ে ওঠায় ভমিকা রেখেছিল। রীতিমতো সাফল্য এনে দিয়েছিল। একই মানুষের হাতে কোনও গানের কথা এবং সুর তৈরি হলে তা গানটিতে ভিন্ন মাত্রার আবেদন ও সাফল্য যোগ করে বৈকি! তবু, প্রচারের অভাবে পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান গীতিকার সুধীন দাশগুপ্ত বাঙালি মানসে কেবল সুরকার হিসেবে যতটা পরিচিত, গীতিকার হিসেবে ততটা নন।
পরিবারের সঙ্গে কেমন ভাবে সুধীনবাবু সময় কাটাতে পছন্দ করতেন এটা যদি বলেন। এ ব্যাপারে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও জানতে চাইব?
তিনি আদ্যোপান্ত একজন পারিবারিক মানুষ ছিলেন। তাঁর আশেপাশে সবার প্রতি, বিশেষত শিশুদের প্রতি তিনি অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন। আমরা যে-বাড়িতে থাকতাম, সেই বাড়ির অনেক বাচ্চা সহজেই তাঁর সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে অনেকটা সময় কাটাত। স্বভাবতই আমার এবং আমার ছোটো বোনের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক আগাগোড়াই খুব গভীর ও আন্তরিক ছিল। হাজার ব্যস্ততার পরেও আমরা কখনও তাঁর অভাব বোধ করিনি। আমাদের যে-কোনও সাফল্য বা কৃতিত্বে তিনি অত্যন্ত গর্ববোধ করতেন। সর্বোপরি, আমার মায়ের সঙ্গে তাঁর চমত্কার, দ্বিধাহীন বোঝাপড়ার সম্পর্ক ছিল। আমার দিদা (তাঁর শাশুড়ি)-র সঙ্গেও তাঁর অত্যন্ত সহজ একটি সম্পর্ক ছিল।
বাবা রান্না করতে পছন্দ করতেন এবং সুযোগ পেলেই নানারকম সুস্বাদু রান্না করে আমাদের খাওয়াতেন। পারিবারিক বা সামাজিক মানুষ হিসেবে বাবার মস্ত বড়ো যে-গুণটির কথা উল্লেখ না করলেই নয় তা হল, আমি তাঁকে কখনওই, কারও সাথে, কোনও ব্যাপারে ধৈর্য হারাতে দেখিনি।
সোশ্যাল গ্যাদারিং, পার্টি ইত্যাদিতে শোনা যায় তেমন যেতে চাইতেন না সুধীনবাবু, একটু যেন প্রচার বিমুখ, এটা কেন?
ব্যক্তিমানুষ হিসেবে বাবা অন্তর্মুখী ছিলেন। তবে, এই বৈশিষ্ট্য তাঁর পারিবারিক পরম্পরা। আমাদের বাড়ির সকলেই এই ধারা তাঁদের রক্তে বহন করছেন।
তাঁর মিতভাষী, শান্ত স্বভাবের জন্যই অনেকে বাবার সঙ্গে আলাপ করতে দ্বিধা করতেন। স্বভাবগুণেই বাবা কখনও অনেক লোকের ভিড়ে থাকতে চাইতেন না এবং তথাকথিত পার্টি বা গ্যাদারিং যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন। তিনি আপন মনে সংগীত রচনার কাজে ডুবে থাকতেই সবচাইতে বেশি ভালোবাসতেন এবং চেষ্টা করতেন সেভাবেই তাঁর সময় কাটাতে। ক্যামেরার সামনে থাকার চেয়ে তিনি তার পেছনে থাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। প্রসঙ্গত বলি, ফটোগ্রাফি ছিল তাঁর অন্যতম শখ বা প্যাশন।
যশ, প্রচার বা খ্যাতিলাভের কোনও আকাঙ্ক্ষা বাবার কখনওই ছিল না। মনের তাগিদে নিজের সংগীত জগতে সৃষ্টির আনন্দে তিনি মেতে থাকতেন। সম্ভবত এই কারণেই তিনি যে-কোনও পেশাদার সমাবেশ এড়িয়ে চলতেন।
সুধীনবাবু মুম্বইয়ে শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ালেন কিন্তু বোম্বেতে হিন্দি ছবির কাজ করলেন না, এর কারণ কী?
উনিশশো পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে গুরু দত্তের একজন সহকারী হিসেবে সুধীন দাশগুপ্ত কয়েক বছর মুম্বইতে ছিলেন। গুরু দত্ত এবং গীতা দত্ত উভয়ে সঙ্গেই বাবার খুব ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক ছিল। তখন পেয়াসা ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করার একটা অভিপ্রায় বাবার ছিল। কিন্তু যে-কোনও কারণে কাজটির জন্য সুরকার এস ডি বর্মণকে নির্বাচন করা হলে, বাবা মুম্বই-এর মোহ ত্যাগ করে কলকাতা ফিরে আসেন। এরপরে বাবা আর কখনওই সেখানে থেকে কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে মুম্বই যাননি। যদিও চিত্রতারকা ধর্মেন্দ্র মুম্বাইয়ে চিত্রজগতে কাজ করতে বাবাকে দু-দুবার তাঁর সঙ্গে রেখে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু বাবা সেই আগ্রহে সায় দেননি।
তবে, ১৯৭৮-৭৯র দিকে বাবা একটি দ্বিভাষিক ছবির যৌথ প্রযোজনা করার উদ্যোগ নেন। সিনেমাটির নাম ভাবা হয়েছিল সাত সমুন্দর পার / সোনার কাঠি রূপোর কাঠি। দুর্ভাগ্যক্রমে, এই সিনেমাটি কখনওই শেষ হয়নি।
নিজের ছেলে–মেয়েদের সুরসাধনার ব্যাপারে সুধীনবাবু কেমন উৎসাহ দিয়েছিলেন আপনার মিউজিকের ক্ষেত্রে, আপনার বাবা অনুপ্রেরণা হিসেবে কতখানি এটা জানতে চাই?
আমার ছোটোবলায় বাবা কখনও চাননি আমি সংগীতচর্চা করি কিংবা সংগীতকে আমার পেশা হিসেবে নিই। তিনি চেয়েছিলেন আমি যেন পড়াশোনা করে অন্য কোনও পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি। ফলে বাড়িতে তাঁর গানের ঘরে বা পরিবেশে ছোটোবেলায় তিনি আমাকে বিশেষ ঠাঁই দেননি। সহজ কথায়, ছেলেবেলা থেকে আমাকে কখনও সংগীতচর্চায় উৎসাহিত করা হয়নি। কিন্তু, খানিকটা বড়ো হওয়ার পরে যখন বুঝলেন যে, আমি পড়াশোনায় যথেষ্ট মনোযোগী এবং তাতে ভালো করছি, তখন তিনি আমাকে গিটার শেখার অনুমতি দেন।
আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। আমি খুব মন দিয়ে গিটার শিখছিলাম। আমার নিষ্ঠা দেখে তিন বছরের মাথায় বাবা তাঁর চারদিনব্যাপী কোনও এক রেকর্ডিং আযোজনে আমাকে বাজাবার সুযোগ দেন। আর সেই থেকে এটা বেশ নিয়মে দাঁড়িয়ে যায়। তখন তিনি আমাকে কিংবদন্তি গিটার প্লেয়ার কার্লটন কিটোর কাছে জ্যাজ শিখতে ভীষণ ভাবে উৎসাহিত করেছিলেন, যা আমি পরে করেছি।
আমি অবশ্যই আমার বাবার কাজ দ্বারা প্রচণ্ড ভাবে প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি। খুব মন দিয়ে আমি তাঁর সুরের ধরনগুলোকে অনুধাবন করে তাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছি। নিজের কাজে তাঁর সংগীত রচনা বা সুরসৃষ্টির বৈশিষ্ট্য অনুসরণের চেষ্টা করি। তবে সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত ছাড়াও আমার ওপরে ব্লুজ, রক এবং জ্যাজ সংগীতের প্রভাবও যুক্ত হয়েছে।
দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে, আমি একজন আর্কিটেক্ট হিসেবে আমার পেশাগত জীবনকে আমার ভালোবাসার জায়গা, আবেগের জায়গা সংগীতের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে নিয়ে জীবনের পথ চলেছি। এই ভারসাম্য রক্ষা সফল বা সহজ হওয়ার পেছনে অবশ্যই বাবার সংগীত জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা একটি বিশেষ ভমিকা রেখেছে। বাবার সান্নিধ্যে সুরের জগতে বেড়ে উঠেছিলাম বলে, আমি খুব কম সময়ে (তিন বছরে) সংগীতের মূল ধারায় যুক্ত হতে পেরেছিলাম এবং আজও সেই পথে সাগ্রহে এগিয়ে চলেছি।