( ৭ )

খুব গরম পড়েছে। ছাতা নিয়ে স্কুলে যাই। বিকেলটা অনেক বড়ো হয়ে গেছে। দিন যেন শেষ হতেই চায় না। সন্ধেবেলায় সারা বাগানে গন্ধরাজ রজনীগন্ধার সুবাস খেলে বেড়ায়। মা আমাকে নিয়ে সন্ধ্যায় পড়াতে বসে। ঠাম্মা বারান্দায় চাঁদের আলোয় বসে হাতপাখা নাড়ে।

খাওয়া শেষ করে শুতে শুতে এগারোটা বাজে। একটা সেকেলে বিশাল ফ্যান গমগম করে ঘোরে। মায়ের ফের গলা জড়িয়ে ধরে বলি, মা সেজমামার গল্প বলো।

মা বলে, সরস্বতী পুজো হবে না সেবার ঠিক হয়েছিল। সেজদা প্রায় দশ-বারো দিন বাড়ি নেই। মা খুব কাঁদে। খায় না প্রায় কিছুই। বাবা মারা গেছে আজ প্রায় আট বছর আগে। তখন থেকেই মায়ের খাওয়া কমে গেছে। শরীর ভেঙে গেছে। সেজদা চলে যাওয়ার পর মায়ের কথা বলাও অনেক কমে গেছে। সকালে কুটনো কুটে দেয়। বড়দি রান্না করে। এই ডামাডোলের সময় বাড়ির কেউই বড়দিকে বর্ধমানে ইউনিভার্সিটিতে পাঠাতে রাজি নয়। মেজদা বউদি পানাগড়ে থাকে। ওখানে মেজদা চাকরি করে। বড়দা বিয়ে করেনি। করবেও না। সকালে বড়দি রান্না করে দেয়। বড়দা খেয়ে অফিসে চলে যায়। প্রায়ই বড়দির বিয়ে সম্বন্ধ নিয়ে আসে। বড়দিকে খুব সুন্দর দেখতে। অথচ বিয়ে হয় না। মা আবার ভেঙে পড়ে। বড়দি তখন তেইশ।

আমাদের সকলেরই মন খুব খারাপ। সেজদার কোনও খবর নেই। মা খালি বলে, কোথায় আছে, কী খায়, কী পরে জানি না। মা কাঁদে। আঁচলে চোখ মোছে। তিন বোন মাকে ঘিরে বসে থাকি। ছোড়দা চাকরির জন্য এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়। টিউশনি করতে যায়। এমন সময় একদিন সন্ধ্যায় বড়দা বাড়ি ফিরে বলল……

মা থেমে গেল।

মায়ের গলা জড়িয়ে ধরি। বলি তারপর?

মা একটু দম নিয়ে বলল, বড়দা জানাল অফিসে মেজদা ফোন করেছিল। পাটনায় আছে। সঙ্গে সঞ্জীবদা। সরস্বতী পুজোর দিন আসবে। বাড়ির লোক ছাড়া যেন আর কেউ না জানে।

মা কাঁদতে কাঁদতে বাবার ফোটোর সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করে। কী প্রার্থনা করে তা জানতে নেই। আমরাও কোনও প্রশ্ন করলাম না। মা সেদিন রাতে দুটোর জায়গায় তিনটে রুটি খেল। সরস্বতী পুজোয় ওরই বেশি উত্সাহ ছিল। তাই মা বলল পুজোর ব্যবস্থা কর। তারপরের দিনই ছোড়দা নোনতে পালের গোলায় ঠাকুর অর্ডার দিয়ে এল। পুজোর আগের দিন বড়দি আর মেজদি বাজার করতে বেরোল। আমি ছোড়দার সঙ্গে ঠাকুর আনতে গেলাম। বড়দা অফিস থেকে ফেরার সময় আমাদের তিন বোনের জন্য বাসন্তী রঙের শাড়ি নিয়ে আসে। বিকেল থেকেই আমরা শিকলি বানাতে শুরু করি। সেদিন সন্ধেবেলায় পুলিশ এল। মা চুপ করে গেল।

আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ভোর বেলায় সেজমামা ঢুকছে বাড়িতে। গায়ে ধূসর রঙের পাঞ্জাবি আর কালো ফুল প্যান্ট পরেছে। গায়ে একটা লেডিস শাল। মুখে ঘন কালো দাড়ি। ফর্সা রোগা লম্বা মানুষটার চোখ দুটো ঝকঝক করছে। দিদা বুকে জড়িয়ে ধরেছে মামাকে। মা মাসিরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে। কারও বাড়ি কাঁসর ঘন্টা বাজছে। শাঁখ বাজছে। মায়ের কোমরে পা তুলে দিয়ে গলাটা আরও জড়িয়ে ধরি। আমার বুক কাঁপছে। বলি, পুলিশ কী করল।

মা বলল, সারা বাড়ি বনবাদাড় তন্নতন্ন করে খুঁজল। না পেয়ে বড়দাকে বলল, দেবাঞ্জন কোথায়?

বড়দা বলল, জানি না।

জানি না, না বলবেন না? কোনটা?

বিশ্বাস করুন, আমরা কিছুই জানি না। মায়ের দিকে তাকাল একবার। টাউনবাবু মাকে একবার তাকিয়ে দেখল। আমরা তিন বোন কাঠ হয়ে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে হাতে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে টাউনবাবু বললেন, আপনাকে তুলে নিয়ে গেলে সব জানা যাবে।

বড়দা দু হাত তুলে বলল, নিয়ে চলুন।

মেজদি আঁত্কে উঠতেই বড়দি মেজদির হাত টিপে ধরে। ওরা আর কিছু না বলে বাত্থরুমটা দেখে চলে গেল। আমাদের সব কিছু থমকে গেল। আমরা যেন স্থবির হয়ে পড়লাম।

বড়দা বলল, ওরা সারপ্রাইজ ভিজিটে এসেছিল।

বড়দি বলল, যদি কাল আসে?

মা বলল, আজ ঘুরে গেছে, কাল আর আসবে না। মাযো কখনও মিথ্যে বলে না!

আমরা শিকলি টাঙাতে শুরু করলাম।

আমি উঠে বসে মায়ের বুকে মাথা রেখে প্রশ্ন করি, মামা এসেছিল?

কত দিন বাদে মাকে অন্যরকম দেখলাম। মা দু চোখ বুজে বলছে, সকালে উঠেই আমরা চান করে নতুন শাড়ি পরে নিলাম। শুধু মা-ই পুরোনো একটা কাচা শাড়ি পরল। আমরা বারবার ছুটে রাস্তায় যাচ্ছি। ঠাকুরমশাই নয় সেজদা কখন আসবে। ছোড়দা বারণ করল। তারপর একসময় ঠাকুরমশাই এল। পুজো হল, পুষ্পাঞ্জলি হল, শান্তির জল ছেটানো হল। ছোড়দা লাউ এনেছিল। সেজদা খুব ভালোবাসত লাউঘন্ট খেতে। মা সেদিন নিজেই রান্না করেছিল সেজদার জন্য। ফুলকপি দিয়ে খিচুড়ি আর লাউঘন্ট। সেজদার জন্য প্রসাদ তুলে রাখল মা।

বললাম, কখন এল মামা?

সারা দিন এল না। আমাদের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। বিকেলে টগর গাছের সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে মা খুব কাঁদছিল। আমি মাকে ঘরে এনে চেয়ারে বসিয়ে বললাম দেখো, সেজদা ঠিক সময়মতো আসেবেই… আসবে।

মা বড়ো করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, সেজদা এল না। মা কিছু খেল না। আমরা খেতে বসলাম সাড়ে দশটায়। কী ঠান্ডা! দরজায় টুকটুক শব্দ হল। ছোড়দা লাফিয়ে উঠে দরজা খুলতেই লোকটা ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দরজায় ঠেসান দিয়ে দাঁড়াল। দু-চোখ বোজা। হাতে পিস্তল। গায়ে রংচটা শস্তার মোটা সোযোর। পায়ে বহু তাপ্পিমারা বুট। মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। আমরা সবাই ভয়ে কাঁপছি। বুকে চেপে ধরা পিস্তলটা দেখে আমি কেঁদে ফেললাম। লোকটা কাঁধের ছেঁড়া চামড়ার ব্যাগ থেকে আর একটা পিস্তল বার করে বাঁ পকেটে ঢুকিয়ে বলল, আস্তে। কাঁদিস না। মা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেজমামার বুকে।

কেমন আছিস বাবা? সেজদার গলার স্বর পালটে গেছে। ভাঙা ভাঙা খসখসে।

সেজদা বলল, আমাকে খেতে দাও। খিদে পেয়েছে।

মা চুপ। বোধহয় কাঁদছে। মায়ের চোখে হাত বুলিয়ে বলি, তারপর?

ভেজা গলায় মা বলে, বড়দি মেজদি ছুটল লুচি তরকারি আনতে। সেজদা একটা চেয়ারে বসে হাঁফাচ্ছে। আমরা কোনও কথা বলছি না। মা পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, আমার কত কষ্ট বুঝিস না?

সেজদা মায়ের হাতটা চেপে ধরে বলে, এবার আমরা স্বাধীন হব। এই মেকি স্বাধীনতা হঠে যাবে। এই রাষ্ট্রতন্ত্র থাকবে না। সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। চেয়ারে বসেই খাচ্ছিল সেজদা। আস্তে আস্তে কথা বলছে।

মা বলল, এখনই চলে যাবি নাকি?

হ্যাঁ।

আবার কবে আসবি?

বলতে পারছি না।

যাবি কোথায় এখন? এত রাত্রি! ঠান্ডা! একটা চাদর দিই?

দাও। বড়দি বাবার শালটা বার করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় এখন যাবে সেজদা?

জানি না।

থালাটা নীচে নামিয়ে রেখে হাত ধুয়ে মাকে বড়দাকে প্রণাম করে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। তার আট-দশ মিনিট পরেই এল পুলিশ। দরজায় লাথি মারছিল। ছোড়দা দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে টাউনবাবু রিভলবার উঁচিয়ে ঢুকল। সঙ্গে দশ-বারোজন জন পুলিশ। হাতে বেয়োনেট লাগানো রাইফেল।

টাউনবাবু বললেন, সে কোথায়?

বড়দা বলল, আসেনি তো!

আমরা দেখেছি আসতে। কোথায় বলুন?

আপনারা সারা বাড়ি খুঁজুন।

টাউনবাবু রিভলবার হাতে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অন্য পুলিশগুলো ঘরদোর তছনছ করে টর্চ জ্বেলে খাটের তলা আলনার পেছন ড্রেসিং টেবিলের পেছন খুঁজছে। থালাগুলোর দিকে তাকিয়ে টাউনবাবু জিজ্ঞেস করেন, আপনারা ছজনই খাচ্ছিলেন?

হ্যাঁ

এই থালাটায় তো দেখছি খাওয়া হয়ে গেছে। কে খেয়েছেন?

বড়দা বলল, আমি।

হাত ধোননি?

এই, কথা বলছিলাম।

কী কথা?

কাল তো দধিকর্মা। দইটা ভোরবেলায় কে আনতে যাবে।

পুলিশগুলো বেরিয়ে এসে বলল, কিছুই নেই স্যার।

টাউনবাবু ঠাকুরের পেছনে ঝোলা গালিচাটা সরিয়ে দেখে বললেন, আবার আসব রাত্রে।

মা চুপ করে রইল।

আমি বললাম, আমিও আন্দোলন করব। জিন্দাবাদ…

মা আমার মুখটা চেপে ধরে বলল, এসব কথা বলতে নেই বাবা। কখনও বোলো না। শুয়ে পড়ো।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম একটা রিভলবার নিয়ে ভুঁড়িওয়ালা হুমদো মতো টাউনবাবুকে তাড়া করছি। টাউনবাবু প্রাণপণ ছুটছে। আমি ক্রমশ লম্বা হয়ে উঠছি, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। তাতে কয়েক রাউন্ড কার্তুজ। আমি যেন সেজমামা হয়ে উঠেছি। ফায়ার করছি। টাউনবাবু পড়ে গিয়ে আবার দৌড়োতে শুরু করল। তারপর যে কোথায় মিলিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না।

আমার ঘুম ভেঙে গেল। মাকে নাড়া দিয়ে বললাম, একটু জল দাও না মা।

মা কাঁসার গেলাসটা মুখের সামনে ধরে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, হাঁফাচ্ছিস কেন? স্বপ্ন দেখেছিস?

না। আবার শুয়ে পড়লাম। মা মাথার বালিশটা ঠিক করে দেয়।

এই স্বপ্নের কথা মা-ঠাম্মা কাউকেই বলিনি।

( ৮ )

সেজমামা যেন আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে। বিপ্লব শব্দটির মানে আমার কাছে বেশ অস্পষ্ট। তবুও শব্দটা শুনলেই সেজমামার কথা মনে পড়ে প্রথমেই। ইতিহাসের ক্লাসে মহাত্মা গান্ধি, সুভাষচন্দ্র, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভমিকা যখনই নৃপেণবাবু পড়ান তখন আমার সামনে এসে দাঁড়ায় সেজমামা। বলে, এই আন্দোলন মেকি। স্বাধীন রাষ্ট্রের সংগ্রামের ইতিহাস অন্য।

ঠাম্মার সামনে স্বাধীনরাষ্ট্রের আন্দোলনের কথা তোলা যায় না। আমাদের বাড়ির সকলের অন্যরকম প্রেক্ষাপট। বাবার দাদু স্বদেশি আন্দোলন করতেন। বহুবার জেল খেটেছেন। চিত্তরঞ্জন দাশ, বিধানচন্দ্র রায়ে সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল। আমাদের শহরের মিউনিসিপ্যালিটির ভোটে তাঁকে দাঁড়াতে বলা হয়েছিল। আমি এসব কিছুই বুঝি না। শুধু বুঝি এই বাড়ির বউ হওয়ায় ঠাম্মার ব্যক্তিত্ব এবং অহংকার দুই-ই ছিল। মাকে কখনও ভোট দিতে যেতে দেখিনি। ঠাম্মা সকাল সকাল চান করে নতুন শাড়ি পরে ভোট দিতে যেত। যেন স্বাধীনতার অধিকার।

আমি যেতাম ঠাম্মার সঙ্গে। কী লম্বা লাইন। ঠাম্মার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। আমাকে ভোটের ঘরে ঢুকতে দেয় না। দরজার বাইরে থেকে দেখি ঠাম্মার আঙুলে ওরা কালি লাগাচ্ছে। তারপর ঠাম্মা ঢুকে যায় বস্তার আড়ালে।

রাত্রে শুয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করি, মামা কোথায় গেছিল?

খুব আস্তে আস্তে মা বলে, তার কয়েক দিন পরই সেজদা আর প্রশান্তদা অ্যারেস্ট হয়েছিল। মা আর ছোড়দা জেলে দেখা করতে গেছিল। দেখা করতে দেয়নি।

মা একটু থেমে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, তার কদিন পর সেজদাকে ছেড়ে দিয়েছিল। পুলিশ কিছু প্রমাণ করতে পারেনি।

আমি মাকে চেপে ধরে বলি, তার পর?

তারপর বড়দা সেজদাকে বাড়ি নিয়ে এল। সারা পিঠে চাবুকের লাল-কালো দাগ। হাঁটুর কাছে থেঁতলানো। রক্ত ঝরছে তখনও। হাঁটতে পারছিল না। ঘাড়ে রক্ত। হাতে রক্ত। সে যে কী অবস্থা! মা অজ্ঞান হয়ে গেছিল।

তারপর?

মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমরা জল গরম করে তাতে ডেটল দিয়ে তুলো ভিজিয়ে সব পরিষ্কার করছিলাম। ছোড়দা ডাক্তার ডেকে আনল। মা চুপ।

তারপর?

সেজদা হাঁটতে পারে না। ধরে ধরে হাঁটে। ডাক্তার আসে। রাত্রিবেলায় চুপিচুপি দীলিপদা, কেষ্টদারা দেখা করতে আসত। বাড়িতে যত বই ছিল সব লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল। প্রদ্যুৎদা একটা গুপ্তি দিয়ে গেছিল।

সেটা কী?

সেটা একটা বাঁশের লাঠির মতো। খুললেই একটা তীক্ষ্ন রড বেরিয়ে আসত। পেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। আবার না খুলে লাঠির মতো পেটানো যেত। ওটা জেঠাইমার বাড়ির পেছনে বনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলল, ঘুমিয়ে পড়ো। আবার অন্য দিন বলব।

উঠে বসে বলি, না। তুমি বলো।

মা বলে, একদম পেছনের ঘরে মিটিং হতো। যাতে চট করে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। সেজদার বন্ধুরা থাকত। আড়াল থেকে আমি আর সেজদি শুনতাম।

তারপর?

মা বলতে শুরু করল, ওরা বলত, ভোট বয়কট করতে হবে। প্রয়োজনে সর্বত্র বিপ্লব ঘটাতে হবে। প্রদ্যুত্দার গলা গমগম করত। আমরা পাহারা দিতাম। মা টগরতলার ধাপিতে বসে থাকত। আমি দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে। যখন রায়গঞ্জে পুলিশের গুলিতে প্রদ্যুত্দার মারা যাওয়ার খবর এল, বড়দি খুব কেঁদেছিল। দুদিন কিছু খায়নি। তার মাস ছয়ে পরে রায়গঞ্জেই বড়দির বিয়ে হল। বলত বিপ্লব দাঁড়িয়ে লাইট পোস্টের আড়ালে। বিপ্লব দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কার্নিসে। এসব আমি কিছুই বুঝছি না। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

বহু দিন পর আবার সেজমামার কথা উঠল। মা চামচে করে দুধ-মুড়ি খাওয়াতে খাওয়াতে বলল, মাসখানেক থাকার পর সেজদা আবার চলে গেল। তার কয়েক মাস পরই বড়দির বিয়ে হল। সেজদা ছিল না। বড়দি খুব কেঁদেছিল। সেজদা আর বড়দাকে কোনও দিন ফোন করেনি।

আমাকে জল খাইয়ে মা বলে, ছোড়দা এক নেতাকে ধরে রাইটার্সে চাকরি পেল। সেজদার বন্ধুরাও পালিয়ে গেছিল। বছরখানেক পর সবাই ফিরে এল শুধু সেজদা এল না। বন্ধুরাও কিছু বলতে পারেনি। শুধু বলেছিল মাস ছয়ে আগে জলপাইগুড়িতে ছিল। বড়দা, ছোড়দা সবাই জেলে জেলে থানায় থানায় খোঁজ নিয়ে কোনও খবর পায়নি।

মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ঠাম্মা একটু দূরে বসেছিল। দেখলাম মায়ের কথা শেষ হতে ঠাম্মা আঁচলে চোখ মুছে চশমাটা পরল। ঠাম্মা কার জন্য কাঁদছিল বাবা না সেজমামার জন্য বুঝতে পারিনি।

পড়তে বসে বারবার বাবার কথা মনে পড়ছে। বহুদিন পর। কালকের টাস্ক কিছুই করতে পারছি না। বাবার সাইকেলটা সিঁড়ির তলায় পড়ে আছে। মা, ঠাম্মা ওটা বিক্রি করেনি। ওই সাইকেলে চড়ে মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে গঙ্গার ধারে যেতাম। মামার বাড়ি যেতাম। সাইকেলের রডে ছোট্ট একটা সিট লাগানো ছিল। তাতে বসতাম। বিকেলে মামার বাড়ি গেলে সন্ধ্যায় ফেরার পথে বাবা ডায়নামো জ্বালাত। মামার বাড়ি যাওয়ার থেকে সেটাই আমার বেশি ভালো লাগত। আমি ডায়নামোর সামনে একটা দুটো তিনটে আঙুল মেলে ধরতাম। রাস্তায় ছায়া পড়ত। ভত… ভত… আলো! বাবা বকত না। বাবা মুখটা নামিয়ে এনে বলত ও রকম করতে নেই পিকুন।

আমি ডায়নামোর আলো থেকে হাত সরিয়ে বাবার দাড়ি কামানো গালে হাতটা বোলাতাম।

হু হু করে কেঁদে উঠতেই মা ছুটে এল। বলল, কী হয়েছে? কাঁদছিস হঠাৎ?

শুধু বাবা শব্দটা উচ্চারণ করতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে মা কেঁদে উঠল।

ঠাম্মা ছুটে এল। আমাকে খাটে শুইয়ে দিয়ে মাকে আমার চেয়ারে বসিয়ে বলল, কেঁদো না বউমা। আমার কষ্ট হয় না?

সেদিন টিভি খোলা হয়নি।

রাত্রিবেলায় আমাকে ঠাম্মা খাইয়ে দিল। মা ঠাম্মা অনেক পরে খেল।

( ৯ )

হঠাৎই যেন বড়ো হয়ে গেলাম। সিক্স পেরিয়ে সেভেন, সেভেন পেরিয়ে এইট, এইট পেরিয়ে নাইনে উঠে পড়লাম। অনেকটা লম্বাও হয়েছি। ঠাম্মা বলে, বাবার মতো হব।

আয়নায় দেখি ওপরের ঠোঁটে সরু গোঁফের রেখা। গলার স্বর খানিকটা ভাঙা ভাঙা খসখসে হয়ে উঠেছে।

আমাদের সঙ্গে সুমিতাদের জমিতে গড়ে ওঠা ফ্ল্যাটের একটি ছেলে খেলতে আসে। খুব ডেঁপো। পাকা পাকা কথা বলে। অমিতা বলে, একদম পাত্তা দিবি না। ভীষণ মিথ্যে কথা বলে।

আমাদের খেলা জমে না। জয়ন্তদের কলকাতায় টেলারিং শপ আছে। ওরা কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনতে চলে গেছে। সঞ্জনার বাবা ব্যাংক-এ চাকরি করেন। ওরা তমলুক চলে গেছে। বাসব কম আসে। ওর বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। প্যারালাইসড হয়ে শুয়ে আছেন বিছানায়। সরস্বতীদি স্কুলে চাকরি নিয়ে বহরমপুর চলে গেছে।

আমরা ভাঙা মন্দিরের পাশে পাশে ঘুরে বেড়াই। বড়োরা মাঠে ফুটবল খেলে। ওখানে আর খেলি না আমরা। বনের পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে ঘেঁটুফুল তুলি। নাকের সামনে মুঠো এনে গন্ধ শুঁকি। ঘুরতে ঘুরতে একসময় সন্ধ্যা নেমে আসে মন্দিরের মাথায়। আমরা সূর্য‌্যাস্ত দেখতে দেখতে অঞ্জলিভরা সব ফুল ভাসিয়ে দিই জলে। জল ছেটাই। ফুলগুলো ভাসতে ভাসতে ভেসেই যায়। বুঝতে পারি না আমার ফুল কোনটা, রাইমার কোনটা, সুমিতা কিংবা ডলির ফুল কোনটা।

মা আমাকে সাযে্স গ্রুপটা ছাড়া সবই পড়ায়। সাযে্স গ্রুপের টিচার খোঁজা হচ্ছে।

একদিন ডলির মা এসে বললেন কেন, সুদেববাবুর কোচিং-এ ভর্তি করে দিন। ডলি তো ওখানে পড়ে। সপ্তায় তিনদিন।

মা বলল, সে তো অনেক দূর!

ডলির মা বলে, ও পড়তে যায় ছটায়। আটটায় ডলির বাবা নিয়ে আসে। পিকুনও আসবে।

তখনই আমার জীবনে অন্য পরিবর্তন ঘটল। আমাদের খেলা বন্ধ হয়ে গেল। খুব মুষড়ে পড়লাম।

ডলি একদিন বলল, অসুবিধের কী আছে? রবিবার বিকেলে আমরা সমরকাকুর মাঠে যাব।

ডলিকে দেখলাম কত লম্বা হয়ে উঠেছে। কী চমত্কার স্বপ্নের মালা গাঁথে। ওর কাছেই প্রথম শিখলাম স্বপ্নের জাল বোনা।

আমার চোখে চোখ রেখে ডলি বলে, আমি রাইমা গান রাইব। সুমিতা, অমিতা নাচবে। আমরা রবীন্দ্রজয়ন্তী করব সুমিতাদের উঠোনে।

রবীন্দ্রজয়ন্তী?

আমার বিষ্ময় দেখে ডলি বলল হ্যাঁ। হ্যাঁ রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে। আমরা আগের মতোই গল্প করব। হাসব। রুমাল চোর খেলব। ঝিলের জলে ভাসাব। আঁশফল, ফলসা পেড়ে খাব। প্রজাপতি ধরব।

আমি বলি, ঝিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে জলফড়িং দেখব। গোলাপের পাপড়ি ভাসাব। তোরা গাইবি দখিন হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল গোপন রেণুকা।/ গন্ধে তারি ছন্দে মাতে কবির রেণুকা।

ডলি দু হাতে আমার হাতটা চেপে ধরে বলে তোরা গাইবি কোমল প্রাণের পাতে পাতে লাগল যে রং পূর্ণিমাতে

সম্পর্কটা জলরঙে আঁকা ছবির মতো। রাত্রে শুয়ে শুয়ে ছবিটা কীভাবে আঁকা শুরু করব ভাবছিলাম। এখন ভালোবাসা শব্দটা অনেকটাই স্পষ্ট। লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই না তুলে উপন্যাস তুলি অনেক দিন ধরেই। সম্পর্কের ছবি আমার কাছে এখন স্পষ্ট আকার নিতে শুরু করেছে।

ডলি যেন দেবী হয়ে ফুটে উঠছে আমার চোখে। বন্ধ চোখের পাপড়িতে এসে বসল জ্যোত্স্না মাখা ডলি। রামধনুর মতো দুই ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করল, কী ভাবছিস?

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিকেলে জড়িয়ে ধরা ফুলের কলির মতো ওর দুহাতের আঙুলের স্পর্শানুভতিটা আমায় মাতাল করে তোলে। ওর নিটোল গোল মুখের টানা চোখের গভীরে ঢুকে পড়ে সাঁতার কাটতে থাকি। ও নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমাদের এতদিনের সম্পর্কের অতল সমুদ্রের তলটা খুঁজে বেড়াই। সামুদ্রিক মাছের পাশ কাটিয়ে আরও আরও গভীরে নামি। নেমে আসে ডলিও তুলতুলে শরীর আর বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা সম্পর্কের অতলে। আমরা ক্রমশ জলের গভীরে নেমে যাই। কীভাবে বুঝতে পারি না।

সুদেববাবুর কাছে ভর্তি হলাম। পড়তে পড়তে হারিয়ে যাই এক গহন অরণ্যে। এই বয়সেই আমরা যেন অনেক কিছু বুঝে গেলাম। ডলি আর আমি কোচিং ক্লাসে অনেক দূরে দূরে বসি। চোখে চোখে খেলি। আমাদের সব কথা চোখেই হয়। ছোঁওয়া, ভালোলাগা, অভিমান চোখে চোখেই গাঢ় হয়ে ওঠে সবার আড়ালে।

আটটায় আমাদের পড়া শেষ হয়। কমলকাকু নারকোল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকেন। সবাই বেরিয়ে আসি। যারা সাইকেল আনে তারা কায়দা করে মজা করতে করতে যায়। আমরা দুজন শেষে বেরোই। আমাদের কোনও তাড়া নেই হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ফিরি। অনেক গল্প করি। সামনে হাঁটেন কমলকাকু। কোর্টে চাকরি করেন। শান্ত, গম্ভীর।

একদিন ডলি ফিস ফিস করে বলে, অত জোরে জোরে কথা বলিস কেন? বাবা বেশি কথা বলা পছন্দ করে না।

আমরা আস্তে আস্তে কথা বলি। রাস্তায় কুকুর আসতে দেখলেই ডলি আমার পেছনে এসে হাতটা ধরে বলে ওঠে ও মা! ভীষণ ভয় করে।

আমি স্পষ্ট বুঝি কুকুরকে ভয় পাওয়ার থেকে আমাকে ছোঁওয়াতেই ওর মজা বেশি। বকুলতলার মুখে এসে যখন আমি দাঁড়াই ওরা সোজা চলে যায়। তখন আমাদের চোখে চোখে কী কথা হয় তা শুধু আমরাই বুঝি। অন্য কেউ নয়। নীল আকাশের জ্যোত্স্না, মায়াবী তারা কিংবা ল্যাম্প পোস্টের মৃদু আলো কেউ নয়।

মনে মনে বলি, কাল ঝিলের ধারে নীল প্রজাপতি ধরব। পুটুসফুলের বুকে বসিয়ে দেব। ডলি যেন বলে যায়, সন্ধ্যামণি ফুলের মালা গাঁথব। সূর্য‌্যাস্তের সময় ঝিলের জলে ভাসিয়ে দেব। আমরা দুজনেই যেন বলে উঠি, ওসব আনার নয়। স্বপ্নের ভুবনে রেখে আসার জিনিস।

আমার হাওয়াই চটির মুখ প্রায়ই খুলে যায়। আবার হেঁট হয়ে লাগিয়ে দৌড়ে গিয়ে ডলিকে ধরে ফেলি। পড়তে যাওয়ার সময় ডলি আমাকে ডাকতে আসে। একদিন ডলি বলল, মায়ের কাছ থেকে দশ টাকা এনে দেব। একটা চটি কিনে নিবি।

ডলির চোখে চোখ রাখলাম। ও যেন চোখের ভাষাতেই বোঝায় তোকে যে কত কী দিতে ইচ্ছে হয়…!

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...