( ৯ )
আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়নি। ঠিকমতো ব্যবস্থা করা হয়ে উঠল না। হঠাৎ করেই অমিতার বিয়ে হল। কিছুটা কথা চালাচালি। তারপর সব চুপচাপ। এমনকী সমরকাকুও।
কী দ্রুত দিন কাটে। গরম চলে গিয়ে আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা। বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে বেড়ায় আকাশে আকাশে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ে। সবাই মন্দিরে উঠে দাঁড়িয়ে থাকি। রাইমা মন্দিরের সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির জলে নাচের মুদ্রায় বাঁ হাতটা নাড়াতে নাড়াতে গায় ছায়া ঘনাইছে বনে বনে, গগনে গগনে ডাকে দেয়া…
আমরা সব্বাই সুরের মূর্ছনায় বৃষ্টির সঙ্গে মিশে যাই। আকাশ জুড়ে বৃষ্টি নামে। গাছের পাতা দোলে। ব্যাং লাফায়। পতঙ্গেরা আপনমনে উড়ে বেড়ায়। নিম গাছের ডালে পাখি ডানা ঝাপটায়। সেদিন সন্ধ্যায় অনেকদিন পর কবিতার খাতাটার পাতায় লিখলাম
বৃষ্টির সুর ভেসে বেড়ায় গাছের পাতায় পাতায়/ মনের ডানায় ডানায় মন্দিরের কুঠুরিতে কুঠুরিতে।/ বনের মাঝে এই ভাঙা মন্দিরে/ কোনও পুরোহিত থাকে না।/
সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বালে না কেউ।/ রাত্রি গভীর হলে/ সত্তর দশকে মৃতবিপ্লবীদের ছায়া পাহারা দেয়/ এই পরিত্যক্ত মন্দির।
খাতাটা সরিয়ে রেখে ইংরাজি টেক্সট বইটা টেনে নিই। তখনই শুরু হল হাঁচি, আর হাঁচি। ঠাম্মা কপালে হাত দিয়ে বলল, হ্যাঁ। যা ভেবেছি তাই। জ্বর এসেছে।
মা রান্নাঘর থেকে বলল, বৃষ্টিতে অত ভিজলে জ্বর হবে না!
ঠাম্মা বলল, যাও শুয়ে পড়ো। আমি বাবুল ডাক্তারকে বলে কটা পুরিয়া নিয়ে আসি।
ঠাম্মা বেরিয়ে গেলে মা আমায় শুইয়ে একটা চাদর চাপা দিয়ে বলল, ঘুমোও। খাবার সময় ডাকব।
গভীর রাতে স্বপ্নে এল ডলি। আমার মাথায় নরম হাত বুলিয়ে বলল, জ্বর এসেছে।
হ্যাঁ
কত?
জানি না। মা জানে।
তুই ঘুমো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
ঘুমটা আমার ভেঙে গেল।
মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মা বলল, জ্বরটা বেড়েছে। আর একটা পুরিয়া খেয়ে নাও। মা পুরিয়া খুলে আমার মুখে ওষুধ ঢেলে দেয়।
( ১০ )
দুদিনেও আমার জ্বর ছাড়ল না।
ঠাম্মা বলল, ও হোমোপ্যাথির কাজ নয় বউমা, আলোপ্যাথ দেখাও।
মা আমাকে শুভজিৎ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তারবাবু বলল ম্যালেরিয়া। আমার চিকিৎসা শুরু হল।
স্কুলে যাই না। কোচিং ক্লাসে যাই না। হাত পায়ে জোর নেই। জ্বর বাড়ে-কমে। মা কিংবা ঠাম্মা ড্রইংরুমে জানলার ধারে চৌকির ওপর শুইয়ে দেয়।
বর্ষা শেষের শরতের আকাশ। কী নির্মল! কী সুন্দর হালকা নীল রং। রাস্তা দিয়ে যে-কত ফেরিওয়ালা যায় তার ঠিক নেই। পিঠে বিরাট বস্তা ঝুলিয়ে যায় কাগজওয়ালা। মাথায় স্টিলের বাসন নিয়ে যায় মহিলারা। মাঝে মাঝে বাড়িতে ঢুকে বলে, কাপড়ের বদলি বাসন নেবে গো?
মাথায় মিষ্টির ঝাঁকা নিয়ে উড়ে খাবারওয়ালা যায়। মাঝেমধ্যে মা, ঠাম্মা ডাকে। মিষ্টি নেয়। আজও লোকটা আমাদের সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী নেবেন?
ঠাম্মা গিয়ে রসগোল্লা, সন্দেশ আর সিঙাড়া নিয়ে আসে আমার জন্য।
দরজাটা দুপুর পর্যন্ত খোলাই থাকে। পরিচিত লোকজনেরা আসে। আমি বিছানায় উঠে বসে মিষ্টি খেতে খেতে লোকজন দেখি। কুকুর দেখি। সাইকেল রিক্শার আসা-যাওয়া দেখি।
দুপুরে মায়ের পাশে শুয়ে শুনি সেই কালো লোকটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সুর করে বলতে বলতে যায়, শিল কাটাও। শিল কা-টা-ও! সুরটা শুনতে ভীষণ ভালো লাগে। আমিও সুর করে গান করি, শিল কাটাও! শিল কা-টা-ও! ঠিক যেমন ডাকঘরের অমল বলত, দই চাই গো দই
চা-ই-ই…
ডাক্তারবাবু আমাকে ঘর থেকে বেরোতে বারণ করেছেন। দুপুরে আমার ঘুম আসে না। বিছানাতেও রোদ আসে না আর। গরম বিছানায় বসে জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখি। উঠোনে চড়াই পাখির দল ঘুরে বেড়ায়। বুলবুলি পাখিটা খালি পেঁপে গাছের ডালে বসে আর উড়ে যায়। নানান রঙের দোপাটি ফুল ফুটেছে পাঁচিলের ধারে। আম গাছটায় আম ধরে না। শুধুই লম্বা হচ্ছে। শুকনো সুপুরি পাতা ঝরে পড়ে। কাক ডাকে কা-কা… মা পাশ ফিরে শোয়।
বিকেলে প্রায়ই রাইমা, অমিতা কিংবা সুমিতা, বাসব আসে। ডলি কোচিং ক্লাসে যাওয়ার সময় আমাকে দেখে যায়। লুকিয়ে লুকিয়ে কচু ভাজা অথবা ঝাল চানাচুর দিয়ে যায়। আমি ঠোঙাটা পেছনে রেখে সবার আড়ালে কচুভাজা পুরে দিই ডলির মুখে।
ডলি বলে, ও বাব্ বা! কী ঝাল!
জল খাবি?
দে।
আমি রান্নাঘর থেকে কাঁসার গেলাস ভর্তি জল এনে দিই। ডলি গেলাসটা নেওয়ার সময় আমার আঙুল চেপে ধরে। তখন মনে হয় আমি আবার ভালো হয়ে উঠেছি। বেনি দুলিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলি, তুই ঠিক ডাকঘরের মতো আমার মালিনী।
ডলি যেতে যেতে তির্যক ভঙ্গিতে ঠোঁট আর ভ্রূ নাচায়। সেই নাচনে আমি সারা সন্ধে নাচতে থাকি। ও পাড়ার মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসে, আল্লা হো আকবর…। বারান্দায় ঠাম্মার পাশে বসে বসে শেষ বিকেলের আলোয় ডলির চলে যাওয়া পথে তার পায়ের চিহ্ন খুঁজি। ঠাম্মা হাত পাখা নিয়ে মাঝে মাঝে আমার ঝুলে থাকা পায়ে সামনে হাওয়া দিয়ে মশা তাড়ায়। তখনই আমার জ্বরটা আসে। রোজ সন্ধেবেলায় আমার জ্বর আসে শীত করে। ঠাম্মা-মা আমায় ধরে এনে শোওয়ার ঘরে শুইয়ে দেয়।
আমি কম্বল চাপা দিয়ে কাঁপি। মা দুধ-সাবু এনে আমায় খাওয়ায়।
সন্ধে দিয়ে গলায় আঁচল জড়িয়ে ঘরে ধূপ দেখাতে এসে ঠাম্মা বলে বউমা, কাল একবার গিয়ে ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট দাও। এক হপ্তাতেও একটুও সুস্থ হল না!
মা আমার মুখের সামনে চামচ ধরে বলে, যাব।
আমি বলি মা,ডাক্তারবাবুকে বোলো আমার ঘরে থাকতে ভালো লাগে না। বাড়ির আকাশটা বড্ড ছোট্ট লাগে। স্কুলে যেতে পারি না। টিফিনে ক্রিকেট খেলতে পারি না। আমি… আমি… আমার গলার স্বর জড়িয়ে যায়। ঘুমিয়ে পড়ি।
অদ্ভুত এক অনুভতি মাঝে মাঝে আমাকে খুব বিষণ্ণ করে তোলে। আবার উত্ফুল্লও করে। কী যেন একটা মনের মধ্যে বাসা বাঁধে। ব্রাশ করতে করতে রোদ্দুর দেখেই অনুভতিটা গাঢ় হয়ে ওঠে। ভালো অথবা মন্দ। বিষাদ কিংবা আনন্দ। সারা দিনরাত্রিই অনুভতিটা ঘুরতে ঘুরতে আমাকে পেঁচিয়ে ধরে। আনন্দেও আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি সেই খেলায়।
কাল রাত্রে আমি স্বপ্নে একটা চিঠি পেলাম। আমার নামে কোনও চিঠি আসে না। ঠিক অমলের মতো। সে বেচারি রোজ অপেক্ষা করে থাকে রাজার চিঠির জন্য। কিন্তু আমি কার চিঠির জন্য অপেক্ষা করব। তবুও করি অজানা একটা চিঠির জন্য।
স্বপ্নের চিঠিটা পিওনকাকু উঠোনে ছুড়ে দিয়ে চিঠি চি-ঠি… বলে চলে গেল। খামটা আমার খোলা হল না। আনন্দ নাকি উত্কন্ঠায় আমার ঘুম ভেঙে গেল বুঝতে পারলাম না। নিঃশব্দে উঠে জল খেলাম, যাতে মায়ের ঘুম না ভাঙে।
সকালে পেঁপে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ব্রাশ করতে করতে আমার চিঠিটার কথা মনে পড়ল। জবা গাছের ওপর আছড়ে পড়া তীব্র রোদ্দুরটার দিকে তাকিয়ে মনটা বিষণ্ণতায় ভরে উঠল। দৌড়ে গিয়ে বাথরুমে ঢুকি। তারপর থেকেই বিষণ্ণতা আমায় পাকে পাকে জড়িয়ে ধরতে শুরু করল।
দুধ বিস্কুট খেয়ে আবার শুয়ে পড়ে জানলা দিয়ে দূর আকাশে চিলের পাক খাওয়া দেখি। শরীরটা আজ অনেক ভালো আছে।
ঠাম্মা চান করে উঠে গামছায় চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, আজ আর চোখ দুটো ছলছল করছে না জ্বর আসেনি তো?
শুয়ে শুয়ে দুপাশে মাথা নাড়ি।
বিকেলবেলায় রাইমা আর বাসব এল। পড়ার ঘরে টুলে বসে গল্প করছি। হাসছি। মা প্লেটে করে নারকেল নাড়ু দিয়ে গেল। হঠাৎই গম্ভীর হয়ে রাইমা বলল, অমিতার ব্যাপারটা শুনেছিস তো?
কী ব্যাপার? বাসব, আমি ওর দিকে তাকালাম।
মাথা নীচু করে হাতের তালু দেখতে দেখতে রাইমা বলল, অমিতা ফিরে এসেছে।
মানে? চমকে উঠলাম। কথাটার অর্থ বুঝি।
রাইমা বলল, ছেলেটা কীরকম যেন। দাঁত মাজে না, চান করে না। থালা ছুড়ে ফেলে।
রাইমা আবার বলল, সমরকাকু নিয়ে চলে এসেছেন। ও আবার স্কুলে ভর্তি হবে।
সকালের বিষণ্ণতা আমাকে ছাযায় ঢেকে দিল। আমার কোনও কষ্ট হল না। শুধু অবাক হলাম। স্বপ্নে দেখা সেই চিঠিটা আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের আর কোনও কথা হয় না।
ওরা চলে গেলে ঘটনাটা মাকে বললাম। মা থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, এসব ভেবো না কিছু। সব ঠিক হয়ে যাবে। এসব ভাগ্যের পরিহাস। নিয়তির খেলা। তা না হলে এইটুকু মেয়ে বিয়ে করে ফেলে!
হাতের গেলাসটা নামিয়ে রেখে বলি, জ্বর এসেছে।
( ১১ )
পড়তে যাওয়ার সময় ডলি বলল, আজ মা আসবে নিতে। বাবা পিসিমনির বাড়ি গেছে। তুই আমাদের পেছন পেছন আসবি। কথাটার অর্থ কিছু বুঝলাম না। আমার বুকে একটা মোচড় লাগল। বললামঠিক আছে।
অন্যদিনের মতো আজ আর খলবল করে কথা বলছি না দেখে ডলি আমার হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করে, রাগ করলি?
না।
তবে কথা বলছিস না কেন?
আমার বুকটা আবার মুচড়ে উঠল। বিনুনিটা নাড়িয়ে দিয়ে বললাম, তোর ওপর আমি রাগ করতে পারি না।
এটা তুই বানিয়ে বলছিস।
আমি তোকে মিথ্যে বলতে পারি না।
এটাও বানানো। বিড়াল তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে ডলি বলল।
তাহলে কী বললে বিশ্বাস করবি?
তুই শুধু শুধু রেগে যাচ্ছিস। ডলি গম্ভীর হল।
তুই শুধুমুদু আমার সঙ্গে ঝগড়া করছিস!
ঝগড়া করছি? ও আমার দিকে অবাক চোখে তাকায়।
আমি সত্যি সত্যি রেগে গিয়ে বলি, তা নয় তো কী? এমন টোনে কথা বলছিস…
ডলি আর কোনও কথা না বলে হাঁটতে থাকে। একটু পরে হাতের নীল বুটি বুটি রুমালে চোখ মোছে।
তুই কাঁদছিস, ডলি? প্লিজ রাগ করিস না। প্লিজ…
আমরা স্যারের বাড়ির সামনে এসে গেছি। ডলি তাড়াতাড়ি হেঁটে ঢুকে গেল। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসছে। আমার রুমাল নেই তাই হাতের উলটো পিঠে জল মুছলাম।
পড়তে বসে অভিমানে এক বারও ওর দিকে তাকাইনি। ও তাকিয়েছিল কিনা বুঝতে পারিনি। আমরা দুজনেই খুব গম্ভীর ভাবে স্যারের তড়িৎ চুম্বক পড়ানো শুনছি।
মৌসুমি কাকিমা স্যারের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন গ্রিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেখে আজ চলি দিদি বলে বেরিয়ে এলেন।
আমি আগে আগে হাঁটছি। একটু দূরত্ব রেখেই। আমাদের গলির মুখে এসে বললাম, কাকিমা যাচ্ছি।
ডলি বলল, যাচ্ছি বলতে নেই, আসছি বলতে হয় বোকা।
আমার বুকে যেন সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস। আবার ভাব হয়ে গেল। আমি জামার হাতায় চোখ মুছলাম।
কাকিমা বললেন, দাঁড়া। আমরা যাব।
পেছন ফিরে তাকিয়ে দৌড়োতে শুরু করলাম। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে ধাক্কা মেরে মা-মা বলে ডাকতে লাগলাম।
দূর থেকে ডলি বলছে, ইশ্! ওরকম চ্যাঁচাচ্ছিস কেন? আস্তে ডাকতে পারিস না?
মনে মনে বলি, রোজ তো তাই করি। আজ যে কী হল!
মা দরজা খুলে কাকিমাকে দেখে অবাক।
ঘরে ঢুকেই মা কাকিমা আর ঠাম্মা কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
একটু দূরে টুলে বসে বললাম, তড়িৎ চুম্বক মাথায় ঢুকেছে?
ডলি মুখের সামনে রুমাল নাড়তে নাড়তে বলল, একটুও না। বাড়িতে গিয়ে নিজে নিজে না পড়লে কিছু বুঝতে পারব না।
সেকি রে? এত সহজ চ্যাপ্টার বুঝতে পারিসনি?
ডলি সেই প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা নিয়ে আমার চোখে চোখ রাখল। বুঝলাম ওর মনটা আজ পড়ার মধ্যে ছিল না। সেই মহাসাগরের গভীরে আমি সাঁতরাতে লাগলাম।
তখনই মৌসুমি কাকিমা বললেন, মাসিমা, পরশু ভাইফোঁটা। ডলি এসে পিকুনকে ফোঁটা দিয়ে যাবে।
আমরা দুজনেই মহাসাগরে ভাসতে ভাসতে কাকিমার দিকে তাকাই।
হঠাৎই বলে উঠি, দারুণ ব্যাপার! অনেক দিন পর ফোঁটা পাব!
মা আমার দিকে তাকায়। সেই চোখ দেখেই বুঝে নিলাম এমন বোকার মতো কথা বলতে নেই।
আমার বাবা এক ছেলে। নাতনিরা ছোটোবেলায় আমাকে ফোঁটা দিত। এখন আর আসে না।
মা বলল, সে তো খুব ভালো কথা। মা রান্নাঘরে চা করতে যেতে যেতে ডলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, দুপুরে তুই এখানে খাবি। ডলি খুশিতে মুখ নীচু করে।
ভাব, ভাব, ভাব…। সবার আড়ালে বুড়ো আঙুল তুলে ডলিকে দেখাই।
পিঠের পেছনে হাত রেখে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ডলি মুখ ভ্যাংচায়। আমিও জিভ ভ্যাঙাই।
বাসব লাইফ সাযে্স আর ফিজিক্যাল সাযে্সের প্র্যাকটিক্যাল খাতা দিয়ে গেছে। ওরা চলে গেলে আমি পড়তে বসলাম। মা আমার প্র্যাকটিক্যাল খাতার ফিতে খুলে পৌষ্টিকতন্ত্র, রেচনতন্ত্র, বিকার, পরীক্ষাগারে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রস্তুতির ছবি এঁকে দিচ্ছিল। সব ছবি মা-ই এঁকে দেয়। মা তো ছবি আঁকতে পারে। বাবা বলেছিল আমাকে আঁকার স্কুলে ভর্তি করে দেবে। আমার আর ভর্তি হওয়া হয়নি।
পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। স্বপ্নে দেখলাম শিউলিতলায় শিশির ভেজা ঘাসের ওপর ফুল কুড়োচ্ছি। পাশে একটি মেয়ে বাঁহাতে পেতলের সাজি নিয়ে ফুল কুড়োচ্ছে। মুখটা কিছুতেই দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু তার ফ্রকের রং ডিজাইন সবই আমি চিনি। মেয়েটিকে ডাকছি, কিছুতেই সে সাড়া দিচ্ছে না। আমি রাগে লাফিয়ে গিয়ে তার হাত ধরলাম। মেয়েটি খিল খিল করে হেসে উঠে বলল, বোকা!
মা ডাকল, পিকুন, ওঠো। খেয়ে নাও। সাড়ে দশটা বাজে।
আজ ভাইফোঁটা।
ছোটোমামা তাড়াতাড়ি আসবে বলেছে। এখানে সেরে রিষড়ার মেজ মাসিমণির কাছে যাবে। বড়োমামার অফিস আছে। রাত্রে খেয়ে যাবে। মেজমামা পান্নাগড় থেকে আসে না। প্রতিবারই মা একটা পোস্টকার্ডে চিঠি লিখে মাথার ওপর চন্দনের ফোঁটা দিয়ে দুদিন আগে আমাকে পোস্ট করতে দেয়।
মা আমাকে তাড়াতাড়ি চান করে নিতে বলল। আমি চান করে পাজামা পাঞ্জাবি পরে রেডি হয়ে নিলাম। ঠাম্মা পুজোয় বসল। মা পরে বসবে।
গতবারে বড়োমামার দেওয়া ছাপা নতুন শাড়িটা মা পরেছে। কী সুন্দর লাগছে মাকে দেখতে। মা দ্রুত হাত-পায়ে সব কিছু করছে। দুব্বো তোলা, প্রদীপ জ্বালিয়ে শাঁখ বাজিয়ে আসন পেতে রাখা অনেক কিছুই। ড্রইযংরুমটা কাল মা-ঠাম্মা দুজনে ঝুলটুল ঝেড়ে জিনিসপত্র সামান্য এদিক ওদিক করে ঘবরটাকে সাজিয়েছে।
কাল খেলতে যাইনি বিকেলে। মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে ডলির জন্য একটা গীতবিতান, দুমামার জন্য শার্টের পিস কিনে এনেছি। মা সুন্দর করে রঙিন কাগজে মুড়ে দিয়েছে গীতবিতানটা।
আটটার পর ছোটোমামা এল। স্কুটার ঢোকাতে ঢোকাতে পিকুন পিকুন বলে ডাকছে। আমি দৌড়ে গেলাম। মামা স্কুটারটা স্ট্যান্ড করে ঘরে ঢুকতেই স্কুটারে উঠে বসলাম। গিয়ারটা অহেতুক নাড়াচাড়া করছি। ব্রেক কষছি। অ্যাকসিলেটরে চাপ দিচ্ছি। স্কুটার চালানোর সময় যেমন শরীর নড়ে সেই সব কায়দা করছি। ঠাম্মা ডাকল। ছুট্টে ঘরে ঢুকি।
ছোটোমামা আসনে বাবু হয়ে বসে। সামনে প্রদীপ জ্বলছে। একটা প্লেটে সাতরকম মিষ্টি জলভর্তি কাচের গেলাস নিয়ে মা এল। চন্দন, ধান, দুব্বো, সুপুরি, পানের রেকাবিটা মায়ের পাশে রেখে শাঁখ নিয়ে দাঁড়াল পেছনে।
আমি একটা কাঠের চেয়ারে বসে দুলতে দুলতে সব দেখছি।
মা ফোঁটা দিয়ে শার্টের পিস মামার হাতে তুলে দিল। মামা শাড়ির প্যাকেটটা মাকে দেয়। ঠাম্মা শাঁখ বাজাচ্ছে। সারা বাড়ি জুড়ে শাঁখের গম্ভীর শব্দ ছড়িয়ে পড়েছে। বেশ পুজো পুজো মনে হচ্ছে।
মা চন্দনের বাটিটা নিয়ে চৌকাঠের মাথায় চন্দনের ফোঁটা দিতে দিতে সেজ মামার জন্য হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।
মামা খাজা চিবোতে চিবোতে বলছে,মিঠু কাঁদিস না। কাঁদিস না। কাঁদতে নেই…
ঠাম্মা মাকে ধরে শোওয়ার ঘরে নিয়ে গেল।
হঠাৎই পরিবেশটা গুম মেরে গেল। মা খাটে শুয়েছিল। মামা এ ঘরে এসে চেয়ারে বসল। আমি খাটের বাজু ধরে দাঁড়াই।
ঠাম্মা চা এনে দেয়। মামা চা খেয়ে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আসছি বলে চলে যায়। মা এখনও কাঁদছে। একটু পরে মা উঠে ঠাকুর ঘরে গেল।
ধূপের সুবাসে সারা বাড়ি ম ম করছে। মা পুজো করছে। ঘন্টাধ্বনি শঙ্খধ্বনিতে আবার সেই পুজো পুজো ব্যাপারটা ফিরে আসে।
আমি জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আমগাছে বুলবুলির বাসা তৈরি দেখি। দুটো পাখি এ-ডালে ও-ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে বাসা তৈরি করছে। সুতুলি দড়ি কাঠি কাগজ কত কী যে জড়ো করেছে! ঠিক তখনই সে এল।
লাল পাড় ক্রিমকালার তাঁতের শাড়ি পরেছে। ঘন বড়ো বড়ো চুলে আলতো ভাবে হাতখোঁপা বাধা। কপালে কুমকুমের লাল টিপ। পাতলা ঠোঁটে কমলা রঙের লিপস্টিক। ডান কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনী ব্যাগে ওকে ঠিক স্কুলের দিদিমণির মতো লাগছে।
আমি ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে হাতের ইশারায় তাকে দাঁড়াতে বলি। ঘর থেকে বেরিয়ে ওর কাছে গিয়ে আঙুল তুলে আমগাছে বুলবুলির বাসা বানানো দেখাই। কয়েক সেকেন্ড পর হঠাৎই পাখি দুটো উড়ে চলে গেল।
বিস্ময়ে ডলি বলে উঠল, যাঃ উড়ে গেল!
আমি বলি, আবার আসবে। ঘর তৈরির সরঞ্জাম আনতে গেছে।
আমার দিকে তাকিয়ে ও আলতো হাসে। সেই হাসির ঝাপটা আমার সারা শরীরে এসে পড়ে।
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর আমরা সবাই ছিটকে গেলাম। আমরা আর সমরকাকুদের ওখানে খেলতে যাই না। মেযো আর আসে না। একদিন ডলি বলল, এখন আমরা বড়ো হয়েছি। ওরকম বনে-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে খেলা মানায় না।
তবে তো তোর সঙ্গে দেখা হবে না?
কেন হবে না? তুই আসবি আমাদের বাড়ি। আমি যাব তোদের বাড়ি।
সত্যি! তোর সঙ্গে পারা যায় না।
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ডলি বলল, আরও চালাক হও, হাঁদারাম!
সাইকেলটা ঝিলের পাশে দাঁড় করানো। সন্ধ্যা ঘন হয়ে এসেছে। আমরা দুজনে ছাতিম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে এই রাস্তা দিয়ে লোকজন যায় না। পেছনে মন্দির। মজা পুকুর। চারপাশে ঘন জঙ্গল। এখন ঝিঁ ঝিঁ পোকার কোনও শব্দ নেই। জোনাকির আলো নেই। পুব আকাশের একফালি চাঁদ শুধু ঝিলের জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। চারপাশে শুধু ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের খিল খিল হাসির শব্দ। আমাদের কথাগুলো গড়িয়ে গিয়ে ভেসে যাচ্ছে ঝিলের জলে।
ডলি আমার দুহাত ধরে সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু আলোয় ঠিক ওকে রাজকন্যার মতো লাগছে। ও বলল, কী নিয়ে পড়বি?
বললাম, আর্টস।
এ ম্মা! তুই সাযে্স নিয়ে পড়। আমাদের মতো মাথা মোটা মেযো আর্টস পড়ে।
জানিস, মা ইংরাজিতে অনার্স। তাই আমাকেও ইংরাজিতে এমএ করাবে।
আমিও বলি, সত্যি! তুই না দারুণ স্বপ্ন দেখতে পারিস? কিন্তু একই সাবজেক্ট হলে ঝগড়া হবে কী করে?
আমার মুখের সামনে মুখ তুলে ডলি বলে, ঝগড়া করব কেন?
আমাকে ডলি দুহাতে জড়িয়ে ধরে। আমি ওর মাথাটা বুকে চেপে ধরি। ওর শরীরের সব গন্ধ আমার শরীরে মিশে যায়।
বুকে মাথা ঘষতে ঘষতে কান্নাভেজা গলায় বলে, তুই খালি ঝগড়া করিস আমার সঙ্গে।
দুহাতে ওর মুখ তুলে চোখে জলের চিকচিক দেখতে দেখতে বলি, আর করব না। কখনও নয়।
ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁওয়াতে যাই। তখনই কে যেন কেশে উঠল। ভয়ে দুজনে দু-দিকে ছিটকে যাই। বুকের ভেতর ধুপ ধুপ করছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। শরীর কাঁপছে ভয়ে কে দেখল! চারদিকে তাকাই। কাউকে দেখতে পাই না। ডলি বুকে হাত দিয়ে ঝিলের ওপারে তাকিয়ে রয়েছে। ওপারে ছোটো ছোটো টালির ঘরে মোমবাতি কিংবা হ্যারিকেন জ্বলছে।
শুকিয়ে যাওয়া গলায় বলি, শব্দটা ওপারে হয়েছে। পুকুরের ওপর দিয়ে ভেসে এসেছে। ডলি তাকায় আমার দিকে। আমি এগিয়ে যাই। হাতটা ধরে কাছে টানি। মুখটা তুলে ধরি ওর মুখের সামনে।
মৃদু কন্ঠে ডলি বলল, আজ থাক। আবার এক দিন আসব।
আমি ওর হাতটা ধরে ঠোঁট ছোঁওয়াই। ডলি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ভিজে জায়গাটা চুষতে চুষতে হেঁটে এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
ক্রমশ…