( ১১ )

আমরা এখন অন্য আকাশ খুঁজে বেড়াই। অন্য ভুবন। বাসব অন্য বন্ধুদের সঙ্গে মেশে। স্কুলের দু’তিনজন বন্ধু আর ওদের চারজন বন্ধু নিয়ে আমার অন্য গ্রুপ। সারা শহর ঘুরে বেড়াই। সাইকেলে চড়ে গ্রামের দিকে চলে যাই। সেখানে গিয়ে চুপি চুপি আম জাম পেড়ে খাই। শহরের ব্যস্ততা এখানে নেই। চারপাশ নিঝুম, নিস্তব্ধ।

বাঁশের বেঞ্চে বসে গোয়ালাদের সাইকেলে বালতি ঝুলিয়ে ছানা নিয়ে যাওয়া দেখি। ধুলো ওড়া পথ দেখি। চারপাশ সবুজে সবুজ। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিই। রাত্রে ডায়ারিটা টেনে নিয়ে লিখি—

ওই যে দূরের বিস্তৃত শ্যামলিমা

সে যে তুমি

ওই যে দূরে ধুলো মাটির পথে

আবছায়া যে দাঁড়িয়ে সে যে তুমি

কালো মেঘের আড়ালে যে হরিণী ছুটে যায়

সে যে তুমি

ছাতিম গাছের নীচে পড়ে…আছে

আমাদের অপূর্ণ স্বপ্ন

একদিন রঙিন মাছের পিঠে চড়ে

পূর্ণ করে আসব-হে জীবন!

একদিন দুপুরবেলায় ঠা ঠা রোদে ডলি এল আমাদের বাড়ি ছাতা মাথায়। ঘেমে নেয়ে একসা। ওড়নাতে মুখ মুছতে মুছতে বলল, শুয়ে ছিলাম। ভালো লাগছিল না। তোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছিল।

তাই চলে এলি?

রাগ করলি?

ওর হাত টেনে সিঁড়ি থেকে বারান্দায় তুলে বলি, একদম না।

খিলখিল করে হেসে ওঠে ডলি। ওর পেছনে আম গাছের ডালে বসে একটা কাক ক্রমাগত ডেকে চলেছে। নিথর গাছের পাতা। একটু বৃষ্টি না হলে মানুষ মরে যাবে। এই রোদ্দুরে পথে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বা রিকশার প্যাঁক প্যাক শব্দও নেই। শুধু গরম হলকা বয়ে যাচ্ছে।

পড়ার ঘরে ঢুকে ফ্যানটা চালিয়ে চেয়ারে বসলাম। ফ্যানের গম গম শব্দে ঘরটা ভরে ওঠে। যত না জোরে ঘোরে শব্দ হয় তার থেকে অনেক বেশি।

আমার বিছানায় পা তুলে বসে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে ডলি প্রশ্ন করল, তুই এখানে ঘুমোস?

যেদিন মন ভালো থাকে সেদিন এখানে শুই। মন খারাপ থাকলে মায়ের কাছে।

ও উঠে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ভেজা কপাল আমার কপালে ঠেকিয়ে বলে, তোর মন খারাপ হয়? কেন? আমার জন্য নাকি অন্য কেউ?

নির্ভীক ও। সাহসী ও। আবেগী ও। আমি এর কোনওটাই নয়। ঠাম্মা বা মা যে-কোনও সময় উঠে পড়তে পারে। যা গরম! ঠাম্মা ফ্যান চালায় না। হাত পাখায় হাওয়া খায়।

মনে মনে সাহসী হওয়ার প্রতিজ্ঞা করতে করতেও ওর হাত দুটো ছাড়ানোর জন্য ফিস ফিস করে বলি, তোর দেখা না পেলেই মন খারাপ হয়। আমাদের তো ফোন নেই যে তোকে ফোন করব।

ও আমাকে ছেড়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে বলে, হবে। সব হবে। বাবা বলছিল, মোবাইল ফোনে সারা দেশ ছেয়ে যাবে।

আমার সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায়। চেয়ারটা বিছানার আরও কাছে এগিয়ে নিয়ে বসি। দরজার দিকে তাকিয়ে ওর নরম গালটা টিপে ধরি। আমার হাতটা ও গালে চেপে ধরে। আমি ঠোঁটটা ওর মুখের সামনে ধরি।

ঠাকুমা আসছেন। বলেই রোল করে অনেক দূরে সরে যায়।

আমার শরীর উথাল পাথাল। সংযত হতে পারি না। দরজার সামনে গিয়ে দেখে আবার ফিরে এসে বসি।

ও খিলখিল করে হাসে। বলে, আজ নয়। অন্য দিন। অন্য কোনওখানে। আমি রাগ করি না ঠকে যাওয়ার জন্য। ডায়ারিটা খুঁজতে থাকি। ওকে কবিতাগুলো শোনাব।

উদাসী দুপুর, মায়ময় বিকেল হারিয়ে যায়। পশ্চিম আকাশ থেকে নেমে আসে সন্ধ্যার ছায়া। সন্ধ্যামণি ফুল ফোটে রান্নাঘরের পাশে। টগর ফুলে ভরে ওঠে গাছ। ডলির দেওয়া ফুলদানিতে মা গন্ধরাজ ফুল সাজিয়ে দেয় বাবার ফটোর সামনে।

এখন আমি দিশাহীন নাবিক। উদ্দেশ্যহীন পথ খুঁজে বেড়াই। সন্ধ্যাতারা দেখে দেখে বাড়ির পথে ফিরি। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও বাড়িতে কিছু বলে না। অনেক গম্ভীর হয়ে উঠলাম সেদিনই যেদিন ঝিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে ডলি বলল, বাবা বদলি হয়ে যাচ্ছে আরামবাগ।

সেদিন কাকতালীয় ভাবে সন্ধ্যার আকাশে মেঘ ছিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। ঝিঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ঐক্যতান হচ্ছিল। ঝিলের ওপারে কুঁড়েঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলেনি। গুরুগম্ভীর মেঘের ডাকে ছাতিমগাছের নীচে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে কেঁপে উঠি।

বলি, তোরা সবাই চলে যাচ্ছিস?

গাছে হাত বোলাতে বোলাতে ও বলল, হ্যাঁ, সব্বাই।

তোর সাথে আর দেখা হবে না?

উদাস হয়ে বলে, হয়তো হবে! হয়তো না। আমি ওর পিঠে হাত রাখি।

কেন হবে না? আমি তোদের ওখানে গিয়ে ক’দিন থেকে আসব ছুটিতে। তুইও আসবি। প্রতি সপ্তায় তোকে একটা করে চিঠি দেব। তুইও দিবি। মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকায়।

কিরে, পারবি না?

গাছের গায়ে মাথা রেখে হু হু করে ডলি কেঁদে ওঠে…

ওকে বুকে চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁওয়াতে যেতেই দৌড়ে চলে গেল।

আমি ডাকি, ডলি! ডলি! দৌড়োস না। পড়ে যাবি। পড়ে যাবি।

সাইকেলটার হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকি। নিথর আমি। নিস্তব্ধ আমি। অথর্ব আমি। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে আমার শার্ট প্যান্ট। আমার গলার স্বর থেমে যায়। আবছা আলোয় দৌড়ে যাচ্ছে ডলি কোন তেপান্তরের দিকে।

রাত্রে খেতে বসে একদিন মাকে বললাম, আমাদের তো ফোন নেই। একটা মোবাইল সেট কিনবে? মা রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে আমার দিকে তাকায়।

কেন?

অনেকেই তো কিনছে। এখন ফোনের যুগ এসেছে। বিপ্লব ঘটে যাবে সারা দেশে। অলকেন্দু কিনেছে। দেখাল আজ। চঞ্চলের বাবার আছে।

ঠাম্মা বলল সেটা কেমন?

আমি দু’হাত নেড়ে বোঝাই, তুমি পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারবে। যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারবে। এইটুকু দেখতে। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোওয়াইট। কালার ফোন বেরোতে আর একটু দেরি হবে। আমাদেরটা বাড়িতে একটা স্ট্যান্ডের ওপর বসিয়ে রাখব। মামার বাড়ি মাসিমণির বাড়ি পিসিমণিদের সঙ্গে কথা বলা যাবে। আর পোস্টকার্ড লাগবে না মাসে মাসে। মা ঠাম্মা অবাক হয়ে আমাকে দেখে।

রাত্রে শুয়ে ঘুম আসে না। কী এক শূন্যতা মনের মধ্যে খালি পাক খায়। বুকে ব্যথা করে। মা ঠাম্মা কাউকেই বলি না যে মাঝে মাঝে চোখে ঝাপসা দেখি। কারও সঙ্গে ঝগড়া করি না। হেরে গিয়ে নিজেকে বোঝাই। কারও ওপর রাগ করি না।

ডলিরা আরামবাগ চলে গিয়ে ঠিকানা দিয়ে একটা চিঠি লিখেছিল। তাতে লেখা ছিল রেজাল্ট বেরোতে এখনও একমাস দেরি। কদিনের জন্য চলে আয় না। দামোদরের ধারে মাটির নীচু পথে পথে হেঁটে বেড়াব। পাখির ডাক শুনব। শেষ বিকেলে সূর্য‌্যাস্ত দেখব। কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে পাখির ফিরে আসা দেখব। ঠিক আচ্ছাসাহেবের ঝিলপাড়ের মতো।

যাব বলে চিঠি লিখেছি। তার উত্তর আসেনি। ঠিক অভিমান নয়, ঠিক অনুরাগ নয়, ঠিক যে কী কারণে যাচ্ছি না তাও জানি না। আমাদের ফোন কেনা হয়নি, বাড়ি রং করা হবে, আমি পাশ করলে সত্যনারায়ণ পুজো দেওয়া হবে ঠাম্মা বলেছে।

আমার নামে হলুদ খামে ভরা চিঠি এল। ডলি লিখেছে অত ছোটো চিঠি লিখেছিস কেন? আমার ওপর রাগে? বাবা বলেছে দুবছরের মধ্যেই আবার ওখানে ট্রান্সফার নিয়ে ফিরে যাবে। চন্দননগর যুগীপাড়ায় আমাদের জমি কেনা আছে। চন্দননগর কলেজে ভর্তি হব। এখানে এসে একটা সাদা স্পিত্জ কেনা হয়েছে। ছমাস বয়স। সারাদিন পায়ে পায়ে ঘোরে আমার। বিকেলে বুকে জড়িয়ে মায়ের সাথে বাঁধের ধারে হাঁটি। মায়ের সুগার ধরেছে। আরও অনেক অ…নে…ক কথা। তিন পৃষ্ঠার চিঠি।

পড়ার ঘরে চিঠি লিখতে বসলাম।

কত বড়ো চিঠি লিখেছিস! বিশ্বাস কর, তোর ওপর আমি রাগ করতে পারি না। এটা মোহ কিনা জানি না। তবে তা সত্য। ধ্রুব সত্য। তোর চিঠিটা আজই পেলাম। ভরা গ্রীষ্মে ঠিক বসন্তের হাওয়ার মতো। খোলা জানলা দরজা দিয়ে দখিনা বাতাসের মতো শরীর বেয়ে মনের ভেতর ঢুকে পড়ছে। দুবছর বাদে ফিরে আসছিস জেনে দারুণ লাগছে। সারা ঘরে যেন ছাতিমফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ওই গানটা দুপুর থেকে মনের মধ্যে বাজচ্ছে ওগো দখিন হাওয়া, ও পথিক হাওয়া, দোদুল দোলায় দাও দুলিয়ে..।

পুরোনো টেপরেকর্ডারটা সারিয়েছি। বাড়িতে থাকলে সব সময়ই রবীন্দ্রসংগীত শুনি। মাংস কিনতে গিয়ে রাইমার সঙ্গে কদিন আগে দেখা হল। হইহই করে কত কথা বললাম। তোর কথাও উঠল। রাইমার খুব মন খারাপ আমাদের সঙ্গে দেখা হয় না বলে। ওকে বলেছি যাব একদিন।

এই চিঠি-চিঠি খেলাটা আমাদের দারুণ জমে উঠেছে। খুঁটিনাটি সবই চিঠিতে একে অপরকে জানাই। শহরটা যে পালটে গেছে কিংবা অনেক দোকান গড়ে উঠেছে নতুন রাস্তার দুপাশে সবই জানাই।

ডলিও লেখে, বর্ষা প্রায় এসে গেছে। দামোদরে জল বেড়েছে। কুকুরটা ওর পাশে শোয়।

এক বারের চিঠিতে লিখেছে রাইমার বাড়ি যাস? কেমন লাগে? আমার থেকেও ভালো? ওর সাথে ঝগড়া করিস? ব্যস, এইটুকু।

আমি ওর অভিমান বুঝতে পারি। এখন আমি অনেক কিছু শিখেছি। প্রতিদিনই নতুন নতুন কত কী যে শিখছি! ভালোবাসা যে কী তা ডলি চলে গিয়ে আমাকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ শুধু ওর কথাই মনে পড়ে। পেছন থেকে হঠাৎই কোনও মেয়েে দেখে চমকে উঠি। মনে মনে ভাবি ডলিরা কি চলে এসেছে!

আমার ভুল ভাঙলে বুঝতে পারি আমার মনের অস্থিরতা। ডলিরও নিশ্চয়ই তাই হয়। তা না হলে রাইমার কথা ও লিখবে কেন? ডলির মনের গভীরে আরও গভীরে ধীরে ধীরে ডুব দিই। মনের উতল হাওয়াটাকে থামাতে চেষ্টা করি। মধ্যরাত্রে মনের ভেতর বাঁশি বাজে। বনের বাণী আকাশের বাণী নক্ষত্রের বাণী ভেসে আসে বুকের মাঝে। হাওয়াটাকে কিছুতেই আয়ত্তে আনতে পারি না।

জানলা দিয়ে ভিজে হাওয়া আসে। নারকেল সুপারি গাছের মাথায় হাওয়ার শব্দ হয়। জানলা দিয়ে দেখি আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে। চারদিক অন্ধকার। ফিসফিস করে বলি, ডলি, ঘুমিয়ে রয়েছিস? আকাশে মেঘ জমেছে। মন্দিরের মাথায় বৃষ্টি নামবে। চল ছাতিমগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়াই। বৃষ্টির কাল্পনিক রিমঝিম শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি।

আমরা সবাই ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করলাম। মা রাইমা, সুমিতা, বাসব, এমনকী অমিতাকেও একদিন মিষ্টি খাওয়াল। ডলিকে বুথ থেকে ফোন করেছিলাম। ও সুমিতাকে তার আগেই ফোন করে সকলের খবর নিয়েছে। সেদিন ডলির কথা যখনই উঠছিল আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম।

কী এক আকুলতায় ছিন্ন-বিছিন্ন হতে হতে দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে। পুরোনো স্কুলে ভর্তি হয়েছি আর্টস নিয়ে ক্রমাগত পড়াশোনার মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য। বিকেলে আজকাল বন্ধুদের সঙ্গে খুব বেশি আড্ডা দিতে যাই না। এখন আমার ফ্রেন্ড সার্কেল অনেক বড়ো হয়েছে। শুধু বড়োই নয়, অনেক বৈচিত্র‌্যময়ও। ভালো খারাপ অনেক কিছুই শিখলাম দেখলাম এবং অনুভব করলাম। সিগারেট ধরলাম।

মা এক দিন শার্টের গন্ধে ধরে ফেলল। কিছু বলল না। নিজে নিজেই সংযত হলাম। ডলিও আজকাল কম চিঠি লেখে। আমি মাঝে মাঝে সন্ধের সময় ফোন করি। বুঝি পড়ার চাপেই হোক বা দেখা না হওয়ার জন্যই হোক আমাদের আবেগ উচ্ছ্বাস অনেক কমে গেছে। বুকের ভেতর কী এক হাহাকার। তবুও কী হয়! জানি না। জিজ্ঞেস করিনি কখনও।

শারীরিক উত্তেজনা মাঝে মাঝেই আমাকে বেসামাল করে দেয়। বিকেলে কখনও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে পুরোনো স্মৃতি হারিয়ে যায়। তখন ঝিলপাড় অথবা ভাঙা মন্দিরের কথা মনে পড়ে না। মনে পড়ে না কয়ে মাস আগে সারা দুপুর কাটানো মাটির বাড়ি, গোবর নিকোনো উঠোন, ধুলোমাখা পথের কোনওটাই। ফাজলামির মধ্যেই সারাটা বিকেল কেটে যায়।

একদিন স্কুল থেকে ফিরতেই মা বলল, ডলি এসেছিল। বুকটা কেঁপে উঠল। কী করব কী বলব কিছুই বুঝতে পারছি না। চোখ জলে ঝাপসা হয়ে উঠল।

শাড়ি ভাঁজ করতে করতে মা বলল, স্কুলে এসেছিল মায়ের সাথে। ফিরে গেছে। ওদের আজকের দিনটা থাকতে বললাম। থাকল না।

মা আরও কিছু বলেছিল আমি কাঁপা বুকে চোখে জল নিয়ে পড়ার ঘরে ঢুকে ব্যাগটা নামিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মনটা ছটফট করছে। দুচোখ বুজে ওর মুখটা মনে করতে চেষ্টা করছি। কিছুতেই মনে করতে পারছি না। সব অস্পষ্ট। ঝাপসা। গায়ে রং-টাও মনে পড়ছে না। কাটা শাঁকালুর মতো নাকি চন্দনকাঠের মতো। কিছুই না। বুকের গন্ধ, চুলের গন্ধ, মনের রং যেন সবটাই হারিয়ে ফেলেছি। আমি যেন কত পালটে গেছি। আগের মতো ছটফট করাটাও ভুলে গেছি। আমাকে যেন ও থমকে দিয়ে গেছে। রাত্রে ইংরাজি স্যারের থেকে পড়ে ফিরে চিঠি লিখতে বসলাম।

দশ-এগারো দিন পর উত্তর এল। লিখেছে, তোর সব রাগ আর অভিমান কি আমার ওপরেই? আমার কি কষ্ট হয় না? কাকিমার কাছে শুনলাম কীসব বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মিশছিস? সে কি আমার ওপর ঘৃণায়? সিগারেট খাচ্ছিস কেন? তাতে কি স্মার্ট হওয়া যায়? চিঠি লিখিস না, আমাকে ফোন করিস না আমার বুঝি অভিমান হয় না? রাগ হয় না? সে দিন মাকে অনেক ভাবে রাজি করিয়ে তোদের বাড়ি গেছিলাম। জানতাম তোর সঙ্গে দেখা হবে না। তবুও গেলাম বাড়িটা দেখতে, বাগানটা দেখতে। পড়ার ঘরে তোর গন্ধ পেতে। ঘরটা কী নোংরা করে রেখেছিস? তোর টেবিলটা গুছিয়ে দিলাম। পেন পেনসিলগুলো সাজিয়ে রাখলাম পরপর। আমার চিঠিগুলো কোথাও পেলাম না। ফেলে দিয়েছিস? আমাকে ভুলে যাচ্ছিস? আমি তো কই তোকে ভুলতে পারি না। তোরা কেউ আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখিসনি। রাইমা, অমিতা, সুমিতা, কেউ চিঠি দেয় না। আমি কি অন্যায় করেছি? আমি ওদেরও চিঠি দিতাম। তোর মতোই কেউ আমাকে চিঠি দেয় না। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কাঁদি। তুইও যে এমন করবি ভাবিনি। আমার ওপর রাগ করে যদি তুই তৃপ্তি পাস তবে তাই কর। আমাকে ভুলে যা। ইতি, তোর ভুলে যাওয়া ডলি।

আমার এই রাগই আমার বড়ো শত্রু। ঠাম্মা বলে বাবার যেমন জেদ ছিল তেমনই রাগ ছিল। আমারও তাই। মা বলে রাগ ভালো না, বড়ো কাজ করতে দেয় না।

আমি কিছুতেই রাগটা কমাতে পারি না। ভুল বুঝি। এই যেমন ডলির ওপর আমার রাগটা যে কেন জানি না। বুঝতে পারি আমার ওভাবে চিঠি লেখাটা আসলে তীব্র ভালোবাসারই প্রকাশ। কিন্তু ওকে যে হার্ট করতে পারে তা ভাবতে পারিনি। ও ঠিকই বলত হাঁদারাম। প্রতি মুহূর্তেই বুঝতে পারি আমি একটি হাঁদারাম।

মা কখনও আমাকে সরাসরি কিছু বলেনি। আমাকে বকতে দেখলেই ঠাম্মা রেগে যায়। মা আমাকে শাসন পর্যন্ত করে না। কিন্তু আমি যে কত ছোটো হয়ে গেছি মায়ের চোখে তা এই চিঠিতে বুঝলাম। মায়ের অভিমানটাও বুঝলাম। আজ বিকেলে আর বেরোলাম না। টিভি দেখলাম কিছুক্ষণ। ঠাম্মার সাথে খোলা বারান্দায় বসে গল্প করলাম।

আজ ইংরাজি স্যারের কাছে পড়তে যাওয়া নেই। সন্ধেবেলায় পড়তে বসলাম। ঠিক মন বসছে না। ডলির চিঠিটা আবার পড়লাম। মনটা চঞ্চল হয়ে রয়েছে। কী লিখব বা কীভাবে ওকে বোঝাব আমার কথা, তার কোনও ভাষাই খুঁজে পাচ্ছি না। এ-বই ও-বই অনেকক্ষণ ধরে নাড়াচড়া করলাম। মনটাকে শান্ত করার জন্য কবিতার ডায়ারিটা বার করে পুরোনো কবিতাগুলোই পড়তে লাগলাম। হঠাৎই উঠে রান্নাঘরে গেলাম। ঠাম্মা টিভি দেখছে। মা গ্যাস আভেনের সামনে দাঁড়িয়ে আটা মাখছিল।

মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুমি আমার ওপর রাগ করেছে?

দূর বোকা। রাগ করব কেন?

ওই যে ডলি লিখেছে বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশি?

ওরা বড়োলোকের ছেলে। ওদের আদবকায়দা অন্যরকম। ওদের জীবনযাপনও অন্য ধরনের। আমাদের সঙ্গে মেলে?

মা, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত।

ভালো করে পড়াশোনা করো। অনেক বড়ো হতে হবে। জীবনের আদর্শ ঠিক করো। স্বামীজি, বিধানচন্দ্র, ক্ষুদিরাম এঁদের কথা ভাবো। ব্যক্তি-স্বাধীনতা দিয়ে বড়ো হওয়া যায় না।

আমি মায়ের কথার অর্থ বুঝতে পারি। এখন অনেক বড়ো হয়েছি। আমাকে সামাজিক হতে হবে। রাগ অভিমান বড়ো নয়। আদর্শ মানুষ হয়ে উঠতে হবে। আমি ফিরে এসে পড়তে বসি।

 

পড়তে পড়তে আমি অনেক বড়ো হয়ে গেলাম। হায়ার সেকেন্ডারি, বিএ, তারপর ইংরাজিতে এমএ পাশও করলাম। মায়ের চুলে পাক ধরেছে। ঠাম্মাও আগের থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছে। আমি চাকরির চেষ্টা করি। ডলির কথা মনে পড়ে না আর। ওরা এখানে বাড়ি করেছে কিনা জানি না।

আচ্ছাসাহেবের ওদিকেও আর যাওয়া হয় না। অতীত আমার কাছে হারিয়ে গেছে। শুধুই বর্তমান আর নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। মাঝেমধ্যে কবিতা লিখি। লিটিল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। বড়ো পত্রিকাতেও বেরোয় কখনও-সখনও। কিছু টাকা পাই। মাকে দিয়ে দিই।

ইউনিভার্সিটির কয়েজন বন্ধু মিলে চটি একটা ম্যাগাজিন বার করতাম। দুবার বেরিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। তারপরই চাকরির পরীক্ষার জন্য ছোটাছুটি শুরু করলাম। সিএসসি, এসএসসি সবেতেই পরীক্ষায় বসতে থাকি। বাড়িতে মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক লেভেলে ইংরেজি পড়াই। এগারোজন স্টুডেন্ট। মাকে কিছু টাকা দিই।

হঠাৎই ঠাম্মার হার্ট অ্যাটাক হল। ডাক্তার হাসপাতাল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। একটা মোবাইল সেট কেনার জন্য হাজার তিনেক টাকা জমিয়েছিলাম। সব ঠাম্মার অসুখে খরচ করে ফেললাম। তাতে আমার আনন্দই হল। দিন পনেরো পরে যখন ঠাম্মাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম, তখন আর আমার আনন্দের সীমা রইল না।

ঠাম্মা খাটের বালিশে ঠেসান দিয়ে বসে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, কত সাবালক হয়ে গেছিস তুই! নাতি হয়ে আমার ছেলের মতো কাজ করেছিস। তোর বাবা থাকলে…

মা বলল, ওর তো করারই কথা। থাক ওসব। হরলিক্সটা খেয়ে নিন। ঠাম্মার চোখ চকচক করছে। আমি মাথা নীচু করলাম।

মাসখানেক পর থেকে ঠাম্মাকে নিয়ে ভোরবেলায় হাঁটতে বেরোই। ডাক্তারবাবু বলেছেন। পাড়াতেই হাঁটি। ঠাম্মাকে একটা ছড়ি কিনে দিয়েছি। ঠাম্মা ছড়ি নিয়ে হাঁটে।

একদিন বড়ো রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে বলল, চল সামনের গলিটায় একটু হেঁটে আসি।

বুক দুর দুরু করে উঠল। পা দুখানা কেঁপে উঠল। একটা আবছা মূর্তি যেন সামনে দাঁড়িয়ে বেণি দুটো দুলছে অল্প অল্প। হাত দুটো আমার সামনে মেলা। জুতোর ঠকঠক শব্দ। ঠিক যেমন ডলি করত। কথা বলত না। জুতোর শব্দে ওর দিকে তাকাতেই চোখের ইশারায় সব বলে দিত। হাওয়ায় উড়ছে মূর্তিটার ওড়না। পর মুহূর্তেই মনে হল মূর্তিটা সুমিতার। হঠাৎই সুমিতা হারিয়ে গিয়ে রাইমা হয়ে উঠল। না ঠিক তা নয়। মূর্তিটা বাসবের।

মনে মনে বলি ডলি তুই কোথায়? কেমন আছিস? আমার কথা কি তোর মনে আছে?

আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মসজিদের পাশে কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। গরু ঘাস খাচ্ছে। শিমূলগাছের আড়াল থেকে কোকিলের ডাক ভেসে আসছে। ভেরেন্ডা আশ শ্যাওড়ার ঝোপে ঝোপে জোনাকি উড়ে বেড়াচ্ছে।

ঠাম্মা বলল, কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লি?

আমার একটুও যেতে ইচ্ছা করছে না। একটু হাঁটলেই ঝিল। মজা পুকুর। মন্দির। আচ্ছাসাহেবের মাঠ। কী এক শূন্যতায় বুকটা কাঁপছে। বললাম, রাস্তাটা ভালো নয়। গর্ত, উঁচু নীচু। তুমি হাঁটতে পারবে না।

ঠাম্মা আমার কথা বিশ্বাস করে উলটো পথে হাঁটতে শুরু করল। ঠাম্মার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনটা কেমন বিষণ্ণতায় ভরে উঠল।

যারাই ঠাম্মাকে দেখতে আসে তাদের সবাইকে মা ঠাম্মা পরপর সুর করে বলতে থাকে, পিকুনকে নিয়ে চিন্তা। একটা চাকরি পেলে যেন একটু শান্তি পাই আমরা। আরও কত কী! পড়াতে পড়াতে সব শুনতে পাই।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর কখনও কখনও ছাদে বসে সিগারেট খাই। নিঝুম দুপুর। পাঁচিলের ওপাশ থেকে ভেসে আসে ঘুঘুর ডাক। কুকুরছানার চিত্কার। ফেরিওয়ালা হেঁকে যায়। নারকেল গাছের পাতায় ঘুড়ি আটকে। সুতো ঝুলছে। ছাদের এ-মাথা ও-মাথা হেঁটে বেড়াই। কত কী যে ভাবি তার মাথামুণ্ডু নেই।

ভাবতে ভাবতেই ছটা বছর কেটে গেল। চাকরি পাইনি। চাকরি পাইনি বলাটা ভুল। সিপিএমের রাজত্ব চলছে এখন। এক নেতাকে ধরে মহসিন কলেজে পার্ট টাইম পড়ানোর একটা সুযোগ পেয়েছি। সেই সুবাদেই আমার বাড়ি স্টুডেন্টে ভর্তি হয়ে গেল। সকাল সন্ধে রাত্রি শুধু পড়াই, পড়াই আর পড়াই।

রোজ কাগজে দেখি খুনখারাবির ছবি। ঘটনা। সিঙ্গুর, লালগড়, নন্দীগ্রাম, জঙ্গলমহলে বিদ্রোহ প্রতিবাদের কাহিনি। মানুষ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা। জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের শায়েস্তা  করতে কোবরা বাহিনীর অভিযান। মাটির তলায় নুনে ঢাকা মানুষের ছবি। হার্মাদ বাহিনীর অত্যাচার। জমি দখলের লড়াই। পড়তে পড়তে টিভি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি।

বহু দিন আগে মা বলেছিল জীবনে একটা আদর্শ থাকা দরকার। এই ত্রিশ বছরে পা দিয়ে আমার কি কোনও আদর্শ গড়ে উঠেছে! মা ঠাম্মাকে ভালো ভাবে রাখাই কি আদর্শ! অথবা ছাত্রদের সুন্দর ভাবে গড়ে তোলাই কি আদর্শ! নাকি সুবিধাবাদী ইনটেলেকচু্য়াল হয়ে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই, জঙ্গলমহলে অত্যাচারিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই আদর্শ! কিছুই বুঝতে পারি না। কিছুই না।

ক্রমশ……..

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...