( ১৫ )

চার মাসের মধ্যেই কলেজে আমার বেশ নাম হয়ে গেল। এক দিন ইংরাজি ডিপার্টমেন্টের হেড এসডি আমাকে বললেন, বেশ ভালোই তো পড়াচ্ছ শুনছি। এবার পিএইচডি-টা করে নাও।

আপনি যদি স্যার একটু হেল্প করেন তবে আপনার আন্ডারে…

আমার কাঁধটা বাঁ হাতে ঝাঁকিয়ে এসডি বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে।

স্বপ্নটা আমার বহু দিনের। খুশিতে বারবার তাঁকে থ্যাংকস জানিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন শীতের বিকেল বিদায়ের জন্য প্রস্তুত।

খোলা বারান্দায় বসে ঠাম্মা আর মা গল্প করছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম ঠাম্মা বলছে, দ্যাখো বউমা, পিকুন ঠিক বাবার মতোই হয়েছে। লম্বা চেহারা, চওড়া কাঁধ। ব্যাটা ছেলে তো এরকমই হবে।

মা বলল, লক্ষ্য করেছেন মা, কেমন বয়স্কদের মতো ব্যাক ব্রাশ করে চুল আঁচড়ায়?

আমি বললাম, ঠিক আছে, রবিবারই চুলের স্টাইল পালটে খোকা হয়ে যাব।

মা চা করতে গেল। ঠাম্মার পাশে মায়ের চেয়ারটায় বসলাম। ঠাম্মার হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। গোল গোল হাতে কেমন শিরা ফুটে উঠেছে।

ঠাম্মা বুঝতে পেরে বলল, হবে না। বয়স কত হল?

ডাক্তার দেখিয়ে তোমাকে এবার ভিটামিন ওষুধ এনে দেব।

আচ্ছা আচ্ছা। সব হবে। পোশাক ছেড়ে হাত ধুয়ে নে। সেই কখন বেরিয়েছিস।

আমি পোশাক পালটাতে যাই।

হাত মুখ ধুতে ধুতে ঠিক করে ফেললাম পোস্ট মর্ডান পোয়েট্রি  নিয়ে আমার পেপারস রেডি করব। চা খেতে খেতে এসডিকে ফোন করলাম। উনি খুশি হলেন।

ঠাম্মার সঙ্গে চা খেতে খেতে সন্ধ্যা শুরুর আকাশ লাল হয়ে উঠল। আমাদের ছোট্ট আমগাছটায় পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ। কয়েটা বাদলে পোকা বারান্দায় ওড়াউড়ি করছে। রাস্তা দিয়ে যে কত লোক যাচ্ছে! বাইক যাচ্ছে। রিকশা যাচ্ছে। এই পথটার গুরুত্ব আজকাল অনেক বেড়ে গেছে। বহু রাতেও বাইক কিংবা সাইকেলের শব্দ শোনা যায়। মা ঠাম্মাকে একটা চাদর দিয়ে গেল।

ঠাম্মা বলল, গায়ে কিছু দে। শুধু পাঞ্জাবি পরে থাকলে হবে? ঠান্ডা লাগবে।

পরছি।

বাগানে মালি দিয়ে মা অনেক গাছ লাগিয়েছে। লম্বা পাইপ এনে দিয়েছি। মা রোজ জল দেয়, কতরকম ফুল ফুটেছে। গাঁদা, সিজন ফ্লাওয়ার, চন্দ্রমল্লিকা অনেক অনেক। ডালিয়ায় কুঁড়ি ধরেছে। সুন্দর লাগে বাগানটা দেখতে।

হঠাৎ বলি, ঠাম্মা পুরি যাবে?

পুরি?

হ্যাঁ। আমরা তিনজন। সবাই বেড়াতে যায়। আমরা কোথাও যাই না। ঠাম্মা দুহাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে বলে, জয় বাবা জগন্নাথ।

কিন্তু বাড়িতে থাকবে কে?

নতুন কাজের বউটাকে বলো না? কদিন রাত্রে শোবে। এক্সট্রা টাকা দেব।

মা বলল, কবিতাদির সঙ্গে কথা বলবে। ওদের বাড়িতে যে-লোকটা শোয় বেড়াতে গেলে বেশ ভালো। যাবি কবে?

ঠাম্মা বলল, তোর দাদুর সঙ্গে একবার দেওঘর আর একবার কাশী গেসলাম। আর কোথাও যাইনি।

মা বলল, ছোটোবেলায় খুব ঘুরেছি। বাবা তো রেলে চাকরি করত। পুরি, আগ্রা, নৈনিতাল সব ঘুরেছি। বিয়ে পর দার্জিলিং গেছিলাম তোর বাবার সঙ্গে। তখন তুই হোসনি।

জমে উঠল বেড়ানোর গল্প। কোথায় কী সমস্যা হয়েছিল কোথায় মজা সব কথা পালা করে বলে মা ঠাম্মা। আমি বন্ধুদের সঙ্গে এমএ পড়ার সময় একবার বসন্তোত্সবে শুধু শান্তিনিকেতনে গেছিলাম। আর কোথাও নয়। রোজই কলেজে শুনি এ ভইজ্যাক যাচ্ছে, সে গোয়া যাচ্ছে, ও ত্রিবান্দম যাচ্ছে। বেড়ানোর গল্পের মধ্যেই সন্ধে নেমে এল। রাস্তায় আলো জ্বলে উঠল। গাছে গাছে কুঁড়ি ফুটে উঠল।

 

সপ্তাহ দুয়ে হল মেয়েটি কলেজে জয়ে করেছে। ফিলোজফির পার্ট টাইমার। দূর থেকে দেখেছি। শ্যামলা রং। শর্ট হাইট। বেশ সপ্রতিভ। হাইহিল জুতো পরে গটমটিয়ে হাঁটে।

স্টাফ রুমে বসে চা খাচ্ছিলাম। অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার র‌্যাকে রেখে আমার পাশের চেয়ারটায় বসে বলল, আপনিই ডিএম? সরি। দেবদত্ত মল্লিক?

হ্যাঁ।

আমি গার্গী সোম।

হাঁ, আপনাকে দূর থেকে দেখেছি। আর রুটিনে দেখেছি জিএস লেখা।

আমাকে থামিয়ে বাঁ হাতের ঘড়িটা ঘুরিয়ে সোজা করতে করতে বলল, আপনার তো খুব নাম। ছেলে-মেযো সবাই বলে। আমি মুচকি হাসলাম।

আপনি আসেন কোথা থেকে?

বৈদ্যবাটী।

চা খাবেন?

না। আমি দুবার চা খাই। সকালে আর বাড়ি ফিরে।

ওর কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে উঠলাম। গার্গীও হাসল। গোল মুখে গজ দাঁতে ভারি সুন্দর লাগছে দেখতে। টিপ পরে না। হর্সটেইল করে বাঁধা চুল।

জিজ্ঞেস করি, কোন সালের ব্যাচ?

দুহাজার আট। আপনি?

চার।

আমাদের আলাপ জমে ওঠে। এখন চোখে চোখ রেখেই মেয়েের মন বুঝতে পারি। বলি, ক্লাস শেষ?

শেষই বলতে পারেন। তিনটে পযঁতাল্লিশে সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস আছে। ওরা বলল আজ আর ক্লাস করবে না ইউনিয়নের মিটিং আছে। আমি আর বসে থেকে কী করব? আপনার ক্লাস শেষ?

হ্যাঁ।

বেরোবেন? সরি। যদি আপনার অন্য কাজ থাকে…!

না। আমার কাজ আর কিছু নেই। সিলিং-এর ঝুল-ধুলো দেখতে দেখতে বললাম।

দুলালদাকে চায়ে দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কলেজ পেরিয়ে রবীন্দ্রভবন পার করে মাঠের পাশ দিয়ে আমরা হাঁটছি। হালকা উত্তুরে হাওয়া ভেসে আসছে। মাঠে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। সাদা পোশাকের প্লেয়ারদের দেখলেই আমার মনে হয় যেন টেস্ট খেলা হচ্ছে। দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে হাঁটছিলাম। যেন ও থটরিডার। আমার মনের কথা সব বুঝতে পেরেছে। এমন ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করল, ক্রিকেট আপনার প্রিয় খেলা, না?

দূর! সেভাবে কোনওদিন কিছু খেলিইনি।

আপনার চোখ দেখেই মনে হয় পড়াশোনাটাই বোধ হয় আপনার প্রিয়? গল্প লেখেন?

না না।

প্রবন্ধ?

উরিঃ বাবা। ওসব কিছু নয়। তবে একটু আধটু কবিতা লিখি, মাঝেমধ্যে।

অবাক চোখে আমাকে দেখে বলে, ওসব কিছু নয় মানে আপনি ক্লাসে ঔযে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, এলিয়ট, যেভাবে পড়ান…। একদিন এসডি সিএম-কে বলছিলেন, একে বারে ফাটাফাটি।

ওঃ।

ব্যাগটা কাঁধে ভালো করে ঝুলিয়ে বলল, ফরাসি কবিতা আপনার কেমন লাগে?

ও-উ-ফ! দারুণ!

জানেন আমাকে এক বন্ধু সুনীল গাঙ্গুলীর ছবির দেশে কবিতার দেশে বইটা দিয়েছিল। কী কবিতা! জাক প্রেভের একটা কবিতা দারুণ লাগে আমার।

আড় চোখে ওর সস্তার সিন্থেটিক শাড়িটা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করি, কোনটা?

ওই যে ওই কবিতাটা, লোহার বাজারে গিয়েছি আমি/ শিকল কিনেছি। কঠিন শিকল/ তোমারই জন্য/ হে আমার প্রেম…। একটু থেমে বলে, কী ডেপথ! কী কনসেপ্ট! অদ্ভুত অ্যাপ্রোচ! ভাবা যায় না। দারুণ।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা অটোস্ট্যান্ডে চলে এলাম। বলি, অটো ধরবেন তো স্টেশনে যাওয়ার?

( ১৬ )

এক শুক্রবার কলেজে ক্লাস হল না। ছাত্র-ছাত্রীদের নানান দাবিতে ক্লাস বয়কট চলছে।

স্টাফরুমে বসে গার্গী বলল, দেড়টা বাজে। আর বসে থেকে কী হবে? চলুন বেরিয়ে পড়ি। বাড়ি গিয়ে একটু ঘুমনো যাবে।

ফিজিক্সের অন্তরাদি ওর পাশেই বসেছিলেন। বললেন, তুমি দুপুরে ঘুমোও? মোটা হয়ে যাবে যে! হিহি করে হেসে ওঠে গার্গী। বলে, মোটাই তো হয়ে গেছি।

অন্তরাদি ডান কাঁধে ঝোলা হলুদ শালটা পিঠে ছড়িয়ে নিয়ে বললেন, না না। মোটা কোথায়? এত চমত্কার স্লিম ফিগার তোমার! আমিই কেমন মুটিয়ে গেছি। উনি বাঁ হাতটা গলা থেকে বুলিয়ে নীচের দিকে নামালেন।

আমি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলি, চলুন। যাওয়া যাক।

আমরা তিনজনে স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে কাঠের পেঁচানো সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম।

বট-শিমূলের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে গার্গী বলল, আপনারা চলুন আজ আমাদের বাড়ি।

আমি রাজি।

অন্তরাদি কসবায় থাকেন। অনেক দূর যেতে হবে। বললেন, আজ নয়! একটা ছুটির দিন বরং তোমার বাড়ি যাব। আমরা অটোয় স্টেশনে এলাম। আমার টিকিট কাটতে কাটতে ট্রেন চলে এল। অন্তরাদি ট্রেনে উঠে পড়লেন। গার্গী স্টেশনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে।

টিকিট কেটে একটা বেঞ্চে আমরা বসলাম। গার্গী তাদের বাড়িটা কেমন, কে কে আছেন বাড়িতে এসব বলছিল। আজ ও পেনসিল ন্যারো ব্লু জিনসের সঙ্গে গুজরাটি কাজ করা সবুজ কুর্তি পরেছে। একটা কালো কার্ডিগান ওর শরীরটা ঢেকে রেখেছে। আজ ওকে ভীষণ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। আমার মনে হল ও যেন সবুজ পরি। গলার দু-পাশে ঝোলা সাদা উড়নিটা যেন ওর দুটো ডানা।

আবার আমি হারিয়ে গেলাম। ওর কথা কিছুই শুনছি না। বাড়িতে গেলে তো সব কিছুই দেখতে পাব। জানতে পারব। এক অন্য খেলায় মেতে উঠলাম। বললাম, আমি কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারব না। ওর মুখটা শুকিয়ে গেল।

ওর চোখে চোখ রেখে বলি, আমার টিউশনি আছে। স্টুডেন্টরা এসে বসে থাকবে।

মুখ নীচু করে বাঁ হাতের সিলভার কালারের নেল পালিশ লাগানো আঙুলগুলো দেখতে দেখতে বলল, তা হলে এলেন কেন?

কন্ঠস্বরে ওর অভিমানটা বুঝতে পেরে বলি, আরে অনেক সময় আছে। ছটায় পড়তে আসবে। ও কিছু না বলে ট্রেন লাইনের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

একটু পরে ট্রেন আসতেই উঠে পড়লাম। ফাঁকা ট্রেন। সামনা সামনি দুজনে বসি। ওর মুড একদম পালটে গেছে। ঠোঁটে হাসি। চোখে আনন্দের আভাস। বলল, দু-পাশটা দেখুন। সবুজ সবুজ। ওই আমগাছগুলো আর কয়েমাস পরে বউলে বউলে ভরে উঠবে। ফলে ফলে ভরে যাবে। ইউনিভার্সিটি যাওয়ার সময় দেখতাম।

ওহ।

অবাক চোখে গার্গী দেখছে। যেন ছাত্রীজীবনের সময়টাকে খুঁজছে। তিনটে স্টেশন পেরিয়ে আমরা নামলাম। খুব নির্জন স্টেশন। এখন বেশি যাত্রী থাকার কথা নয়,  নেইও। চায়ে স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বলি, চা

কটা? চাওয়ালা জিজ্ঞেস করে।

আপনি চা খাবেন?

আজ খাব।

আমরা বিস্কুট নিলাম। ভাঁড়ে গরম চা। দাম মেটালাম।

স্টেশনেরএকটা বেঞ্চে বসে গার্গী বলল, একটু পরে ওইখানে গরম চপ ভাজবে। আঙুল তুলে দেখায়।

খাবেন?

খাব। একটা কথা বলব? রাগ করবেন না? সরু চোখে আমার দিকে তাকায়।

কী কথা?

আজ যদি বাকি সময়টা এখানে বসে কাটাই? অন্য দিন না হয়…

সেই ভালো। ওই দেখুন ট্রেন আসছে। মেল ট্রেন। কেমন সারা প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে যাবে!

এমন ভাবে ও বলছে যেন ও-ই ব্যাপারটা আবিষ্কার করেছে। আমাকে দেখাতে এনেছে।

ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে গার্গী। কী বিস্ময় ওর চোখে। হুইসেল দিতে দিতে ট্রেনটা ছুটে আসছে। প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়েছে। ইঞ্জিনের ঝমঝম শব্দ। ট্রেনটা যেন বাঘের মতো দৌড়ে গেল শিকার ধরতে।

ঘাড় ঘুরিয়ে ট্রেনের পেছনের অংশটা মিলিয়ে যাওয়া পর‌্যন্ত চুপ করে দেখে বলল, পুরুষ মানুষ ঠিক এমনই হবে। গ্রিক সেনাপতিদের মতো। হাতে তরোয়াল নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে যাবে রণক্ষেত্রে। পেছন পেছন সৈন্যরা। কী রোমাঞ্চকর বলুন তো?

রেলিঙের ওপাশে ভাঁড়টা ছুড়ে ফেলে বলি, আপনি খুব রোমান্টিক তো?

খিল খিল করে হেসে উঠে বলে, ব্যাপারটা আমার দারুণ লাগে। আগে বন্ধুরা মিলে বিকেলে মেল ট্রেন দেখতে আসতাম। বন্ধুরা বলত কত লম্বা ট্রেন। জানেন, আমরা সবাই লম্বা পুরুষ দেখতাম আর খুঁজতাম তাদের মধ্যে গ্রিক যুবকদের বৈশিষ্ট্য আছে কি না। এমা! আপনাকে সব বলে ফেললাম।

আমার বেশ ভালো লাগছে শুনতে। আপনি বলুন।

না। আর কিছু বলার নেই। তবে হ্যাঁ, পুরুষ মানুষ মেল ট্রেনের মতো হবে। লাফাবে ঝাঁপাবে কাঁপাবে। গোবেচারা ছেলে মোটেই ভালো লাগে না।

ট্রেন লাইনে দুটি শালিক খাবার খুঁটে খাচ্ছে। ও ডান হাতটা তিনবার কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করে।

আপনি এসব মানেন?

সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আপনি খুব ভদ্র।

কেন?

আমি আমার বাড়ির সব কথা বললাম।

তো?

আমার মায়ের কথা বলিনি। আপনিও কিছু জানতে চাইলেন না, তাই।

আমি অবাক হয়ে বলি, ঠিক তা নয়।

দূরে গাছের সারির দিকে তাকিয়ে বলল, জানেন, আমার মা মেন্টাল পেশেন্ট। চট করে আপনি বুঝতে পারবেন না। অসংলগ্ন কথা বলে। কেমন শিশুর মতো। দু-বার সুইসাইড করতে গেছিল। একবার গলায় শাড়ি আর একবার ট্রেনে।

একটা শিহরণ বয়ে গেল আমার শরীরে। আপনা আপনিই আমার বাঁ হাতটা উঠে গেল ওর মাথায়।

ডাক্তার কী বলছে।

ওপাশের প্ল্যাটফর্মে মা-কুকুরের সঙ্গে দুটো ছানার খেলা দেখতে দেখতে বলল, ডাক্তার ওষুধ দেয়। খায়। ভালো থাকে। আবার যে কী হয়…

আমি একটা সিগারেট ধরাই। লোকাল ট্রেনের আসা-যাওয়া দেখতে দেখতে সময় কাটে। সূর্যের আলোয় ওপারের পোস্টের ছায়া লম্বা হয়ে আমাদের সামনে পড়ে রয়েছে। উনোনের ধোঁয়া শেড পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। আমাদের পেছনে রেলিঙের ওপাশে ধুলোমাখা কুল গাছ, কলা গাছ। তারও ওপাশে পরিত্যক্ত কারখানার লোহার শেড। কী ভযংকর দেখতে!

আমার ব্যাগে হাত রেখে গার্গী বলে, চলুন আমাদের বাড়ি।

আজ নয়। অন্য দিন যাব। বিকেলটা দেখি। সত্যি, জানেন বহুদিন বিকেল দেখিনি। আমার বিকেলটা হারিয়ে গেছে। নিস্তব্ধ বিকেল, আলোময় বিকেল, ভালোবাসার বিকেল বহুকাল দেখিনি। দেখিনি সূর্য‌্যাস্ত কিংবা সন্ধ্যাতারা।

আপনি বিরক্ত হলেন আমার কথায়?

না না। হেসে বলি, আজ চপ খাব।

ও আমার দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল মুখে বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ। সেই ভালো। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি,ওর চোখের কোণে জলের ফোঁটা।

রবিবার একটু বেলা করেই উঠি। চা খেতে খেতে খবরের কাগজ দেখছিলাম। নিউজ খুব একটা পড়ি না। আমি খেলার পাতাটা দেখছিলাম। ঠাম্মা পুজো সেরে গলায় কাপড় জড়িয়ে এ-ঘর ও-ঘর ধুনো দেখাতে দেখাতে বলল, নির্মল ঘটক কাল এসেছিল। আমি মেয়ে দেখতে বলেছি। আর দেরি করে কাজ নেই। বিযো দিয়ে যেন মরতে পারি।

হঠাৎ এমন কথা শুনে বুকের ভেতর কী সব দুলে উঠল। চিঠি তো আমার আর আসে না! দামোদরের বাঁধ মেঘের ঘনঘটা কিংবা সিগারেট খাওয়া বন্ধ করার জন্য বকুনি দিয়ে কেউ তো আর চিঠি লেখে না! বহুদিন ছাতিমতলার কথাও আমার মনে আসেনি! এখনই হুড়মুড়িয়ে সব আমার মনে এসে জড়ো হল।

গরদের শাড়ির খস খস শব্দ তুলে ঠাম্মা এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এত চুপচাপ থাকিস কেন? মুখটা সব সময়ই শুকিয়ে থাকে। কী এত ভাবিস?

কিছুই ভাবি না।

তবে খালি কপাল কুঁচকে থাকিস কেন?

কোথায় কুঁচকে থাকি? আমি হেসে বলি, ঠাম্মা তোমার চোখের পাওয়ার চেঞ্জ করতে হবে।

শোনো বাছা, তোমার ওসব লোকভোলোানো কথায় আমি ভুলছি না। ঠাম্মা ধোঁয়া ছড়িয়ে ঠাকুর ঘরে চলে গেল।

আমি খবরের কাগজের পাতায় ছোট্ট একটি বউকে দেখতে পাচ্ছি। যে লাল তাঁতের শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা পায়ে আলতা লাগিয়ে একবার ঠাম্মার একবার মায়ের একবার আমার কাছে আসছে-যাচ্ছে। বউটির মুখ দেখতে পাচ্ছি না কিছুতেই।

গার্গীর সঙ্গে অদ্ভুত একটা খেলা চলে আমার। ছুটে ছুটে এসে কথা বলে। যেন বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উথলে ওঠে আমার মন। নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারি না।

গার্গী বলে, মায়ের শরীরটা খুব খারাপ। সমস্যাটা বেড়েছে। ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। আমি চুপ করে থাকি।

আমাদের নিয়ে স্টাফরুমে হাসাহাসি হয়। কলেজ স্টুডেন্টরাও নিশ্চয়ই কিছু লক্ষ্য করেছে। করুক। আমরাও তো স্যার বা ম্যামকে নিয়ে অনেক কথা ভেবেছি। বলেছি। হেসেছি। ক্লাস শেষে আমরা হাঁটতে হাঁটতে অটো স্টপেজে এসে দাঁড়ালাম।

আজ ও অনেক গম্ভীর। মায়ের কথাই ভাবছে হয়তো। একটা হালকা নীল শাড়ি পরেছে। পিঠে ঝুলছে মেরুন শাল। ফ্রেঞ্চ রোল স্টাইলে চুল বেঁধেছে। কী উজ্জ্বল দেখাচ্ছে! এক শূন্য অতীত আমাকে হাতছানি দেয়। দিগন্তরেখার সামনে থমকে থাকে জীবন। আমরা কেউ কথা বলছি না। কী যে ভাবি জানি না। রঙিন পোশাকের অজস্র মানুষ এই শেষ বিকেলে হেঁটে যায়। আমরা দেখি। দোকানের ঝোলা রকমারি জিনিস দেখি। মানুষের ব্যস্ততা দেখি। কোথায় যে হারিয়ে যাই বুঝতেই পারি না। গার্গী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, একটাও অটো আসছে না।

কিছু খাবেন? কোন সকালে খেয়ে বেরিয়েছেন!

আপনি আমার কথা ভাবেন?

যাঃ বাবা! কেন ভাবব না?

খুব আনন্দ হচ্ছে জানেন?

কেন?

এত আন্তরিক ভাবে আপনি বললেন! আমার কথা বাড়িতে কেউ ভাবে না। বাবা সকালে অফিসে বেরিয়ে যায়। বোন কলেজে। ভাই স্কুলে। সারাদিন যে-মহিলাটি থাকে সে শুধু মায়ের দেখাশোনা করে। কেউ কারও কথা ভাবে না। ভাবতে চায়ও না। আমিই খালি ভেবে মরি। গিয়ে টিফিন তৈরি করব। রান্না করব। একটুও সময় পাই না। তার মধ্যে খাতা দেখা। এভাবে বাঁচা যায়?

কেন যাবে না? বাঁচার পথটা খুঁজে নিতে হবে। আমাদের ইংরাজি সাহিত্যে একটা কথা আছে, জয় ইজ সাচ এ থিং, ইফ ইউ কান্ট শেয়ার, ইউ কান্ট এনজয় দ্য সেম।

বাজারে হঠাৎ বাসবের সঙ্গে দেখা। কত বছর পর। ও নাগাল্যান্ডে চাকরি করে। ওর মুখেই শুনলাম, সাত-আট বছর আগে অমিতা সুইসাইড করেছে।

আমি স্তম্ভিত। অমিতার মৃতু্য আমার কাছে এক ভযংকর ব্যাপার। স্বল্পভাষী হাসিখুশি অমিতা নিজেকে এভাবে শেষ করে দিতে পারল! অসম্ভব। আমি আর কিছু শুনতে চাইছিলাম না। আমার সারা শরীরে কী যেন হচ্ছে। শীতের হিমেল হাওয়াতেও আমার বুকের ভেতর ঘাম জমছে।

বাসব বলল, সব কেমন ওলোট-পালোট হয়ে যাচ্ছে। বললাম, আমাদের শৈশব কবেই হারিয়ে গেছে। এখন সবই নস্ট্যালজিয়া।

তা ঠিক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসব বলে, এখনই আমাদের দাঁড়াবার সময়। টাকা রোজগারের সময়। আমি চাকরি ছাড়া কাঠের ব্যাবসাও করছি।

দারুণ।

তুই কী করছিস?

কলেজে পার্টটাইম পড়াই।

ওঃ।

এমন ভাবে শব্দটা ও উচ্চারণ করল যার অর্থ আমি যেন কিছুই করছি না। চলে আসছিলাম। জানি এবার ও কোন প্রশ্নটা করবে। ঠিক তাই হল। আমি ঘুরে দাঁড়াতেই ও জিজ্ঞেস করল, বিয়ে করেছিস?

না, আলুর দোকানে যেতে যেতে বলি। কত শার্প ছিল ও। আজ ওকে দেখে আমার করুণাই হল। রাইমা সঞ্জনা ডলি সবাই বিয়ে করে ঘর সংসার করছে। সবই হারিয়ে গেছে। শুধু সন্ধ্যাতারা ওঠা আর সূর্য‌্যাস্ত নিয়ম করে হয়। দিশাহীন আমি নিরন্তর ভেসে বেড়াই অথৈ সাগরে।

ভাবি এক দিন গিয়ে দেখে আসব সমরকাকুর ভুবন। মন্দির। ঝিল। ছাতিমগাছটাকে। কুড়িয়ে রুমালে জড়িয়ে নেব কৈশোরের গন্ধ। ভালোবাসার শুরু ও শেষ বুঝে নেব। ঝিলের জলে ভাসিয়ে দেব চটি জোড়া। ঝিল মন্দির ছাতিমগাছ সবাইকে বলব, আর এখানে কোনওদিন আসব না। তোমাদের কথাও ভাবব না। তোমরা হারিয়ে গেছ। আমরা হারিয়ে গেছি। সম্পর্কহীন জীবনযাপন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...