( ১৮ )
ক্রিসমাস ডে-র ছুটি চলছে। এগারোটার সময় পড়িয়ে উঠলাম। মা বলল, দোকান থেকে একটু গরমমশলা এনে দে তো। মাছওলা যাচ্ছিল। কটা গলদা চিংড়ি কিনেছি।
গলদা চিংড়ি! বাচ্চা ছেলের মতো লাফিয়ে উঠলাম।
চাদরটা চেয়ারের ওপর ছুড়ে ফেলে বেরোতে যাচ্ছিলাম তখনই লোকটা এল। লম্বা রোগা, গালে খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি। গায়ে রং তামাটে। জিনসের ওপর কালো জ্যাকেট পরেছে। চোখ দুটো খুব জ্বলজ্বল করছে। মাথায় বেশ কিছু পাকা চুল। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কেমন সন্দেহজনক।
বললাম, কী দরকার বলুন?
খুব স্পষ্ট উচ্চারণে ভারী গলায় বলল, মিঠু আছে?
অবাক হলাম। লোকটা মাকে খুঁজছে কেন?
বললাম, বলুন কী দরকার?
ওর সঙ্গে একটু দেখা করব। কথা বলার ভঙ্গিতে তার ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্য ফুটে উঠল।
মাকে ডাকতে মা খুব অবাক হয়ে বলল, আমাকে?
হ্যাঁ গো। তোমাকে।
মা বেরিয়ে এসে অবাক চোখে দেখছে আগন্তুককে। লোকটি বলল, মিঠু, আমাকে চিনতে পারছিস না?
মা বারান্দার শেষ ধাপে নেমে বুক চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ে ধরে টেনে তুলতে তুলতে বলল, সেজদা, তুমি?
হ্যাঁ। বাড়িতে গেছিলাম। তোর ঠিকানা নিয়ে চলে এলাম।
মা সেজমামাকে চেয়ারে বসিয়ে পায়ের সামনে বসে বলল, তুমি আসবে...
মামা মায়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, কাঁদিস না বোন। কাঁদিস না। সবাই জানত আমি মরে গেছি। কিন্তু...
ঠাম্মা রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এই রকম এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকার জন্য গর্ব হচ্ছে। ঝোড়ো সত্তর দশক এখন অতীত। কিন্তু তার উত্তাপ এখনও আমি অনুভব করছি। বহুবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা, নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে বেঁচে থাকা এক বিপ্লবীর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড়ো তুচ্ছ মনে হচ্ছে। দোকান থেকে ফিরে আসতেই মামা বলল, পিকুন!
হ্যাঁ। কী যে আনন্দ হল মামার মুখে নামটা শুনে!
কলেজে পড়াচ্ছ?
হ্যাঁ।
কেমন লাগে?
শুধুই মেশিনের মতো কিংবা ফাইট ফর দ্য এক্জিসটেন্স।
ফাইন। তুমি ভাবতে পারো।
না। পারি না। এই বাংলা এই ভারতবর্ষ অথবা পৃথিবীর অনুন্নত দেশ সম্পর্কে আমার ধারণা কিছুই নেই।