( ১৮ )

ক্রিসমাস ডে-র ছুটি চলছে। এগারোটার সময় পড়িয়ে উঠলাম। মা বলল, দোকান থেকে একটু গরমমশলা এনে দে তো। মাছওলা যাচ্ছিল। কটা গলদা চিংড়ি কিনেছি।

গলদা চিংড়ি! বাচ্চা ছেলের মতো লাফিয়ে উঠলাম।

চাদরটা চেয়ারের ওপর ছুড়ে ফেলে বেরোতে যাচ্ছিলাম তখনই লোকটা এল। লম্বা রোগা, গালে খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি। গায়ে রং তামাটে। জিনসের ওপর কালো জ্যাকেট পরেছে। চোখ দুটো খুব জ্বলজ্বল করছে। মাথায় বেশ কিছু পাকা চুল। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কেমন সন্দেহজনক।

বললাম, কী দরকার বলুন?

খুব স্পষ্ট উচ্চারণে ভারী গলায় বলল, মিঠু আছে?

অবাক হলাম। লোকটা মাকে খুঁজছে কেন?

বললাম, বলুন কী দরকার?

ওর সঙ্গে একটু দেখা করব। কথা বলার ভঙ্গিতে তার ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্য ফুটে উঠল।

মাকে ডাকতে মা খুব অবাক হয়ে বলল, আমাকে?

হ্যাঁ গো। তোমাকে।

মা বেরিয়ে এসে অবাক চোখে দেখছে আগন্তুককে। লোকটি বলল, মিঠু, আমাকে চিনতে পারছিস না?

মা বারান্দার শেষ ধাপে নেমে বুক চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ে ধরে টেনে তুলতে তুলতে বলল, সেজদা, তুমি?

হ্যাঁ। বাড়িতে গেছিলাম। তোর ঠিকানা নিয়ে চলে এলাম।

মা সেজমামাকে চেয়ারে বসিয়ে পায়ের সামনে বসে বলল, তুমি আসবে…

মামা মায়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, কাঁদিস না বোন। কাঁদিস না। সবাই জানত আমি মরে গেছি। কিন্তু…

ঠাম্মা রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এই রকম এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকার জন্য গর্ব হচ্ছে। ঝোড়ো সত্তর দশক এখন অতীত। কিন্তু তার উত্তাপ এখনও আমি অনুভব করছি। বহুবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা, নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে বেঁচে থাকা এক বিপ্লবীর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড়ো তুচ্ছ মনে হচ্ছে। দোকান থেকে ফিরে আসতেই মামা বলল, পিকুন!

হ্যাঁ। কী যে আনন্দ হল মামার মুখে নামটা শুনে!

কলেজে পড়াচ্ছ?

হ্যাঁ।

কেমন লাগে?

শুধুই মেশিনের মতো কিংবা ফাইট ফর দ্য এক্জিসটেন্স।

ফাইন। তুমি ভাবতে পারো।

না। পারি না। এই বাংলা এই ভারতবর্ষ অথবা পৃথিবীর অনুন্নত দেশ সম্পর্কে আমার ধারণা কিছুই নেই।

আর?

জীবন সম্পর্কে ভাবনাটা ভীষণ ন্যারো।

সেজমামা উঠে কড়াপড়া হাতে আমার হাতটা ধরে পাশের চেয়ারে বসিয়ে বলল, হতাশ হোযো না। হতাশা থেকে কিছু সৃষ্টি হয় না। সৃষ্টির জন্য চাই আত্মশক্তি।

আমি অবাক চোখে দেখছি মানুষটিকে। ছোটোবেলায় মায়ের মুখে শোনা ঘটনাগুলো আবছা মনে পড়ছে। সত্তরের দশক মুক্তির দশক! মা চা দিয়ে গেল।

মামা বলল, বিপ্লব বোঝো? বিপ্লব কীভাবে হয়, জানো?

আমি কিছুই বলি না।

বিস্কুটটা চিবোতে চিবোতে উনি বলেন, তবে তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। তোমার পথ অন্য।

সেজমামা থাকেনি। সেদিন বিকেলেই ফিরে গেছে। কোথায় যাবে তাও বলেনি। তবে আবার আসব বলে গেছে। নিজের ফোন নম্বরও দেয়নি। কিন্তু আমার নম্বরটা নিয়ে গেছে।

একদিন শেষ বিকেলে রেস্টুরেন্টে গার্গীর সঙ্গে কফি খেতে খেতে সেজমামার কথা বললাম। মায়ের কাছে শোনা ঘটনাগুলো বললাম। টেবিলে কনুইয়ে ভর দিয়ে দু-গালে হাত রেখে অবাক বিস্ময়ে সব শুনল ও।

বললাম, কফি খান। ঠান্ডা হয়ে গেল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডান হাতে কাপটা তুলে একটু চুমুক দিয়ে কফি পড়ে যাওয়া প্লেটটা সরিয়ে টেবিলে কাপটা রেখে বলল, আপনি ভীষণ বোকা।

কেন?

এইরকম একজন মানুষকে দুদিন আটকে রাখতে পারলেন না? এমনকী মোবাইলে তাঁর ছবিও একটা তোলেননি যে আমি দেখব?

হ্যাঁ। ওটা সত্যিই আমার ভুল হয়ে গেছে।

আবার কবে আসবেন?

জানি না। লম্বা শ্বাস ফেলি।

পরিবর্তনের যুগেও পরিবর্তন নেই। মারামারি খুনোখুনি লেগেই আছে। চিটফান্ড মানুষের অর্থ লুঠ করছে। শ্লীলতাহানির খবর কাগজ খুললেই দেখা যাবে। মন্ত্রীদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে আমরা বোকা বনছি। মাওবাদীরা ট্রেন উড়িয়ে দিচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তি চারপাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে এ এক অস্থির সময়ে মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি।

ঠাম্মা বলল, টিভি বন্ধ কর। যত বাজে বাজে খবর সব।

মা বলল, জি বাংলাটা করে দে। সিরিয়ালটা দেখি।

আমি সিরিয়াল দেখি না। ভালো লাগে না। তাছাড়া স্টুডেন্টরা এবার আসবে। রিমোটটা ঠাম্মার হাতে দিয়ে পড়ার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।

একটু আগেই সন্ধে হয়েছে। এখনই কী ঠান্ডা! জানলাটা একটু ফাঁক করে একটা সিগারেট ধরালাম। শুরু হল বোমাবাজি। বোধ হয় খেয়ালিসঙ্ঘের দখলদারি নিয়ে হচ্ছে। শব্দটা ওই দিক থেকেই আসছে। কদিন ধরেই ঝামেলাটা চলছে।

মা টিভি দেখতে দেখতে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোর স্টুডেন্টরা কি সুভাষপল্লি দিয়ে আসে?

এই ব্যাচের কেউ আসে না।

টিভি-র সাউন্ড কমিয়ে দিয়েছে। শীতের নিস্তব্ধ রাতে শব্দটা ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। ঠিক মনে হচ্ছে পাশের বাড়িতে বোম পড়ছে। রাস্তায় মানুষের দৌড়োদৌড়ির শব্দ। আমি দরজা খুলতে যাচ্ছিলাম।

ঠাম্মা বলল, বেরোসনি। কোথায় কী হবে!

পর পর বোমা পড়ছে। একটু পরেই রাস্তায় হুটারের শব্দ। নিশ্চয়ই পুলিশের গাড়ি। শীতের রাত্রে ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কোনও পাগল চিত্কার করে বলছে, ভাঙ… ভাঙ। ভেঙে ফেল সব কিছু। লুঠে নে যা আছে। ভাঙ… ভাঙ…

ভেতর থেকে দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছি হাঁটু ছেঁড়া ফুলপ্যান্টের ওপর সে পরেছে বহু যুগের পুরোনো তেল চিট চিট কালো কোট। পিঠে ঝুলছে তার মূল্যবান নোংরা ঝোলা। বড়ো বড়ো চুল আর এক মুখ দাড়ি নিয়ে সে চিত্কার করে রোজকার মতো আজও ভেঙে ফেলার কথা বলছে। বুঝতে পারি না তার এত রাগ কীসের ওপর।

( ১৯ )

উদয়গিরি খণ্ডগিরি হয়ে বাস এসে দাঁড়াল লিঙ্গরাজ মন্দিরের সামনে। বাস থেকে নেমে দাঁড়াই একটা চায়ে দোকানের সামনে। মন্দিরে ঢোকার কোনও ইচ্ছাই আমার নেই।

বৃষ্টি এখন হচ্ছে না। কাল রাত্রি থেকে শুরু হয়েছে নিম্নচাপ। উত্তাল হয়ে উঠেছে পুরীর সমুদ্র। পুলিশ মাইকে বারবার জলে না নামার জন্য অ্যানাউন্স করছিল। কাল রাত্রে হোটেলের বারান্দায় বসে দেখছিলাম সমুদ্রের কালো জল ফুলে ফেঁপে লাফিয়ে এসে আছড়ে পড়ছিল পাড়ের কাছে। হ্যালোজেনের আলোয় ঢেউয়ে মাথাগুলো সাদা ধবধব করছিল। কত রকম ভাবে ঢেউগুলো তৈরি হয়ে এগিয়ে আসছিল।

মা ঠাম্মা আসেনি। সাইটসিন দেখার জন্য একাই এসেছি। সারাদিন ধরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ঘোলাটে আকাশে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে সূর্যদেবকে। ঝাপসা। চা খেতে খেতে দেখছি সার সার বাস দাঁড়িয়ে কত লোক যে আসে! একটা অল্প বয়সি পান্ডা আমাকে পুজো দেওয়ার জন্য বার বার বিরক্ত করছে। শেষে দশ টাকা হাতে ধরিয়ে বিদায় করি। পান্ডাটা আমাদের বাসে উঠে

যে-টু্যরিস্টরা মন্দির দেখতে যায়নি তাদের ধরল।

একটা সিগারেট ধরিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মন্দিরটার দিকে তাকালাম। বাসের গাইড বলছিল, দেবতা এখানে স্বয়ম্ভু।

স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের অধীশ্বর। রাজা কেশরীর মৃত্যুর পর তাঁরই পরিকল্পিত লিঙ্গরাজ মন্দির গড়েন গঙ্গারাজ ললাট কেশরী প্রায় হাজার বছর আগে। মন্দিরের সূক্ষ্ম কারুকার্য স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও তার আঙ্গিকটা বুঝতে পারছি।

গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল। আমি বাসে উঠে বসলাম। জানলার ধারেই মাঝামাঝি জায়গায় আমার সিট। শাটার সরিয়ে দোকানের সারি, লোকজন গাছগাছালি দেখছিলাম। হঠাৎ একটি পাঁচ-ছবছরের ফুটফুটে মেয়ে এসে বলল, তুমি পিকুন আঙ্কেল?

অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। মেয়েি পরেছে পিংক কালারের কেডস পিংক কালারের কেপ্রির সঙ্গে ব্ল্যাক টপ আর হোয়াইট সোযোর। তার রেশমের মতো বয়ে কাট চুলে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করি, তুমি জানলে কী করে?

সে কথার উত্তর না দিয়ে রাইট, রাইট বলে শিশুটি চলে গেল।

আমি উঁকি মেরে দেখি ডাবল সিটের সেকেন্ড রো-তে বসা এক মহিলাকে হাত পা নেড়ে নাচের ভঙ্গিতে কী সব বোঝাতে বোঝাতে আমায় দেখছে। আমি চোখের ইশারায় জিজ্ঞাসা করি, কী?

শিশুটি ছোট্ট দুটি হাত মাথার ওপর তুলে আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে নাড়ে। আমিও দুহাত মাথায় তুলে নাড়ি। একটু পরেই ছুটে এসে আমার হাতে একটা কমলালেবু দিয়ে বলল, তুমি খাও।

পালিয়ে যাচ্ছিল, খপ করে কচি হাতটা ধরে বললাম, তুমি খাবে না? বাঁ হাতেরটা দেখিয়ে বলে, এই তো আমারটা।

তোমার নাম কি? আমি তাকে হাঁটুর কাছে দাঁড় করাই।

তিস্তা, তিস্তা মজুমদার।

বাহ! ভারি সুন্দর নাম তো। তিস্তা নদী দেখেছ?

আমার দু-কাঁধে হাত রেখে চোখ বুজে আদুরে ভঙ্গিতে বলল, হুঁ-উ-উ…। আমি যাই। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই ছুটে গেল।

সিটে বসে পেছন ফিরে মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখছে। আমি আঙুলের ইশারায় ডাকি। তখন মুখ ফিরিয়ে নেয়।

বাস ছাড়বে এবার। সবাই ফিরে এসেছে। ড্রাইভার ইঞ্জিন স্টার্ট করে অপেক্ষা করছে আর কেউ বাইরে আছে কি না। গাইড গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বাস ছাড়ার কথা ঘোষণা করছে।

বাসে উঠে থেকেই গাইডকে দেখছি। ওকে আমার দারুণ লাগছে। বয়স পঁয়ত্রিশ-আটত্রিশ হবে। স্লিম ফিগার। বেশ লম্বা। ফরসা গায়ে জলপাই রঙের সুটটা দারুণ মানিয়েছে। সাদা শার্টের ওপর লাল-কালো ডোরাকাটা টাইটা একটু ঝুলিয়ে লাগিয়েছে। বাংলা হিন্দি আর ইংরাজিতে সমস্ত জায়গার বিবরণ দিচ্ছে। কখনও কখনও ওড়িয়াতেও কিছু বলছে। সুন্দর বলছে। গোঁফহীন মুখে হেসে হেসে সব কথা বলছে। কপালে বিরক্তির কোনও চিহ্ন নেই।

বাস ছাড়াতেই গাইড বলল, এবার আমরা ধৌলি যাচ্ছি।

অমিতাভ বচ্চন আর রেখার সিলসিলা ফিল্মের বাকি অংশটুকু দেখানোর জন্য বিকট শব্দে ভিডিও চালু হল। কেউ বোধহয় সাউন্ড কমানোর কথা বলল। গাইড মিষ্টি খেয়ে সাউন্ড কমিয়ে দিল।

আমি সিনেমা দেখছি না। দেখছি খেত খামার গাছ গাছালি আর মেঘভরা আকাশ। চিপসের প্যাকেটটা হাতে ধরেই বসে আছি। আমার সিটের পাঁচটা রো আগে সেই মহিলা তিস্তার সঙ্গে বসে। কিন্তু মহিলা কে? আমার আত্মীয় বা পাড়া-প্রতিবেশী কেউ! না হলে পিকুন নামটা কেউ জানে না। উঠে গিয়ে দেখা করতেও কেমন সংকোচ হচ্ছে।

আমার পাশের সিটে বসে মোটা এক গুজরাটি ভদ্রলোক সড়াৎ সড়াৎ করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। শব্দটা বিশ্রি ভাবে কানে ধাক্কা মারছে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তবুও কিছু বলার নেই আমার।

মাঝে মাঝে মেঘ সরে গিয়ে রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়ছে হলুদ সর্ষে খেতে। মৃদু হাওয়ায় দুলছে গাছগুলো। বিস্তীর্ণ শস্য খেত হলুদ ফুলে ছেয়ে আছে। চোখ জুড়ানো হলুদ রঙের কী যে বাহার! মনে হচ্ছে বাস থেকে নেমে আলপথ ধরে দৌড়োতে দৌড়োতে হারিয়ে যাই।

মায়ের ফোন এল। কী রে কোথায় আছিস?

ধৌলি যাচ্ছি।

অসুবিধা হচ্ছে না তো? বৃষ্টি পড়ছে?

না। তোমরা খেয়ে?

হ্যাঁ। ফিরবি কখন?

ড্রাইভার বলল সাতটা সাড়ে সাতটা হবে।

ঠিক আছে।

ফোন ছেড়ে আবার হারিয়ে যাই মাটির কুঁড়েঘরে। খালের ধারে ধারে কিংবা রাস্তার পাশে দল বেঁধে বসে থাকা কালো মুখ হনুমানের সঙ্গে খেলে বেড়াই। হু হু করে ছুটছে বাস। সিনেমা শেষ হয়ে গেছে। সকলের চোখেই ভাত ঘুম। শুধু আমারই ঘুম আসে না। তিস্তাকে চিনি না। কোনও দিন দেখিনি। হঠাৎ মনে হল ওরা হয়তো আমার স্টুডেন্টদের কোনও আত্মীয়।

গাইড মাইক্রোফোনটা তুলে নিল। দুবার ফুঁ দিয়ে দেখে নেয় শব্দ হচ্ছে কিনা। প্রথমে বাংলায় বলা শুরু করল।

আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ধৌলি পৌঁছে যাব, রেঞ্জের মধ্যে এসে গেছি। ওই দূরে পাহাড়ের রেখা দেখা যাচ্ছে। অনেকে ধবলগিরিও বলেন। ২৬১ খ্রিস্টপূর্বে মৌর্য সম্রাট সন্তোষ এবং কলিঙ্গরাজের যুদ্ধের বিভীষিকা আজও শিহরণ জাগায়। যুদ্ধে জিতেও হাজার হাজার বলা যেতে পারে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু, শত শত কাটা ঘোড়া এবং বিশাল অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অস্ত্রশস্ত্র আর ভযংকর ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা সম্রাট অশোকের জীবনধারায় পরিবর্তন আনে।

গাইড থামল। তার কথাবার্তা চমত্কার। কন্ঠস্বরে বেশ নাটকীয়তা আছে। সবাই উন্মুখ হয়ে শুনছি তার কথা। সে মুখের চুইংগামটা গালের অন্য পাশে রেখে বলতে শুরু করল, ধবলগিরির পাশে বয়ে চলা দয়া নদীর রং হয়ে উঠেছিল লাল। তরবারি ছেড়ে সবাই আমার সন্তান বলে অনুশোচনায় দগ্ধ রাজা অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। শপথ নেন, তরবারি নয়, এবার জয় প্রেম আর ভালোবাসা দিয়ে

গোঁ গোঁ শব্দ করে এঁকে বেঁকে বাস উঠছে পাহাড়ে। পিস প্যাগোডা ঘোলাটে রোদ্দুরে আরও সাদা হয়ে উঠেছে।

( ২০ )

ভেবেছিলাম বাস থেকে নেমেই দেখা করব তিস্তাদের সঙ্গে। কিন্তু সবাই এমন হুড়মুড়িয়ে নামতে শুরু করল যে, অসংখ্য মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল তিস্তারা। সারি দিয়ে বাস দাঁড়িয়ে আমি আর তাড়াহুড়ো না করে সব শেষে ধীরে সুস্থে নামলাম।

প্যাগোডার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। চারদিকে চার মূর্তি স্থাপিত গৌতম বুদ্ধর। নিমীলিত চোখে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধদেব। কী অপূর্ব! চারদিকে পর্যটকের ভিড়। নেপালি, ইংরেজ, চায়নিজকারা নেই!

ডান দিকে ফিরতেই একটু দূরে দেখতে পেলাম তিস্তাকে। জোড়া পায়ে লাফিয়ে উঠছে একটা সিঁড়িতে আবার লাফিয়ে নামছে। একটু সময় দেখে ধরতে যাচ্ছিলাম ওকে, কে যেন হাতটা টেনে ধরল। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি সুন্দরী এক মহিলা। আমার হাতটা ছেড়ে বলল, চিনতে পারছিস?

মানে, আপনি… তিস্তা…

মহিলা আমার বুকের সামনে এসে মুখটা তুলে বলে, এবার?

চমকে উঠে বলি, ডলি!

ডলির ঠোঁটে লিপস্টিক মাখানো সেই বাঁকা হাসি। চোখ দুটো আমার জ্বলে উঠল। তিস্তা দৌড়ে আসে। মা, একটু ওপাশের ঠাকুরটা দেখে আসি?

যাও। এক্ষুনি চলে আসবে।

ওক্কে। দৌড়ে চলে গেল তিস্তা।

রুমালে চোখ মুছে ডলির চোখে চোখ রাখি। হারানো সুরটা আবছা ভাসছে আমাদের চোখে। ডলি আমার চোখে চোখ রাখে এবার।

বাসটা নামছে। মাঝে মাঝে ব্রেক কষায় দুলে উঠছি আমরা। পিস প্যাগোডাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি। ডলির পাশে বসে তাই মনে হয়। এভাবেই আমরা অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাই।

আমার ফোনটা নিয়ে আমার সিটে বসে গেম খেলতে ব্যস্ত তিস্তা। আমরা কেউই অতীতকে নিয়ে নাড়াচাড়া করছি না। হয়তো ইচ্ছাকৃত অথবা কাকতালীয়। জানলা দিয়ে ডলি গাছ দেখছে। রাস্তার পাশে বয়ে চলা খাল দেখছে। মেঘলা আকাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ বলে উঠল, তোর সঙ্গে যে দেখা হবে এভাবে স্বপ্নেও ভাবিনি।

আমিও কি তাই ভেবেছিলাম। তোকে তো চিনতেই পারিনি।

ডলি খিল খিল করে হেসে উঠে বলে, আমি তোকে ঠিক চিনতে পেরেছিলাম। চায়ে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে যখন সিগারেট টানছিলি তখনই।

ডাকলি না কেন?

তোকে ওয়াচ করছিলাম।

তাই?

হ্যাঁ। ঠিক তাই।

কী দেখলি?

দেখলাম, সেই ছোট্ট হাঁদারাম এখনও সেই হাঁদারামই রয়ে গেছিস। অত সুন্দর সব মেযেুলো তোকেই দেখছিল। তোর চোখে ওসব ধরা পড়ছিল না। বেচারা!

অনেক বুঝেছিস!

ওম্ মা! বুঝব না? কত

ঘাত-প্রতিঘাত ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে এলাম। চেনার বোঝার বয়স পেরিয়ে এখন দেখার পথে দাঁড়িয়ে শুধুই দেখি আর দেখি।

কী, দেখিস?

সে কথা এড়িয়ে গিয়ে আমার মুখের সামনে চোখ তুলে বলে, এই যেমন তোকে দেখছি।

ভ্যাট!

সত্যি বলছি। আমার হাতে হাত দিয়ে বলে, বিশ্বাস কর।

ওর কথার মধ্যে কী যে ছিল আমি আর কোনও কথা বলতে পারলাম না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানলা দিয়ে ধূসর গাছপালা দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে, কোথায় উঠেছিস?

বালানন্দজি হোটেলে। তোরা কোথায়?

পুরী হোটেলে। একদম পেছন দিকে। সমুদ্র দেখতে পাস?

না। তুই পাস?

হ্যাঁ। ব্যালকনিতে বসে কাল অনেক রাত পর্যন্ত উত্তাল সমুদ্র দেখেছি। কী তার শব্দ! কী তার গর্জন!

শব্দ আমরাও পাই। কার সাথে এসেছিস?

মা আর ঠাম্মা।

আর কেউ নয়? অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকায়।

হেসে বলি, আবার কে আসবে?

ওঃ। মুখটা ফিরিয়ে নেয়।

ওর কাছে আমার অনেক প্রশ্ন অনেক কৌতূহল জমা হয়ে আছে। কিন্তু কিছুই জানতে চাই না। যেটুকু সময় আমরা পাশাপাশি আছি সেটাই ভালো লাগছে। আমার শরীরে ভর দিয়ে ও প্রকৃতি দেখছে।

নন্দনকাননের সামনে দাঁড়িয়ে তিস্তা বলল, আমি লেপার্ড দেখব।

আমার বন্দিজীবন না-পসন্দ। বাসের পাশে দাঁড়িয়ে মনে হল কিছু পশু পাখিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ তা দেখছে। কী আনন্দ! কী উত্সাহ তাদের! ভাবা যায়! আমরা কি বন্দি হয়ে জীবন কাটাতে পারি। আবার আমরাও তো নানান ভাবে সমাজ সংসারে জড়িয়ে মুক্তি কোথায়? চিড়িয়াখানায় ঢোকার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ডলি যেভাবে আমার হাতটা টানল, উপেক্ষা করতে পারলাম না।

কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে কমলা আলো গাছের পাতায় পাতায় এসে বসেছে। জালে জালে ঘেরা পশুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ-খাঁচা থেকে ও-খাঁচার কাছে ছুটে ছুটে যাচ্ছে তিস্তা। বাঘ দেখে সিংহ দেখে কী খুশি সে। সেই খুশি ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের মধ্যেও। আমরা হাসছি। অবাক হচ্ছি।

ডলি বলল, ওই যে গন্ডার!

আমি বলি, ওই যে সাদা কুমির!

মা, ওই যে গরিলা!

আমরাও শিশু হয়ে যাই। এ-মাথা থেকে ও-মাথা ছুটে বেড়াই। ইগোয়ানা, গন্ডার, স্কুইরেলের খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। পা ব্যথা করলে বেঞ্চে বসে বোতল খুলে জল খাই। তিস্তা আমার হাত ধরে হাঁটছে।

বাদাম চিবোতে চিবোতে ডলি বলল, আমাদের জমিটা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

ভ্রু কুঁচকে বলি, তারপর?

ছমাস হল বাবা রিটায়ার করেছে। কামারপাড়ায় একটা ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে। আমরা ওখানেই থাকি। তোরা এখানেই আছিস?

আর…

আমার বিয়ে হয়েিল মানিকতলায়। আমার স্বামী মণি-মুক্তোর বিজনেস করত। মুম্বই চলে গেছে চার বছর। শুনেছিলাম বিয়ে করেছে। জানি না!

ওর গলা কাঁপছে। কোনও প্রশ্ন না করে ওর কাঁধে হাত রাখলাম।

বাবা মার সঙ্গেই এসেছি মঙ্গলবার। বাদামের খালি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ঘুরছিল। একটা গোল হাঁ-মুখ ডাস্টবিনে ফেলে বলল, শনিবার ফিরব।

ওলোটপালোট খেতে খেতে আমি যে কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারি না। ফেরার পথে তিস্তা, মায়ের পাশেই বসেছিল। একটা সময় কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

বাস থেকে নেমে ডলি বলল, ফোন নম্বরটা দে।

আমি নম্বরটা বললাম।

ডলি বলল, মিস কল দিচ্ছি। সেভ করে নিস।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...