( ২৫ )
এত চিৎকার চ্যাঁচামেচি সত্ত্বেও, লরিগুলো দাঁড়িয়ে আছে। খালাসিরা লরিতে মাটির ওপর বসে আয়েশ করে বিড়ি টানছে। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করি,
তোমার নাম কি?
পার্থ।
আমাকে চেনো?
জয়ন্ত আমার খুড়তুতো দাদা। আপনাকে চিনব না? ডলিদিকেও চিনি।
আমার বুকটা আনন্দে নেচে ওঠে। বহুদিন পর জয়ন্তর নাম শুনলাম। ওর আত্মীয়রা এখানে আছে জানলাম। মনে হল এক্ষুনি হয়তো বাসবকেও দেখতে পাব। বলি, এখানে এসব কারা করছে?
সমরকাকুর এক আত্মীয় বাড়িটাও বিক্রি করে দিয়েছে। এবার পার্টির সাহায্য নিয়ে ঝিল বুজিয়ে ফ্ল্যাট করবে। অনেকদিন ধরেই আস্তে আস্তে মাটি ফেলছে। যেন কেউ বুঝতে না পারে।
কেউ কিছু বলছে না?
কে বলবে? পার্ক হবে বলে মাটি ফেলছে। এই ওয়ার্ডের কমিশনারও যুক্ত আছে এর সঙ্গে।
তারপর?
আমরা ভেতরে ভেতরে খোঁজ নিয়ে কদিন আগে ব্যাপারটা জেনেছি।
লুঙ্গিপরা লম্বামতো একটি লোক এগিয়ে এসে বলল, কীসব হচ্ছে বলো তো? লোকটিকে আমি চিনি।
ডলি হঠাৎ বলে উঠল, এসব ভালো না। এত বড়ো ঝিল এ শহরে একটাও নেই। মিউনিসিপ্যালিটি কোথায় চারপাশে গাছ বসিয়ে প্রকৃতিকে সুন্দর করে সাজাবে তা নয়, ঝিল বোজাচ্ছে!
ডলির উত্তেজনার আঁচ যেন ছড়িয়ে পড়ল হঠাৎই। চারপাশ থেকে আরও কিছু পুরুষ মহিলা এসে জড়ো হল। কয়েকজন চিত্কার করে উঠল, এসব হতে দেব না। এলাকার উন্নয়ন চাই। ফ্ল্যাট চাই না। মন্দির সারাতে হবে। জমি বিক্রি চলবে না। দুমদাম লরিতে ঘুষি লাথি পড়ছে। কারা যেন লাঠি রড এনেছে।
পার্থ বলল, পিকুনদা আপনারা চলে যান। দাঁড়াবেন না পাবলিক খেপে গেছে।
লম্বা লোকটি আমার কাঁধে ঠেলা মেরে বলল, চলে যাও। শিগগিরি পালাও।
পার্থকে বললাম, আমার বাড়ি চেনো?
হ্যাঁ দাদা।
কাল সকালে আসতে পারবে?
নিশ্চয়ই যাব।
লরির গায়ে লাঠির শব্দ। ঢিব ঢিব। লরির হেডলাইট জ্বলে উঠল। ইঞ্জিন স্টার্টের শব্দ হচ্ছে। আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল আরও কয়েকটি ছেলে। বলল, পালান আপনারা।
কেন? ডলি আমার হাতটা ধরে ওদের জিজ্ঞেস করল।
এক্ষুনি পুলিশ আসতে পারে। প্রমোটারের লম্বা হাত আছে।
একজন বলল, প্রমোটার এমএল-এর কাছের লোক।
ডলি বলল, তাতে কী হয়েছে? এই ঝিল বোজানো চলবে না। মন্দিরের জমি বিক্রি বন্ধ করতে হবে।
আমার কথাগুলোই যেন ও বলছে। আমার শরীর গরম হয়ে উঠল। বললাম, না। এ হতে দেওয়া যায় না।
এক মহিলা আমাদের সামনে এসে বলল, আমরা সারা জীবন এই ঝিলে কাপড় কেচেছি, বাসন মেজেছি, চান করেছি।
ময়নাপিসি তুমি চুপ করো। আমরা দেখছি। একটি ছেলে বলে।
কেন চুপ করব? যে যা খুশি তাই করবে? মন্দির ভাঙবে? ওসব চলবে না।
পার্থ বলল, পিকুনদা, আপনারা যান। কাল আপনার সঙ্গে দেখা করব।
ঠিক আছে।
আমরা হাঁটতে লাগলাম। সব কিছু কেমন ওলট-পালট হয়ে গেল। আধ ঘন্টা আগের সঙ্গে এখন কোনও মিল নেই। হাঁটতে হাঁটতে ডলি বলল, পিকুন, আমাদের ছোটোবেলার কোনও স্মৃতিই কি আর থাকবে না?
জোরে জোরে বলি, থাকবে। থাকবে। থাকতেই হবে।
সন্ধেবেলায় ঝিলের সামনে এসে দাঁড়াই। পার্থ এবং অন্য দুজন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। ডেস্টিনেশন এই ওয়ার্ডের কমিশনার।
স্টুডেন্টদের বলে দিয়েছি আজ সন্ধ্যায় পড়াব না। সকালে পার্থ এসেছিল আমার বাড়ি। আমরা পরিকল্পনা ঠিক করে নিয়েছি।
ওয়ার্ড কমিশনার শশীকান্ত যাদব যেন জানতেনই আমরা আসব। বৈঠকখানায় বসেছিলেন সবুজ ফাইবারের চেয়ারে। বছর পঞ্চান্ন-আটান্ন বয়স হবে। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। মেরুন রঙের চওড়া গোঁফ। বড়োসড়ো চেহারা। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরনে। ঘরে দশ-বারোটা চেয়ার। আরও চারজন মানুষ বসে। ঘরের দেয়ালের ধারে অনেকগুলো প্লাস্টিকের কাপ পড়ে। সারা ঘরজুড়ে পোড়া দেশলাইয়ে কাঠি বিড়ি সিগারেটের টুকরো ছড়িয়ে ঝুলে ভরা ঘরের দেয়ালের রং।
যাদববাবুর বাঁ পাশে কাঠের টেবিলে গোটা তিনেক লেটারহেড প্যাড, চার-পাঁচটা ডট পেন একটা স্ট্যাম্প প্যাড পড়ে। উনি একটা প্যাডে কিছু লিখছিলেন। আমারদের দিকে মুখ তুলে একগাল হেসে বললেন, আসেন। আসেন। বসেন পিকুনবাবু। আমার নামটা জানেন দেখে ভীষণ অবাক হলাম। আমরা বসলাম।
শশীকান্ত প্যাডের ওপরের পাতাটা ছিঁড়ে একজনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ছবি এনেছ?
হ্যাঁ।
শশীকান্ত ফেভিস্টিকটা তার দিকে এগিয়ে ধরে বাজখাঁই গলায় বললেন, লাগিয়ে নাও।
লোকটি তাঁর হাত থেকে কাগজ আর স্টিকটা নিয়ে ছবি পেস্ট করতে লাগল।
আমাদের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হেসে বললেন, বলেন, কী ব্যাপার?
হাত জড়ো করে নমস্কার জানিয়ে বললাম, আমরা এসেছি ওই ঝিলের ব্যাপারে।
বলেন।
আসলে ওই ঝিল, তার পাশে মন্দির, এসবই এই শহরের প্রাচীন ঐতিহ্য।
হুঁ।
আমরা চাই এই ঐতিহ্য অটুট থাক। আরও সুন্দর করে গড়ে তোলা যেতে পারে। মন্দিরটাকে সারানো দরকার। ঝিলের পাশে আরও গাছ লাগানো উচিত। ঝিল আর মন্দিরের মাঝখানে ছাতিমতলায় শিশু এবং প্রাতঃ বা বৈকালিক ভ্রমণকারীদের জন্য পার্ক হলে ভালো হয়।
হুঁ হুঁ। একদম ঠিক। ভেরি গুড প্ল্যানিং। শশীকান্ত টেবিলে বিশাল থাবা রেখে বললেন।
এরকম কথায় আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। লোকটি সম্পর্কে সমস্ত খোঁজ খবর নিয়ে একেবারে প্রস্তুত হয়ে এসেছি। এখানে এসে সব কেমন গুবলেট হয়ে গেল। তবুও মনকে শক্ত করে বলি, কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে।
সোমস্যা? উনি ভ্রূ কুঁচকে চোখ সরু করে আমার দেখছেন।
হ্যাঁ। সমস্যা। কোনও এক প্রমোটার ঝিল বুজিয়ে ফ্ল্যাট করার প্ল্যান করেছে। ঝিলের এপাশে লরি লরি মাটি ফেলা হচ্ছে।
তাই? হো হো করে গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলেন শশীকান্ত।
লোকটিকে আমার ঠিক সিনেমার ভিলেনের মতো লাগছে।
হাসি থামিয়ে বললেন, ওসব কোনও বেপার নয়। আমি দেখছি। সামনের হপ্তায় আপনারা ফির একবার আসুন।
নমস্কার জানিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। রাত্রে ফোন করে ডলিকে সব বললাম।
( ২৬ )
ঘটনার দুদিন পর ভোরবেলা পার্থ ফোন করে আমাকে বলল, দাদা, কাল ভোররাতে ওরা আবার লরি ঢুকিয়েছে। মাটি ফেলেছে।
আমার শরীর গরম হয়ে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে অনেক বিষয় মাথায় খেলে বেড়াল। মনে হল এখনই ছুটে যাই। তা না করে বলি, তোমরা কোনও শব্দ পাওনি?
না দাদা।
ঠিক আছে। আমি কলেজ যাওয়ার পথে তোমাদের সঙ্গে দেখা করছি।
একটু বেলায় ডলিকে ফোন করলাম। সব শুনে ডলি বলল, কখন যাবি বল, আমিও যাব।
গম্ভীর গলায় বলি, তুই যাস না। আমি যাই। পরে তোকে ফোন করব।
না। আমি যাব। এ লড়াই সকলের। রুখতেই হবে। প্রয়োজনে অপোন্যান্ট পার্টির কাছে যেতে হবে। সর্বদলীয় প্রচেষ্টা দরকার। তা না হলে হবে না।
ডলির কন্ঠস্বর এবং কথাবার্তায় চমকে উঠলাম। এই ডলিকে আমি চিনি না, জানি না। ওর ভেতরের আগুনটা আজ সকালে আমাকে আরও উজ্জীবিত করে তুলল। বললাম, দশটার সময় ঝিলপাড়ে আসিস।
এসে দেখি আমার আগেই ডলি এসে গেছে। ওকে ঘিরে পনেরো-কুড়িজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছোটো ছোটো কয়েকটি ছেলে-মেয়ে মাটির ঢিবির ওপর খেলছে। বসন্তের হাওয়া খেলে বেড়াচ্ছে নারকেল গাছের মাথায় মাথায়। দূরে পাটাতনের ওপর কাপড় জামা কাচছে ধোপারা। ধব ধব শব্দ এখানেও শোনা যাচ্ছে। দড়ির মাথায় ঝুলছে শাড়ি। হসপিটালের সাদা চাদর। কোথায় যেন কোকিল ডাকছে, কুহু কুহু। যেতে যেতে মানুষজন থমকে দাঁড়াচ্ছে আমাদের সামনে।
পার্থ কয়েকজন মাঝারি বয়েসের মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। ডলি গম্ভীর গলায় বলল, আমাদের এখনই কমিশনারের কাছে যাওয়া দরকার। একজন ল-ইয়ারের সঙ্গে কথা বলা উচিত প্রথমেই।
একজন বলল, পাড়ায় তো ল-ইয়ার আছে।
কে?
ভাদুড়িবাবুর ছেলে।
শিবুকাকা বলল, হাইকোর্ট প্র্যাকটিস করে। সন্ধেবেলায় যাওয়া যাবে।
ঠিক আছে যাব। কিন্তু আমাদের প্ল্যানিং হল রাত্রে সজাগ থাকতে হবে।
সকলেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, নিশ্চয়ই থাকব। প্রয়োজনে রাত জাগব।
ঘড়িটা দেখে বলি, চলুন, কমিশনারের কাছে যাওয়া যাক। বহু লোক মিলে হাঁটতে লাগলাম।
গিয়ে দেখি কমিশনার নেই। ভেতর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এসে বলে, এই মাত্র সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
কে যেন বলল, শালা স্পাই আছে দলে। চমকে উঠি।
কী করে বুঝলে?
একটি বছর তিরিশের ছেলে আমার সামনে এসে বলল, পলিটিক্স বুঝতে বহু সময় লাগে।
আর একজন বলল, বাড়িতেই আছে। দেখা করছে না।
বলি, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানকে ব্যাপারটা জানানো যেতে পারে। এটা ভেস্টেড কিনা তাও জানতে হবে।
পার্থ বলল, ঠিক আছে, আমি শিবুকাকাকে নিয়ে মিউনিসিপ্যালিটি যাচ্ছি ল্যান্ড ডিপার্টমেন্টে কথা বলব। চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করব।
বললাম, আটটার সময় আসব।
ল-ইয়ারের কাছে যাব।
সব শুনে উকিলবাবু বললেন, জমির, ঝিলের দাগ নম্বর জানা আছে?
না।
দাগ নম্বর বার করতে হবে। কারও কাছে এরিয়া ম্যাপ আছে?
না।
আপনারা সেটেলমেন্ট অফিসে যান। ওখানে খোঁজ করুন। এগুলো না হলে কাজ এগোবে না।
আমাদের সকলের মুখেই বোধ হয় হতাশার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। সবাই চুপ করে রইলাম।
উকিলবাবু বললেন, আপনারা কিছু পোস্টার লাগিয়ে প্রচার করুন।
ঠিক বলেছেন।
আপনারা থানায় জানান। চেয়ারম্যানকে যেমন জানিয়েছেন তেমনি এমএলএ-কেও লিখিত ভাবে জানান। বিএলআরও-কে, ডিএম-কে, এমপি-কে লিখিত জানান। যত পারবেন মানুষের সই জোগাড় করুন। তারপর দেখছি।
মা এটা শুধু আমার ব্যাপার নয়। বহু মানুষ জড়িয়ে এটা ঐতিহ্যের সমস্যা। একটা মন্দির যুগের পর যুগ ধ্বংসাবস্থায় পড়ে থাকবে, ঝিল বুজিয়ে ফ্ল্যাট হবে, তা মেনে নেওয়া যায়?
ঠাম্মা বিরক্ত হয়ে বলে, তুই কী করবি?
আমি এই ধান্দাবাজ রাজনৈতিক নেতা প্রমোটারের বিরুদ্ধে সব মানুষকে এক জোট করব। আমাদের এই আন্দোলন সারা রাজ্যে এক ইতিহাস হয়ে উঠবে।
তোর পাশে কে আছে? কাপে চা ঢালতে ঢালতে মা প্রশ্ন করে।
এলাকার সব মানুষ আছে। আমরা এমএলএ, এমপি-র সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। প্রয়োজনে প্রেস মিট করব। মিডিয়াকে জানাব।
মা-ঠাম্মা অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। ঠিক সেই সময় পার্থ এবং তিন-চারটে ছেলে এল। ড্রইংরুমে ওদের এনে বসাই।
একটি ছেলে বলে, দাদা পোস্টার লেখা হচ্ছে। রাতের মধ্যেই সব লাগিয়ে ফেলব।
মাকে বলি, একটু আঠা করে দেবে?
মা নিঃশব্দে রান্নাঘরে ঢুকে যায়।
আমরা পাঁচজন বসে ব্লু প্রিন্ট তৈরি করি।
ঠাম্মা চায়ের কাপ হাতে বলে ওঠে, একটা মিছিল দরকার। আমরা সবাই চমকে উঠি।
ঠাম্মা আবার বলে, হ্যাঁ, ঠিকই বলছি মিছিল দরকার। একটা-দুটো-তিনটে… বাড়ির মেয়েবউকেও নিতে হবে মিছিলে।
একটি ছেলে বলে, ঠিক বলেছেন। জাত ধর্ম আমরা জানি না। সবাইকে এক হতে হবে।
জীতেন নামে একটি ছেলে বলে, এই আন্দোলন হবে ধর্মের ঊর্ধ্বে।
আমি অবাক চোখে সবাইকে দেখি। পার্থর ফোন আসে, বল।
আজ রাতের মধ্যে…
এমএলএ এখানে নেই। কলকাতায়।
তোরা থাক। আমরা যাচ্ছি।
ন্যাকড়ায় ধরে আঠার ডেকচিটা মেঝেতে নামাতে নামাতে মা বলল, সব বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বোঝাতে হবে। প্রাচীনতাকে বিসর্জন দিয়ে আধুনিক সভ্যতা গড়া যায় না। আমার বুকে ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে।
( ২৭ )
কলেজ যাওয়ার পথে ঝিল পাড়ে দাঁড়াই। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে সারা অঞ্চল। ঝিলের ওপর মাটি ফেলা অংশেও খুঁটির ওপর দরমা লাগিয়ে পোস্টার সাঁটা হয়েছে।
আমাকে দেখে শিবুকাকা এগিয়ে এসে জানালেন, ওরা দুপুরে কোর্টে যাবে চিঠি টাইপ করাতে।
মানিব্যাগ থেকে দুশো টাকা বার করে শিবুকাকার হাতে দিয়ে বলি, এটা রাখুন। আরও টাকা আমরা তুলব।
একটা কথা বলি।
কী?
সকালে পার্টির একজন লোক, আমাদের সঙ্গেই আছে, এমএলএ-কে ফোন করেছিল। দুএক দিনের মধ্যেই উনি ফিরলে দেখা করতে বলেছেন।
বাঃ। এ তো ভালো খবর। আমি চলি। রাত্রে যোগাযোগ হবে আবার।
ঠিক আছে। চললে কোথায়?
একটা রিকশায় উঠে বললাম, কলেজ।
রাত্রে ওরা চিঠিগুলো টাইপ করে এনে আমাকে দেখায়। চিঠিগুলো পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আমরা সত্যিই যেন এক বৃহৎ আন্দোলন করতে চলেছি। যেভাবে ভারত স্বাধীনের আন্দোলন হয়েছিল ঠিক তেমনই! ওই অঞ্চলটা যেন আমাদের মাতৃভমি হয়ে উঠেছে।
ওরা বলল কাল থেকেই সই সংগ্রহে নেমে পড়বে। দুদিনেই কাজটা করে ফেলবে। আমরা একটা স্বপ্ন দেখতে পারছি। আমরা কিছু করতে চেষ্টা করছি। সমবেত ভাবে আমরা আগামী প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে চলেছি। যেভাবে সত্তরের যুবক যুবতিরা নতুন রাষ্ট্রগড়ায় মেতে উঠেছিল, সেই ভাবেই আমরা স্বপ্ন দেখছি। গেম প্ল্যান তৈরি করছি।
রাতে ঘুমের মধ্যে কতগুলো ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল আমার সামনে। অস্পষ্ট। তাদের কাউকেই চিনতে পারছি না। তারা হাতের ইশারায় ডাকছে, আমি একটুও এগোতে পারছি না। পা দুটো বাঁধা যেন কীসের সঙ্গে। আমি ওদের চিত্কার করে কাছে ডাকছি। কেউ আসছে না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নদীটাকে। পাড়ে অসংখ্য গাছ। হাওয়ায় ওদের চুল উড়ছে। বেণি দুলছে। হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে ওরা সুর করে গাইছে, এলাটিন বেলাটিন সই লো, কীসের খবর আছে, রাজা মশাই একটি বালক চাইল…।
ঘুমের আড়ালে স্বপ্নে আমি চিত্কার করে উঠি রাইমা! সঞ্জনা! বাসব! জয়ন্ত! সুমিতা! অমিতা! চমকে উঠি। অমিতা তো মারা গেছে। তবে!
ঘুম ভেঙে যায়। বোতল থেকে জল খাই। বুকটা লাফাচ্ছে। ঘেমে উঠেছে। বিছানা থেকে নেমে আস্তে করে ফ্যানটা চালাই।
স্বপ্নের রেশ আমার কাটে না। স্বপ্নটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নদী নয়, ওটা ঝিল। চারপাশে গাছ। ভাঙা মন্দিরের চড়ায় বসে কাক ডাকছে কা কা…। মন্দিরের চারপাশে বুনো ঝোপ। বুনো ঝোপ হঠাৎই মিলিয়ে গেল। দেখতে পেলাম লাল হলুদ সবুজ ওযোর কোটেড ছোটো ছোটো কতগুলো শৌখিন বাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছাদের রেলিঙে শাড়ি উড়ছে। পাঞ্জাবি ঝুলছে।
ঝিল পাড়ে এখন আর মাটির লরি আসে না। অচেনা মানুষজনকে আর ঝিল পাড়ে দেখা যায় না। এক রবিবার সকালে আমরা সারা অঞ্চল জুড়ে মিছিল করেছি। লাঠির মাথায় পোস্টার হাতে নিয়ে হেঁটেছি। সামনে দাঁড়িয়ে ডলি নেতৃত্ব দিয়েছে। বাসবকে আসতে বলেছি। বাসব জয়ন্তর নাম্বার জোগাড় করে ফোন করেছে আসার জন্য। বিএলআরও, এমপি-কে চিঠি দিয়েছি। এখনও কোনও উত্তর পাইনি। মঙ্গলবার ডিএম-এর কাছে ডেপুটেশনে যাব।
আমরা প্রায় রোজই আলোচনায় বসি। ডলি আসে। সিনিয়র মানুষেরাও থাকে। আমাদের পাশে এখন লোকজন অনেক। সবাই মিলে কাজ করি। রাত্রে ঝিল পাড়ে পাহারা থাকে। বেশ গরম পড়েছে।
দোলের দিন গান গেয়ে আবির খেলে বেড়িয়েছি সারা অঞ্চলটায়। নতুন বাড়িগুলোর লোকজনও মেতে উঠেছিল আমাদের সঙ্গে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আবির খেলেছিল, গলা মিলিয়েছিল। আমরা মিষ্টিমুখ করেছি। মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন ভাবে মন্দিরকে গড়ে তোলার শপথ নিয়েছি। পার্ক হবে। ফুলে ফুলে সেজে উঠবে বাগান।
একদিন সন্ধ্যায় অখিল পাসোয়ানের বাড়িতে মিটিঙে একজন বলল, প্রমোটার পুলিশ দাঁড় করিয়ে ঝিল ভরাট করবে শুনছি।
কোথায় শুনলে? সমবেত প্রশ্ন।
এক সার্ভেয়ার বলেছে।
আর কী বলেছে?
ফ্ল্যাট হবে। সুইমিং পুল হবে। মাল্টিপ্লেক্স হবে। রাস্তা চওড়া হবে।
কয়েকজনের কোমর থেকে চপার কুকরি বেরিয়ে এল। তারা সেগুলো মাথার ওপর তুলে বলল, জীবন থাকতে হতে দেব না।
আমি তাদের শান্ত করতে চেষ্টা করি। খবরটার সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে বলি।
জীতেন বলে, দাদা, কথাটা অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। এই ব্যাপারে একটা বিরাট র্যাকেট কাজ করছে।
একটি অল্প বয়েসি ছেলে হঠাৎ বলে উঠল, বোম মেরে সব উড়িয়ে দেব।
পরিষ্কার বুঝতে পারছি তাদের আবেগ ভালোবাসা এবং আন্দোলনের উন্মাদনা। প্রতিবাদ এবং দখলদারী চিরকালই ছিল আছে আর থাকবেও। ইতিহাস তাই তো বলে। স্বাধীনতার লড়াই এবং উন্মত্ত সত্তর সত্য। চিরকালীন। শুধু বিষয়টাই অন্যরকম। কিন্তু আন্দোলন এভাবে করতে চাই না। উত্তেজিত লোকজনকে এখনই থামাতে হবে। মিটিং শেষ করে দিতে হবে। মিটিং চললে উত্তেজনা আরও বাড়বে।
দুহাত তুলে বলি আরও একটু সময় নিয়ে আরও কিছু ইনফর্মেশন জোগাড় করি। তারপর আমরা পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করব।
কয়েকজন বলে উঠল দাদা, আমরা কিন্তু ছাড়ব না। এর শেষ দেখব। কিছু না বলে নিঃশব্দে আমরা বেরিয়ে আসি।
ডলিকে পৌঁছে দিয়ে ফিরছিলাম। এখন প্রায় দশটা বাজে। সকাল থেকেই বেশ মেঘলা আকাশ। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। দোকান টোকান সব বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তাতেও লোক চলাচল প্রায় নেইই।একটু হেঁটেই বাড়ির রাস্তায় ঢোকার মুখে কয়েকটি মোটর বাইক আমাকে চারপাশ থেকে গোল করে ঘিরে ধরল। হেড লাইটের তীব্রতায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ওদের মুখ থেকে খিস্তি ভেসে আসছে। বাইক থেকে নেমে দুটি ছেলে আমার কলার ধরে ঘুসি মারতে লাগল। আমি বাধা দিতে চেষ্টা করেও ওদের গায়ে জোরের সঙ্গে পারছি না। মুখ চোখ ফেটে গেল। রক্তে ভেসে যাচ্ছে আমার বুক। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। হাত মুচড়ে ধরে আমায় মারছে। চুলের মুঠি ধরে মাথা এপাশে ওপাশে ঘোরাচ্ছে। রাস্তায় ফেলে বুকে পেটে লাথি মারতে লাগল। মাথায় ইট মারছে। হাঁটুতে মারছে।
একজন বলল, ছেড়ে দে। মরে গেলে কেস জন্ডিস হয়ে যাবে।
অন্যজন বলল, দাদাগিরি ছুটিয়ে দেব।
ঠিক সেই মুহূর্তে দূর থেকে ছুটে আসার কিছু পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। তারা চিত্কার করছে, ধর… ধর…
বাইকগুলো উলটো দিকে ছুটে গেল। কারা যেন বলছে, ইশ। কী করেছে! এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে চল।
আমার মাথাটা দুহাতে তুলে কে যেন বলল, রাজুর টাটা সুমোটা বার করে আন।
একজন বলল, ডলিদিকে খবর দে।
আমি আর তাকাতে পারছি না। কিছু শুনতেও পাচ্ছি না। মৃদু কণ্ঠে বলি, মা… মা…
অনেকগুলো কন্ঠস্বর চিত্কার করে উঠল আমাদের লড়াই চলছে, চলবে। আমরা পিছু হঠব না। ওদের ধরে মাটিতে পুঁতে ফেলব। খুঁজে বার করবই। চিত্কার বাড়ছে আমি আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না। বুঝতে পারছি না। শুধু চেতনায় বাজছে একটা সুর।
এক দল বলছে এলাটিন বেলাটিন সই লো।
অন্য দল বলছে কীসের খবর আইল?
আগের দল বলছে রাজামশাই একটি বালিকা চাইল।
পরের দল বলছে কোন বালিকা চাইল?
চাইল… চাইল… 0
সমাপ্ত