করোনা অতিমারি আমাদের সকলের জীবনশৈলীতে বড়সড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। শারীরিক ছাড়াও মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যও প্রবল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবসাদ, মানসিক অবসাদের লক্ষণ নিয়ে রোগীরা ডাক্তারের সাহায্য নিতে বাধ্য হচ্ছেন। শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্করাই নন, বাচ্চারাও অবসাদের শিকার হচ্ছে। বাচ্চাদের অবসাদের পিছনে যে শুধু করোনার হাত রয়েছে তা নয়, আরও অনেক কিছু কারণেও বাচ্চা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। পড়াশোনার মাত্রাতিরিক্ত চাপ, পারিবারিক সমস্যা, মা-বাবার মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা, আর্থিক সমস্যার প্রভাব, বন্ধুবান্ধবহীন জীবন এসব কিছুই শিশুকে অবসাদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। অভিভাবকেরা বেশিরভাগ সময়ে বাচ্চাদের অবসাদের লক্ষণকে সেভাবে গুরুত্ব দিতে চান না। তাঁরা মনে করেন বাচ্চা আসলে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। কিন্তু বড়োদের উচিত এই বিষয়ে আরও অনেকবেশি সচেতন হওয়া। বাচ্চার মনে যদি Depression একবার গেঁড়ে বসে যায় এবং বাড়ির বড়োরা সেটা এড়িয়ে যাওয়াই সমীচীন মনে করেন তাহলে ক্রমশ বাড়তে থাকা অবসাদ বাচ্চাকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলতে পারে। বাচ্চাদের ব্যবহারে কোনও অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখলেই সতর্ক হন। বর্তমান সময়ের চাপে বাচ্চাদের মধ্যে বাড়তে থাকা স্ট্রেস এবং একাকিত্ব দূর করা কীভাবে সম্ভব, তাই আমাদের আলোচ্য বিষয়।
বাচ্চার মন থেকে Depression এবং স্ট্রেস দূর করতে
বন্ধুত্বপূর্ণ এবং ইতিবাচক পরিবেশ : বাচ্চার মনে স্ট্রেসের প্রধান কারণ হল বাড়ি এবং বাইরে নেতিবাচক পরিবেশে কাটানো। অভিভাবকেরাই বাচ্চার কাছে রোল মডেল হয়ে থাকে তাই পেরেন্টদের দায়িত্ব বাড়ির পরিবেশ বন্ধুত্বপূর্ণ রাখা। কোনও কারণ যদি বাচ্চাকে চিন্তিত করে তোলে বা বাচ্চার মনে দুঃখ দেয়, তাহলে পরিবেশ এমন হওয়া উচিত যে, মা-বাবাকে সত্যিকারের বন্ধু ভেবে বাচ্চা তাদের সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করতে পারে। এতে বাচ্চা সঠিক রাস্তাও খুঁজে পাবে এবং মনের অবসাদও কম হবে।
এছাড়াও বাড়িতে বড়োদের মধ্যে ঝগড়া, অশান্তি, অভদ্র ভাষার ব্যবহার বাচ্চাকে ভীত সন্ত্রস্ত যেমন করে তোলে, তেমনি চরিত্রগত ভাবে আক্রামণাত্মক হয়ে উঠতেও বাচ্চার দেরি লাগে না। সেজন্য বাড়ির পরিবেশ পজিটিভ রাখা জরুরি। বাচ্চার উপর কথায় কথায় রাগ না করে মৃদু কণ্ঠে রুচিসম্মত ভাষায় বাড়িতে কথা বলার অভ্যাস তৈরি করা বাঞ্ছনীয়। বাচ্চার সামনে অপরের আলোচনা একেবারেই করবেন না। বাচ্চাকে নিজের কথা বলার সুযোগ দিন এবং তাকে বোঝার চেষ্টা করুন। এতে ভালো-মন্দর বিচারবোধ জন্মাবে বাচ্চার মধ্যে এবং এরকম পরিবেশে বাচ্চা খুশিও থাকতে পারবে।
তুলনা করবেন না : সাধারণত বাচ্চার আত্মসম্মান তখনই আঘাতপ্রাপ্ত হয় যখন সেই বাচ্চাকে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাই অন্য বাচ্চাদের সামনে তাকে নীচু প্রতিপন্ন করা বা পরীক্ষার ফলাফল ভালো করতে না পারলে তাকে অপর বাচ্চার সঙ্গে তুলনা করা ইত্যাদি ব্যবহার বাচ্চার সঙ্গে না করে বরং তাকে রেজাল্ট নিয়ে বেশি চিন্তা করতে বারণ করুন। পরামর্শ দিন, পরের বারের পরীক্ষার জন্য মন দিয়ে এখন থেকেই পড়াশোনা করতে। সবরকম ভাবে আপনি তাকে গাইড করবেন এ ধরনের আশ্বাস বাচ্চার মনোবল বাড়াতে সাহায্য করবে।
ভয়ের কথা শেযার করবেন না : অনেক সময় পরিবারে বা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটে যায় যেটা নিয়ে বড়োদের মনেই এমন ভয় বসে যায় যে, তার থেকে বাইরে বেরোতে বেশ সময় লাগে। সুতরাং বড়োদের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে বাচ্চাদের মনে কী হতে পারে সেটা ভেবে দেখার। তাই বাচ্চাদের সঙ্গে ভয়ের বা দুঃখের ঘটনা শেয়ার করা, একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। যদি বাচ্চাকে এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতেই হয়, তাহলে চেষ্টা করবেন তাকে বুঝিয়ে মন থেকে ভয়টা বার করে দিতে। কোনও ঘটনা বাচ্চার মনকে কীভাবে প্রভাবিত করবে আগে থেকেই সেটা বোঝা খুব মুশকিল।
মনের ভিতরের ভয় দূর করার চেষ্টা করুন : অনেক সময় বাচ্চা খেতে ভয় পায় বা লোকজনের সামনে আসতে চায় না। বন্ধুদের থেকেও দূরে দূরে থাকা পছন্দ করে। এই নিয়ে বাচ্চাকে বকাবকি করবেন না। বরং বড়োদের দায়িত্ব এই আচরণ নিয়ে বাচ্চার সঙ্গে কথা বলা। কেন সে স্কুলে যেতে ভয় পায় বা লোকজন এড়িয়ে চলে তাকে ভালো করে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে পুরোটা জেনে নিন। প্রয়োজন হলে স্কুলের টিচারদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান বার করার চেষ্টা করুন।
খেলার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করুন : অভিভাবকরা যদি বাচ্চাদের সময় না দেয়, মজার মজার খেলায় তাদের সঙ্গে মেতে না ওঠে, তাহলে বাচ্চা বোর ফিল করতে থাকবে। নতুন কিছু করার উৎসাহ যদি বাচ্চা হারিয়ে ফেলতে থাকে, তাহলে তাদের মোটিভেট করার জন্য নানারকমের খেলায় তাকে শামিল করুন। এতে সে নতুন করে অনুপ্রাণিত হতে পারবে।
আপনি সন্তানকে বন্ধু ভাবুন : যদি চান সন্তান আপনার সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করবে, কোনও কিছু লুকোবে না, তাহলে আপনাকেও তার বন্ধু হয়ে উঠতে হবে। তার সঙ্গে নিজের কথা শেয়ার করতে হবে। তাকে বলুন সেই প্রথম ব্যক্তি যার সঙ্গে আপনি এই কথা শেয়ার করছেন। এর ফলে সন্তানের চোখে আপনিই হয়ে উঠবেন সবথেকে ভালো বন্ধু এবং এই সম্পর্কে বিশ্বাস যদি বাচ্চার মনে নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে পারে, তাহলে বন্ধু থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে উঠতে আপনার বেশি সময় লাগবে না।