কাটরা থেকে বৈষ্ণোদেবী যাওয়ার রাস্তাটি মনোরম আশ্চর্যতায় ভরা। প্রশান্ত উপত্যকা, সবুজ গাছের সমারোহ, পাখি এবং প্রবাহিত মনোরম বাযু মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেয়।
দুরাত্রি ট্রেন জার্নির পর সকাল ৭টার সময় জম্মুতে নেমে হোটেলে গিয়ে স্নান সেরে সকালের খাবার খেয়ে জ্বালামুখী মন্দির দেখতে বেরিয়ে পড়ি। জ্বালামুখী মন্দির একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তিপীঠ। এখানে সতীর জিভ পড়েছে বলে জানা গেছে। বহু প্রাচীন শাস্ত্রে এর উল্লেখ রয়েছে। মন্দিরটি একটি পাহাড়ে অবস্থিত। ভিতরে, একটি তামার পাইপ থেকে চিরন্তন শিখা জ্বলতে থাকে, যা দেবী দুর্গার নয় রূপকে উপস্থাপন করে বলে বিশ্বাস করা হয়। সম্রাট আকবর শিখার উপরে একটি সোনার ছাতা দান করেছিলেন।
জ্বালামুখী মন্দির দেখে এসে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে বাসে করে কাটরা যাবার জন্য রওনা দিই। দুঘন্টার মধ্যে কাটরা পৌঁছে গেলাম। সারাদিন হোটেলে বিশ্রাম করার পর রাতে সবাই মিলে বৈষ্ণোদেবী যাওয়া হবে বলে ঠিক হল।
ভারতের অন্যতম তীর্থস্থান মাতা বৈষ্ণোদেবী গুহা মন্দিরটি জম্মুর কাটরায় ত্রিকূট পাহাড়ে অবস্থিত। কাটরা থেকে বৈষ্ণোদেবী মন্দিরটি ১৩ কিলোমিটার পথ। অনেকে হেঁটে যান, আর যারা হাঁটতে পারেন না তাঁদের জন্য পোর্টার, পালকি এবং পোনি ভাড়া করে যাওয়া যায়। আবার কাটরা থেকে হেলিকপ্টার পরিষেবাও আছে। যাইহোক কাটরা বাস স্টেশনের কাছে যাত্রা নিবন্ধকরণ কাউন্টার থেকে যাত্রা স্লিপ নিয়ে আমাদের দলের ২৫ জনের মধ্যে অনেকে হেঁটে গিয়েছে,আবার অনেকে পোনির পিঠে করে গিয়েছে। আমাদের পরিবার অবশ্য পোনির পিঠে করে উঠেছি আর নামার সময় হেঁটে নেমেছি।
আমরা রাত ১১টায় পোনির পিঠে চেপেছিলাম আর ভোর ৪টের সময় বৈষ্ণোদেবী গুহার কাছে পেঁছোলাম। তারপর লাইন দিয়ে দেবীর গর্ভগৃহে ভোর ৫টায় প্রবেশ করে দেবী দর্শন করে চোখ ও মন জুড়িয়ে গেল।
দেবী সাড়ে পাঁচফুট লম্বা শিলা আকারে আছেন যার তিনটে মাথা রয়েছে। মাতা বৈষ্ণোদেবীর ভক্তরা লালচুনরি, শাড়ি, শুকনো ফল, ফুল ইত্যাদি দিয়ে থাকেন। আমরাও দিয়েছিলাম। মাতা বৈষ্ণোদেবীর পবিত্র গুহাটি হিন্দু পুরোহিত পণ্ডিত শ্রীধর আবিষ্কার করেছিলেন বলে জানা যায়। বৈষ্ণোদেবী দর্শন করে নীচে নেমে হোটেলে গিয়ে খাবার খেয়ে বিশ্রাম নেওয়া হল। অবশ্য ওই দিন কাটরা হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে আমরা বাসে করে মানালির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
প্রায় সাড়ে নয় ঘন্টা জার্নি করে বিকেলবেলা মানালি পেঁছোলাম। হোটেলে গিয়ে ঘরে বিশ্রাম নিয়ে কিছু খাবার খেয়ে সবাই মিলে ম্যালে ঘুরতে বেরোলাম। মানালির ম্যাল খুব সুন্দর। ম্যালের কাছে প্রচুর গরম পোশাকের দোকান ও হস্তশিল্প কেনাকাটির জন্য অনেক দোকান আছে। এছাড়াও হরেক দোকান আছে খাবারদাবারের। তাছাড়া ম্যালের কাছাকাছি তিব্বতি বাজার এবং তিব্বতি মঠ রয়েছে। আমরা সবাই কিছু কেনাকাটি করে হোটেলে ফিরে আসলাম।
বিয়াস নদীর ধারে অবস্থিত মানালির সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা খুব শক্ত। এখানে যেমন আছে সবুজ পার্বত্য উপত্যকা, বরফে ঢাকা সারি সারি পর্বতশৃঙ্গ, তেমনি আছে পাহড়ের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া সুন্দরী বিয়াস নদী। মানালিতে আমরা দুদিন ছিলাম। একদিন আমরা হিড়িম্বা মন্দির দেখতে যাই। পাইন, দেবদারুর ঘন বনের মধ্যে এই মন্দির। জনশ্রুতি, হিড়িম্বা এইখানেই একটি গুহায় বসবাস করতেন। মন্দিরটি নির্মাণ করেন মহারাজা বাহাদুর সিংহ ১৫৫৩ সালে।
হিড়িম্বা মন্দিরের কিছুটা আগে একটা বড়ো গাছের তলায় হিড়িম্বার পুত্র ঘটোত্কচের পুজো হয়। মন্দিরের আশেপাশে অনেক দোকান আছে। মানালির ক্লাবহাউসও অতি চমত্কার। পরের দিন রোটাং পাস যাওয়া হল। মানালি থেকে ৫১ কিলোমিটার দূরে পীর পাঞ্জাল রেঞ্জে প্রায় চার হাজার মিটার উঁচুতে রোটাং পাস। রোটাং এর বেশ কিছুটা আগে থেকে সবুজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় প্রায়, অক্সিজেনের এখানে বেশ অভাব। তবে রোটাং-এর বরফের মধ্যে আমরা খুব মজা করেছি। রোটাং পাস থেকে নেমে সোজা হোটেলে গেলাম। সেইদিন হোটেলে রাত কাটিয়ে পরের দিন ডালহৌসির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
ডালহৌসি হিমাচল প্রদেশের একটি মনোরম শৈলশহর। ১৮৫৪ সালে সেনাবাহিনী ও সরকারি পদাধিকারিকদের গ্রীষ্মবকাশ যাপনের জন্য ব্রিটিশ সরকার, এই শহরের পত্তন ঘটান। শহরটি ভারতের তত্কালীন গভর্নর লর্ড ডালহৌসির নামাঙ্কিত। শহরটি পাঁচটি শৈলশিখর নিয়ে গঠিত। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬,০০০ – ৯,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। শহর জুড়ে ভিক্টোরিয়ান ও স্কটিশ স্থাপত্যের বিভিন্ন নিদর্শন দেখা যায়। একইসঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলন যেন ঘটেছে এখানে। ডালহৌসিতে দেখার মতো যা যা রয়েছে তা হল খাজিয়ার, সাতধারা জলপ্রপাত, পঞ্চপুলা, চামেরা লেক।