মানুষের আধুনিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজকেও হতে হবে আধুনিক। এখনও আমাদের সমাজে কন্যা সন্তানরা উপেক্ষিত, গ্রামে গঞ্জে ছাড়াও বড় বড় শহরেও আজও মানুষ শিক্ষিত হয়েও কন্যা ভ্রূণ নষ্ট করতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে থাকে। অথচ কেন এই বৈষম্য? আজ আধুনিকতার বুলি আউড়েও মনসিকতায় কিন্তু আধুনিক হতে পারিনি। আধুনিক হয়েছি শুধু ভাষায়, আদব কায়দায়, পোশাকে। পুত্র সন্তান কে নিয়ে যেমন মা বাবার মনে আশার শেষ নেই কারণ সেই কিনা হতে পারে বুড়ো মা বাবার মাথার ছাতা! অথচ এমন ভাবনা মেয়ের জন্যেও ভাবা যায় নাকী? নতুন করে ভাবার সময় এসে গেছে। কন্যা সন্তানই হতে পারে মা বাবার গর্বের কারণ।
লক্ষ্য নির্ধারণ করুন
বিশ্বের দরবারে চোখ রাখলেই বহু আদর্শ ছবি চোখে পড়বে ঠিক যার মতো আপনি মেয়েকে তৈরি করতে চান। লক্ষ্য নির্ধারণ করা মানে শুধু কোনও প্রফেশনই নয়, বরং মানুষ, ব্যক্তিত্ব, মানসিকতা সবকিছুরই বিকাশ ঘটা। এর ফলে একটি শিশু আত্মনির্ভর হয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারবে।
ছেলের মতো মানুষ করার অভিলাষে অমিত নিজের মেয়ে জীবন নষ্ট করে দিয়েছে, এমন ঘটনাও কিন্তু ঘটছে। আমি ছেলে-মেয়েতে ভেদাভেদ করি না এই মানসিকতায় বড়ো হয়ে ওঠা অমিতের মেয়ে রোশনি আধুনিকতার মুখোশের পিছনে নিজের জীবনটা ছারখার করে দিয়েছে। না কোনও কাজে তার আগ্রহ আছে আর না তো উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পেরেছে সে। ফলে আজ বাবার অবর্তমানে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতাই তার তৈরি হয়নি।
সারাদিন পার্টি, হই-হুল্লোড়, ফূর্তি এবং পরনির্ভরশীল একটা মানুষ রোশনি। নির্ভর করতে নয় বাবাকে দরকার বা স্বামী। এর ফলস্বরূপ আজ শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ধাক্কা খেতে হচ্ছে রোশনিকে। মেয়েকে অমানুষ তৈরি করার সব দায় শ্বশুরবাড়ি, অমিতের ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছে।
এখন সকলেরই প্রায় ১টি কি ২টি সন্তান। ছেলেরা বেশি পড়াশোনা করে বাড়ি থেকে দূরে কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছে। মানুষ মেয়েদের উপর নির্ভর করছে, আশা করছে মেয়েরাই তাদের বার্ধক্যে সেবাযত্ন করবে। তারা মেয়েদের সংবেদনশীলতা এবং সেবার মনোভাবের পরিপূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে। অথচ এই মা-বাবারাই নিজেদের যৌবনে মেয়েকে অন্য পরিবারে বিয়ে দিয়ে পাঠাবেন, এই মানসিকতা নিয়ে বড়ো করেন।
যে-মেয়ে নিজেই অন্যের উপর নির্ভরশীল আর্থিক ভাবে, সে কতদূর পর্যন্ত নিজের মা-বাবাকে সাহায্য করতে পারবে? তবে ধীরে ধীরে সমাজ বদলাচ্ছে সঙ্গে মানুষের চিন্তাভাবনাও।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত মেয়েদের হাতের কলম কেড়ে নিয়ে ঘরকন্নায় তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। শিক্ষার আলোর বদলে টেনে নামানো হতো সংসার নামক অন্ধকারের জাঁতাকলে। সেটাই তাদের জীবন, বারবার মনে করানো হতো। তবে আশীর্বাদ এটাই, মানুষ বদলাচ্ছে সচেতনতা বাড়ছে। কন্যাসন্তানের প্রতি মা-বাবা, সমাজেরও ধারণায় প্রভূত পরিবর্তন এসেছে।
এইভাবে করে তুলুন আত্মনির্ভর
- কন্যাসন্তান হলে তার যেন এটা মনে না হয় মা-বাবা বাধ্য হচ্ছে তার দেখাশোনা করতে। আপনাদের কাছে সে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা তাকে বলা এবং বোঝানোটা জরুরি
- সবসময় ভরসা দিন আপনার বাড়িই ওরও বাড়ি। সেটা আপনার মেয়ে বিবাহিতাই হোক কিংবা নিজে কয়েকটা বাড়ির মালকিনই হোক
- আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বা চেনা পরিচিতির মধ্যে যে-সাফল্য অর্জন করেছে তার কথা, নানা গল্প মেয়েকে বারবার শোনান। কার মতো নিজেকে সে তৈরি করতে পারে সেই পরামর্শও আপনি তাকে দিতে পারেন। মনে রাখবেন আপনার কর্তব্য হচ্ছে তার রাস্তা প্রশস্ত করা, নিজের ইচ্ছা তার উপর চাপিয়ে দেওয়া নয়
- মানসিক এবং শারীরিক ভাবে মেয়েকে শক্ত করে গড়ে তুলুন সহজে যাতে সে ভেঙে না পড়তে পারে। তাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিন। বিশ্বাস রাখুন আপনি যেটা পছন্দ করেন সেইমতোই সে সিদ্ধান্ত নেবে। যদি সে কোনও ভুলও করে বসে নিরুত্সাহিত করবেন না। বেশি বাধা দিলে বাচ্চা হীনম্মন্যতার শিকার হয়
- মেয়ে যেটা বলছে মন দিয়ে গুরুত্ব দিয়ে শুনুন। প্রথম থেকেই যদি ওর কথা শোনেন তাহলে মেয়েও আপনার কাছে খুলে বলার অভ্যাস তৈরি হবে। আপনার কথাও সে শুনবে। কথোপকথনের মাধ্যমে ঠিক বেঠিকটাও আপনি তাকে বলতে পারবেন
- মেয়েকে এমন ভাবে শিক্ষা দিন যাতে সে বুঝতে পারে একটা বয়সের পর তাকে আর্থিক ভাবে পুরোপুরি আত্মনির্ভর হতে হবে। আর্থিক আত্মনির্ভরতা তার মনোবল দৃঢ় করতে সাহায্য করবে। ফলে নিজের জীবনে যে-কোনও সিদ্ধান্ত নিতে নিজে সক্ষম হবে এবং মা-বাবার বার্ধ্যক্যের লাঠিও হয়ে উঠতে পারবে।
সুতরাং কন্যাসন্তানকে মনে করুন অহংকারের বস্তু, তাকে সুশিক্ষা দিন এবং সংবেদনশীল হতে শেখান।