শৈলশহরের নরম রং অসতর্ক ছায়াপথে তুলির টানে দিকদিগন্ত এঁকে রাখে। কার্শিয়ং জানে ভ্রমণপ্রেমী বাঙালির পাহাড়প্রেমের তত্ত্বতালাশ। সুসংহত ও কমনীয় সাজে সাজিয়ে রাখে শহরকে। সাহেবিয়ানা এই শহরের রন্ধ্রে এখনও। দার্জিলিংয়ে মতো প্রখর হাড়কাঁপানো শীত নেই, বরং কার্শিয়ংয়ের আবহাওয়া বছরভরই মনোরম। অথচ দার্জিলিং থেকে কার্শিয়ংয়ের দূরত্ব ব্যবধান মাত্রই ৩০ কিলোমিটার। তুলনা না করেই বলা যায় দার্জিলিং যদি হয় পাহাড়ের রানি, কার্শিয়ং তাহলে পাহাড়ের রাজকন্যে।

লেপচা শব্দ খর্সং মানে হল ভোরের ধ্রুবতারা। তদানীন্তন ব্রিটিশদের অনভ্যস্ত উচ্চারণে খর্সং হয়ে গেছিল কার্শিয়ং। আবার অন্যমতে কার্শান-রিপ্ নামে একপ্রকার সাদা অর্কিডের নাম অনুসারে শহরের নাম কার্শিয়ং। লেপচা ভাষায় কার্শিয়ং মানে ছোট্ট অর্কিড। সমস্ত শহর জুড়ে চন্দ্রবিন্দুর মতো শ্বেত-শুভ্র অর্কিড ফুটে থাকে। প্রভাতের ফুল ফোটার সঙ্গে আকাশের তারার সৌন্দর্যের সাদৃশ্য নিরূপণ করেই সম্ভবত এমন নাম রেখেছিলেন লেপচারা।

আনুমানিক ১৭৮০ সাল নাগাদ নেপালিরা Kurseong ও তার আশপাশের এলাকা বাজেয়াপ্ত করে নেয়। পরে গোর্খাদের সঙ্গে যুদ্ধে নেপালিরা হেরে যায়। ১৮১৭ সালে টিটালিয়ার চুক্তি হয় সিকিম-নেপালের। তখন ব্রিটিশরাজ চলছে, পাহাড়ের এই অঞ্চলের আবহাওয়া তাদের কাছে উপভোগ্য মনে হয়েছিল। মিলিটারি রোড হওয়ার আগে, টিটালিয়ার থেকে কার্শিয়ং হয়ে দার্জিলিং যাবার প্রথম পথ নির্মিত হয় ১৭৭০-৮০ সাল নাগাদ। পাইন, ফার, বার্চে ছাওয়া ৪,৮৬৪ ফুট উচ্চতায় কার্শিয়ং, ব্রিটিশরা সিকিমের ছোগিয়াল রাজবংশ থেকে ১৮৩৫ সালে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নেয়।

সিকিমরাজ তুষুপুড় নামগিয়্যাল পারিতোষিক দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বশ্যতা মেনে নিতে বাধ্য হন। আরও পরে ১৮৮০ সালে দার্জিলিং-হিমালয়ান রেলপথ চালু হতেই ব্রিটিশ মিলিটারিদের স্বপরিবারে স্বাস্থ্য উদ্ধারের ঘাঁটি হিসাবে কার্শিয়ংয়ের গুরুত্ব বাড়ে এবং মহকুমার শীর্ষ দফতর হয়। সেই সময়ই এটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। কার্শিয়ংয়ের ইতিহাস সুপ্রাচীন এবং স্বাধীনতার আগে থাকতেই তা বিবর্তিত হয়ে আজকের শৈলশহরের রূপ পেয়েছে।

ইতিহাসের একঘেয়ে কথা থাক। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে জনপ্রিয় শৈলশহর মেঘ, কুয়াশা, কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছানি, খেলনাগাড়ি, চা-খেত, আঁকাবাঁকা পাহাড়িপথ, মেঘে ঘুমিয়ে থাকা পাইনের ঘেরাটোপ এবং একরাশ মায়া নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট সাদা রঙের অর্কিড ফুলে ছয়লাপ জমজমাট শহর। তাই তো কার্শিয়ংকে বলা হয় ল্যান্ড অফ হোয়াইট অর্কিড।

প্রকৃতিবিলাসীদের জন্য আসন পেতে রাখা যাত্রাপথে কার্শিয়ংয়ের পৌঁছে খানিক জিরেন নেয় খেলনা-ট্রেন। মন্দির-গির্জার-গুম্ফার সহাবস্থান শহরে। মসৃণ সবুজ জেল্লায় পাহাড়ের ঢাল বরাবর প্রচুর নামিদামি উর্বর চা-খেত। মকাইবাড়ি অন্যতম। মকাইবাড়ি চা-বাগিচার গল্প না বললে কার্শিয়ং ভ্রমণের কথাই অধরা থেকে যাবে। বিশ্বমানের ফার্স্ট ফ্ল্যাশ চায়ের কদর মকাইবাড়ির।

৪,৯০০ ফুট উঁচুতে ৩০০ একর জমি জুড়ে নিখুঁত করে ছাঁটা চায়ের ঝোপের বাহার। বাগিচা কর্তৃপক্ষ থেকে প্রাপ্ত ব্রোশিওর থেকে জানলাম, ১৮৫৯ সালে চা-বাগিচাটির পত্তন হয়, বাঙালি মালিকানায় চা-বাগিচাটি চলতে থাকে। সাতটি গ্রাম যথা কোদোবাড়ি, ফুলবাড়ি, ছেপতে, কৈলাপনি, থাপাথলি, ছুংগে ও মকাইবাড়ি নিয়ে বিস্তীর্ণ চা-ক্ষেত্র। মকাইবাড়ির ঝুলিতে রয়েছে জৈবসারে উত্পন্ন কৃষিজমির চা হিসাবে বিশেষ পুরস্কার। মকাইবাড়ি চা প্রথম বাণিজ্যমেলায় অংশ নেয়। চা-বাগিচা অভিযানে চা-শ্রমিকদের চা-পাতা তোলা, চা-প্রশিক্ষকের অনুমোদিত চায়ের স্বাদ নেওয়া, চা-শ্রমজীবীদের জীবিকা সম্পর্কে ধারণা হয়।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...