আমাদের অনলাইন বুকিং করা ছিল কার্শিয়ংয়ের টয়ট্রেন স্টেশন থেকে কিলোমিটার দুয়ে দূরে পঙ্খাবাড়ি ফাটক রোডের ওপর এক বিগতকালের প্রাসাদের হোটেল কোচরেন প্লেস। কেতাদুরস্ত হোটেলটি বেশ কিছুটা মহার্ঘ্য হলেও সমগ্র হোটেলটাই ঘুরে ঘুরে দেখার মতো। সে যুগের পিয়ানো, ফ্রেমবাঁধানো প্রচুর চিত্র, ভিন্টেজ গাড়ি, আসবাবপত্র, বাসনকোসন ইত্যাদি নিয়ে অন্দরমহলটাই রাজকীয় ভাবে সাজানো। মেঘরাজ্যের খোলা বারান্দায় ছিমছাম খাওয়ার জায়গায় মধ্যাহ্নভোজন সেরে শহর ঘুরতে যাব আমি তো হোটেলচত্বর দেখতেই কালক্ষেপ করছি। এখানে বেশ কিছু হোমস্টের গায়ে টয়ট্রেন যাবার লাইন পাতা। সারা দিনমান টয়ট্রেনের যাওয়া-আসা দেখার অভিজ্ঞতাই অন্যরকমের।
কাছেপিঠে কত যে অফবিট দ্রষ্টব্য রয়েছে। যেমন বেলতার নামে এক জায়গায় রয়েছে ওপেন সুইমিং পুল। টুং স্টেশনের পাশ দিয়ে চা-বাগানের মধ্য দিয়ে গড়াতে গড়াতে দিব্যি পৌঁছে যাওয়া যায় বেলতার। সবুজ চারদিকের ছায়ার মাঝে গোল পুষ্করিণীর পাশে নিরালা বেলতার রিসর্ট। মূলশহর থেকে ৫.২ কিলোমিটার দূরে উচ্চতম স্থান ডাউহিল সম্পর্কে প্রচলিত ভূতের গল্প চাউড় রয়েছে। এখানে নাকি ঠাঁই নেয় অশরীরীরা। গোটা এলাকা কুয়াশার জালে আগলে রাখে মায়াবী রহস্যময়তা। লোকমুখে প্রচারিত, এখানে নাকি এক স্কন্ধকাটা বালককে দেখা যায়।
পাহাড়ি-পথে জীবিকা নির্বাহের কারণে কাঠকুটো নিয়ে চলাচল করেন সাধারণ মানুষ। তারা অনেকেই চাক্ষুস করেছেন নানান অলৌকিক ঘটনা, একাধিকবার। কার্শিয়ং থেকে পঙ্খাবাড়ি পথে ডাউহিলের গা ছমছমে ভয়ংকর ভৌতিক ইশারাময় প্রকৃতি কিন্তু মাত করে দেয়। ডাউহিল থেকে বনদফতর পর্যন্ত আলোআঁধারি অরণ্যপথটি স্থানীয়দের কাছে ডেথ রোড বা মৃত্যুপথ নামে কুখ্যাত। যদিও ডাউহিলের অপ্রতিম সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু। তবে ভারতের রহস্যঘন স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম। রহস্য মৃত্যুর হরেক কল্পকাহিনি ও প্রেতাত্মার গল্প লোকের মুখে মুখে ফেরে। অনেকেই তা কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দিতে পারেন।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কুসংস্কারের পালে হাওয়া দেওয়া ভূতুড়ে গল্প চালু করায় ক্ষুব্ধ স্কুল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় অধিবাসীরা। এই এলাকায় রয়েছে ব্রিটিশ আমলের ডাউহিল চার্চ, দুটি স্কুল সেন্ট জোসেফ ও ভিক্টোরিয়া বয়েজ স্কুল। একটি মৃগদাব, বন-প্রদর্শশালা এবং সুন্দর একটি ইকোপার্ক। একধরনের পাহাড়ি ঘুঘু পাখির নাম ডাউ। এই পাহাড়ি এলাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে ডাউ পাখি দেখা যায়। সেইজন্যই এই পাহাড়চড়ার নাম ডাউহিল।
কার্শিয়ং ঈগল ক্রেগ পার্কের নজরমিনারে ঠায় বসে থাকি। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে উচ্চতা ও সমতলের ঘনত্বের নিরিখে দেখি। দু’চোখের আঙিনায় পান্নাসবুজ তিস্তা ও মহানদী উপত্যকার দিগন্তবিস্তৃত সবুজের সমারোহ প্রশান্তি আনে। কার্শিয়ং থেকে দার্জিলিং অংশে টয়ট্রেন চলে মোটামুটি নিয়মিত। বাঁকের পর বাঁক ভোঁ বাজাতে বাজাতে ধীরে ধীরে এর বাড়ির দাওয়া, ওর বাড়ির জানলার গা ঘেঁষে কু ঝিকঝিকিয়ে কার্শিয়ং-টুং-সোনাদা-ঘুম-দার্জিলিং চলে যায় টয়ট্রেন। সালামান্দার ঝিল প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে, সেখানে নানা প্রজাতির সরীসৃপ, মাছ এমনকী রয়েছে ঝিলের জলে নৌবিহারের বন্দোবস্তও। মেঘে মেঘে ছয়লাপ পাহাড়ের মাঝে নৌবিহারও জমে যায় পর্যটকদের মধ্যে।