আমাদের পরবর্তী গন্তব্য অম্বুটিয়া চা-বাগিচা ও অম্বুটিয়া শিবমন্দির। সার্কিটহাউস থেকে কিছুটা দূরে গ্রিন টি-র জন্য খ্যাত এই চা-বাগিচাটি। গিদ্দা পাহাড় ভিউপয়েন্টটা পর্যটকদের কাছে বেশ লোভনীয় দ্রষ্টব্য। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ব্যাপ্তি ও সৌন্দর্য দেখার মতো। গিদ্দা পাহাড়ে রয়েছে স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আরাধ্য রাম-সীতা মন্দির ও দুর্গামাতা মন্দির। সামনেই রোদ্দুর-মেঘের রূপান্তরিত ছটায় হিমালয় দর্শন। কার্শিয়ংয়ের সেন্ট মেরি হিল ক্যাথলিক চার্চ, হিলকার্ট রোডের সেন্ট পলস চার্চ দুটিও দেখার মতো। এছাড়া আপার নয়া বস্তিতে রয়েছে কুনসাং কয়েলিং মনেস্ট্রি। মার্গারেট ডেক টি-লাউঞ্জে একপ্রস্থ ধূমায়িত চা ও কুকিজ খাওয়া হল।

কার্শিয়ংয়ের চোখের পাতায় এখনও যেন ঘুমের আদর লেপটে আছে। মূল সড়ক ধরেই পায়চারি করা ছাড়া আপাতত আর কোনও উদ্দেশ্য নেই, বিধেয় নেই। শহরের ত্রিসীমানায় নিঃশব্দ পদচারণ করে যাই। পায়ে হেঁটেই এক লহমায় শেষ হয়ে যাবে। কার্শিয়ংয়ের কুয়াশার আবডালে জেগে আছে একফালি জনবসতি ও দুধারে গজিয়ে ওঠা হোটেল ছাড়াও বেশ কিছু হোমস্টে।

ইদানীং স্থানীয় প্রায় সব পরিবারই এখানে হোমস্টে খুলে রেখেছেন, বাড়তি আয়ের জন্য। সীমিত ব্যাবস্থা, সাধাসিধে আয়োজন। হোমস্টে মানেই স্থানীয় কোনও পরিবারের গৃহে অতিথি হয়ে থেকে যাও, নগদ অর্থ মূল্যে। নির্ধারিত মূল্যে খাওয়াদাওয়াও সেখানেই। তারপর তো আরাম করো, খানিক ঘোরো-ফেরো। হাতের নাগালেই প্রকৃতি।

ইতিহাসের পাতা ওলটালে আরও দেখা যাবে যে সুভাষচন্দ্র বসু, ভগিনী নিবেদিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন, মার্ক টোয়েের মতো স্বনামধন্যদের পদধূলি পড়েছিল কার্শিয়ংয়ের গিদ্দা পাহাড়ে বন্দিদশা কাটিয়েছিলেন নেতাজি। কবিগুরুর বেশ কিছু সাহিত্যকর্ম এখানেই। বহু নামকরা আবাসিক স্কুল রয়েছে, এই জন্য কার্শিয়ংকে স্কুল-টাউন বলেন অনেকে। এখানকার হাসেল-খোলা নামের শীর্ণ এক নদীর বাঁক দিয়ে হুইসল বাজিয়ে টয়ট্রেন যেত বলে স্থানটির নামই হয়ে গেছে হুইসল-খোলা বা হাসেল-খোলা।

নেতাজি মিউজিয়ামটিও দ্রষ্টব্য তালিকায়। ওল্ড মিলিটারি রোডের অরণ্যসরণিতে বিস্তারিত শ্বেত অর্কিডের বীথিকা। টিবি হসপিটালের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলে এখানে একটি কীটপতঙ্গের খামারবাড়ি ও কার্শিয়ং বেতার স্টেশন। কার্শিয়ংয়ের তিব্বতি-গোর্খা-নেপালি-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মিলে মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এখানে গোর্খাদের তিহার অর্থাৎ দীপাবলি ও দেশাই অর্থাৎ বিজয়াদশমী স্বাতন্ত্র উত্সব। তিনপ্রকার তেওহার পালন স্থানীয় লোকবিশ্বাসের আওতায় পড়ে। মাঘে সংক্রান্তি এখানকার অন্য প্রধান উত্সব ছাড়াও তিব্বতীদের নববর্ষ লোশার উত্সব বিখ্যাত।

পাহাড়ের নিজস্ব কিছু ভাষা থাকে। স্তব্ধ ও নীরব। কোথাও পথের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত টাঙানো মন্ত্রপুতঃ রংদার বৌদ্ধ পতাকাগুলি নীরবতার মধ্যে বহমান। হাওয়ার ঝোঁকায় উড়ছে পতপত করে। পাহাড়িয়া ভূমিপুত্রদের অগাধ বিশ্বাস, এমন করেই হাওয়ার বিস্তারে ছড়িয়ে যাবে তথাগত বুদ্ধের বাণী দেশ থেকে দেশান্তরে। নীরবতার ভেতরেই জাগরুক থাকে পবিত্র মন্ত্রধ্বনি। যাবতীয় ক্লান্তি ভুলে সেইসব ভাষা মিশে যেতে থাকে সফরনামায়।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...