হিড়িম্বা মন্দিরের কিছুটা আগে একটা বড়ো গাছের তলায় হিড়িম্বার পুত্র ঘটোত্কচের পুজো হয়। মন্দিরের আশেপাশে অনেক দোকান আছে। মানালির ক্লাবহাউসও অতি চমৎকার। পরের দিন রোটাং পাস যাওয়া হল। মানালি থেকে ৫১ কিলোমিটার দূরে পীর পাঞ্জাল রেঞ্জে প্রায় চার হাজার মিটার উঁচুতে রোটাং পাস। রোটাং এর বেশ কিছুটা আগে থেকে সবুজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় প্রায়, অক্সিজেনের এখানে বেশ অভাব। তবে রোটাং-এর বরফের মধ্যে আমরা খুব মজা করেছি। রোটাং পাস থেকে নেমে সোজা হোটেলে গেলাম। সেইদিন হোটেলে রাত কাটিয়ে পরের দিন ডালহৌসির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
ডালহৌসি হিমাচল প্রদেশের একটি মনোরম শৈলশহর। ১৮৫৪ সালে সেনাবাহিনী ও সরকারি পদাধিকারিকদের গ্রীষ্মবকাশ যাপনের জন্য ব্রিটিশ সরকার, এই শহরের পত্তন ঘটান। শহরটি ভারতের তত্কালীন গভর্নর লর্ড ডালহৌসির নামাঙ্কিত। শহরটি পাঁচটি শৈলশিখর নিয়ে গঠিত। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬,০০০ – ৯,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। শহর জুড়ে ভিক্টোরিয়ান ও স্কটিশ স্থাপত্যের বিভিন্ন নিদর্শন দেখা যায়। একইসঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলন যেন ঘটেছে এখানে। ডালহৌসিতে দেখার মতো যা যা রয়েছে তা হল খাজিয়ার, সাতধারা জলপ্রপাত, পঞ্চপুলা, চামেরা লেক।
সাড়ে নয় ঘন্টা জার্নি করে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল ডালহৌসির হোটেলে পেঁছোতে আমাদের। সেই রাতটা খাবার খেয়ে সবাই বিশ্রাম নিলাম। ডালহৌসিতে আমরা তিনরাত দুইদিন ছিলাম। পরদিন সকালে জলখাবার খেয়ে প্রথমে আমরা গেলাম খাজিয়ার। ভারতের মিনি সুইজারল্যান্ড হিসেবে পরিচিত খাজিয়ারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। একটি বেশ সুদৃশ্য লেক রয়েছে খাজিয়ারে এছাড়া রয়েছে বিশালাকার নয়টি গলফ কোর্স। খজিয়ারের পর আমরা সাতধারা জলপ্রপাত ও পঞ্চপুলা দেখতে যাই।
সাতধারা জলপ্রপাত স্থানীয় ভাবে গান্ডাক নামে পরিচিত। সাতধারা ঝরনায় সাতটি ঝরনার জল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১,০৩৬ মিটার উঁচু স্থানে মিলিত হয়ে নীচে নেমে আসে। বলা হয় এর জলে মাইকা বা অভ্র নামক এক পদার্থ রয়েছে, যার ফলে ত্বকের বিভিন্ন রোগের নিরাময় ঘটে।
পাঁচটি ঝরনা ধারার মিলনে পঞ্চপুলা এক অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। স্থানীয়দের কাছে পঞ্চপুলা জলের অন্যতম উত্সও বটে।
ডালহৌসির দুটো প্রধান কেন্দ্র, সুভাষচক এবং গান্ধিচক। আমাদের হোটেল ছিল সুভাষচকের কাছে। শেষদিনে আমরা চামেরা লেক দেখে হিমাচলি পোশাক পরে ফটো তুললাম তারপর আমরা সবাই মিলে গান্ধি চকে কেনাকাটার জন্য গেলাম। কেনাকাটা হয়ে গেলে হোটেলে ফিরে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন সকালে জলখাবার খেয়ে আমরা অমৃতসরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। দুপুরবেলা অমৃতসরের হোটেলে পৌঁছে গেলাম।
পঞ্জাবের কেন্দ্রস্থলে অমৃতসর একটি বড়ো বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। শহরটিতে শিখ ধর্মের আধ্যাত্মিক গুরু, হরমান্দির সাহেবের বাড়ি, এটি স্বর্ণমন্দির নামেও পরিচিত। আমরা হোটেলে পৌঁছে স্নান খাওয়া সেরে বাসে করে ওয়াগা সীমান্তে যাই। ওয়াগা সীমান্তের অনুষ্ঠানটি সূর্যাস্তের দুই ঘন্টা পূর্বে প্রতিদিন সীমান্ত গেটে অনুষ্ঠিত হয়। পতাকা অনুষ্ঠানটি ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) ও পাকিস্তানের রেঞ্জার্স (পিআর) দ্বারা পরিচালিত হয়। অপূর্ব সুন্দর অনুষ্ঠান দেখে ফিরে এলাম হোটেলে।
পরদিন আমরা সকালে স্নান করে স্বর্ণমন্দির দেখতে গেলাম। অপূর্ব পরিবেশ। মন্দিরের ভিতর ঢুকলে আর বেরোতে ইচ্ছা করে না। স্বর্ণমন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ এর প্রসাদ। আসল ঘি দিয়ে তৈরি প্রসাদের গন্ধ মাতোয়ারা করে দেয়। এখানে জাত, ধর্ম, বর্ণ বিশেষে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করা হয় না। স্বর্ণমন্দিরের থেকে খুব কাছেই জালিয়ানওয়ালাবাগ।
১৯১৯সালে ১৩ই এপ্রিল রাওলাট আইনের প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালনার অর্ডার দেন জেনারেল ডায়ার। নির্বিচারে গুলি চালনায় প্রাণ দেন প্রচুর মানুষ। জালিয়ানওয়ালাবাগ এসে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।
বেড়ানো প্রায় শেষ, পরদিন দশটায় বাড়ি ফেরার ট্রেন। মনের মণিকোঠায় সঞ্চয় করে নিয়ে গেলাম পাহাড়ি রাজ্যের ও অমৃতসরের কিছু অবিস্মরণীয় স্মৃতি।