কুমারী নদী থেকে ‘মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ড’-দের আরও একটু কাছে থেকে দেখা গেল, উঁচু চ্যাটানো পাথুরে জমি জল থেকে মাথা তুলে রয়েছে। কিছু গাছপালাও রয়েছে ওই দ্বীপগুলিতে। মাঝি দুই নদীর সঙ্গমস্থল দেখিয়ে আমাদের জানাল, গ্রীষ্মে জল কমলে সঙ্গমটা পরিষ্কার দেখা যায়। নৌকা এবার ড্যামের দিকে এগোতে লাগল। আমরা যাব অন্য পাড়ে পরেশনাথ শিবমন্দির ও কালী মন্দির দর্শন করতে।
মিনিট ১৫ নৌকাবিহারের পর আমরা জলাধারের অন্য পাড়ে এসে পৌঁছোলাম। তীর থেকে উঠে এলাম পাকা রাস্তায়। গরমে সকলেরই বেশ তেষ্টা পেয়েছিল। প্রথমেই রাস্তার ধারের দোকান থেকে ঠান্ডা জলের বোতল কিনলাম। একটু বিশ্রাম করে আমরা কেউ নিলাম চা, আবার কেউ ঠান্ডা পানীয়।
দোকানের পাশেই সিঁড়ি শিবমন্দিরে যাবার জন্য। আমরা গন্তব্যে পৌঁছে দেখি, মহাদেবের এক উন্মুক্ত মন্দির, স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে যা পরম পবিত্র স্থান। ড্যাম তৈরির সময় মাটি খনন করা হলে, ওই লিঙ্গাকৃতি অবয়ব খুঁজে পাওয়া যায়। শিবলিঙ্গের চারিধারে দেখতে পেলাম আরও বেশ কয়েকটা প্রস্তরমূর্তি। অনেকেই বিশ্বাস করেন, কিছু মূর্তি জৈন প্রবর্তকদের। বহু মানুষ এখানে আসেন মহা শিবরাত্রি উদযাপন করতে। এবার আমরা এগোলাম কালীমন্দিরের পথে। ড্যামের উপরের রাস্তা দিয়ে মিনিট পাঁচেক হেঁটে অন্য পাড়ে গিয়ে পৌঁছোলাম। ডানপাশে ছোট্ট একটি মন্দিরে সুন্দর কালীমূর্তি।
বিকেল ৫টা বেজেছে। সূর্যের রং ও অবস্থান দেখে বুঝলাম, সূর্যাস্ত হতে আর বেশি দেরি নেই। আমরা রাস্তা থেকে নদীতীরে নেমে এলাম। ধীর গতিতে আমাদের নৌকা চলেছে। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। সূর্যের কমলা রং লুটিয়ে পড়েছে কংসাবতীর বুকে। নৌকা এগোচ্ছে পূর্ব দিকে, আর আমাদের দৃষ্টি পশ্চিম দিগন্তে। রক্তিম সূর্যের অর্ধেকটা জলের মাঝে, মেঘের গায়েও কমলা আভা। হঠাৎই সূর্যদেব পাহাড়ের পিছনে অস্তমিত হলেন, চারিদিকে তখনও তার স্তিমিত আলো। এক ঝাঁক টিয়াপাখি ডাকতে ডাকতে ফিরে চলল তাদের বাসায়। আমাদের নৌকার গতিও বেড়ে গেল। তীরে এসে নৌকা থেকে নেমে চলে এলাম আমাদের জন্য অপেক্ষারত গাড়িতে।
রাত পৌনে ৮টা নাগাদ গাড়ি নিয়ে আবার গেলাম ড্যামের কাছে। গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে হেঁটে বেড়ালাম আলোকোজ্জ্বল ড্যামের রাস্তায়। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই ড্যামের দৈর্ঘ্য ১১.২৭ কিমি এবং নদীবুক থেকে উচ্চতা ৪১.১৫ মিটার। নদীর অববাহিকার আয়তন ৩৬২৫ বর্গকিলোমিটার। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ছোট্ট বাজার এলাকায়। দোকানপাট ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছে একে একে। আমরাও ফিরে এলাম। রাত সাড়ে ৯টায় ডিনারের ডাক পড়ল। দুপুরের রান্নার মতো রাতের পদগুলিও ছিল বেশ সুস্বাদু।
ভোর সাড়ে ৫টায় উঠে মুখ ধুয়ে রেলিং ঘেরা বারান্দায় এসে বসলাম। সকাল ৬টাতেই পেয়ে গেলাম কম-চিনির লিকার চা। একে একে স্নান সেরে যে যার পছন্দের মেনুতে প্রাতরাশ সেরে নিলাম। হোটেলের বিল মিটিয়ে ঠিক সকাল ১০টায় চেক-আউট করলাম। শুরু থেকেই মসৃণ রাস্তা। গাড়ি তেঁতুলচিটা, বেকিয়া হয়ে চলে এল ছেঁদুড়ি মোড়। এবার ডান দিকে বাঁক নিয়ে গাড়ি এগোল রানিবাঁধ-এর দিকে। রাস্তার দুই পাশে শুধুই সবুজ গাছের সমারোহ। মাঝেমাঝে কাশফুলের মেলা। আধ ঘন্টার মধ্যেই রানিবাঁধ পৌঁছে গেলাম। এবার পথের দু’পাশে হালকা জঙ্গল। রানিবাঁধ বাজার এলাকা বেশ ব্যস্ত মনে হ’ল। পরবর্তী মোড় থেকে আবার ডানদিকে বাঁক নিলাম ঝিলিমিলির পথে। ঝিলিমিলির দূরত্ব এখান থেকে আরও ২১ কিমি।
অপূর্ব সুন্দর রাস্তা। দু’পাশে শাল, পলাশ, শিমূল, পিয়াল ও মহুয়ার জঙ্গল। যা এখানে পরিচিত ‘১২ মাইলের জঙ্গল’ নামে। জঙ্গল এবার আরও ঘন, অন্তহীন। রাস্তার ডান পাশে জঙ্গলের সীমায় ওয়াচ টাওয়ার। কিছুদূর পরেই হাতি পারাপারের ‘সেফ জোন’। দলমা পাহাড় থেকে মাঝে মাঝে হাতি চলে আসে সুতানে বা ১২ মাইলের জঙ্গলে। কয়েক কিমি এগোনোর পর বাঁ দিকে পথ এগিয়েছে সুতানের জঙ্গলের দিকে। কিছুটা এগোলেই ডানদিকে অম্বিকানগর যাবার পথ।