অতনুর কথা

সকালবেলা ম্যানহাটনের অফিসে পৌঁছে ল্যাপটপ ডকিং স্টেশন-এ লাগিয়েছি— অমনি মোবাইল বেজে উঠল। সতেরো তলা থেকে দেখা যায় দূরে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। কিন্তু সে সব দেখে অভিভূত হওয়ার দিন আর নেই। এখন ফোন এলেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। কোনও বাঙালির ফোন নয় তো? ঠিক তাই। রূপম। ইচ্ছা না হলেও ফোনটা ধরলাম।

—অতনু?

—বলছি।

—কী ব্যাপার বল তো? তোরা কি আর আমাদের শান্তিতে থাকতে দিবি না?

—না মানে… কী হয়েছে?

—কী হয়েছে? অরুণিমার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। দেশ থেকে ফোন পেয়ে ও তো খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তিনদিনের মাথায় ই-মেইল এল ‘কী রে খুব তো গর্ব করছিলি মেয়ে এমআইটি-তে চান্স পেয়েছে বলে, এখন কেমন লাগছে? মায়ের জন্য দেশে যাবি, না মেয়ের জন্য পার্টি দিবি?”

—ই-মেইল… মানে।

—থাক আর ন্যাকামি করতে হবে না। দেখ ‘কুহকিনী@ইয়াহু.কম’ তোর না তোর বউয়ের ই-মেইল আইডি, তা নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। তবে ওটা যে তোদের বাড়ি থেকেই আসছে তা এখানকার সব বাঙালিরা জানে। তবে আমরাও ছাড়ব না। এর একটা বিহিত করবই। ফোনটা কেটে দিল রূপম।

“তোর বউ’। ওরা আজকাল সুচরিতার নাম উচ্চারণ করতে ঘৃণা বোধ করে। অথচ এই রূপম – অরুণিমা, মিলন-অজন্তা, প্রবাল-মিতা, সুমিত-রাধা, অভ্র-বনানী, মিহিরদা-অঞ্জনাদি – এদের সঙ্গে এত বছর কত আড্ডা, শনিবারের ডিনার, রবিবার লাঞ্চ, ছেলেমেয়েদের জন্মদিনের পার্টি, পিকনিক, বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের সরস্বতী পুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তী, দুর্গাপুজো— কী না করেছে এত দিন। আজ মুখ দেখাদেখি বন্ধ।

এসবের শুরু বছর দুয়েক আগে। আমাদের একমাত্র মেয়ে রাকা যখন হাইস্কুল পাস করে কোনও ভালো কলেজে চান্স পেল না, তখন থেকেই দেখি সুচরিতার মুখ গম্ভীর। বন্ধুদের ফোন করা বন্ধ, কাউকে বাড়িতে ডাকে না, কেউ আসতে বললে এড়িয়ে যায়। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল তোমার? মেলামেশা বন্ধ করে দিচ্ছ নাকি?’

সু উত্তর দিল— আজকাল ওদের সঙ্গে মিশতে গেলে মাথা গরম হয়ে যায়। আমিও আর কথা বাড়াইনি।

এর ক’দিন পরে হঠাৎ এক সন্ধ্যায় মিলনরা ফোন করে বলল, ‘আসছি, জরুরি কথা আছে।’ মিলন আর অজন্তা এলে সু চা করে নিয়ে এল। ওরা দেখছিলাম বেশ গম্ভীর। হঠাৎ অজন্তা সু-কে জিজ্ঞেস করল, ‘কুহকিনী@ইয়াহু.কম কী তোর ই-মেইল আইডি।’

সু বলল, “না তো৷’ কিন্তু ওর মুখচোখ দেখে মনে হল, অবাক হওয়ার বদলে খুশির আভা।

—দ্যাখ বাজে কথা বলবি না। ইংলিশ অক্ষরে বাংলা কথা— দেশ থেকে পনেরো হাজার টাকা দামের শাড়ি কিনে দেখি খুব ডাঁট! নিজের চেহারা কি ভুলে গেছিস? দ্যাখ আবার ওই শাড়ি পরে ছবি ফেসবুকে পোস্ট করিস না! দেশের লোকেরা বলবে, তোদের ওখানে আজকাল কাজের লোক পাওয়া যায় বুঝি?

—আমি যে পাঠিয়েছি তোকে কে বলল? সুচরিতার গলায় রীতিমতো খুশির ঝলক।

—দ্যাখ শাড়ির দামটা খালি তোকেই বলেছিলাম। ছেড়ে দেবার পাত্রী নয় অজন্তা।

—সে তো কলকাতার দোকানদারও দামটা জানে। এবার সত্যিই হেসে গড়িয়ে পড়ল সুচরিতা।

ওরা আর বসল না। চা না খেয়েই চলে গেল। আমি স্তম্ভিত। সু-কে বললাম ‘তুমি সত্যিই ওই ই-মেইলটা পাঠিয়েছিলে?’

সু চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেশ করেছি।’ উঠে শোওয়ার ঘরে চলে গেল সু। সেদিন আর এ নিয়ে কোনও কথা হয়নি।

এর প্রায় এক মাস বাদে, একদিন সকালে অভ্র-র ফোন অফিসে। ‘জরুরি কথা আছে, লাঞ্চের সময় তোকে অফিস থেকে তুলে নেব।”

অভ্র গাড়ি নিয়ে এসেছিল। কাছাকাছি চাইনিজ বাফেতে গিয়ে দেখি চাঁদের হাট — রূপম, মিলন, প্রবাল, সুমিত, মিহিরদা, অরুণিমা, অজন্তা, মিতা, রাধা, বনানী, অঞ্জনাদি সবাই হাজির। আগেকার মতো চেঁচিয়ে উঠলাম ‘একি! সারপ্রাইজ পার্টি নাকি?’ ওরা কেউ হাসল না। শুধু বনানী বলল, ‘চলো অতনুদা, খাবার নিয়ে নাও, তারপর কথা বলা যাবে।’

দশ ডলারে অল ইউ ক্যান ইট। খিদেও পেয়েছিল। সবাই যে যার ভর্তি প্লেট নিয়ে এসে বসলাম। তখনও জানি না আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে।

প্রথমে মিতা শুরু করল। অতনুদা, তুমি কতটা জানো আমরা জানি না, গত কয়েক দিন আমরা সবাই ‘কুহকিনী@ইয়াহু.কম’ থেকে ভীষণ বাজে বাজে ই-মেইল পাচ্ছি। আমরা জানি এগুলো সবই সুচরিতার লেখা। আমার বাবা কলকাতায় থাকেন, বয়স আশির উপর। জীবনে কখনও মদ ছোঁননি। একদিন রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটতে গিয়ে গর্তে পড়ে পা ভেঙেছেন। মেইল এল ‘আর এখান থেকে বাবার জন্য স্কচ নিয়ে যাস না, রাস্তায় বেরিয়ে মাতলামি করে লোকের মার খেয়ে একটা পা ভেঙেছে, এরপর আরেকটাও যাবে।’

—কিন্তু তোমাদের সঙ্গে অনেকদিন তো সুচরিতার যোগাযোগ নেই। ও এত সব জানবে কী করে? আমার গলা নিজের কাছেই অন্যরকম লাগল! আমি কি সুচরিতার হয়ে ওকালতি করছি?

—সে কথা আমরাও ভেবেছি। আসলে আমাদের ছেলেমেয়েদের নেটওয়ার্ক খুব স্ট্রং। মিতা বলে চলল

—তোমার মেয়ে রাকাকে একদিন ফোন করেছিলাম। ও বলল রোজ ওর মা ওকে ফোন করে সব মাসিদের কথা জিজ্ঞেস করে। ও বন্ধুদের কাছে যা শোনে তা-ই মাকে বলে। রাকাকে অবশ্য আমি আর কিছু বলিনি।

—আমি বয়সে বড়ো বলে বোধহয় তুই তোকারি করেনি। কিন্তু যা লিখেছে তা তোমাদের সামনে বলতে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে, অঞ্জনাদি বলে উঠলেন। তবে চুপ করে থাকতে তো পারব না, তাহলে এটা চলতেই থাকবে। জানো বোধহয় তোমাদের মিহিরদার চাকরি নেই। ও তো আবার গান বাজনা ভালোবাসে৷

মেইল এল ‘এবার মুখে রং মেখে রেড লাইট এরিয়ায় গিয়ে লাইন দাও, সংসার চালাবে কী করে? বরকে বলো তুমি যখন খদ্দের সামলাচ্ছ, তখন টুপি খুলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হেঁড়ে গলায় রবীন্দ্রসংগীত গাইতে— কিছু বাড়তি রোজগার হবে।”

—আমার বাবা ও শাশুড়িকে এক সঙ্গে গত সামারে দেশ থেকে এনেছি, রাধা বলল। মেইল এল, ‘তোদের তো একটাই গেস্টরুম, বাবা ও শাশুড়ি কি একই ঘরে? এবার ইস্কনের মন্দিরে গিয়ে মালাবদল করিয়ে নে। ওটাই বা বাকি থাকে কেন?’

—ছেলেদেরও বাদ দেয়নি, মিলন বলে উঠল৷ আমাকে আজকাল প্রায়ই টুরে যেতে হয়। তোর কুহকিনী লিখেছে ‘বউ তো মাত্র একশো ডলারে ঘরে লোক নিচ্ছে, রেটটা একটু বাড়াতে বলো। প্রসাদেরও তো স্টেটাস থাকে।’

—আমার ননদের ছেলে টুবাই এমএস করতে এখানে এসেছে দেশ থেকে, অরুণিমা বলল। ক’দিন আগে আমার মেয়ে পৃথার সঙ্গে শপিং মলে গিয়ে সুচরিতার সঙ্গে দেখা। পৃথা তো কিছুই জানে না। ‘মাসি মাসি’ করে অনেক গল্প করেছে। বাড়ি এসে আমায় বলতেই আমি ভয়ে কাঁটা। ঠিক যা ভেবেছি। রাত্রেই মেইল এল, “তুই কি তেলুগু হয়ে গেছিস? মেয়েকে পিসতুতো দাদার সঙ্গে ডেট করতে পাঠাচ্ছিস?’

—এ তো তবু ভালো৷ বনানী এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবার বলে উঠল— রিমলিকে তো তোমরা জন্ম থেকে দেখছ অতনুদা। এখন গ্রেড নাইন। সেদিন স্কুলে হঠাৎ পেটে ব্যথা। ওরাই নাইন ওয়ান ওয়ান ডেকে হসপিটালে পাঠিয়েছে। ডাক্তার বলল অ্যাপেনডিসাইটিস। অপারেশনের পর দু’দিন হসপিটালে থেকে বাড়ি এসেছে। পরের সপ্তাহে কুহকিনীর মেইল, ‘অ্যাবরশন হয়ে গেল? বাচ্চাটার বাবা কে? চিনা না কাল্লু?’

ওরা আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল। আমার কানে আর কিছু ঢুকছিল না। সুচরিতা এত নীচ? এত কদর্য? ওদের ঠোঁটগুলো নড়ছে দেখতে পাচ্ছিলাম। শব্দগুলো বেরিয়ে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিল। আমার কানে কিছুই আসছিল না।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...