—তা কী করে হয়, বাবার অবর্তমানে মা, আর মায়ের অবতর্মানে আমরা তো বাবার পেনসনের কণামাত্র পাব না।
— না এমনি পাবে না, তবে পেনসনটা তো বিক্রি করা যায়। অর্পিতা সেদিন কোনও উত্তর দেয়নি। বাবার নিয়মভঙ্গের কাজ। কয়েকঘর আত্মিয় কুটুমের পাশে পাড়ার কয়েকঘরও নিমন্ত্রিত ছিল। তাদের সবার কাছে আর কথা বাড়াতে ভালো লাগেনি। এমনিতেই বাবা বেঁচে থাকাকালীন দিদির বিয়ে হয়। অর্পিতা তখন টুয়েলভে পড়ে। যথেষ্ট দিয়ে দিদির বিয়ে হলেও দিদি এ বাড়িতে এলেই বলে, “আমি তো সেরকম কিছু নিইনি।” বা “বাবা তো আর আমাকে কিছু দেয়নি।’ মেজদি সামনেই বলে দেয়, “আর কত নিবি, মায়ের সব সোনা নিলি, বাবার পুরো পিএফের টাকা নিলি, তাতেও এই কথা!”
মেজদির শরীর ভালো নয়। অল্প বয়সেই থাইরয়েড, হাইসুগার। বাবা বেঁচে থাকাকালীন বিয়ের দেখাশোনা শুরু হলেও রোগের কথা শুনেই সবাই পা ফেলবার আগেই পা গুটিয়ে নিত। তবে কথাবার্তা হচ্ছে শুনেই মেজদির চোখ মুখটা চকচক করে উঠত। তারপরেই সব শেষ। মেজদিকে দেখেই অর্পিতার সব থেকে খারাপ লাগে। দিদি জামাইবাবু মেজদির সামনেই বলে, ‘তোর আর বিয়ে হবে না, বুঝলি। কে আর রোগধরাকে বিয়ে করে বল তো?”
এসময় মেজদি কোনও উত্তর দেয় না। আড়ালে শুধু কাঁদে। দাদাকে কথাগুলো জানালে দাদা, বড়দি আর জামাইবাবুর হয়েই কথা বলে। বাবার মারা যাওয়ার এক বছরের মধ্যেই দাদা নিজে বিয়ে করে নেয়। বউ নিয়ে ঘরে মাস দুই থাকবার পরেই মাকে বলে, “আমার এখান থেকে অফিসে যেতে অসুবিধা হচ্ছে। অফিসের কাছে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিচ্ছি।”
—অফিসের কাছে, না শ্বশুরবাড়ির কাছে?
মেজদির কথাগুলো শুনেই দাদা খেঁকিয়ে উত্তর দেয়, ‘শ্বশুরবাড়িটা যদি আমার অফিসের কাছে হয়, সেখানে তো আমার কিছু করবার নেই। আমি তো তোমাদের সুবিধার জন্যেই যাচ্ছি।’
—আমাদের সুবিধা! সেকি রে! আমাদের আবার কী সুবিধা হবে?
—সুবিধা মানে দুটো ঘর, থাকব কোথায় ?
—ও।
অর্পিতা বা মেজদি দাদার সঙ্গে কথা বললেও মা কিন্তু এক্কেবারে চুপ। না ভালো, না খারাপ। শুধু দাদা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর বলে, ‘পিন্টু ভয় পেয়ে গেছে। দুটো বোন, মা, যদি এদের সবার দায়িত্ব নিতে হয়। বউমাও আমাদের এখানে থাকতে চায় না।”
অর্পিতার বউদি কারওর সঙ্গে সরাসরি ঝগড়া ঝামেলা না করলেও কথায় কথায় দাদার চাকরির তুলনা দিত। অথচ বাবা, দাদার পড়াশোনার কোনও ত্রুটি রাখেনি। কলেজ শেষ করে কম্পিউটার ট্রেনিং কোনও কিছুতেই পিছিয়ে আসেনি। দাদা সরকারি চাকরি না পেলেও বেশ ভালোই একটা চাকরি পায়। ভালো স্যালারি, অন্যান্য সুবিধা। বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় দাদা বলে যায়, “তোরা কোনও চিন্তা করবি না, আমি ঠিক সময় করে এসে দেখে যাব।’
প্রথম কয়েকমাস দাদা বউদি প্রতি সপ্তাহে এসে মায়ের হাতে টাকা দেওয়া ছাড়াও, ফল মিষ্টি কিনেও এনেছিল। তারপর দিন গড়াতে গড়াতে এক্কেবারে বন্ধ। দাদাকে ফোন করা হলে প্রথম দিকে নানারকম কথা বলে এড়িয়ে যেত, বাহানা করত। আস্তে আস্তে রাগতে আরম্ভ করল। বাড়ি আসার কথা বললেই রেগে যেত, “আমার কি আর কোনও কাজ নেই? যখন সময় হবে গিয়ে দেখে আসব। ফোন করে এমনি ভাবে বিরক্ত করবি না।’
মায়ের পেনসনের টাকায় সব খরচ সামলানো যায় না। মাসের নিত্য খরচের পাশে ডাক্তার, ওষুধের খরচও কম নয়। মেজদি একদিন অর্পিতাকে বলে, ‘বোনরে আমার আর ওষুধ আনতে হবে না। আমি তো আর ঠিক হব না, আমার বিয়ে থাও হবে না!”
ক্রমশ……