সবুজ পর্দায় একটা ছায়া পড়ল। কিন্তু এটা কীসের ছায়া! সাধনবাবুর হাত থেকে চায়ের গেলাসটা পড়ে গেল। ছায়াটার সরু সরু হাত, সরু সরু পা, পাঁজরের সরু সরু হাড়। একটা কঙ্কাল। কঙ্কালটা হাত তুলল, তার আঙুলগুলো নড়ে উঠল।

সাধনবাবুই প্রথম বিস্ময় ও আতঙ্কের ঘোর কাটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এটা হচ্ছেটা কী! ছায়া মিলিয়ে গেছে। পর্দাটা একা একা বাতাসে দুলছে। ওই বাড়িটার ভেতর কী আছে দেখতে হবে! সাধনবাবুর কেমন রোখ চেপে গেল। পা চালিয়ে রাস্তা পার হলেন। আরও কয়েকজন তাঁর সাথে উঠে এল।

নীচের দরজা খোলাই ছিল। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল সবাই। দোতলার দরজাটাও খোলা। মাঝের বড়ো ঘরটা পার হয়ে তারা বেডরুমে এলেন। কিন্তু ঘরে তো কেউ নেই! বিছানার ওপর একটা গোলাপি রঙের নাইটি পড়ে রয়েছে, আর একটা নীল—সাদা হাফ হাতা শার্ট। ঘরের মেঝেতে ধুলো জমে আছে, যেন অনেকদিন ঝাঁট দেওয়া হয়নি। মনেই হয় না কেউ থাকে এখানে। ঘরের ভেতর একটা তীব্র ওষুধের গন্ধ।

এর মানেটা কী! একটু আগেই তো তারা দোকানে বসে পর্দায় ছায়া দেখলেন। ছেলেমেয়ে দুটো যদি বেরোয়, তাদের সামনে দিয়েই তো বেরোবে। তাহলে? চলে আসুন সাধনদা, একজন বলল। গলা শুনেই মনে হয় ভয় পেয়েছে। সবাই সিঁড়ি দিয়ে নামছে এমন সময় পেছন থেকে গলাটা ভেসে এল— পাতলা, নরম গলা, ‘যাচ্ছেন কোথায়? কী জন্য এসেছেন বলে যাবেন না।’

চমকে ফিরে তাকাল সবাই। অন্ধকার সিঁড়ির ওপরে মনোময় দাঁড়িয়ে আছে।

—কোথায় ছিলেন আপনি? সাধনবাবু কোনও মতে জিজ্ঞেস করলেন।

—এই তো ছাদে। একটু হাওয়া খাচ্ছিলাম। আসুন ঘরে বসবেন সবাই। এ ওর মুখের দিকে তাকায়। তারপর আবার উঠে আসে। মনোময় তাদের সোজা বেডরুমেই নিয়ে এল।

—কেন এসেছিলেন, বললেন না? মনোময়ের মুখে চাপা হাসি।

—মানে, আপনার ঘরের পর্দায়…!

–কিছু দেখেছেন? মনোময় হাসে ও কিছু নয়, ভুল দেখেছেন। মাঝে মাঝে ছায়াও দেখে।

—কিন্তু আমি যে পরিষ্কার দেখলাম !

—কী দেখলেন? এই ভাবে হাত নেড়ে ডাকছে? মনোময় হাত তুলে দোলায়, তারপর শব্দ করে হেসে ওঠে। একটু পর হাসি থামিয়ে বলে তাহলে আসল কথাটাই বলি। এই যে আমার ফোনটা দেখছেন — মনোময় পকেট থেকে তার মোবাইলটা বার করে। এটা একটা প্রোজেক্টর ফোন। এটা দিয়ে পর্দায় ছবি ফেলা যায়। ছায়াকে একটু ভয় দেখাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনারাই দেখছি ভয় পেয়ে গেলেন।

সাধনবাবু হতভম্ব হয়ে তাকালেন। ছেলেটার মাথায় ছিট আছে নাকি! কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চমকে ফিরে তাকাল সবাই। মেয়েটা কখন ঢুকল ঘরে? গোলাপি নাইটিটা পরে বিছানায় বসে আছে। চুলে মুখ ঢাকা।

—ও কাঁদছে কেন? সাধনবাবু প্রশ্নটা না করে পারলেন না।

—ওকে মেরেছি।

—কেন?

—কথা শুনছিল না, মনোময় হাসে। বললাম জানলার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা খুলতে, আপনারা দেখতে চান! ও খুলবে না। মাথায় যেন হঠাৎ করেই আগুন জ্বলে ওঠে সাধনবাবুর। এগিয়ে এসে সপাটে এক থাপ্পড় মারেন মনোময়ের গালে — ইয়ার্কি হচ্ছে। তোমার বেলেল্লাপানা আমি ঘুচিয়ে দেব। সাধন দত্তকে তুমি চেনো না। কালকেই এই বাড়িটা ছেড়ে তোমরা চলে যাবে। এটা ভদ্রলোকের পাড়া।

—আমরা কোথাও যাব না, শান্ত গলায় বলে মনোময়। সাধনবাবুর ভারী হাতের থাপ্পড়ে তার ঠোঁটের একদিক কেটে গেছে। কিন্তু মুখের হাসিটা মোছেনি। এই বাড়িটা আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমরা এখানেই থাকব।

সাধনবাবুকে দেখেই বোধহয় অন্যেরাও সাহস পেয়ে গেল। একজন এগিয়ে এসে তার কলার চেপে ধরল, ‘শোন ভালো কথা বলছি, কাল থেকে এই পাড়ায় যেন তোদের না দেখি। ওই মেয়েটা তোর কে হয় বে? শাখা-সিঁদুর নেই। কোথা থেকে তুলে এনেছিস?

—ছায়া সম্বন্ধে কিছু বলবেন না, মনোময়ের গলা ঠান্ডা। তার চোখদুটো জ্বলছে।

ক্রমশঃ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...